রাষ্ট্রের গোয়েন্দাগিরির সহযোগী কি ওরাকল!

চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের পুলিশ বিভাগ একবার অপরাধীদের আটক করতে ফিন্যান্সিয়াল রেকর্ড, ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য, পরিবহন নিবন্ধন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সার্ভিলেন্স ক্যামেরার ফুটেজ থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করল। এই তথ্যগুলো যাচাই ও বিশ্লেষণে পুলিশ কর্মকর্তাদের খুবই সংবেদনশীল অ্যানালাইটিক সফটওয়্যার প্রয়োজন ছিল। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি কোম্পানি ওরাকল এ বিষয়ে একেবারে সিদ্ধহস্ত। জায়ান্ট এ কোম্পানিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য খুঁজে বের করতে পারে ও চলমান তদন্তে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে সেগুলোকে একীভূত করে দেয়। আর এ কারণেই লিয়াওনিংয়ের পুলিশ ওরাকলের দ্বারস্থ হয়। 

২০১৮ সালে ওরাকলের ক্যালিফোর্নিয়া হেডকোয়ার্টারে আয়োজিত এক কনফারেন্সে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে পুলিশকে সহায়তা করে কোম্পানিটির এমন কিছু কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। লিয়াওনিং পুলিশ ‘অপরাধ বিশ্লেষণ এবং অনুমান’ করতে ওরাকলের চারটি পণ্য ব্যবহার করেছে। ওরাকলের তৈরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে পুলিশ বিভাগ হোটেল রেজিস্ট্রেশনের তথ্য দিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গ্রাফ তৈরি করে এবং এভাবে সন্দেহভাজন অপরাধীর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে, এমন অপরাধীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। 

ওরাকলের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, কোম্পানিটির প্রতিনিধিরা মার্কেটিং কার্যক্রমে উল্লেখ করেছে যে, তাদের তৈরি ডাটা অ্যানালাইটিক সফটওয়্যারগুলো চীনের পুলিশ ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্যই। এ ধরনের কয়েক ডজন ডকুমেন্ট কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। চীনের পুলিশ কর্মকর্তারা ওরাকলের সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে, এমন দুটি উদাহরণও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি লিয়াওনিং প্রদেশ ও অন্যটিতে শাক্সি প্রদেশকে ‘ক্রেতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওরাকলের ওয়েবসাইটে আরো দেখা গেছে যে, তাদের তথ্য নিরাপত্তা সেবা কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। শিনজিয়াংয়ের পুলিশসহ দেশটির অনেক প্রদেশের পুলিশ বিভাগ ওরাকলের এ সেবা নিয়েছে। 

বিপণন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ওরাকল বলেছে, তাদের তৈরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনলাইনে করা বিভিন্ন মন্তব্য, রেকর্ড, হোটেল রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স প্লেটের তথ্য, ডিএনএ ডাটাবেস ও ছবি থেকে পুলিশ তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। ওরাকলের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, মাদক ব্যবহারকারী ও যৌনকর্মীর দলসহ বিনোদন-শিল্পসংশ্লিষ্টদের নজরদারিতে রাখতে চীন সরকারের তৈরি করা ডাটাবেসের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যের সমন্বয় ঘটাতে কোম্পানিটির সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া চীনের ‘পুলিশ ক্লাউড’ প্রযুক্তিটিও এ কোম্পানির সরবরাহ করা। চীনের নজরদারি কার্যক্রমে এটি অনেক বড় ভূমিকা রাখে। 

ওরাকলের একটি প্রেজেন্টেশনে ডাটাবেস ও ডাটা সিকিউরিটিতে উল্লেখ করা তথ্যের মাধ্যমে জানা গেছে, শুধু পুলিশ বিভাগ নয়, চীনের সামরিক ক্ষেত্রেও পণ্যবিপণন কার্যক্রমে অগ্রগতি সম্পন্ন করেছে ওরাকল। ‘ওরাকল অ্যান্ড দ্য ন্যাশনাল ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি’ শিরোনামের এই প্রেজেন্টেশনে চীনের একাধিক সামরিক বিভাগের নাম রয়েছে। পিপলস লিবারেশন আর্মি, চায়না নিউক্লিয়ার করপোরেশন ও চায়না অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি করপোরেশনের নাম রয়েছে এতে। এছাড়া চীনা ভাষায় ওরাকলের আরো দুটি প্রেজেন্টেশনেও সামরিক বিভাগগুলোকে টার্গেটে রাখার তথ্য পাওয়া গেছে। 

এসব তথ্য পর্যালোচনা করে সবার কাছে একটি বিরক্তিকর চিত্র ফুটে উঠেছে, এই প্রযুক্তি কোম্পানিটি চীনে তাদের ডাটা অ্যানালেটিক সফটওয়ারের প্রবেশ নিশ্চিত করতে পেশাগত মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে। যেখানে তথ্যের সবচেয়ে বড় সংগ্রাহক দেশটির সরকার। এ ছাড়া চীনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে ওরাকলের প্রেজেন্টেশনগুলো কোম্পানিটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কোম্পানিটি মার্কিন সামরিক বিভাগের সঙ্গেও ভালো হৃদ্যতা বজায় রেখেছে। গত বছর কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের ক্রেতার মধ্যে ‘যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিভাগের পাঁচটি শাখার’ সবই রয়েছে। সেই সঙ্গে নাসা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সিআইএ-এর সাথে চুক্তি আছে। মার্কিন পুলিশ বিভাগের সাথেও খুব নিবিড়ভাবে কাজ করে আসছে কোম্পানিটি। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচে কর্মরত চীনের জ্যেষ্ঠ গবেষক মায়া ওয়াং এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনোভাবেই কোম্পানিগুলো কোনো প্রকার নজরদারি পূর্বাভাসমূলক পুলিশিং সিস্টেম বিক্রি করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে এ ধরনের কোনো ব্যবসাই করতে পারবে না তারা। কারণ এর ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, চীনে নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলছে পশ্চিমা বিশ্ব।’

নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির ফেলো ও চীনের সামরিক কৌশলবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলসা কানিয়া বলেন, ‘চীনের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি তাদের পণ্যের মার্কেটিং করছে, এ ধরনের যুক্তি সত্যিকার অর্থেই একেবারে দুর্বল। বিশেষ করে ওরাকল যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত সুযোগ সন্ধান করছে।’ 

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে এ প্রসঙ্গে কানিয়া আরো বলেন, ‘নীতিশাস্ত্র এবং যথাযথ অধ্যাবসায় নয় বরং এখানে মুনাফা ও মার্কেট শেয়ারের প্রশ্ন জড়িত।’

দ্য ইন্টারসেপ্টকে ওরাকলের মুখপাত্র জেসিকা মুর বলেন, আমাদের উপকরণগুলোর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে- ‘কেউ যদি আমাদের পণ্য ব্যবহার করে কিছু তৈরি করে, তাহলে আমরা কী করতে পারি। আমাদের উদ্দীপনামূলক ব্যবসায়িক আইডিয়া ছাড়া আর কিছু নয়।’ 

টিম যুক্তরাষ্ট্র

১৯৭০ সালের শেষের দিকে সিআইএ-এর জন্য ডাটাবেস তৈরির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল ওরাকল। মার্কিন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে কোম্পানিটি এখনো তাদের সুনাম ধরে রেখেছে। কোম্পানিটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ল্যারি এলিসন চীনের জন্য সেন্সর করা সার্চ ইঞ্জিন চালু করায় গুগলের সমালোচনা করে ফক্স নিউজকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। আমি এক্ষেত্রে টিম ইউএসএ’র দলে। গুগল চীনে প্রবেশ করেছে ও দেশটির সরকারের নজরদারি কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই পীড়াদায়ক।

ওরাকলের সিইও সাফরা কাটজ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিশনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কমিশনারও ছিলেন। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ন্যাশনসের সূচনা হয়। প্রযুক্তিখাতে চীনের বর্ধনশীল উত্থান এই কমিশনের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল। এ সময় ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষতিকর আচরণ’ নিয়ে কাটজকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত ই-মেইল করতেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চীনবিষয়ক সাবেক পরিচালক। 

গুগল থেকে ২০১৮ সালে পদত্যাগকারী কর্মকর্তা জ্যাক পউলসন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ওরাকলের নির্বাহী কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক নিরাপত্তা পলিসি নিয়ে বদ্ধপরিকর এবং তারা এখনো তদন্তের প্রয়োজনে চীনা পুলিশ বিভাগের কাছে প্রযুক্তি পাঠিয়েই যাচ্ছে।’ এ দিকে টিকটক থেকে শুরু করে হাল জামনায় ফুলেফেঁপে ওঠা ক্লাউড মার্কেট নিয়েও আগ্রহ রয়েছে ওরাকলের। এ ছাড়া এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়েও কাজ করে কোম্পানিটি। ওরাকলের প্রধান কাজ ডাটাবেস সফটওয়্যারকে কেন্দ্র করে হলেও গত এক দশকে কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি অনলাইন সার্চ ও ডাটা অ্যানালাইটিক স্টার্ট আপ কিনে নিয়েছে। তথ্য কেনা-বেচার বড় দালাল হিসেবেও নাম হয়েছে ওরাকলের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের তথ্য বিক্রি করেছে কোম্পানিটি। বর্তমানে নতুন নতুন বাজারে প্রবেশের জন্য অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওরাকল। অন্য দেশগুলোর সরকারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে তারা। 

ওরাকলের চেয়ারম্যান এলিসন বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আমাজনের মতো কোম্পানিগুলোর তুলনায় আমাদের আরো বেশি দেশে কাজ করতে হবে


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //