প্রদর্শনী যখন সৃজনশিল্পের জানালা

সময় সামনের দিকেই যায়। তো পেছনে তাকিয়ে দেখে অবাক লাগে- আমাদের শিল্পীজীবনের চল্লিশ বছর কেমন কেমন করে যেন চলে গেল! ঘটনাবহুল এ সময়ে জল কম গড়ায়নি। এ সময়ে সতীর্থ আর সহপাঠী শিল্পীর অনেকে দেশে বিদেশে সুপরিচিত হয়েছেন, মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন কেউ কেউ।

ছবি আঁকা নিয়ে যারা টিকে আছেন, তাদেরই একজন শিল্পী ধনঞ্জয় মণ্ডল, আমাদের সহপাঠী- ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের অংকন শিক্ষক। নিজে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন গুণী ও দেশবরেণ্য চিত্রকর আবদুল বাসেত, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, শহিদ কবীর, শাকুর শাহ, ফরিদা জামান প্রমুখকে। তার তরুণকালে সেই দূর ১৯৮৬ সালে কলকাতায় একাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করেছিলেন, লেডি রানু মুখার্জি ও কলকাতায় নিযুক্ত ডেপুটি হাইকমিশনার এস এম রাশেদ প্রদর্শনীর দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান করেছিলেন অজিত পাণ্ডে। সেবার একাডেমি অব ফাইন আর্টসে সত্যজিৎ রায়, অমলেন্দু গাঙ্গুলি, লেডি রানু মুখার্জি প্রমুখ খ্যাতিমানের সঙ্গে পাশাপাশি বসে তরুণ ধনঞ্জয় নাটক দেখেছেন!

জন্ম তার ১৯৫৯ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জ জেলার লক্ষ্মীবিলাস গ্রামে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন যথাক্রমে হাঁসাড়া কালীকিশোর বিদ্যালয় ও ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে। ১৯৭৯ সালে তিনি ঢাকায় তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন চিত্রবিদ্যা শিখতে। পাঁচ বছর পড়ে ১৯৮৪ সালে চারুকলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। পেশাগত জীবনে প্রথমে যুক্ত হয়েছেন এনজিওদের সমিতি এডাবে, পরে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতায় থিতু হয়েছেন।

শিল্পী আঁকেন আমাদের গ্রামীণ জীবন ও নিসর্গের ছবি- নদী, নৌকা, শাপলাবিলের সৌন্দর্য। এমনতর নিসর্গের বিচিত্র রূপ ও রস ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন তার চিত্রপটে। আবার কতক চিত্রকর্মে প্রত্যক্ষ করি চারপাশের চেনারঙ ও চেনা-অচেনা রেখাকে অবলম্বন করে প্রকাশবাদী বিমূর্ততায় নিজের সৃজন ভাবনাকে তুলে আনার প্রয়াস। তার চিত্রকর্মে প্রয়োগকৃত বর্ণ প্রায়শই অমিশ্রিত কিংবা স্বল্পমিশ্রিত, ফলে পিগমেন্টের স্বাতন্ত্র্য কিছুটা রয়ে যায়।

শিল্পী ধনঞ্জয় মণ্ডলের সবচেয়ে বড় গুণ হলো- অসীম ধৈর্য নিয়ে শিল্পচর্চায় লেগে থাকা। সহপাঠী বন্ধুদের দলীয় প্রদর্শনী আয়োজনেও তার আগ্রহ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা মনে রাখার মতো।

আমাদের দেশে শিল্পের বাজার রাজধানীকেন্দ্রিক ও সীমিত, আবার যেটুকু আছে তার প্রায় পুরোটাই খ্যাতিমানদের কব্জায়। এই অসম বণ্টনের সমাজে শিল্পসৃজনে অনেক প্রতিযোগিতা, প্রতিবন্ধকতা ও বঞ্চনা সত্ত্বেও চল্লিশ বছর ধরে নিয়মিত ছবি আঁকা চালিয়ে যাওয়া বিরাট কৃতিত্বের কাজ! আর আমি মনে করি- প্রদর্শনী সৃজনশিল্পীর জন্য আত্মোপলব্ধির এক অনন্য জানালা।

গত ১ মার্চ শুক্রবার বরেণ্যশিল্পী বীরেন সোমের সভাপতিত্বে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্পী অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য। বক্তব্য রাখেন- সীব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক সামিয়া জামান ও শিল্পী জাহিদ মুস্তাফা। প্রদর্শনীতে শিল্পী ধনঞ্জয় মণ্ডলের ৩৭টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। প্রদর্শনী শেষ হয়েছে গত ৭ মার্চ, ২০২৪।

চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি-১-এ শিল্পীর এই দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী দর্শকদের সঙ্গে যেমন তার কাজের পরিচয় ঘটাবে তেমনই নিজের সৃজনের সঙ্গে তার বোঝাপড়াটাও আরেকটু বাড়াবে বৈকি!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //