গতি পাচ্ছে চীনের অর্থনীতি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন যত দিন ছিল, তত দিন বিশ্ব দ্বিমেরুতে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব একমেরুতে পরিণত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রাশিয়া থাকলেও, অর্থনীতিতে সেই পরিমাণে শক্তিশালী ভিত গড়তে পারেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিকভাবে চীনের দুর্দান্ত উত্থান এবং এতে রাশিয়াসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার জানান দেয়। তবে করোনা মহামারি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য-যুদ্ধ এবং ইউক্রেন যুদ্ধ চীনের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ভোক্তা ব্যয় কমেছে। মধ্য শরৎ উৎসব ‘গোল্ডেন উইক’ সেই অবস্থা থেকে ফিরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। গোল্ডেন উইকের ছুটিতে চীনের ভোক্তা ব্যয় করোনা-পূর্ববর্তী সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। পর্যটন খাতের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি এসেছে খুচরা ব্যবসায়। এতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার আরও গতিশীল হয়েছে। 

চীনের অর্থনীতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে মন্থরতার পর এবার কিছুটা আশা সঞ্চার করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশটির জিডিপি নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সিটি গ্রুপ ও জেপি মরগান মনে করে, চলতি বছর চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশ। এর আগের পূর্বাভাসে সিটি গ্রুপ ৪.৭ ও জেপি মরগান ৪.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকার কথা জানিয়েছিল।

চীনের সরকার প্রভাবিত সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, দেশটির মধ্য শরৎ উৎসবে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে আসে। এ সময়ে প্রতিবছরই ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। চলতি বছরে উৎসবটি জাতীয় দিবসের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়েছে ছুটির সময়। দেশটির স্থানীয় পরিষেবা জায়ান্ট মেইতুয়ান জানিয়েছে, পরিষেবা ও রিটেইল খাতে দৈনিক বিক্রি ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৫৩ শতাংশ বেড়েছে। খাবার বাবদ খরচ বেড়েছে ২৫৪ শতাংশ।

গত বছর মহামারিসংশ্লিষ্ট বিধিনিষেধের কারণে মানুষ পর্যটনে অনুৎসাহিত ছিল। এবার সেই বিধিনিষেধ কাটিয়ে চীনের পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, এবারের ভ্রমণ মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৮২ কোটি ৬০ লাখ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা ৭১.৩ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের তুলনায় ভ্রমণ বেড়েছে ৪.১ শতাংশ। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত থেকে আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৩০০ কোটি ইউয়ান। ২০২২ সালের ছুটির মৌসুমের তুলনায় এটি ১২৯.৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের তুলনায় আয় বেড়েছে ১.৫ শতাংশ।

চীনের বড় শহরগুলোর মধ্যে সাংহাই, বেইজিং, চেংডু, চংকিং ও শেনঝেনে ভোক্তা ব্যয় সবচেয়ে বেশি। শহরের প্রধান সড়কগুলোয় ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। তিব্বতের লিনঝি ও গুয়াংডংয়ের শানওয়েইতে এবার রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকের সমাগম হয়েছে। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, ছুটির প্রথম সাত দিনে রিটেইল ও ক্যাটারিং প্রতিষ্ঠানগুলোয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ।

আলিবাবা গ্রুপের অধীনে পরিচালিত অনলাইন ট্রাভেল প্রতিষ্ঠান ফ্লিগি ছুটির মধ্যে পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা জানিয়েছে। ফ্লিগি থেকে গাড়ি ভাড়া করে নেওয়ার হার ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে ৪.৬ শতাংশ। দক্ষিণ চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ গন্তব্য হাইনান। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে শুল্ক বাদে মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১০১ কোটি ইউয়ান বা ১৪ হাজার কোটি ২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে ৯৪.২ শতাংশ। ক্রেতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার, যা গত বছরের তুলনায় ১২০ শতাংশ বেশি। 

চলচ্চিত্র শিল্প পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ডেংটা জানিয়েছে, ছুটির মৌসুমে বক্স অফিসের আয় ২৬০ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়েছে। গত বছর আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি ইউয়ান। এবার প্রথমবারের মতো মাথাপিছু ব্যয় ২০১৯ সালের হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। 

তবে আবাসন খাতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় পর্যটন খাতকে যথেষ্ট বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। সেই সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমুরার জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ লু টিং সতর্ক করেছেন, ‘ছুটি পার হলেই ভোক্তা ব্যয় কমতে শুরু করবে। স্কুলগুলো খুলে দেবে। এগিয়ে আসছে গ্রীষ্মকাল। পরিবহন, পোশাক ও হোটেল ব্যয়ের গতি কিছুটা মন্থর হবে আগামী দিনগুলোয়।’

২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদানের পর থেকে চীনের পরিষেবা বাজার অব্যাহতভাবে উন্মুক্ত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক নোজি ওকোঞ্জো-আইওয়েলা বলেন, ‘বিশ্বের পরিষেবা বাণিজ্যে চীনের অংশ ২.৪ থেকে বেড়ে ৬.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। চীন হলো বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ পরিষেবা রপ্তানিকারক ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিষেবা আমদানিকারক দেশ। চীন বিশ্বের পরিষেবা সরবরাহকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।’

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদানের পর চীনের বাজার অর্থনীতি বৈশ্বিক মাত্রা পেয়েছে। ২২ বছরে চীনের পণ্যবাণিজ্যের পরিমাণ ১১ গুণ বেড়েছে। চীনের সঙ্গে সংস্থাটির সম্পর্কে ঐতিহাসিক পরিবর্তন এসেছে। চীন এখন আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের নিয়মগুলোর সক্রিয় গ্রহণকারীতে পরিণত হয়েছে।

চলতি বছর বিশ্বের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি দুর্বল। তবে চীনের অর্থনীতি অব্যাহতভাবে পুনরুদ্ধার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মহাব্যবস্থাপক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, ‘যদিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমাজে চ্যালেঞ্জ অনেক, তবুও চীনা অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিশ্বের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছে। চীনের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার মানে ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান তিন ভাগের এক ভাগ বা তারও বেশি হবে। আমাদের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চীনের জিডিপিতে প্রতি এক শতাংশ বৃদ্ধি এশীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ০.৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে।’

এর আগে এ বছরের মার্চ মাসে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, চলতি বছরে ৫ ভাগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নীতির সংস্কার করবে চীন। এ ক্ষেত্রে বড় বড় নীতির মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা আরও প্রসারিত করা হবে। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি উদ্যোক্তা বা উদ্যোগগুলো যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় তার জন্য একটি ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। আমরা সব ধরনের বাজার সত্তার জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করব। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’ চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি অনুকূল অবস্থার উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘চীনের রয়েছে একটি অতি-বৃহৎ বাজার। রয়েছে একটি কার্যকরী শিল্প ব্যবস্থা, মানব সম্পদের সমৃদ্ধ সরবরাহ, একটি শক্তিশালী উন্নয়ন ভিত্তি এবং উল্লেখযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি। এসব বিষয়ের ওপর ভর করে অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার জানান দেবে চীন।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //