চীনবিরোধী প্রেসিডেন্টেই জনসম্মতি তাইওয়ানে

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ও আইনসভার নির্বাচন গত ১৩ জানুয়ারি একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। তাইওয়ানের জনগণ মূলত একসঙ্গে তিনটি ভোট দেওয়ার অধিকার রাখে। তারা প্রেসিডেন্ট, নিজ জেলা থেকে আইনসভার প্রতিনিধি নির্বাচন এবং নিজেদের পছন্দের দলের জন্য তিনটি ভোট আলাদাভাবে দিতে পারে। দেশটির আইন এমনই যে দল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পায়, তারপরও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে চীনের ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) প্রার্থী উইলিয়াম লাই চিং-তে জয়ী হয়েছেন। তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে ডিপিপি। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ১ কোটি ৯৫ লাখের বেশি ভোটার রয়েছে তাইওয়ানে। এর মধ্যে ৫০ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন লাই।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব বিবেচনায় এবারের তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এ নির্বাচনকে যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যে বিকল্প বেছে নেওয়া বলে মনে করছে চীন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ ভোটে তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এরপর থেকে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ধরে রেখেছে তাইওয়ান। ভোটের আগে লাইকে বারবার ‘বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে উল্লেখ করেছে বেইজিং। সেই সঙ্গে তার দেওয়া আলোচনার প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে চীনা প্রশাসন। এরপরও তাইওয়ান প্রণালিতে শান্তি বজায় রাখা ও প্রতিরক্ষা জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। 

তাইওয়ানের মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কিছুটা কম (২ দশমিক ৯২ শতাংশ) হলেও বেশিরভাগ তাইওয়ানিজ মনে করে, এখানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। তাই এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করে, অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখাই হবে নতুন প্রেসিডেন্টের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এবারের নির্বাচনে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোই ছিল ভোটারদের কাছে প্রধান ইস্যু। তাইওয়ান একটি আমদানি-নির্ভর দেশ। এর প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় ৯৭ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। দেশটিতে জ্বালানির অভাবে ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২২ সালে ব্যাপক ব্ল্যাকআউট হয়। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে সরকারের ওপর তীব্র জন-অসন্তোষ ছিল। এখন চীনবিরোধী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বেইজিং যদি তাইওয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, সে ক্ষেত্রে তাইওয়ানের যে পরিমাণ গ্যাস, কয়লা ও তেলের মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ২০০ দিন চলতে পারবে দেশটি। তাই নির্বাচনে জয়ী হয়েই রিজার্ভ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন লাই। প্রতিরক্ষা জোরদার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

রাজনৈতিক জীবনের প্রথমে লাই নিজেকে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতাকর্মী’ হিসেবে দাবি করতেন। কিন্তু ডিপিপির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার পর তিনি তার এই অবস্থান পরিবর্তন করেন। ডিপিপি মনে করে যে তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার দাবি অপ্রয়োজনীয়, কেননা দেশটি ইতোমধ্যেই একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র। লাই এবং তার দল সব সময়ই চীনের ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’র একত্রীকরণের কাঠামোকে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। তারা ‘১৯৯২ সালের ঐকমত্য’-কে অস্বীকার করে। স্বাভাবিকভাবেই লাই তার পূর্বসূরি সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়ানের নীতিই বজায় রাখতে চাইবেন। 

তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক তাইওয়ানের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চারটি নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমত তাইওয়ানের জনগণ এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে চীনের সঙ্গে কোনো সামরিক সংঘাত চাইবে না। দেশটির জনগণ চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। তবে অধিকাংশ আবার চীনের একটি প্রদেশ হিসেবে একত্রীকরণের বিষয়টিকে তেমন সমর্থন করে না। বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্বে চলা দেশটির শাসন কাঠামো তাদের অপছন্দ। দেশটির বড় সংখ্যক জনগণই চীনের আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের পক্ষে ক্ষতিকর কোনো নীতি গ্রহণের বিপক্ষে। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে চীনের সঙ্গে জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী এরকম ভারসাম্যপূর্ণ নীতি বজায় রাখাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।

দ্বিতীয়ত তাইওয়ান একটি একদলের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়েছে। তবে এখনো দেশটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশের নির্বাচন বা দলীয় রাজনীতি বিমুখতা একটা সমস্যা হিসেবে জিইয়ে আছে। এবারের নির্বাচনেও প্রায় ৪০ শতাংশ তাইওয়ানিজ ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকতে চেয়েছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো দলকে তারা বেছে নেয়নি। তাইওয়ানের নির্বাচনী পদ্ধতির জন্য এটি একটি বড় সংকট। এখানেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। 

তৃতীয়ত তাইওয়ানের মতো পরিণত অর্থনীতিতে এখন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া প্রায় ২৩ মিলিয়ন জনগণের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং পেনশন সুবিধা বজায় রাখাও বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। মূলত দেশটির নিচু পর্যায়ের কর ভারের জন্য এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। জনগণের আবারও ডিপিপিকে বেছে নেওয়ার পেছনে এই অর্থনৈতিক দুর্বলতা মোচনের আকাক্সক্ষা বড়ভাবে কাজ করেছে। তাই এখন নতুন সরকারকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

চতুর্থত তাইওয়ানের নির্বাচন পদ্ধতিতে লাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও আইনসভায় বিরোধীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই ঘটনা ঘটলে লাইয়ের নেওয়া যে কোনো পদক্ষেপ বা নীতি আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধীরা বাতিল করতে পারে। এমন রাজনৈতিক বিভাজন দেশটির যে কোনো সংকটকালীন মুহূর্তকে তীব্র করতে পারে। এই বিষয়টি নতুন প্রেসিডেন্টের বিবেচনায় ভালোভাবে থাকা উচিত।

লাই যদি তার চীনবিরোধী অবস্থানকে আরও তীব্রতর করতে চায়, তাহলে চীন ধৈর্য হারাতে পারে। তখন দেশটি তাইওয়ানের ওপর সামরিক, বাণিজ্যিক নানামুখী চাপ জারি করবে। আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করে তাইওয়ান খুব বেশি লাভবান হতে পারবে না। কেননা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই বেশ বেকায়দায় রয়েছে। তাই নতুন প্রেসিডেন্ট লাইয়ের রয়েসয়ে সরকার চালানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। -আল জাজিরা, রয়টার্স এবং দ্য ডিপ্লোম্যাট অবলম্বনে

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //