এশিয়ায় নতুন ঠান্ডাযুদ্ধের ইঙ্গিত

বৈশ্বিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দিন দিন কমছে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে রয়েছে চীন। এ দুই পরাশক্তির লড়াই বাণিজ্যযুদ্ধ দিয়ে শুরু হলেও এখন তা কূটনীতি, রাজনীতি ছাড়িয়ে ভূ-রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক একমেরু বিশ্বব্যবস্থা এখন প্রায় ভেঙে পড়েছে। সেখানে এখন বহুমেরুবিশিষ্ট ব্যবস্থার বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। তবে এর মূলেও রয়েছে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব। আর এশিয়ার ভূ-রাজনীতি ও মারণাস্ত্রের মজুদ নতুন ঠান্ডাযুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনকে রুখতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, চাপ বাড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু এই পদক্ষেপ ঠিকমতো কাজ করছে না। চীনের উৎপাদিত পণ্য এখন গোটা বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই সঙ্গে কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) চীনের বাজার সম্প্রসারণে বড় প্রভাব রেখেছে। কার্যত বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দেশটি ভূ-রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলছে। 

বিআরআইয়ের পর ২০২১ সাল থেকে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভকে (জিডিআই) সামনে এনেছে চীন। বিআরআই মূলত যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সংযুক্তির উদ্যোগ। আর জিডিআই হচ্ছে মূলত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ডিজিটাল অর্থনীতিকে ঘিরে উন্নয়ন সহযোগিতার উদ্যোগ। বাংলাদেশসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ বিআরআই প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। বিআরআইয়ের পর জিডিআইকে উন্নয়নের প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে দেশটি। এই উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বন্ধুদেশগুলোকে চীন আরও কাছে নিতে চায়। মূলত বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করতে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে এশিয়া। এতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে চীন ও আঞ্চলিক উৎপাদন কেন্দ্রস্থলগুলো। তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান অস্থির কৌশলগত প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক গত পাঁচ দশকের মধ্যে শীতলতম পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মোট প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মধ্যে ২০০০ সালে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ব্যয় ছিল সাড়ে ১৭ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয় ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ (উত্তর কোরিয়া এ হিসাবের বাইরে)। এরপর থেকে এই ব্যয় আরও বেড়েছে। এশিয়ায় প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ চীন। দেশটির সামরিক খাতের বার্ষিক ব্যয় এখন ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক ব্যয় এখন তাদেরই। বিশ্বে সামরিক ব্যয়ের হিসাবে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বার্ষিক সামরিক ব্যয় ৮০ হাজার কোটি ডলার। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক ব্যয় তাদের পুরো বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের জন্য। আর চীনের লক্ষ্য এশিয়া। 

অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি জিনপিং তার দেশের সেনাবাহিনীকে ভারত থেকে শুরু করে তাইওয়ানের বিরোধপূর্ণ এলাকায় যেভাবে ব্যবহার করছে, তাতে উদ্বেগ বেড়েছে। কম্বোডিয়ায় চীনের নতুন নৌঘাঁটি ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে দেশটির চুক্তি ঘিরে এই উদ্বেগ আরও জোরালো হয়েছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বিরোধের বিষয়টি। মার্কিন কমান্ডাররা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ বা ২০২৭ সাল নাগাদ যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। অপরদিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, ওয়াশিংটন যদি ভুল পথে হাঁটতেই থাকে, তবে তার দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য।

অনেক দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এতে তারা চীনের সেনাবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে বা রোষানলে পড়বে। কিংবা চীন তাদের অর্থনৈতিকভাবে শাস্তি দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে তাই অনেক দেশ বাণিজ্য ও প্রশিক্ষণ সুবিধা চাইছে। তবে এসব দাবি মার্কিন কংগ্রেস পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের ভূ-রাজনৈতিক অগ্রগতি রুখতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া----এই চার দেশ ২০০৭ সালে কোয়াড জোট গঠন করে। জোট গঠনে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। তবে পেছন থেকে মূল কলকাঠি নেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জোটটির ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো----ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নৌ যাতায়াতকে মুক্ত রাখা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়া এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। চীন অবশ্য এই জোটকে এই অঞ্চলে তার ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে সীমিত করার মার্কিন পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইউরোপে সামরিক সংগঠন ন্যাটোর মতো এই জোটও যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে দক্ষিণ এশিয়ায় একই ভূমিকা পালন করবে। চীনের দ্রুত উত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। 

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে ২৪ মে জোট কোয়াডের শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার কথা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। রাষ্ট্রীয় ঋণসীমা নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে সম্প্রতি যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তার অজুহাত দেখিয়ে বাইডেন হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন শেষে দেশে ফিরেছেন। স্বাগতিক দেশ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ নিরুপায় হয়ে দুঃখভারাক্রান্ত মনে শীর্ষ সম্মেলন বাতিল ঘোষণা করেন। এই শীর্ষ সম্মেলন বাতিল হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। চীনা বুদ্ধিজীবীরা এখন স্পষ্টভাবেই যুক্তি দিচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে একটি অকার্যকর দেশ, তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল, কংগ্রেস অকার্যকর এবং দলভিত্তিক বিভেদে দ্বিধাবিভক্ত----যুক্তরাষ্ট্র কোনো নির্ভরশীল মিত্র নয়। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমার এরই মধ্যে চীনের পক্ষ বেছে নিয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিককালে চীনের প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখা যাচ্ছে থাইল্যান্ডের। যদিও দেশটি কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে থাই সরকার। সিঙ্গাপুর কোনো পক্ষে না যাওয়ার দাবি করেছে। চীনের সঙ্গে সিঙ্গাপুর যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে এবং কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালির নিরাপত্তা জোরদার করেছে; কিন্তু সিঙ্গাপুরের প্রতিরক্ষা স্মারক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক’, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সদস্যদের সিঙ্গাপুরে আমন্ত্রণ জানানো----এসব বিবেচনায় বলা চলে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

ইন্দোনেশিয়া এখন পর্যন্ত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে; কিন্তু দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমানগুলোকে তাদের দেশে অবস্থান করতে দিতে সম্মত হয়নি। ফিলিপাইনের অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে চীনবিরোধী ও যুক্তরাষ্ট্রপন্থি অবস্থানের কারণে ফার্দিনান্দো মার্কোস জুনিয়র প্রশাসন আগের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের নীতি পরিত্যাগ করেছেন। দক্ষিণ চীন সাগরে বিশাল যৌথ মহড়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের সামরিক সম্পর্ক জোরালো করেছেন মার্কোস। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির (ইডিসিএ) পরিসরও বাড়িয়েছেন তিনি। 

ভিয়েতনাম কৌশলগতভাবে রাশিয়ার মিত্র। চীনের সঙ্গে তাদের সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারত্বের সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গভীর সামরিক সহযোগিতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম চারটি ‘না-এর নীতি’ বজায় রেখে চলেছে। এক. কোনো সামরিক জোটে যুক্ত না হওয়া, দুই. বিদেশি কোনো দেশের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে দেশকে ব্যবহৃত হতে না দেওয়া, তিন. দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে কোনো একটির পক্ষে না যাওয়া এবং চার. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ কিংবা বলপ্রয়োগের হুমকি না দেওয়া। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে কার্যত এশিয়া বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে; যা নতুন ঠান্ডাযুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //