চিত্রকলার রবীন্দ্রনাথ

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুমুখী এক প্রতিভার নাম। শিল্প-সাহিত্যের নানাবিধ শাখা তার হাতের পরশে সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশাল মহীরুহ তিনি। তার সৃষ্টিকর্ম প্রবলভাবে প্রত্যেককে বিস্মিত করে, এখন তিনি বাঙালি জাতিসত্তার এক অনিবার্য পুরুষে রূপান্তরিত। তার চিন্তাস্রোতে ঋদ্ধ হয়েছে এই জনপদ। তিনি বিশ্বসভায় নোবেল প্রাপ্তির মাধ্যমে বাংলাকে একটি বিশেষ স্থানে স্থানন্তর করেছেন। তাকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘যেমন সাহিত্যের স্রষ্টা হিসেবে তেমনি শুধু কবি হিসেবেও তার বহুমুখিতা বিস্ময়কর; যেমন চিত্র রচনায় পিকাসো, তেমনি কাব্যরচনায় বিশ্বম্ভর আমাদের রবীন্দ্রনাথ। পিকাসোর মতো তারও আছে বহু ভিন্ন-ভিন্ন রীতি, পর্যায় ও মনোভঙ্গি, উপাদানের বিরাট ভাণ্ডার, এমন সচ্ছল অপ্রতিহত দক্ষতা, যাতে খেয়ালখুশিও রূপান্তর হয় শিল্পকর্মে।’ দৃশ্যত তাই-ই, তদুপরি আমরা এখানে শিল্পী রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার পাঠ নিয়েই পর্যালোচনা করছি। কেননা তিনি ভালোভাবেই বুঝতেন একটি বস্তু উপকরণগত বাস্তবতা নিয়ে নিঃশেষ হয় কিন্তু শিল্প অনুভূতির অন্তঃসার নিয়ে জীবন্ত হয়। শিল্প হচ্ছে দৃষ্টিগোচরতায় পৃথিবীকে অনুভব করার একটি আবেগময় কৌশল। 

বস্তুর একটি সত্তা আছে যে সত্তা হচ্ছে তার বস্তুগত অস্তিত্ব। কবি এবং শিল্পীর দৃষ্টিতে বস্তুর বস্তুত্বটি কিছুই নয় কিন্তু তার সজীবতা এবং সচলতাই একমাত্র প্রতিপাদ্য। বাতাসে কম্পমান প্রভূত পত্রে সমৃদ্ধ একটি গাছের শাখায় সূর্যের আলো এসে যখন পড়ে তখন শিল্পী স্থির একটি শাখাকে দেখেন না, তিনি আলোর কম্পনে একটি সজীব অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। এই অস্তিত্বের ব্যপদেশে নিমগ্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ কারণে তার চিত্রকলা একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

যামিনী রায়কে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তার কাছে ‘ছবি’র অর্থ হলো সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তার ভালো-মন্দের আর কোনোরকম যাচাই হতে পারে না।” আবার বুদ্ধদেব বসুর কাছে সাক্ষাৎকার পর্বে চিত্রকলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তার অত্যন্ত আধুনিক মত ঘোষণা করেছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ছবিটা ছবিই, তার বেশি কিছু নয়, তার কমও নয়। ভারতীয়, অজন্তীয়, ওসব কিছু না।’ 

ভারতীয় চিত্রকলায় আধুনিকায়নের সূচনা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। সমাজ বাস্তবতার সচেতন প্রতিফলন চিরন্তন অবয়বকে বদলে দেয়, রেখায় ও রঙে আসে বৈচিত্র্য। একজন শিল্পবোদ্ধা ও উঁচু মানের কবি রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার জগতে চলমান আন্দোলনে নিজেকে শামিল করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

এ কথা প্রচলিত, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলায় আসেন প্রৌঢ় বয়সে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি ঢেকে দেবার জন্য উদ্দেশ্যহীন আঁকাআঁকি, রেখায় রেখায় মেলবন্ধন, তার চিত্রকলার মূল জায়গা। শিল্পজগতে বিচরণ, ড্রয়িংয়ের সমালোচনামূলক মূল্যায়নে আগ্রহসৃষ্টি বেশ দেরিতে- জীবনের শেষ সতেরো বছরে। রবীন্দ্রমানসে চিত্রকলার উন্মেষ কখন ঘটে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া দুষ্কর। এ কথা মনে রাখতে হবে জোড়াসাঁকোতে পারিবারিক আবহ ছিল শিল্পসাহিত্য বান্ধব এবং সমকালীন অন্য যে কোনো পরিবারের চেয়ে অগ্রসর। তাই একথা জোর দিয়েই বলা চলে শৈশব থেকেই চিত্রকলার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে এবং তিনি তখনই চিত্রশিল্প চর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ক্ষিতীশ রায় উল্লেখ করেন, তিনি রবি ঠাকুরের কিছু ড্রয়িং দেখেছেন। বুলবন ওসমান দাবি করেন, ‘কবি ১৮৭৪-৮২ এই সময়কালে মালতি নামে একটি পুঁথির পাতায় ছবি আঁকতেন। তবে সে ছবি প্রথাগত চিত্রশিল্পীর মতো নয়, বরং নিজের খেয়ালখুশি মতো, নিজের জন্য।’

 রবিঠাকুর নিজেই ‘আমার ছবি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “(ষোলো বছর বয়সে) ... তত দিনে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ঐতিহ্য মেনে আধুনিক শিল্প আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। তত দিনে আমার সম্পূর্ণ বোঝা হয়ে গিয়েছে যে শব্দের আঁটোসাঁটো চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার ছাড়পত্র ভাগ্য আমাকে মঞ্জুর করেনি।’’ 

কবিগুরুর চিত্রশিল্পের প্রতি ঝোঁক দেখা যায় বিশের দশকের শেষের দিকে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সাহিত্য ও চিত্রকলার বৈচিত্র্যময় যাত্রা এবং খোলস বদল, এটা কবি মানসে নতুন বোধেরই প্রতিফলন। তাই দেখা যায় পূর্বপরিকল্পিত ধ্যান-ধারণা ও শিক্ষাকে উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ আঁকতে শুরু করেন। যেন অজানা সাগরে পাড়ি দেবেন বলে মনস্থির করেছেন। শিল্প কীর্তির অন্যসব শাখায় আমরা দেখি, তার সৃষ্টিশীলতা বাস্তব থেকে প্রতিফলিত অর্থাৎ বাস্তবকে বিশ্লেষণ, পুনর্নির্মাণ বা পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে সৃষ্টকে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চিত্রশিল্পে ঘটেছে উল্টোটা। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আঁকিবুঁকির মধ্যে থেকে দৈবক্রমে লব্ধ সৃষ্টকে বাস্তবতায় আনতে চেয়েছেন রেখায় রঙে। প্রায় সময়েই বলেছেন, ছবি তার কাছে আসে। এই উক্তির অর্থ তিনি ছবি আঁকতেন ইনটিউশনের ভিত্তিতে, রেখা ও রঙ যেখানে যেতে চায় সেখানে গিয়ে শেষ করতেন সুস্পষ্ট কোনো নির্ধারিত লক্ষ্য ছাড়াই। লক্ষ্য শুধু একটাই ছবি শেষ করা। এই আপাত উদ্দেশ্যহীন যাত্রার মাঝেই লুকিয়ে আছে তার চিত্রকলার শেকড়।

বিশের দশকের শেষ ভাগ রবীন্দ্রমানসের নতুন এক সূচনা পর্ব। অন্যান্য সৃষ্টি মাধ্যমে ইতোমধ্যেই তিনি স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত। এ সময়টাতে বিশ্বসাহিত্য এবং চিত্রকলার জগতে চলছিল ভাঙাগড়া। চিত্রশিল্পের প্রকৃতি কী- তার প্রেরণা, উদ্দেশ্য, ধ্যান-ধারণা এমনকি তাকে হৃদয়ঙ্গম করার প্রক্রিয়া; সর্বক্ষেত্রেই প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার করা হচ্ছিল। বাস্তবতার প্রতি নিষ্ঠা আর আস্থায় চিড় ধরল। আবির্ভাব ঘটল নানাবিধ বিকল্প কল্পরূপের, যা শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে উৎসারিত। সাহিত্যে নান্দনিকতার যে ধ্যান-ধারণা গড়ে তুলেছেন রবিঠাকুর, যে নান্দনিক রোমান্টিসিজমের নিসর্গ তিনি গড়েছেন তা ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে বাস্তবতার কশাঘাতে। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ভাঙনে দুর্বিষহ সময়ের সন্তানেরা। আর এ সময়টাতেই তার আঁকাআঁকির সূচনা। তাই তিনি অস্বীকার করলেন অপরাপর মাধ্যমের রবীন্দ্রনাথকে, শিল্প ও সুন্দরের রবিঠাকুরকে। নির্ঝরের স্বপ্ন যেন ভঙ্গ হলো, রুধিত আবেগ ঝরঝর ঝরতে শুরু করল। জীবনের শেষ সতেরো বছর এঁকেছেন দুহাতে। এই সময়ে তার আঁকা ছবির সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেকের মতে তিনি ২০০০-এর বেশি ছবি আঁকেন। তবে রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ শিবনারায়ণ রায়ের মন্তব্য তার আঁকা ছবির সংখ্যা তিন থেকে চার হাজার। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে তার ছবি নিয়ে যে আলোচনাগুলো হয়েছে সেগুলো অনেকাংশেই পরিপূর্ণ নয়, কেননা তার চিত্রসম্ভার অনেকের পক্ষেই দেখা সম্ভব হয়নি। তার চিত্রাঙ্কন প্রবণতাকে ভ্রাতুষ্পুত্র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলনা করেছেন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে। প্রায়দিনই চার পাঁচটি ছবি এঁকে শেষ করতেন। হাতের কাছে যা পেতেন তাই ব্যবহার করতেন- ভাঙা কলম, পেন্সিল, ফেলনা কাগজ- সব। তিনি প্রধানত ব্যবহার করতেন পেলিক্যান কালি। নিজের ছবি প্রসঙ্গে রানী চন্দকে কবি লিখেছিলেন, 

“তুমি জান আমি চিত্রশিল্পী নই। যাই আঁকি না জেনেশুনেই আঁকি। ভেবেচিন্তে আঁকা বা কোনো সুনির্দিষ্ট রূপ দেবার অভিপ্রায়ে সচেতনভাবে আঁকা, আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার কাজে নানান ইতস্তত আঁকাআঁকি থেকে কোনো এক পর্যায়ে একটা অবয়ব রূপ ধারণ করে। এমন লোককে কি শিল্পী বলা চলে? নিশ্চয়ই বলা চলে, যদি এই কথা আমরা মনে রাখি যে এই শিল্পী কোনো রকম খোঁজ ছাড়াই পাওয়ার আশায় আঁকেন, ফলে তার প্রাপ্তিতে ভালোমন্দের বেশ বড়ো হেরফের রয়েছে।’’

রবীন্দ্র চিত্রকলার লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে ভারতীয় চিত্রকলার হাজার বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবোধ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারার সৃষ্টি। এ কাজটি তিনি করেছিলেন সচেতন সৃজনমানস ও শিল্পের আধুনিকায়নের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে। ১৯১৩ সালে নোবেল জয়ের পরে তিনি মোটামুটি সারা বিশ্বেই পরিচিতি লাভ করেন। এ সময়ের বিশ্ব-ভ্রমণ ও শিল্প সাহিত্যের অগ্রপথিক দেশগুলোর সাহিত্য আর শিল্প আন্দোলনের ভাবধারা তার মানসে গভীর রেখাপাত করে। ইউরোপের রেনেসাঁপ্রসূত বিজ্ঞানচেতনা, মানবতাবাদ, কিউবিজম, ফবিজম, ফিউচারিজম, সুরিয়্যালিজমের চেতনা চিত্র জগৎকে যে নাড়া দিয়েছিল এবং সূচনা করেছিল পরাবাস্তবতার, তার ফলশ্রুতি আমরা দেখতে পাই রবিচিত্রে। ভারতীয় পুরাণভিত্তিক এবং মোগল চিত্রকলার দীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে নিজস্বতা সৃজন করেন। ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে শিল্পের গোঁড়ামিকতার বিরোধিতা করেছেন তিনি সব সময়। তিনি এ সময়েই বলেন, “আমি আমাদের শিল্পীদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি তারা যেন বিগত যুগের শিল্প সৃষ্টির অনুকরণে এমন কিছু করবার দায়িত্ব না নেন যা তথাকথিত ভারতীয় আর্টের নামে ‘ছাপ মেরে’ জনসমাজে চলতে পারে। তারা যেন গর্বের সঙ্গে ছাপমারা পশুর মতো পশুশালায় জড়ো হতে অস্বীকার করেন,” রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন চেতনার জায়গাটিতে ছিল বিশ্ব ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য অবদান। বিশ্বভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায় ছিল জাপান ভ্রমণ। ১৯১৬ সালে গিয়ে সেখানে চলমান শিল্প আন্দোলন বিষয়ে অবহিত হন। সঙ্গে করে কিছু চিত্রকর্ম তৈরি করিয়ে আনেন যা এখন বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালায় আছে। এ সময়েই প্রতিষ্ঠা করেন শিল্পী সাহিত্যের গোষ্ঠী- বিচিত্রা ক্লাব। আশা ছিল এই গোষ্ঠী ভারতীয় সাহিত্য এবং চিত্রকলার নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটাবে। তবে এ আশা পূর্ণ না হলেও পরবর্তীতে শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে আধুনিক চিত্রকলা চর্চার পীঠস্থান। কবি গুরু তার পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরিতে লিখেছেন, “...আর্টিস্ট আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আর্টের সাধনা কী? আর্টের একটা বাইরের দিক আছে সেটা হচ্ছে আঙ্গিক, টেকনিক, তার কথা বলতে পারি নে। কিন্তু ভেতরের কথা জানি। সেখানে জায়গা পেতে চাও যদি তাহলে সমস্ত সত্তা দিয়ে দিয়ে দেখো, দেখো, দেখো।... দেখতে পাওয়া মানে প্রকাশকে পাওয়া। বিশ্বের প্রকাশকে মন দিয়ে গ্রহণ করাই হচ্ছে আর্টিস্টের সাধনা।”

বহুকালব্যাপী ভারতীয় চিত্রকলা ছিল বর্ণনাত্মক, চিত্রে ধর্মীয়, পৌরাণিক-ঐতিহাসিক আখ্যানের বর্ণনাই ছিল চিত্রকলার প্রধান কাজ। সে ছিল ইলাস্ট্রেশনধর্মী আর তার স্বাধীনতা ধর্ম, পুরাণ বা ইতিহাসের কাছে যেন বন্ধক রাখা ছিল। মজার ব্যাপার ইংল্যান্ড থেকে আগত তৎকালীন ইউরোপীয় বা অ্যাংলো শিল্পীদের চর্চায় এর কোনো বদল ঘটেনি যারা ভারতবর্ষে এসে চর্চা করেছেন চিত্রকলা। তাদের চর্চাতে সামান্য রঙ বদল ঘটেছে মাত্র, কিন্তু একদম আনকোরা সুর ফুটে ওঠেনি চিত্রপটে। রবিঠাকুর স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিলেন এখানেই। চিত্রকর্মে আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে পাই সে রবীন্দ্রনাথ আমাদের চেনা, কবি মহর্ষি গুরুদের শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা, শুদ্ধ ও সুন্দরের সাধক নন বরং একান্তই বিপরীত। বিষয় ও আঙ্গিকগত দিক থেকে তার ছবি বিস্ময়কর।

বাহ্যত, রবীন্দ্র চিত্রকলাকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্র, মানব প্রতিচিত্র আর পাখি এবং জীবজন্তুর চিত্র। যদিও এ শ্রেণিকরণ রবীন্দ্র চিত্রের ব্যাপকতা ধারণে ব্যর্থ, তথাপি মোটামুটি সরলীকরণের সুবিধার্থে করা। রবীন্দ্রনাথ নিজের প্রোর্ট্রটেসহ বহু প্রোর্ট্রেটধর্মী কাজ করেছেন। এসব চিত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই চেনা মুখ ছায়ার আড়ালে কেমন যেন আড়ষ্ট একটা অন্যরকম রূপ নিচ্ছে। তার অনেক কিছু বলবার আছে। ভীষণ রকম এক্সপ্রেসিভ কিন্তু বিষণ্ণ কিছু মানব মানবীর ছবি এঁকেছেন তিনি। ক্রমাগত বিষণ্ণ এ মুখগুলো তিনি এঁকে গেছেন বারবার। এসব ছবি নিয়ত ভাঙাগড়ার এক আশ্চর্য উপলব্ধির মাঝে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। চিত্রাঙ্কনে রেখাচিত্রের প্রাধান্য দেখা গেলেও সুস্পষ্ট নিয়ম বা রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা দেখা যায় না। ফলশ্রুতিতে ছবিগুলো হয়ে উঠেছে অনেক বেশি ধোঁয়াশাপূর্ণ। যেন অঙ্কিত মানবমূর্তিগুলো নীরব অথচ চঞ্চল, অংশ নিচ্ছে মূকাভিনয়ে। মানুষের মুখের পিছনকার মুখ বের করতে উদ্ধত সেই মূর্তিগুলো।

তিনি জীবজন্তু এবং পাখি বিষয়ক চিত্রও এঁকেছেন প্রচুর। শুরুর দিকে তার জীবজন্তুরা যেন ছিল এক অন্ধলোকের বাসিন্দা। শরীরের নড়াচড়া ছিল অবিন্যস্ত, তথাপি প্রাণসঞ্চারী অনুভূতিটা ছিল অক্ষুণ্ণ। তার বাঘের ছবিতে দেখতে পাই অদ্ভুত হিংস্র লিপ্সায় আক্রান্ত বাঘ যার বাস্তবতা বা আকার আকৃতিগত দিক মুখ্য না হয়ে প্রকৃতি মুখ্য হয়ে ধরা দেয়। প্রাণিজ চিত্রকলায় গতিময়তার বিষয়টি বাক্সময় হয়ে উঠেছে অতি সুচারুরূপে। তার বেশির ভাগ পশুপাখির ছবিতে আঁকার আকৃতিগত দিকটি চেনা জানা জগতের সঙ্গে মেলে না বরং মনে হয় অলীক এ জন্তু জানোয়ারের প্রতিচ্ছবি, নিসর্গের বদলে ধূসরতা, সময়ের কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ। এভাবেই চেষ্টা করেছেন তিনি প্রথাবদ্ধতা, চিত্রকলার তথাকথিত পরিবর্তনহীন ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে। যারা প্রথাবদ্ধতার পথেই আস্থা রাখেন তাদের উদ্দেশে কবির বক্তব্য, “লোকে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার ছবির মানে কী। ছবির সাথে সাথে আমিও নীরব থাকি। ছবির কাজ প্রকাশ করা, ব্যাখ্যা করা নয়।”

রবীন্দ্র চিত্রকলার উল্লেখযোগ্য দিক ছিল রেখাচিত্র। তার বহুচিত্রকর্ম কালি ও কলমে আঁকা। রেখার আবেশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বহু অবয়ব। তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করতেন কীভাবে রেখাগুলো একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন নতুন ছবি ফুটিয়ে তুলছে শাদা কাগজে। তার চিত্রকলার আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক রঙের ব্যবহার। একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন তার কাজে সবুজ এবং নীল রঙের লক্ষণীয় অনুপস্থিতি এবং গাঢ় খয়েরি বা কালচে খয়েরি রঙের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ তার দৃষ্টির অস্বাভাবিকতাকে দায়ী করেছেন। ব্রিটিশ জার্নাল অব ঈস্থেটিক্সের ১৯৮৭ সালের এক সংখ্যায় লেখা হয়, “রবীন্দ্রনাথ প্রোটোন্যাপ ছিলেন। তিনি নীল আর বেগুনি রং দেখার সময় লাল রঙের সাথে গাঢ় খয়েরি বা কালো রঙের সাথে গুলিয়ে ফেলতেন। চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাথে এসেছেন ব্যাপৃত নিঃসঙ্গতা নিয়ে, সেই সঙ্গে প্রচলের প্রতি ঠাট্টার রেশ নিয়ে। এ কারণেই তার পোর্ট্রেটের দিকে তাকালে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়, নিজের জীবনকেও মনে হয় ক্ষুদ্র, অর্থহীন। অপরাপর কর্মযজ্ঞে নিজের ভাবনাকে প্রকাশের বেলায় নিঃসঙ্কোচ রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে চিত্রকর্ম নিয়ে এক ধরনের শঙ্কায় ভুগতেন। অঙ্কনশিল্পে প্রথাগত দখল ছিল না বলেই হয়তো এ সঙ্কোচ। তিনি এ কথাও বলেছেন যে, নন্দলাল ও অবনীন্দ্রনাথের মতো ছবি আঁকা শেখেননি বলেই এ সঙ্কোচ। যা হোক, তার চিত্রকর্ম ভারতবর্ষে প্রথম দিকে গৃহীত না হলেও ইউরোপে বেশ গুরুত্ব পায়। সেখানে বেশ কয়েকটি দেশে তা প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। কোথাও কোথাও অবশ্য সমালোচিতও হয়েছে।

ভারতীয় চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ ডব্লিউ বি আর্চার, অমৃতা শেরগিল আর যামিনী রায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকেও আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার পথিকৃৎ বলে চিহ্নত করেছেন। প্রথাগত শিক্ষালাভের ব্যাপারটি যে তার সঙ্গে ঘটেনি এটাও একটি পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত। সরসীলাল সরকারকে লিখিত কবির পত্র থেকে জানা যায়, “ছবির কথা কিছুই বুঝিনে। ওগুলো স্বপ্নের ঝাঁক, ওদের ঝোঁক রঙিন নৃত্যে। এই রূপের জগৎ বিধাতার স্বপ্ন- রঙে রেখায় নানাখানা হয়ে ফুলে উঠছে।... অজানার স্বপ্ন উৎসব থেকে বিচিত্র রূপে উৎসারিত- এ সম্বন্ধে বিশ্বকর্মার কোনো কৈফিয়ত নেই।”

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //