লেখার ক্ষেত্রে আমাকে অভিজ্ঞতার স্মরণাপন্ন হতে হয়: খালিদ মারুফ

এ সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল লেখক খালিদ মারুফ। জন্ম ১০ আগস্ট, বাগেরহাট জেলার বেশরগাতী নামক এক সংঘাতপ্রবণ গ্রামে। পুরো কৈশোর আর যৌবনের কিয়দংশ কেটেছে নড়াইল-গোপালগঞ্জ। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগের ছাত্র হিসেবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত। খালিদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো- ‘ইসরাফিলের প্রস্থান [২০১৬]’, ‘রেইলক্রসিং [২০১৭]’, ‘বুনোকুলির রক্তবীজ [২০১৮]’, ‘সাপ ও শাপ সংক্রান্ত গল্পাবলি [২০১৯]’। লেখক খালিদের রচনার বৈশিষ্ঠ্য কৃত্রিম নয়, বাস্তব কোনো ঘটনা থেকে কিংবা অভিজ্ঞতাই তার ভরসা, বলা চলে একেবারে বাস্তবতার নিরীখে নতুনভাবে উদযাপন করা ভাষার স্পষ্টতায়-সহজাত লেখক, যা পাঠককে সহজেই ভ্রমণ করায় আখ্যানের ভেতর-বাহির। 

সুপ্রিয় পাঠক, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪-এ লেখকদের অনেকেরই গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। তারুণ্যদীপ্ত গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক খালিদ মারুফ-এর আগামী প্রকাশনী থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সুখী অ্যাসপারাগাস’ নামের গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটি নিয়ে আড্ডায় মেতেছিলেন লেখকের সঙ্গে সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক এহসান হায়দার...

আপনার নতুন বই এলো এবারের মেলায়, বইটি নিয়ে বলুন?
অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ প্রকাশিত আমার বইটির নাম সুখী অ্যাসপারাগাস। এটি একটি গল্পের বই। বইটিতে সব মিলিয়ে ১১টি গল্প রয়েছে। বইটির প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী, প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী সব্যসাচী মিস্ত্রী। দাম ৩০০ টাকা।

দীর্ঘদিনব্যাপী ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, একজন রাজনীতিবিদ, এই বোধ থেকে জানাবেন কী, নিজের নামটির প্রতি সুবিচার করার চেষ্টা কেমন করেন লেখক হিসেবে- এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
হ্যা। ছাত্রাবস্থায়, মূলত স্কুল জীবনের শেষ দিক থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পাঠের শেষ পর্যন্ত আমি প্রগতিশীল ছাত্র-আন্দোলনের একজন কর্মী এবং সংগঠক ছিলাম। তারপর চাকরি নিয়েছি একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে। রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আমার ছিল না বা ওই চেষ্টা করিনি। তবে রাজনৈতিকভাবে অন্য অনেকের মতো সচেতন থাকার চেষ্টা করি। আর নাম তো আমার একাধিক। রাজনীতির মাঠে আমি ভিন্ন একটা নামে পরিচিত ছিলাম। অবশ্য ইদানীং আমার রাজনৈতিক সতীর্থরাও ‘খালিদ মারুফ’ নামে আমাকে অ্যাড্রেস করছেন। তাছাড়া নাম একটা প্রতীক মাত্র। এটা বদলেও যেতে পারে। যেমনটা আমার ক্ষেত্রে ঘটেছে। নামের বিচার কীভাবে হয়, আমি ঠিক জানি না। তবে কেউ যখন আমার নাম ধরে ডেকে ওঠেন তখন একটা সচেতনতা কাজ করে।

গল্প বিষয়ক ভাবনা আপনার নিকট কেমন- কেবলই কাল্পনিক, না-কী বাস্তব এবং কাল্পনিক ভাবনার সংমিশ্রণে নতুন একটা ভাবনা...
আমার কল্পনা শক্তি একেবারেই কম। কিছু ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। ফলে লেখার ক্ষেত্রে আমাকে অভিজ্ঞতার স্মরণাপন্ন হতে হয়। গল্প নির্মিত হয় কোনো ঘটনা বা চরিত্রকে কেন্দ্র করে। আবার কাল্পনিক বিষয়াদি নিয়েও এটা রচিত হতে পারে। যেটাই হোক সেটা হতে হবে শিল্পসম্মত উপায়ে। চেনা ঘটনার ডিরেকশন বদলে দিয়ে পাঠককে ডিসপ্লেস করা এবং নতুনভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবনার সুযোগ করে দিতে হবে। বিশেষ কোনো ঘটনা ছাড়া এমনকি কোনো প্রধান চরিত্র ছাড়াও কেবল শিল্পাশ্রিত রচনাও গল্প হয়ে উঠতে পারে।

সমাজ রূপান্তরে গল্পকার, কথাসাহিত্যিক- এঁদের দায় কেমন, আপনি কী মনে করেন না এখনকার লেখকদের মধ্যে দায় নেওয়ার প্রবনতা কম, যেমন পাঠপ্রবনতাও কম- কেবলই খ্যাতির মোহে উদ্দেশ্যহীন দৌড়ঝাঁপ একালে; বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি?
সমাজ রূপান্তরে লেখক সাহিত্যিকের দায় আছে। আবার প্রচলিত মূল্যবোধ যা মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করে, সেগুলোর বিরুদ্ধাচারণেরও প্রয়োজন আছে। সাহিত্য কখনো-কখনো অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। ইতিহাসের সত্য মানুষ ভুলে যায়। সাহিত্যের মধ্যদিয়ে সৃষ্ট ‘সত্য’ মানুষ দীর্ঘদিন স্মরণ রাখে। আবার শিল্পের এ দায়টাও রয়েছে, তা-হলো মানুষকে বিস্মৃতির কবল থেকে রক্ষার চেষ্টা করা। 

দৌড়-ঝাঁপ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই লেখকোচিত ভূমিকার পরিবর্তে হয়ে উঠছেন একেকজন ‘এন্টারপ্রেনার’। এটা একটা পরিবর্তন। পাঠ প্রবণতা কম কি-না আমি জানি না। তবে ইন্টারনেটের সীমাহীন উপযোগ সত্ত্বেও মানুষের মিসগাইডেড হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। 

আপনার লেখক হয়ে ওঠার গল্প শোনান?
লেখক, আমি হতে চাইনি। আমি সেই অর্থে কিছুই হতে চাইনি। কেবল সময়ের দাবি মোতাবেক অ্যাক্ট করার চেষ্টা করেছি মাত্র। যদি ধরে নেন আমি একজন লেখক, তবে তাকে তৈরি করার প্রধান দায় আপনার মতো সমালোচক বা সম্পাদকদের। বইপড়ার একটা বিশ্রী অভ্যাস আমার তৈরি হয়েছিল একসময় আর বিভিন্ন আড্ডায় বসে থাকার সুযোগ ছিল বিস্তর। সেখান থেকে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভিন্ন স্কুলের সহচার্য সেখান থেকে কারো সঙ্গে একমত-প্রতিমত ইত্যাদি কারণে হয়তো একটা দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি হয়েছিল। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর আমার অবসর বেড়ে যায়। সেই সুযোগে আমি বুনোকুলির রক্তবীজ লিখতে শুরু করি। এবং বেশকিছু গল্প লিখে ফেলি। শীতার্ত পৌষ অভিমুখেও প্রায় একই সময়ের লেখা। আমার ভাগ্য ভালো যে, আমি জনপ্রিয় হয়ে উঠিনি। আপনার মতো কেউ-কেউ আমার কাছে লেখা চান। ফলে আমার আরও কিছু লেখার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। প্রকাশকরা আমার কাছে আসতে শুরু করলে ‘ফ্যাক্টরি মেড’ গল্প-উপন্যাস হয়তো আমাকেও লিখতে হতো। ধারণা করি আমি সেই দুর্ভাগ্য এড়াতে পেরেছি।       

শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমকে আপনি কীভাবে আলাদা করেন গল্প-উপন্যাস থেকে?
একটা থেকে আরেকটার প্রকরণ ও আয়োজন ভিন্ন। প্রত্যেকটাই আলাদা-আলাদা ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আবার এগুলোর মধ্যে একটা ঐক্যতানও রয়েছে। স্বার্থক গল্প-উপন্যাসের আবেদন ও প্রাসঙ্গিকতা ক্ষেত্রবিশেষে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সত্য বলার চেয়ে সত্য তৈরির ঝোঁকটা এখানে কিছুটা বেশিমাত্রায় ক্রিয়াশীল। চ্যলেঞ্জও রয়েছে এক্ষেত্রে। গল্প-উপন্যাসে সৃষ্ট সৌন্দর্যের ছাপটাও তীব্র। এমন সব গল্প-উপন্যাস আছে যা আপনি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না।

একজন প্রতিনিধিত্বশীল লেখক হিসেবে সমাজ, বাস্তবতা এবং আমাদের মানুষের জীবনাচার সম্পর্কে আপনার সার্বিক মূল্যায়ণ কী?
রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরেই মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও জীবন-যাপনের অধিকার থাকতে হবে। রাষ্ট্র এক ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ফল। একে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কেউ না কেউ আপনার সম্পত্তি ও অধিকার হরণ করবে। আপনাকে অনিরাপদ করে তুলবে। কর্তৃপক্ষের কাজ বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মিমাংসা করা। কর্তৃপক্ষ নিজেই আপনাকে শৃঙ্খলিত করে ফেললে সমস্যার সৃষ্টি হবে। বিবাদমান নানা আদর্শ সমাজে বিদ্যমান। এর সবগুলোতেই গ্রহণীয়-বর্জনীয় দিক আছে। অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতন্ত্রকে আমার কাছে লেটেস্ট অর্থে গ্রহণযোগ্য মনে হয়। ব্যক্তি মানুষের জীবনাচারে সংযম থাকাটা জরুরি। আপোষ মানেই হেরে যাওয়া নয়। জিততে হবেই- এমন মানসিকতা ক্ষতিকর। 

লেখার জন্য পড়ালেখা কিংবা জ্ঞান চর্চার যে একটা বিশেষ অভ্যাস তৈরি হয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় গভীর জীবনবোধ- একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আপনি এ বিষয়ে কী বলবেন?
গ্রোগ্রাসে পুস্তক পাঠের মধ্য দিয়ে জীবনবোধ বা দৃষ্টি তৈরি হয় কি-না সে বিষয়ে আমি নিঃসংশয় নই। এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত। জ্ঞানচর্চা একটি পদ্ধতিগত বিষয় এবং সেটা হতে হয় সঠিক ওয়েতে। 

নিজের রচনার ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারে আপনি স্বাধীন, সে কারণেই জানতে চাইছি- বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন, পাঠকের বোধগম্য হোক এটা তো চানÑ না-কী একদল লোকের মতো পূর্ববঙ্গের ভাষা আর কলকাতার ভাষার মধ্যে লড়াই দেখতে দেখতে একটি দ্বন্দ্ব বোধ করেন?
লেখা পাঠকের বোধগম্য হতে হবে। অনেক সময় সেটা না-ও হতে পারে। নতুন চিন্তা যা একজন সৃষ্টিশীল মানুষ করতে সক্ষম। সবসময় সে-রকম চিন্তা পাঠক না-ও করতে পারেন। চিন্তার অভিনবত্ব লেখকই বহন করেন বা করবেন। নতুন চিন্তা ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বোধ্যতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে। 

ভাষার একটা মান থাকা জরুরি সঙ্গে এর ডেভেলপমেন্ট এবং পরিবর্তনশীলতাকেও গ্রহণ করতে হবে। পূর্ববাংলা- এই ধারণাটি এখন আর নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার ভাষায় আমি কোনো দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। পশ্চিমবাংলা থেকে আসা বাংলাভাষার বই-পত্র পাঠ করতে আমি কখনোই অসুবিধা বোধ করিনি।

নিজের এবারের বইটি নিয়ে আপনার নিজের ভাবনা এবং বইটি তৈরির গল্প বলুন?
বইটি তৈরি হয়েছে এগারোটি গল্প নিয়ে। পাণ্ডুলিপি আকারে বইটি প্রথম পাঠ করেছেন আমার সহকর্মী কবি ফারহান ইশরাক। তিনি এর বেশকিছু জায়গা ইম্প্রোভাইসের পরামর্শ দিয়েছেন। যা-র অধিকাংশই আমি গ্রহণ করেছি। সময় নিয়ে প্রুফ সংশোধন করে দিয়েছেন আমার বন্ধু জনাব আবু ইকবাল। তারপর আমি সেটা মেইল করেছি আগামী প্রকাশনীকে। আগামী প্রকাশনী মেকাপ পরবর্তী একাধিকবার পা-ুলিপির হার্ডকপি আমাকে পাঠিয়েছে। বইটি মেলার দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেই মেলায় ছিল-আছে। কেউ-কেউ কিনেছেন। পড়ে অনুভূতি জানিয়েছেন। আমি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //