যুদ্ধ ঘিরে শক্তিশালী হচ্ছে চীনের অর্থনীতি

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ইউরোপ বা বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে এ যুদ্ধে সবচেয়ে ফায়দা হয়েছে চীনের। যুদ্ধ পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে গত বছর রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। যার আকার ২৪০ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি এবং চীনের মোট বাণিজ্যের ৪ শতাংশ। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ায় উন্নত যন্ত্র (কম্পিউটার নিউমেরিকাল কন্ট্রোল বা সিএনসি) রপ্তানি ১০ গুণ বেড়েছে চীনের। পণ্য তৈরির কাজের জন্য সঠিকভাবে ধাতু কাটতে এ যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এগুলো রাশিয়ার সামরিক শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনের মিত্ররা রাশিয়ার এ সামরিক শক্তি অর্জন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাশিয়ার কাস্টমস অফিসের তথ্যানুযায়ী, জুলাইয়ে রাশিয়ায় ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার মূল্যের সিএনসি বিক্রি করেছে চীন। এটি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির ৬৫ লাখ ডলার মূল্যের বিক্রির চেয়ে বেশি।

সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক মাইকেল রাসকা জানান, সিএনসি রপ্তানির মাধ্যমে চীন ও রাশিয়া সামরিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো এ ধরনের যন্ত্র বিক্রি না করায় চীনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা আরও বেড়েছে। রাশিয়া এর আগে ইউরোপ থেকে সিএনসি ক্রয় করত। কিন্তু এখন রাশিয়ার সিএনসি আমদানির ৫৭ শতাংশই চীন থেকে আসছে। অন্যান্য সরবরাহকারীর মধ্যে রয়েছে তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া।

২০২৩ সালের নভেম্বরে রাশিয়ার কাছে সিএনসি বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। চীনা কোম্পানিগুলো আগামীতে বাণিজ্য জটিলতার মুখে পড়তে পারে। বেইজিং জানায়, তারা মস্কোয় অস্ত্র পাঠায় না। তবে সামগ্রিকভাবে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত অক্টোবরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে জানিয়েছিলেন, দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক কনফ্লিক্ট অ্যানালিস্ট সংস্থা সি৪এডিএসের বিশ্লেষক অ্যালেন ম্যাগার্ড জানান, ধাতব ও অন্যান্য শক্ত উপকরণ সহজে কাটতে সিএনসি ব্যবহার হয়। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরিতে সিএনসির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের রপ্তানি রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সিএনসির চীনা রপ্তানিকারকদের সঙ্গে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে উহান হুয়াঝং নিউমেরিক্যাল কন্ট্রোল। প্রতিষ্ঠানটি এর আগে চীনা ফাইটার জেট প্রস্তুতকারকের সঙ্গে কাজ করেছে।

এদিকে যুদ্ধের কারণে গাড়ি থেকে শুরু করে কম্পিউটারের চিপ- সব কিছুই পশ্চিমা দেশের পরিবর্তে এখন চীন থেকে কিনছে রাশিয়া। আর তেল-গ্যাস ছাড়াও চীনের সুপারমার্কেটগুলো এখন রাশিয়ান চকোলেট, সস ও অন্য ভোগ্যপণ্যে ঠাসা। গাড়ি রপ্তানিকারক হিসেবে ২০২৩ সালে জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে চীন। চায়না প্যাসেঞ্জার কার অ্যাসোসিয়েশন (সিপিসিএ) ৯ জানুয়ারি এ তথ্য দিয়েছে। গত বছর চীনের বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি কোম্পানি বিওয়াইডি ও চেরির ব্যবসা ভালো হওয়ায় গাড়ি রপ্তানিকারক দেশগুলোর শীর্ষে উঠে এসেছে চীন।

সিপিসিএ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, ২০২৩ সালে চীন বিশ্বের শীর্ষ গাড়ির বাজার থেকে শীর্ষ গাড়ি রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে। গত বছর চীনের নতুন গাড়ি রপ্তানি ৬২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালে মোট ৩৮ লাখ ৩০ হাজার নতুন গাড়ি রপ্তানি করেছে চীন। অন্যদিকে জাপানের শুল্ক বিভাগের তথ্যানুসারে, গত বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশটি যাত্রীবাহী নতুন গাড়ি বিক্রি করেছে ৩৫ লাখ পুরনো গাড়ি ছাড়া। 

সিপিসিএর তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের নতুন-পুরনো মিলিয়ে চীন সর্বমোট গাড়ি রপ্তানি করেছে ৫২ লাখ ৬০ হাজার ইউনিট, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০২ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর নতুন-পুরনো মিলিয়ে জাপান মোট গাড়ি রপ্তানি করেছে ৪৩ লাখ ইউনিট। অর্থাৎ চীন এখন বিশ্বের গাড়িশিল্পের নতুন মোড়ল হয়ে উঠেছে, যদিও গত বছর তাদের এই উত্থানের কারণ বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি বিক্রি বেড়ে যাওয়া। গত বছরের শেষ বা চতুর্থ প্রান্তিকে চীনা কোম্পানি বিওয়াইডি বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ির বাজারে টেসলাকে হটিয়ে শীর্ষ স্থানে উঠে আসে; যদিও তাদের গাড়ি বিক্রি হয়েছে মূলত চীনের বাজারে। চীনের গাড়ি রপ্তানি বৃদ্ধির পেছনে টেসলারও ভূমিকা আছে। গত বছর টেসলা চীনের কারখানায় উৎপাদিত ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৭৮টি গাড়ি রপ্তানি করেছে।

চায়না অ্যাসোসিয়েশন অব অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স (সিএএএম) জানিয়েছে, গত বছর ৩০ দশমিক ১৬ মিলিয়ন গাড়ি বিক্রি করেছেন নির্মাতারা। পাশাপাশি পাইকারি স্তরে গাড়ির বিক্রি বেড়ে পৌঁছেছে ৩০ মিলিয়নে। যার মধ্যে ডিলারদের চালানও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে উভয় ক্ষেত্রেই ২০১৭ সালের গাড়ি বিক্রির রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে চীন। এ ছাড়া দেশটির গাড়ি রপ্তানি ৫৮ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ৯১ মিলিয়নে উঠে গেছে। মূলত ২০২২ সালের প্রথম দিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের জেরে দেশটির বাজার ছেড়ে যায় ভক্সওয়াগন এজি এবং টয়োটা মোটর করপোরেশনসহ গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো। আর সেই সুযোগে বাজার দখল করে নিচ্ছে রাশিয়া ও চীনের গাড়ি কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারেও বেড়েছে বিক্রি। ফলে ২০২৩ সালে চীনা গাড়ি রপ্তানির শীর্ষ বাজার গন্তব্য ছিল রাশিয়া। বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশটিতে ৮ লাখ ৪১ হাজার গাড়ি রপ্তানি করেছে চীনা গাড়ি নির্মাতারা। এর পরেই রয়েছে মেক্সিকো। চীনের বৃহত্তম গাড়ি রপ্তানিকারকের অবস্থান ধরে রেখেছে এসএআইসি মোটর করপোরেশন। এর পরেই রয়েছে চেরি অটোমোবাইল এবং ঝেজিয়াং গ্লিই হোল্ডিং গ্রুপ করপোরেশন।

দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৪ সালেও অর্থনীতির মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে উঠবে। পণ্যের চাহিদা কম থাকায় চীনের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২ জানুয়ারি বেইজিংয়ের অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাস্টমসের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মুখপাত্র লিউ ডালিয়াং বলেন, ‘গত বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দুর্বল ছিল। পণ্যের চাহিতা কম থাকার চীনের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

এই দুই দেশের বাণিজ্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা সহজেই অনুমান করা যায় সীমান্তের একটি গাড়ির ডিলার প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে। তুষারে ঢাকা রাশিয়া সীমান্তের চীন অংশে ট্রাক বিক্রয়কারী ডিলার প্রতিষ্ঠানটি মূলত রুশ গ্রাহকদের কাছেই গাড়ি বিক্রি করে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিবেশী দেশটিতে চীনের রপ্তানি এত বেশি যে এই গ্রীষ্মে সীমান্তে গুদাম এবং ২০ তলা অফিস ভবনও তৈরি করা হয়েছে। সীমান্ত শহর হেইহে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান দ্বার। স্থল সীমান্ত দিয়ে রেলপথে রাশিয়ায় গাড়ি পরিবহন করতে পারে চীন। কারণ দেশটির যানবাহন রপ্তানির জন্য আন্তঃমহাসাগরীয় জাহাজের বহর নেই।

চীনের নেতা জিনপিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন দুই দেশের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা দেখিয়েছেন নানা সময়। গত মাসে বেইজিংয়ে জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিন। এ সময় জিনপিং বলেন, ‘চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক দৃঢ়ভাবে বজায় রাখা ও উন্নয়ন দুই দেশের মানুষের মৌলিক স্বার্থের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের একটি কৌশলগত পছন্দ।’

ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে জার্মানি, ফ্রান্স এবং অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতারা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে মানবাধিকারের মতো ইস্যুতে মতপার্থক্য সামনে আনেনি। অন্যদিকে চীনের কর্মকর্তারাও চেয়েছেন ইউরোপ ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই ব্যবসা করতে। 

রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে চীনে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে গাড়ি নির্মাতারা। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাংহাই অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশনের একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি নতুন গাড়ির বহর রপ্তানি করেছে দেশটিতে। মার্সিডিজ-বেঞ্জ এবং বিএমডব্লিউর মতো জার্মানির কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় গাড়ি রপ্তানির শীর্ষে ছিল। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের নিষেধাজ্ঞায় এখন তারা রাশিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

এদিকে রাশিয়ায় বিলাসবহুল গাড়ির বিক্রি কমেছে। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র রুশ পরিবারগুলো কম দামে চীনা গাড়ি কেনা বাড়িয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের পরিচালক আলেকজান্ডার গাবুয়েভ মনে করেন, ‘যারা গাড়ি কেনা বাড়িয়েছে, তাদের পরিবারের সদস্যরা ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। রুশ সরকার এবং বীমাকারীরা দেশটির সেনাদের পরিবারকে মৃত্যু অথবা অঙ্গহানির ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। মৃত্যুর ক্ষেত্রে যা ৯০ হাজার ডলারের মতো।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //