সুনয়নী দেবীর শিল্পভুবন ও দুটি দুষ্প্রাপ্য রচনা

বাঙালি নারীদের চিত্রকলা চর্চার ইতিহাসে সুনয়নী দেবীর নাম উল্লেখযোগ্য। তার জন্ম ১৮৭৫ সালের ১৮ জুন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। বাবা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মা সৌদামিনী দেবী। শিল্পাচার্য গগনেন্দ্রনাথ ও শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ তার ভাই। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী। মাত্র ১২ বছর বয়সে রাজা রামমোহন রায়ের নাতি রজনীমোহন রায়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

পথিকৃৎ শিল্পী সুনয়নী দেবী চিত্রকলা চর্চায় ব্রতী হন সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই। শিখে-পড়ে তিনি ছবি আঁকতেন না। সুনয়নী খসড়া করতেন না, সরাসরি রঙ-তুলিতে আঁকতেন। এ কারণে তার ছবিগুলো কৃত্রিমতা স্পর্শ করতে পারেনি।

তার আঁকা ছবি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯২১-২২ সালে। ১৯২৭ সালের ১ অক্টোবর লন্ডনের উইমেন ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ক্লাবে তার চিত্রকর্ম প্রদর্শন করা হয়। সুনয়নী দেবীর চিত্রকর্মের সর্বশেষ প্রদর্শনী হয় ১৯৩৫ সালে। সুহৃদরা তার বাড়িতেই এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। তিনি কবিতা ও গান লিখতেন। সেতার বাজাতে জানতেন; ছিলেন আত্মমুখী স্বভাবের। এই গুণী শিল্পী ১৯৬২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রয়াত হন। 

সুনয়নী দেবীকে নিয়ে লেখা দুটি দুষ্প্রাপ্য রচনা
১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে সুধাংশু কুমার রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশ হয় ত্রৈমাসিক ‘রসশ্রী’র তৃতীয় সংখ্যা। এ সংখ্যায় চিত্রশিল্পী সুনয়নী দেবীর চিত্রকর্ম নিয়ে লেখেন বরেণ্য ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ওই সময়ে হাতেগোনা অল্পসংখ্যক নারী চিত্রকলা চর্চা করতেন। সেই চর্চাকে সুনীতিকুমারের মতো বিদগ্ধজন গুরুত্ব সহকারে দেখেছেন। সুনয়নী দেবী এবং সুনীতিকুমার- দুজনের কারণেই এ লেখাটির গুরুত্ব অনেক বেশি। স্বল্প পরিসরের এ গদ্যটি সুখপাঠ্য। দ্বিতীয় গদ্যটি লিখেছেন অস্ট্রিয়ান লেখক ও সমালোচক নোরা পুরসার উইডেনব্র্যাক। জার্মান ভাষায় লিখিত প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ মাসিক বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ হয় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায়। উইডেনব্র্যাক নিজেও চিত্রকর ছিলেন। 


সুনয়নী দেবীর চিত্রাবলী; শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, এমএ, ডি.লিট
স্বদেশে ও বিদেশে যাঁহারা আধুনিক কালে বাঙ্গালাদেশে পুনরুজ্জীবিত ভারতীয় শিল্পের খবর রাখেন এবং এই শিল্পধারার শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির আদর করেন তাঁহারা সকলেই শ্রীযুক্তা সুনয়নী দেবীর অঙ্কিত চিত্রগুলির সহিত পরিচিত, এবং সকলেই ইহার চিত্রগুলির আকর্ষণী শক্তি স্বীকার করেন। শিল্পাচার্য্য অবনীন্দ্রনাথ ও তৎশিষ্য সিদ্ধশিল্পী নন্দলাল বঙ্গদেশে তথা ভারতবর্ষে এক অভিনব শিল্প রচনার ধারা ও শিল্পের সমীক্ষা প্রবর্ত্তিত করিয়াছেন, শ্রীযুক্তা সুনয়নী দেবী সেই ধারা ও সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত হইলেও তাঁহার বিশেষ লক্ষণীয় স্বাতন্ত্র্য আছে। তাঁহার শিল্পের অনুপ্রেণনায় ভারতের সুপ্রাচীন যুগের- অজন্তা প্রভৃতির- তথা ভারতের মধ্যযুগের-রাজপুত ও মোগল শিল্পের- প্রভাব পাই না; তিনি জাপানী, চীনা প্রভৃতি বিদেশী শিল্পের নিকটেও ঋণী নহেন। বাঙ্গালী ঘরের মেয়ে তিনি, তাঁহার রেখার আঁচড়ে ও তুলির টানে বাঙ্গালীর ঘরোয়া ভাবটুকু বেশ বজায় আছে। ছবি দেখিয়াই মনে হয়, কালীঘাট প্রভৃতি বাঙ্গালার পল্লীশিল্পের আধারের উপরেই তাঁহার চিত্রাঙ্কনের ভঙ্গীটুকু অবস্থিত-কালীঘাটের পটুয়াদের সেই সরল সবল ও সুকুমার রেখাপাত তাহাদের আত্মভোলা তাব, তাহাদের নিষ্কপটতা, ভাণ না করিয়া বাস্তবকে সুন্দর করিয়া দেখিবার সহজ ও সুব্যক্ত প্রকৃতি ও চেষ্টা।

শ্রীযুক্তা সুনয়নী দেবী চিত্রাঙ্কণের বিভিন্ন যুগ বা দেশের পদ্ধতি অবলম্বন করেন নাই, তাঁহার শিল্প-বীণার তন্ত্রী বহু নহে, তার কয়েকটী মাত্র, কিন্তু তিনি সেইগুলিকেই অবলম্বন করিয়া ভারতীয় শিল্পে নূতন করিয়া পুরাতন রাগ শুনাইয়াছেন। মুখ্যতার তিনি হইতেছেন মুখম-লের শিল্পী, নানাভাবে দেবতাদের এবং মানুষের বিশেষতঃ হিন্দু ঘরের মেরের মুখের ছবি আঁকিয়া, তাঁহার বক্তব্য অতিসুন্দর এবং চিত্তগ্রাহীভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। তাহার অঙ্কিত কয়েকটী রাধাকৃষ্ণ মূর্ত্তি-রাধাকৃষ্ণের মুখ-একেবারে নূতন জিনিস; বিশেষ করিয়া ত্রিপুরার মহারাজা বাহাদুর কর্ত্তৃক কলিকাতার একটী শিল্প প্রদর্শনী হইতে ক্রীত রাধাকৃষ্ণ চিত্রের কথা আমার মনে পড়িতেছে। অন্য মূর্ত্তিগুলিতে নানাভাবে গৃহকর্ম্মে ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে নিযুক্ত মেয়েদের মুখ দেখা যায়- কোথাও মাতা ও শিশু (বা যশোদা গোপাল) কোথাও পদ্ম হস্তে কন্যা, কোথাও সখী সরিবৃতা বিবাহের বধূ, কোথাও কৃষ্ণ বা রাধা, কোথাও শিব ও উমা, এবং দুই চারিটী অন্য দেবতার মূর্ত্তি যথা- যীশু খ্রীষ্ট। তাঁহার আলোচ্যের বিষয় বস্তু অল্প; এবং তাঁহার আঁকা মুখের অনেকটা অর্দ্ধ-নির্মীলিত ভাবের ডাগর চোখে একটী শিশুচিত সারল্য ও কোমলতা যেন ধরা যায়। একটা বিশেষ ধাঁজের মুখের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও সমস্ত শোভা তাঁহার তুলিতেই ধরা দিয়াছে; এই মুখকে আমরা বিশেষ করিয়া তাহার নামের সহিত জড়িত করিতে পারি। যেমন বিরাট শিল্পে আমরা “গ্রীক মুখ”, “বর্ত্তিচেল্লির মুখ”, “র্ব্যন্ জোন্সের মুখ” “গ্র্যজের মুখ” বলিলেই, মুখের আদলটী বুঝিতে পারি। মোটের উপরে, একথা বলা যায় যে, তিনি একটী নির্দ্দিষ্ট গ-ীর মধ্যে বাঙ্গালা তথা ভারতের শিল্পে একটী সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব রীতি বা চাল আনিয়েছেন, এবং এই রীতি আর কেহ আয়ত্ত করিতে পারে নাই, ইহাতে তিনি একক, উচ্চ গৌরবে সমাসীনা।

তাঁহার ছবি দেখিয়া মনে হয় তাঁহার স্বত উৎসারিত শিল্প-প্রেরণাকে বাহির হইতে কিছুই গ্রহণ করিতে হয় নাই। আমরা বাঙ্গালী মেয়েদের কাছে যেভাবে বাঙ্গালী ঘরের কথা চিত্রিত দেখিতে পাইলে আনন্দিত হই, দেবতার চরিত্রে ও শুভ অনুষ্ঠানে যে শ্রী, শান্তি ও কল্যাণ আমাদের সকলের কাম্য, তাহা যেন শ্রীযুক্তা সুনয়নী দেবীর অঙ্কিত সরলরেখা ভঙ্গীতে ও তাঁহার তূলিকার স্নিগ্ধ বর্ণের আভায় মূর্ত্তিমন্ত হইয়া রহিয়াছে।

দুই.

শিল্পী শ্রীমতী সুনয়নী দেবী
শ্রীমতী নোরা পুরসার উইডেনব্র্যাক রচিত বহুদূরের এক প্রান্তর থেকে সুনয়নী দেবীর এই চিত্রগুলি আমাদের নিকট উপস্থিত। নানাদিক হ’তে বিভিন্নভাবে আমাদের এই ছবিগুলিতে মন মুগ্ধ করেছে। চিত্রদর্শনে এক অতৃপ্ত আকাক্সক্ষার বেদনা মনে জেগে থাকে। ইচ্ছা হয় চ’লে যাই সেই পরীর দেশে যেখানে ঐ শ্যামকান্তি, শান্তশ্রী, পদ্মআঁখি দেবতারা বাস করেন। এই ধ্যানমগ্ন দেবতারাই তাদের নিজেদের রূপ দিয়ে জগতের বিচিত্র রূপের প্রলয়ের মধ্য থেকে সৃষ্টির আসলরূপটি ফুটিয়ে তুলছেন। তাই সীমাহীন ক্ষীণ রেখাটুকুর মধ্যেও সেই দেবতাদের প্রশান্ত স্তব্ধ কল্পমূর্ত্তি ধরা দিয়েছে।

শুধু একমাত্র ছন্দের গতিতে রচিত এই চিত্রগুলির মৃদু রেখা কম্পনে আর সীমাহীন অনন্ত মায়ারূপ সৃষ্টিতে বর্ত্তমান যুগের চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির খানিকটা মিল দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কেবল সাদা আর কালোর সমস্ত রং ছাপিয়ে এই ছবিগুলিতে যে অপূর্ব রং ফুটে উঠেছে, সে ভোলবার নয়। মনে হয় যেন এইগুলি সেই পুরাকালের জল ঝড়ে জর্জ্জরিত দেয়ালের গায়ে আঁকা প্রাচীন চিত্রাবলী। মাঝে মাঝে হঠাৎ ভাগ্যলক্ষ্মীর অযাচিত দানের মতন কখনও কখনও স্নিগ্ধ লাল রং গভীর নীল রং-এর মাঝ দিয়ে শোভা পাচ্ছে। আর তারি মধ্যে দেবতাদের প্রশান্ত চোখের চাহনি আর বিচিত্র অলঙ্কারের জ্যোতি জ্বলজ্বল করছে।

এই ছবিগুলি আকারে ছোট হলেও ভাবগৌরবে যেন সমস্ত দেওয়াল জুড়ে আছে। বহু যুগ আগেকার নিঃশ্বাস ইহাদের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে। যেন এক অপার্থিব গৌরবের বৃষ্টিধারা ছবিগুলি থেকে ঝরে পড়েছে। নানা রকমের রচনার ভিতর থেকে একটি অখণ্ড ভাব এই চিত্রগুলিতে অপ্রতিহতভাবে প্রকাশ। সেই ভাবটি হচ্ছে বিশ্বের উপরে আসীন একমাত্র পরম দেবতার উপর ঐকান্তিক নিষ্ঠা। নূতন কিছু করবার বৃথা প্রয়াস বা সাধারণ প্রচলিত ধারা থেকে জোর ক’রে বিচ্ছিন্ন হবার চেষ্টা সুনয়নী দেবীর শিল্পে একেবারেই নাই।

সুনয়নী দেবী রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং আধুনিক বাংলা শিল্প-পদ্ধতির প্রবর্তক শ্রীযুক্ত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগিনী। সম্ভ্রান্ত বংশে তাঁহার জন্ম। শান্তিময় অন্তঃপুরই তাঁহার কর্ম্মস্থল। এই অন্তঃপুরের প্রত্যেকটি ছোটখাট জিনিষও সম্পূত ধর্ম্মভাবে উজ্জ্বল; সব মিলে যেন একটি সুরের ধারা বইছে। এই সুর যখন মৃদুগতি থেকে উচ্চগ্রামে ওঠে, কণ্ঠস্বর যখন মূর্ছনায় কাঁপে তখন সুপ্ত অন্তরাত্মা এক আকুল আবেগে চঞ্চল হয়ে ওঠে। অজানা কানেও সেই অপরিচিত সুর চিরকাল বাজতে থাকে।

সুনয়নী দেবীর ছবিগুলিতেও এই সুরেরই গভীর অনুভূতির প্রকাশ। বংশীবাদন শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর পাশে বিকশিত পুষ্পের মতন বলরামের প্রতিমূর্তিতে এই সুরেরই তাল বাজছে। গৌরাশঙ্কর নামে অর্দ্ধনারীশ্বর মূর্তিতে এই সুরের ছন্দের সমাবেশ অতিশয় দুরূহ কাজÑকিন্তু তাহাও এই চিত্রে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে।

ছবিগুলির মধ্যে কেবল একটিমাত্র চিত্র পার্থিব ব্যাপার নিয়ে রচিত। শিল্পী ইহার নাম দিয়াছেন ‘প্রসাধন’। কিন্তু এই কিশোরী কন্যার নয়নকোণের কাজলরেখা এবং রহস্যময় ক্ষীণ হাসিটুকু এ জগতের নয়- কোনো এক মায়া জগতের ছায়া মাত্র।

সুনয়নী দেবার শিল্পে দেবতায় মানুষে প্রভেদ সামান্যই। মনের আবেগ যেমন পরপারের সঙ্গীতে ক্ষণিকে মিলিয়ে যায়, চকিতে যেমন মৃদুহাসি মুখে ফুটে ওঠে- প্রভেদ সেই রকমই অল্পমাত্রার। 

তথ্যসূত্র
১. মনীষী-জীবনকথা, সুশীল রায়, কলকাতা : ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, সেপ্টেম্বর ১৯৫৮।
২. ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, বৈশাখ ১৩৫৯।
৩. Remembering Sunayani Devi: A forgotten artist from history, Shilpi das, website : The Heritage Lab, March 7, 2019.
৪. ত্রৈমাসিক ‘রসশ্রী’, তৃতীয় সংখ্যা, সম্পাদক : সুধাংশু কুমার রায়, ডিসেম্বর, ১৯৩৪।
৫. মাসিক বিচিত্রা, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত, প্রথম বর্ষ, ২য় খ-, পৃ. ৪৭৩-৪৭৫।
৬. বাংলার মহিলা চিত্রশিল্পীদের কথা, ঈশিতা সেনগুপ্ত, মৃণাল এন্ড উদ্ভাস, ৩১ মে ২০১৪।
৭. দৈনিক যুগান্তর, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২।
৮. দাদাদের প্রভাব এড়িয়েই গড়ে তোলেন স্বকীয়তা, রিম্পি, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //