দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাড়ছে জাপানের প্রভাব

গত ৩০ মার্চ জাপান ও ইন্দোনেশিয়া ‘ডিফেন্স ইক্যুইপমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি ট্রান্সফার এগ্রিমেন্ট’ নামক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তি অনুযায়ী, জাপান ইন্দোনেশিয়াতে সামরিক সরঞ্জাম রফতানি করবে। 

টোকিওতে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকের মাঝেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। 

জাপানের সংবাদমাধ্যম কিয়োদো নিউজ জানায়, এই চুক্তির পেছনে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের প্রভাব বিস্তার নিয়ে জাপানের দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জাপানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোশিমিতসু মোতেগি বলেন, ‘দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে চীনের জোরপূর্বক অবস্থান শক্তিশালীকরণের ব্যাপারে দুই দেশের মাঝে আলোচনা হয়েছে।’ 

ফেব্রুয়ারি মাসে চীন সরকারের জারি করা আইন অনুযায়ী, চীনা কোস্টগার্ড তাদের দাবি করা সমুদ্রসীমায় অন্য দেশের জাহাজকে গুলি করতে পারবে। জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী নোবুও কিশি বলেন, এই আইনের মাধ্যমে চীনারা অন্য দেশের বৈধ অধিকার ও স্বার্থের লঙ্ঘন করতে পারে না। এর আগে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইতালি, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একই রকম প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে জাপান। 

মোতেগি জানান, এই চুক্তির মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে জাপানের নিরাপত্তা সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার জন্য শক্ত ভিত তৈরি হলো এবং একইসঙ্গে আঞ্চলিক হুমকি মোকাবেলায় তা দুই দেশের যৌথ উদ্যোগের প্রতীক হয়ে থাকবে। ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় জাপান সরকার ৪৫৩ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। 

অপরদিকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোভো সুবিয়ান্তো জানান, তার দেশ জাপানকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়নে অংশীদার হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। 

ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে জাপানের প্রতিরক্ষা চুক্তি আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে এখন শুরু হয়েছে আলোচনা। 

প্রতিরক্ষা ম্যাগাজিন আইএইচএস জেনসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, চুক্তিতে কি রয়েছে তার বিস্তারিত বলা না হলেও এর মাধ্যমে জাপান হয়তো ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর কাছে ‘মোগামি ক্লাস’-এর ফ্রিগেট রফতানি করতে পারে, যা তারা বর্তমানে নিজেদের নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করছে। দুই দেশের মাঝে সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা চলছে কয়েক বছর ধরেই। ২০২০ সালের শেষের দিকে একটি সমঝোতা স্মারকের ফলশ্রুতিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। সে সময় জাপানের জাহাজ নির্মাণ সংস্থা মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। 

ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী তাদের ফ্রিগেট ক্রয় প্রকল্পের জন্য চারটি ডিজাইন শর্টলিস্ট করেছিল; যার মধ্যে ছিল- হল্যান্ডের ‘ডামেন’, ইতালির ‘ফিনকানতিয়েরি’, জাপানের ‘মিতসুই’ ও ব্রিটেনের ‘ব্যাবকক’ কোম্পানির ডিজাইন। 

গত বছরের আগস্টে ফিলিপাইনের কাছে ১০৩ মিলিয়ন ডলারে চারটি অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা রাডার বিক্রয়ের চুক্তি করে জাপান। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে জাপানি পার্লামেন্ট প্রতিরক্ষা আইনের আর্টিকেল ১১৬ এর ৩ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিদেশে অস্ত্র রফতানিকে বৈধতা দিয়েছিল। সেই মোতাবেক জাপান সরকার দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের নজরদারিতে সহায়তা দিতে পাঁচটি ‘টিসি-৯০’ সার্ভেইল্যান্স বিমান অনুদান হিসেবে দেয়। 

ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক লেখায় বলা হয়, ফিলিপাইনের কাছে বিক্রি করা রাডারগুলো মূলত দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা সামরিক কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখতে ব্যবহৃত হবে, যেখানে চীনারা বেশকিছু কৃত্রিম দ্বীপ ডেভেলপ করে সেখানে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। জাপান চাইছে তাইওয়ান ও ফিলিপাইনের মাঝ দিয়ে যাওয়া বাশি চ্যানেলে চীনা জাহাজের গতিবিধির ওপর নজরদারি করতে। আর সে ক্ষেত্রে তারা ফিলিপাইনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চাইছে। 

এর আগে ফিলিপাইনের কোস্টগার্ডের জন্য ১৯১ মিলিয়ন ডলারে ১০টি ৪৪ মিটার দীর্ঘ প্যাট্রোল বোট বিক্রি করে জাপান। আর বর্তমানে ১৩২ মিলিয়ন ডলারে দুটি ৯০ মিটার দীর্ঘ অফশোর প্যাট্রোল ভেসেলও তৈরি করছে জাপান। এছাড়াও গত জুলাই মাসে জাপান ভিয়েতনামের কাছে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে ছয়টি ৭৯ মিটার দীর্ঘ অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল রফতানি করার চুক্তি করে। প্রতি ক্ষেত্রেই জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। আর সব জাহাজের মূল কাজ হবে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা। 

জাপানের পররাষ্ট্রনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের রচিত যুদ্ধবিরোধী সংবিধানের ওপর নির্ভরশীল। তবে সম্প্রতি রক্ষণশীলদের শক্ত অবস্থানের ফলে আইনি পরিবর্তনের মাধ্যমে জাপান বিশ্বব্যাপী সামরিক বাহিনী মোতায়েন ও বিদেশে অস্ত্র রফতানি করছে। চীন ও উত্তর কোরিয়ার আক্রমণাত্মক অবস্থান জাপানকে সামরিক শক্তি বাড়াতে একপ্রকার বৈধতা দিয়েছে। তবে জাপানের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন ইন্দোপ্যাসিফিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় তা এখনো ওয়াশিংটনের আশীর্বাদপুষ্টই থাকছে। 

পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আগ্রাসনের ইতিহাস ভুলে না গেলেও জাপানের নতুন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শুধু চীনারাই কথা বলছে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণেই জাপানের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। জাপানের সামরিক শিল্প যথেষ্ট উন্নত হলেও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তা এখনো যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বাধীন নয়। 

দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগরের সমুদ্রপথ শুধু চীনের জন্য নয়, জাপান ও কোরিয়ার জন্যও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে জাপানের এমন কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই, যা মার্কিন নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রতিরক্ষা রফতানির ক্ষেত্রে জাপানের আর্থিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশটি বিরাট অর্থনীতিকে পুঁজি করে প্রভাব বিস্তারে অগ্রগামী হলেও, রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাব বিস্তারে এখনো অনেক পিছিয়ে। মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবেই চীন ও জাপান উভয়েই তাদের সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, যা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়ায় সামরিক শক্তি ধরে রাখতে সহায়তা করছে। 

আবার পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘গ্রেট পাওয়ার’ প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে চীনকে নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র তার এশিয়ার বন্ধু দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে; যা জাপানকে সামরিকীকরণে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //