ভাবমূর্তি সংকট থেকে উত্তরণের পথ জানে কি চীন?

চীন নিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই নেতিবাচক মনোভাব ধারণ করছে। 

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ আমেরিকানই চীনের প্রতি ‘শীতল’ মনোভাব পোষণ করেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০ জন নাগরিকের মধ্যে ৯ জনই চীনকে সহযোগীর বদলে একজন শত্রু  অথবা প্রতিযোগী মনে করেন। 

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের পৃথক এক জরিপে বলা হয়েছে, আমেরিকানদের মধ্যে চীনকে অপ্রয়োজনীয় ভাবার হার ৭৯ শতাংশ, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই নয়, গোটা বিশ্বেই চীনের প্রতি অসন্তোষজনক মতামত রয়েছে; যা গত বছর সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলো নিয়ে চীন যে ‘সঠিক কাজ করছে’ তা নিয়ে আস্থা পাচ্ছে না এমন ব্যক্তিদের হার অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোয় ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। 

তবে এসব দেশের মধ্যে ইতালির জনগণের মনোভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কভিড-১৯ মহামারির সময়ে দেশটিতে ব্যাপক বিনিয়োগ ও চিকিৎসা সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিল চীন। চীনের ধারণা ছিল এ ধরনের কার্যক্রমের ফলে দেশটির জনগণের মধ্যে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে ইতালি সরকার তাদের ওপর সবচেয়ে খুশি হবে। চীনের পক্ষ থেকে সাহায্য পৌঁছানোর পর ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইগি দি মাইয়ো মন্তব্য করেন, ‘আমরা একা নই। এই পৃথিবীতে এমন মানুষ রয়েছে, যারা ইতালিকে সাহায্য করতে চায়।’

এছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মহামারি কূটনীতির মাধ্যমে নিজেদের দল ভারি করা ছাড়াও ভেঙে যাওয়া জোটগুলো পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করেছে চীন। তবে এসব ক্ষেত্রে দেশটির অভিজ্ঞতা মিশ্র। সাব-সাহারা আফ্রিকা ও বলকানের দেশগুলোয় সমন্বিত সরবরাহ শৃঙ্খল ও অস্থায়ী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ভ্যাকসিন ও মাস্ক সরবরাহে সফল হয়েছে চীন; কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বেশ কিছু দেশে চীন ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। সেখানকার সুশীল সমাজ বাণিজ্য উন্মুক্ত ও বিনিয়োগ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে তৈরি হওয়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। 

চীনের কূটনীতিবিদরা এরই মধ্যে ফরাসি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছে। অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের প্রত্যাখ্যান করেছে ও আলস্কায় সাম্প্রতিক এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে চীনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। তবে এ বৈঠক কোনোভাবেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে চীনবিরোধী মনোভাবের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়তা করতে পারেনি। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চীন বিশ্বে নিজেদের সুনাম রক্ষা করতে চায় কি-না। আর যদি চায় তাহলে দেশটির কী করা উচিত। 

অভিযোগ রয়েছে, চীনের ‘নেকড়ে যোদ্ধারা’ (মহামারির সময়ে চীনের অতি আক্রমণাত্বক কূটনীতিবিদদের বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার প্রচলিত হয়ে উঠেছে) আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরো বিঘ্নিত করে তুলেছে। চীন সরকারের মুখপাত্র হুয়া চুনিইয়ং স্পষ্টভাবে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সার্বভৌমত্ব ও নিজেদের মূল স্বার্থ রক্ষায় আমাদের কার্যক্রমকে পশ্চিমারা যদি অনমনীয়ভাবে ‘নেকড়ে যোদ্ধাদের কূটনীতি’ হিসেবে অখ্যায়িত করে, তাহলে সেই অর্থে নেকড়ে যোদ্ধা হয়ে ওঠার মধ্যে কী ভুল?

বিশ্বব্যাপী চীনবিরোধী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে, নিজেদের ভাবমূর্তি পুনঃগঠন করা ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার ক্ষেত্রে চীনের আগ্রহ রয়েছে কি-না। আর যদি তাই হয়, তাহলে তা কীভাবে সম্ভব? কারণ দেশটি এখনো নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য চরিতার্থ করতে সামনে এগোচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও সামগ্রিক উন্নয়নে দেয়া মূল প্রতিশ্রুতিগুলোতে অগ্রসর হতে পারছে না। 

তবে এটি অসম্ভব নয় বলেও মনে করেন শিক্ষাবিদ ড্যানিয়েল এ বেল ও ঝেংশু ওয়াং। তারা বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হলে, চীনকে তাদের ত্রুটিগুলো নিয়ে আলোচনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা ঠিক হবে না।’ 

অর্থনৈতিকভাবে চীনকে ভালো সুনাম অর্জন করতে হবে। শীর্ষস্থানীয় বাজারগুলোয় চীনের কোম্পানি ও বিনিয়োগ আরো সম্প্রসারণের মাধ্যমে নিজেদের এদিক থেকে আরো এগিয়ে নিতে হবে। 

ইইউ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগের সুযোগ আরো সম্প্রসারণে প্রস্তাবিত কম্প্রিহেনসিভ এগ্রিমেন্ট অন ইনভেস্টমেন্ট (সিএআই) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আশাবাদী বেইজিং। তবে চীনের শ্রম পরিস্থিতি ও হুয়াওয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চীনকে নিয়ে ইউরোপের সাম্প্রতিক নজরদারির কারণে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে চুক্তিটির ভাগ্য এখন ঝুলে রয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে চুক্তিটি শেষ মুহূর্তে অনুমোদন না পেলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কে বড় ধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি হবে। ২০১৯ সালে এই দুই পক্ষের মধ্যে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সম্পন্ন হয়েছিল। 

এদিকে ইউরোপের বাইরে, অমীমাংসিত রাষ্ট্রগুলোয় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আবেদন বজায় রাখতে চীনকে অবশ্যই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বর্ধনশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও অভিজাতদের হৃদয় জয় করতে হবে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সাধারণ মানুষের ওপর সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন- এ দুইয়ের মধ্যে একটিকে গ্রহণ করতে বলা হলে, তারা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই মত দেয় বেশি। 

আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করতে হলে কিছু অভ্যন্তরীণ লক্ষ্যপূরণ করাও জরুরি। বেইজিং এখনো তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বৈধতা সমন্বিতকরণ ও প্রযুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। জাতীয়তাবাদী মন্তব্যের মাধ্যমে সাময়িক সময়ের জন্য হয়তো তারা বিজয়ী হবে; কিন্তু এক্ষেত্রে চীন-যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেমন চীনের ক্রেতারা এখনো পশ্চিমা পণ্যের প্রতি খুব আগ্রহী। তাই বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হলে অথবা বিদেশ থেকে পাওয়া ঋণ কমে আসলে তাহলে চীনের ওপর ‘অভ্যন্তরীণ নির্ভর’ হয়ে ওঠার চাপ বাড়বে। 

অন্যদিকে চীন যখন থেকে উচ্চ প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সফলতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে, তখন থেকেই তাদেরকে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও দেশটির কোম্পানিগুলো আয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর খুবই নির্ভরশীল। এ অবস্থায় উস্কানিমূলক বক্তব্যগুলো শীর্ষ চীনা কোম্পানির রাজস্ব সংগ্রহে প্রভাব ফেলতে পারে। আর আন্তর্জাতিক সমালোচনাগুলো চীনের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও টেকসই অর্থনীতি হয়ে ওঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। 

 এ অবস্থায় চীনের জন্য কোন পথটি ভালো হবে? শুরুতেই সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক মিত্র ও অসন্তুষ্ট সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সংশোধন করতে হবে। এর মধ্যে সেসব দেশ বা উপরাষ্ট্র রয়েছে যারা অতীতে চীনের আচরণ নিয়ে অভিযোগ করেছিল; কিন্তু ভবিষ্যতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে প্রস্তুত রয়েছে। গ্রিস, ইতালি ও স্পেনের মতো দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউরোপীয় দেশগুলো এ তালিকায় রয়েছে। এই দেশগুলো একদিকে হুয়াওয়ে ও মেধাসম্পদ অধিকার নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যেমন শক্ত অভিযোগ তুলেছে, অন্যদিকে বেইজিং থেকে আসা পর্যটক ও বিনিয়োগকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। 

এছাড়া ভ্যাকসিন ও মাস্ক কূটনীতির সীমার বাইরে চিকিৎসা সরঞ্জাম ছাড়াও চীনকে দ্বিপক্ষীয় সাংস্কৃতিক বিনিময় ও দুপক্ষের নাগরিক ও সুশীল সমাজের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ দিতে হবে। 

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে শিক্ষার স্থান ও সুশীল সমাজে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তা কমাতে পারলে এখানেও চীনের অবস্থানের পরিবর্তন হতে পারে। 

বিতর্কিত জলসীমা ও সামরিক শক্তি প্রদর্শন নিয়ে জাপানের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা শুরু করলে ‘কোয়াড’ অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গেও টোকিওর সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে থাকবে। উল্লেখ্য, চীনের প্রভাব প্রশমিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে কৌশলগত জোটটিই কোয়াড নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন জো বাইডেনের অধীনে জোটটির কার্যক্রম আরো গতি পেয়েছে। 

আর যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বলতে গেলে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নেতিবাচক বক্তব্য কমে আসলে উভয়েই উপকৃত হবে। অন্যদিকে চীনের কূটনীতিবিদরাও দেশের স্বার্থের প্রতি অবিচল থেকেও সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারে। 

সর্বশেষ বিষয়টি হচ্ছে, চীন তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি আবারও ঠিকঠাক করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ধরনের অযৌক্তিক দাবি না মেনেই চীন এ কাজের শুরু করতে পারে। দু’পক্ষের সম্পর্ক মজবুত হলে, তা উভয় দেশের নাগরিকদের জন্যও মঙ্গল বয়ে আনবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //