মৃত্যুর পর কেন আলোচিত জীবনানন্দ দাশ

স্বয়ং বুদ্ধদেব বসুও একসময় জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় কাব্যগ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা মিলে আনুমানিক ২৬২টি প্রকাশিত কবিতার কথা জানা যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনানন্দ দাশ কেবল কবি। লাজুক স্বভাবের এবং প্রবল অনুভূতিপ্রবণ এই মানুষটি চাকরি জীবনের ব্যর্থতা, পারিবারিক জীবনের অশান্তি সব মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন। ভেবেছেন স্ত্রী একদিন সবটা বুঝবে; কিন্তু আসলে তা ঘটেইনি। বন্ধুস্থানীয় বেশিরভাগ মানুষের কাছে জীবনানন্দ দাশ যতখানি কবি তার থেকে বেশি ছিল সমস্যাযুক্ত মানুষ। কারও কাছে চাকরি প্রার্থনা করছেন, কারও কাছে ব্যক্তিজীবনের অশান্তির কথা প্রসঙ্গক্রমে বলছেন। টাকার টানাটানিতে তিনি কাউকে এমনও বলেছেন যে তিনি আত্মজীবনী লিখছেন সেসবের জন্য অগ্রিম কিছু টাকা তার চাই। কোনো বন্ধুস্থানীয় সাহিত্যিকের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পড়ার ঘর দেখে তার মনে হয়েছেএমন একটা ঘর যদি তার থাকত। আবার কাউকে বলছেনস্ত্রী যদি আপনার আবেদনে সাড়া না দেয় তবে কী করা উচিত? ফলে বেশিরভাগ মানুষের কাছে জীবনানন্দ দাশ যতখানি কবি ছিলেন তার থেকে বেশি ছিলেন সমস্যায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ।

জীবনানন্দ দাশের কবিতা দুর্বোধ্য এই প্রসঙ্গটি জীবদ্দশায় নানাভাবে আলোচিত হয়েছিল। বরং তার তুলনামূলক সহজবোধ্য কবিতা যে পাণ্ডুলিপির ওপর তিনি লিখে রেখেছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ নামে যা পরে ‘রূপসী বাংলা’ নামে প্রকাশ পায় সেসব কবিতা তাকে সহজবোধ্য কবি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। কবিতায় রঙ, রূপ ও ইন্দ্রিয় অনুভূতির সূক্ষ্ম কারুকার্য ক্রমশ পাঠককে টেনেছে। একশ্রেণির জীবনানন্দ ভাবুক, গবেষক ও সর্বোপরি জীবনানন্দপ্রেমী পাঠক ধীরে ধীরে অপ্রকাশিত জীবনানন্দের মধ্য দিয়ে বহুমুখী প্রতিভার জীবনানন্দকে পেয়ে দ্বিগুণ আবেগে তার চর্চা শুরু করেন। জন্মশতবর্ষে নানা প্রতিষ্ঠানে তাকে নিয়ে আলোচনা, অপ্রকাশিত ডায়েরি, ব্যক্তিজীবনে দুঃখী মানুষের অজানা জীবনের প্রতি কৌতূহল জীবনানন্দকে সমাদৃত করেছে। সর্বোপরি কবিতার ভাব, শব্দ ও কাঠামোর অভানীয় সমন্বয় কবিতা বুঝে ওঠার আগেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাঠককে সম্মোহিত করেছে।

শনিবারের চিঠির প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। জীবদ্দশায় আলোচিত ৬টি কাব্যগ্রন্থ থেকে গুটিকয়েক কবিতা তার সাহিত্যপ্রেমী ও সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে সমাদর পেয়েছিল। জীবনের শেষদিকে তিনি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাকে ডাকা হতো কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠের আসরে; কিন্তু মাত্র অল্প কিছু কবিতার বাইরে জীবনানন্দ দাশের যে ট্রাঙ্ক ভর্তি পাণ্ডুলিপি পড়ে ছিল তার খোঁজ আমরা পেয়েছি তার মৃত্যুর অনেক পর। এমনকি এখনো তার অপ্রকাশিত লেখনী প্রকাশ পাচ্ছে। ২১টি উপন্যাস তিনি লিখেছেন, শতাধিক ছোটগল্প লিখেছেন। লিখেছেন প্রবন্ধ, ব্যক্তিগত জীবনের অনুষঙ্গ নিয়ে লিখেছেন ‘লিটেরেরি নোটস’। সাড়ে আটশর মতো কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। বনলতা সেনের মতো জনপ্রিয় অনেক কবিতা পাঠকের সামনে চলে আসে। সমকালীন পৃথিবীতে দাম্পত্য জীবনের সংকট, পেশাগত সংকট, অর্থনৈতিক সংকট এবং অনুভূতিপ্রবণ কোমল কবির উচ্চারিত কবিতা পাঠক ও সামলোচক মহলকে ক্রমশ কাছে টানে। তিনি হয়ে ওঠেন আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে। ফলে মৃত্যুর পর এতসব গ্রন্থ প্রকাশ হলে নতুন জীবনানন্দকে আমরা জানতে পারি। পাঠ্যের বিচারে কবিকে যাচাই করা উচিত নয় জেনেও বলতে হয়- এপার বাংলা ও ওপার বাংলা মিলে আজও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কবি ও কথাসাহিত্যিক জীবনানন্দ দাশ স্বল্পই পাঠ্য।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //