গাজার শিল্পী বিলাল খালিদ

যুদ্ধের ব্যথা প্রকাশ করছেন ভাঙা দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি এঁকে

ফিলিস্তিনের গাজার একজন খ্যাতিমান তরুণ শিল্পী বিলাল খালিদ। এখন বয়স তার ৩৩ বছর। কয়েক দিন আগে ফের বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমে তার নাম উঠেছে। শিল্পী খালিদের অসামান্য আরবি ক্যালিগ্রাফি দক্ষতার জন্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এজেন্সি ফ্রান্স প্রেসসহ অন্যান্য অনেক মিডিয়াতে তার কৃতিত্বের খবর প্রকাশ হয়।

যুদ্ধে ভেঙে পড়া দালানের দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি এঁকে প্রকাশ করছেন ব্যথা। আসলে এটা একটা ব্যতিক্রমী ক্যালিগ্রাফিতিও বটে। তার খ্যাতি সত্ত্বেও খালিদ তার শেকড়ের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি নিজেকে প্রথম এবং সর্বাগ্রে গাজার একজন ফিলিস্তিনি শিল্পী হিসেবে দেখেন। কারণ তিনি গাজা উপত্যকার দেয়ালে তার স্মারকে বেঁচে থাকার জন্য জোর দেন।

ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে তেল আবিব যে ‌‌‌‘অপরাধ এবং গণহত্যা’ করছে তার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার আশায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি আঁকছেন তিনি। ক্যালিগ্রাফি যে অন্যায়ের প্রতিবাদ হিসেবে একটা ভাষা হতে পারে সেটা বিলাল দেখালেন। একই শিল্পকৌশল অবলম্বন করে ২০১৬ ও ২০২১ সালেও তিনি আরও দুটি নজির স্থাপন করেছিলেন। 

২০২১ সালে তিনি অবিস্ফোরিত অর্ডিনেটের ওপর ক্যালিগ্রাফি এঁকে আলোড়ন তোলেন। নান্দনিক প্রতিবাদ তখন নজর কাড়ে শান্তিবাদী মানুষের। ২০১৬-এ ফিলিস্তিনের বডি বিল্ডারদের গায়ে ক্যালিগ্রাফি এঁকে রূপক হিসেবে স্বজাতির শক্তি, সামর্থ্য প্রকাশ করেন। দৃশ্য শিল্পের এ এক সত্যিই অদ্ভুত প্রক্রিয়া।

খালিদ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, ‘আমি গাজা উপত্যকায় বেসামরিক নাগরিকদের, বিশেষ করে শিশুদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ ও গণহত্যার প্রতিবেদন করার জন্য যুদ্ধের শুরু থেকেই একজন ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি।’

তিনি গাজার ধ্বংসলীলাকে এমনভাবে বিশ্বকে দেখানো তার পদ্ধতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা মৃত্যু ও সহিংসতার চিত্রগুলো এড়াতে পারে। 

‌খালিদ ‘ড্রিমস বারিড ইন দ্য গ্রাউন্ড’ নামে নতুন কাজটিতে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে ‘স্বপ্ন’ শব্দটি আঁকেন।

দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে বসবাসকারী এ শিল্পী একটি বাড়ির দেয়াল বেছে নিয়েছেন যেখানে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ১৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তিনি এই ব্যাপারটি গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তাদের বলেন, ‘এই প্রকল্পে আমরা এমন শিশুদের কথা বলছি যারা জীবনের সবচেয়ে সহজ স্বপ্ন, যেমন একটি নিরাপদ জায়গা, পরিষ্কার কাপড় ও গরম খাবার হারিয়েছে। আমরা ১৬,০০০-এর বেশি শিশুর কথা বলছি যাদের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং যারা এই গণহত্যায় নিহত হয়েছে।’

আসলে তিনি যে ভবনে কাজ করছিলেন তার ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেক স্বপ্ন চাপা পড়ে গেছে এবং ইসরায়েলের যুদ্ধের কারণে গাজা উপত্যকায় হাজার হাজার স্থাপনা আর দাঁড়িয়ে নেই।

এ প্রক্রিয়া নিয়ে খালিদ যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সেটা এ রকম- ‘আমরা আমাদের কণ্ঠস্বর বিশ্বের কাছে শোনানোর চেষ্টা করছি, যদিও গাজায় এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে তার কিছুই পরিবর্তন হয়নি।

তবে এটি গাজার জনগণকে বাকি বিশ্বের মুক্ত মানুষের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে বাধা দেয় না।’

তিনি মনে করেন শিল্পের মাধ্যমে বিশ্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন এ জন্য যে এই দেশগুলোতে বেঁচে থাকার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মানুষ।

খালিদের আশা একদিন গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক হামলার অবসান ঘটবে ও এখানকার শিশুরা সারা বিশ্বের অন্যান্য জাতির শিশুদের মতো স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করবে।

প্রসঙ্গত ক্যালিগ্রাফি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং উন্নত শিল্প ফর্মগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের অনেক জায়গায় ক্যালিগ্রাফির চর্চা ও গুরুত্ব কমে গেছে, কিন্তু আরবি সংস্কৃতিতে ২,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্য আগের মতোই প্রাণবন্ত এবং শ্রদ্ধাশীল। সমসাময়িক সংস্কৃতির একটি মুহূর্তে যখন শব্দের সর্বব্যাপিতা তাদের মূল্য হ্রাস করে বলে মনে হয়, আরবি ক্যালিগ্রাফি লেখা ও লিখিত শব্দকে পবিত্র জিনিস হিসেবে বিবেচনা করে একটি শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয় বৈসাদৃশ্য সরবরাহ করে।

ব্যাপকভাবে কথ্য আরবি ভাষায় পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ক্যালিগ্রাফি ঐশী বাণী বোঝানোর জন্য নির্বাচিত মাধ্যম হয়ে ওঠে। মুসলিম লেখকদের জন্য, অন্য কোনো শিল্পের মাধ্যাকর্ষণ বা সৌন্দর্য আল্লাহর বার্তাগুলো বহন করার যোগ্য ছিল না। ফলস্বরূপ কোরানের পৃষ্ঠাগুলো জটিল এবং মন্ত্রমুগ্ধকর ক্যালিগ্রাফিক ডিজাইনে সজ্জিত। মূলত ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে মানব ও পশুর রূপ চিত্রিত করার ওপর ইসলামিক নিষেধাজ্ঞার কারণে, শিল্পীরা অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে ক্যালিগ্রাফির দিকে ঝুঁকেছেন। 

ইসলামি বিশ্বে আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রাধান্য কেবল আরবি ভাষার সাংস্কৃতিক তাৎপর্যকেই বোঝায় না বরং এর জন্য মুসলমানদের গর্বিতও করে। তারা যখন আল্লাহর বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজেদের ওপর দায় নেন তখন লিখিত শব্দের নান্দনিক দিকটি সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, এই উৎসর্গটি বৈচিত্র্যময় এবং পরিশীলিত ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি শৈলীর জন্ম দিয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //