আমার গানে-আমার প্রাণে

একটি স্টুডিও সেশনে ভায়োলিন বাজাব বলে ধানমন্ডির একটি স্টুডিওতে যাচ্ছি, সেদিন রাস্তায় তেমন জ্যাম ছিল না, তাই নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই পৌঁছে গেলাম।

ফোন দিয়ে জানলাম কম্পোজার আর প্রডিউসার দু’জনেই স্টুডিওর পথে, তাদের পৌঁছাতে আরও প্রায় মিনিট বিশেকের মতোন লাগবে।

ভাবলাম, তাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি আরামসে একটু চা খেয়ে নিতে পারি। ধানমন্ডি লেকের কোণের একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বললাম- ‘চা দিয়েন তো মামা, কাপটা একটু গরম পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়েন।’

চায়ের দোকানদার বেশ বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলেন- ‘চা বেচি না মামা, কফি আছে, খাইলে খাইতে পারেন।’
আমি বললাম- ‘এইডা কি রেডিমেড কফি...? দুধ-চিনি সব মিক্সড করা...?’
দোকানদার ঠিক আগের সুরেই উত্তর দিলেন- ‘কফি তো একরকমই, দিমু কি, দিমু না...?’
বললাম- ‘দেন এক কাপ...’

আমি মনে মনে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম, কিছু কিছু জায়গায় আমরা কত অসহায়। মানে, এক কাপ কফি খাব তা-ও নিজের মতো করে খাওয়ার সুযোগ নাই, আপনি কেমন স্বাদের কফি পছন্দ করেন সেটাও অন্য কেউ নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। অবশ্য এটা যে শুধু কফির ক্ষেত্রে তা-ও কিন্তু না। আমাদের চারপাশে এরকম হাজারটা বিষয় আছে যা গতানুগতিক বা ভুল ‘প্রি-সেটে’ সেট করা। আর এটি নির্ধারণ করে এরকমই কতিপয় মানুষ যারা নিজেরাও উক্ত বিষয়ে খুব একটা কিছু জানেন না; কিন্তু ভাবটা এরকম যে তারা ওই বিষয়ে উচ্চবংশীয় জ্ঞানসমৃদ্ধ।

  • হোক তা শাস্ত্রীয় সংগীত, আধুনিক গান বা যেকোনো লোকগান। যথাযুক্ত মেলোডি ছাড়া সংগীত তার পূর্ণতা পায় না। কেন যেন আমার মনে হয় অসুন্দর মেলোডিতে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও বিরক্ত হন আর সুমধুর সুরে মানুষের প্রাণে যেমন আবেগপূর্ণ আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়, তখন সৃষ্টিকর্তাও হন তুষ্ট। কালজয়ী মেলোডি বা সুর সৃষ্টি অনেক সাধনার ব্যাপার

আমি আরও উদ্ভট এবং অদ্ভুত বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম, ঠিক তখনই অনুভব করলাম আমার পেছনে কেউ একজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছে। আমি কফি নিয়ে পাশে থাকা বেঞ্চে বসলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিও সিগারেট হাতে বেঞ্চের অন্য প্রান্তে বসলেন। তাকে দেখে অনেকটা পাগলাটে মনে হলো।

মিনিট খানিক নিজের মতো থেকে, আচমকা ওই লোকটি আমার উদ্দেশ্যে বললেন- ‘মিউজিক করেন নাকি?’
আমি উত্তর দিলাম- ‘হুম..!’
উনি আবার প্রশ্ন করলেন- ‘প্রফেশনালি করেন?’
আমি এবার হালকা বিরক্ত হলাম- উনি কি আমাকে নিয়ে মস্করা করছেন! কিন্তু আমার ভেতরের ‘বিনয় কুমার’ সজাগ থাকায় বিরক্তিটা আর প্রকাশ করলাম না।

লোকটি স্যরি, বলে উনার পরিচয় দিলেন- ‘আমি রোজারিও, প্রায় ২০ বছর লন্ডনে থাকি ফ্যামিলি নিয়ে, তাই এই দেশের বর্তমান শিল্পীদের সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানি না। তবে একসময় আমাদের বাসায় গানবাজনার ভালো একটি পরিবেশ ছিল, ইনফ্যাক্ট আমার মা শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। আমরা প্রচুর গান শুনতাম, রীতিমতো আয়োজন করে- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, পংকজ মল্লিক, মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, এস ডি বর্মন, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, বিটলস, কার্পেন্টারস প্রায় সবার গানেরই এলপি ছিল আমাদের। এখনো অনেক কালেকশন আছে আমাদের বাড়িতে। আমি এখনো ওসব গান বাজনাই শুনি, তবে ইদানীং আমার ছেলের কারণে কিছু অন্য ঘরানার ইংরেজি গানও যোগ হয়েছে তার সঙ্গে।’

রোজারিওর কথা শুনে আমি ইয়া লম্বা একখান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছোট্ট করে নিজের পরিচয় দিলাম আর বললাম- ‘ভাই আপনি অনেক লাকি, কী সুন্দর একটা পরিবেশে আপনার বেড়ে ওঠা।’ এসব বলতে বলতে হঠাৎ একটি প্রশ্নবোধক নোটিফিকেশন ওনার চেহারায় দেখতে পেলাম, তাই আমার কথায় ছোট্ট একটি ‘সেমিকোলন’ দিয়ে উনার প্রশ্ন শোনার আগ্রহ প্রকাশ করলাম।

রোজারিও দুই সেকেন্ড নীরবতা নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বললেন- ‘আচ্ছা, আজকালকার গান, গানের মতো হচ্ছে না কেন বলেন তো?’

আমি আশ্চর্য হইনি... ‘ভেরি ওল্ড’ আর খুবই কমন প্রশ্ন, যা প্রায়শই অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ এবং প্রকৃত সংগীত প্রেমিকরা বলে থাকেন- ‘(ইদানিংকার গান আর মজা লাগে না)।’

আমি একটু ‘ডিপ্লোমেটিক’ উত্তরে বললাম- ‘আসলে এখনো ভাল গান, খারাপ গান সবই হয়, হচ্ছে এবং প্রচুর পরিমাণেই হচ্ছে। তবে ভালো গানের তুলনায় খারাপ গানের সংখ্যাই অনেক বেশি আর সাধারণ মানুষের কাছাকাছি, তাই অনেক ভালো গানই এই কারণে মানুষের সামনে আসতে পারে না, পারছে না।’
উনি বললেন- ‘আপনার উত্তরটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।’

এই যে দেখুন, ‘আকাশের যে তারাটি উজ্জ্বল আর অনেক বড়; সেই তারাটি কি সামান্য মাত্রার উজ্জ্বল তারাটির তুলনায় আসলেই বড় আর উজ্জ্বল?’

বস্তুত, সেই অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বা কম উজ্জ্বল তারকাটি সামনে জ্বলে উঠতে পারছে না শুধু তার অবস্থানগত দূরত্বেরই কারণে। আমাদের অবস্থাও ঠিক এরকমই, সাধারণ মানুষ আর ভালো গানের মধ্যে একটি দূরত্বের সৃষ্টি হয়ে গেছে।

ভাবলাম রোজারিও তার উত্তর পেয়ে চুপ হয়ে যাবে; কিন্তু না, কি জানি একটু হিসাব কিতাব করে আমাকে একটি আক্ষেপের কথা জানালেন- ‘এখনকার গানের মধ্যে না, মেলোডিটাই খুঁজে পাই না, ওইটাই কেন যেন মিসিং লাগে।’

রোজারিওর আক্ষেপের কথাটি আমার কাছে ‘আক্ষেপ টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি’ হয়ে, ‘ধড়াম’ করে আমার কানে এসে লাগল।

আসলেই ‘মেলোডি’ জিনিসটি সংগীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যার অনুপস্থিতিতে সংগীত বেস্বাদ-স্বাদহীন বলে মনে হয়, সংগীতের অবস্থা হয় গুরুতর, শ্রোতারা হন আহত।

হোক তা শাস্ত্রীয় সংগীত, আধুনিক গান বা যেকোনো লোকগান। যথাযুক্ত মেলোডি ছাড়া সংগীত তার পূর্ণতা পায় না। কেন যেন আমার মনে হয় অসুন্দর মেলোডিতে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও বিরক্ত হন আর সুমধুর সুরে মানুষের প্রাণে যেমন আবেগপূর্ণ আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়, তখন সৃষ্টিকর্তাও হন তুষ্ট।

কালজয়ী মেলোডি বা সুর সৃষ্টি অনেক সাধনার ব্যাপার; কিন্তু আবার সাধনা করলেই যে যুগান্তকারী কিছু করা যাবে তেমন কোনো গ্যারান্টিও নাই। যদি সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ থাকে এবং প্রকৃতি যদি কাউকে সংগীতের স্বাদ বোঝার ক্ষমতা দিয়ে থাকেন তবেই ঘটনাটি ঘটবে অন্যথায় নয়।

এর মধ্যে কম্পোজার বন্ধুর কল এলো, আমি রোজারিওকে বললাম- আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল, অখাদ্য কফিটি ডাস্টবিনে ফেলে হাঁটা দিলাম স্টুডিওর দিকে ...

রোজারিওর কথায় একটা জিনিস বুঝলাম যে এখনো কিছু মানুষ সুন্দর সুস্থ সংগীতকে খুঁজে বেড়ায়, আমাকে অন্তত তাদের জন্যে হলেও কিছু ভালো কাজ করতে হবে, যার জন্য আরও অনেক সাধনার পথ পাড়ি দিতে হবে।

আর আমি তাই একজন সুবোধ ছাত্রের মতো সেই পথেই হেঁটে চলেছি- সংগে আপনাদের মতোন সুবন্ধুদের উপস্থিতিও টের পাই প্রত্যেক মুহূর্তে। সুন্দর কিছু সৃষ্টির আগ্রহী অপেক্ষায় রইলাম আমি-আপনি দুই বন্ধু।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //