বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গতি প্রকৃতিতে বিমল বিশ্বাস আশাহত

বাংলাদেশের পিকিংপন্থীরা একসময় বলতেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা নাকি সংশোধনবাদী। সেটা ওই দুই পক্ষের তর্ক-বিতর্কের ব্যাপার কিন্তু এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ওই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্তমান ছন্নছাড়া হতাশাজনক অবস্থার জন্য অনেকাংশে পিকিংপন্থীরাই দায়ী। মনি সিংহ খোকা রায়ের মূল পার্টি থেকে বেরিয়ে আসার পর তারা ফি-বছর একটা করে নতুন দল গড়েছেন এমনকি ঐক্যবৈঠক করতে গিয়েও মূল দল ভেঙ্গে দুই-তিনটি দল তৈরি হয়ে গেছে। দেখা যায় প্রত্যেকেরই তত্ত্বের বিন্যাস ও ব্যাখ্যা আলাদা হলেও শেষ বিচারে সেগুলি দল ভাঙার মত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।

পার্টি করার দায়ে বিমল বাবু মানে বিমল বিশ্বাস বিভিন্ন সময়ে জেল খেটেছেন এবং শেষবার ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যখন বরিশাল কারাগার থেকে মুক্তি পান তার লক্ষ্য ছিল, পিকিংপন্থী এই ছোট-বড় দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। সেখান থেকেই তার স্মৃতিকথাটির দ্বিতীয় খণ্ডের শুরু। তার এই ঐক্য প্রয়াসের বিবরণ আছে অনূর্ধ্ব দুশো পাতা জুড়ে এবং বইয়ের শেষে আছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী) কে দেওয়া তার প্রত্যাহার-পত্র। এই বিয়োগান্তক সমাপ্তি থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না তার প্রায় ত্রিশ বছরের ঐক্য প্রয়াস মূলত ব্যর্থ হয়েছে।

যে হাহাকার আশা করা গিয়েছিলো বইটির শেষ পর্বে তা অবশ্য নেই মনে হল বিমল বাবু হেরে গেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের নিয়তির কাছে। জেলের অভ্যন্তরে সেপাই সান্ত্রীদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে তিনি ভয় পেতেন না কিন্তু পার্টির অভ্যন্তরে নিজ দলের ভ্রান্ত মতাদর্শের ব্যক্তিদের কাছে তিনি পরাজিত। বস্তুত, একেবারে শেষ পর্বে তার যে স্বীকারোক্তি আছে তা একজন আদর্শিক ভাবে না হলেও রাজনৈতিক ভাবে হেরে যাওয়া মানুষের। 

এই স্মৃতিকথাটিতে ১৯৭৯-২০১৮ বিরাট একসময়ের পরিসরকে স্থান দেওয়া হয়েছে। যেহেতু বিমল বাবু ছিলেন নেতৃস্থানীয় অবস্থানে তাই প্রতিটি খুঁটিনাটি বিবরণ, দুই বা ততোধিক দলের বিরোধের সূত্র এবং সেগুলিকে চাপা দিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কিছুই তার রচনা থেকে বাদ পড়েনি। সেই হিসেবে এই বই কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল যা নিশ্চিতভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাসবিদ গবেষকদের কাছে অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও এতসব ভেবে বিমলবাবু বইটি লেখেননি। যতদূর জানি, তিনি লিখেছেন তার দীর্ঘ কমিউনিস্ট জীবনের এক দায়বদ্ধতা থেকে। 

সে যাই হোক, বইটি শুরু হয় বিমল বাবু ও তার আরও কয়েকজন নিঃস্বার্থ কমরেডের ঐক্য প্রচেষ্টা দিয়ে। তারা গঠন করেন বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ। কিছুদিন পরে তারা ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হন ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগে। প্রথম থেকেই গণসংগঠনগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসী ছিলেন তারা। পরবর্তীতে এদের সঙ্গে যুক্ত হয় ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশ ও সাম্যবাদী দলের একাংশ। যারা একত্রিত হলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিতে। কিন্তু বিস্ময়কর হল, কেউ তাদের গ্রুপ স্বত্বা বিসর্জন দিয়ে ঐক্য গড়তে আসেননি। এতদসত্ত্বেও এই প্রয়াস ছিল ইতিবাচক ও সাড়া জাগানো। 

১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর যেদিন ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা হল সেই দিনটি বিমল বাবু বর্ণনা করেছেন এইভাবে আমি পার্টি অফিসে বসে আছি এমন সময় পুরনো পল্টনের মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান আক্রান্ত হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, নবাবপুর রোডেও মরণচাঁদের দোকানটি লুঠপাট করে ভেঙ্গে তছনছ করা হয়। 

নুর মোহাম্মদ ভাই ফোনে আমাকে বললেন আমার স্ত্রীসহ সকলকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিন। কমরেড টিপু বিশ্বাসের সাথে আলোচনা করলে তিনি বললেন আপনার পরিবারের সদস্যরা যদি দূরে কোথাও যেতে রাজি না হয় তাহলে অন্তত আমার বাসায় আশ্রয় নিলে ভাল হয়। শেষ পর্যন্ত তারা সাহসের সাথে নিজগৃহে থেকে যান। কিন্তু ওইদিন রাতেই চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, বরিশাল, সাতক্ষীরাসহ বহু জায়গায় আক্রান্ত হল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কয়েকদিনের মধ্যে সমগ্র জনগণের নানাধরনের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কারণে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ব্যাপকতা সেভাবে আর দেখা যায়নি। 

১৯৮৮ সালে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতার পদে অভিষিক্ত হয়ে গর্বাচেভ চালু করেন পেরেস্ত্রৈইকা ও গ্লাস্তনস্ত। বস্তুত, তা ছিল রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শেষের শুরু। ৮৯ সালের শেষের দিকে বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে দুই জার্মানি একত্রিত করার নামে পূর্ব জার্মানিকে তুলে দেওয়া হল পুঁজিবাদীদের হাতে এবং শেষ পর্যন্ত ৯১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ঘটলো রুশ সমাজতন্ত্রের পতন। 

এই সময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যে দিশাহীনতা ও অস্থিরতা তৈরি হয় তার চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন লেখক। বলাবাহুল্য, এই পতন সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছিল মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের। নেতৃত্বের একাংশ যারা এতদিন পরিচিত ছিলেন পার্টির আশা ভরসা হিসেবে তারা হঠাৎ পার্টি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তারা তৈরি করেন গণফোরাম নামে একটি দল। বিমল বাবু লিখেছেন, ৯৪ সালে মস্কোপন্থীদের ৭৭ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের মধ্যে মাত্র ১৩জন, মার্কসবাদ লেনিনবাদের আদর্শে পুরনো পার্টিকে ধরে রাখতে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন। বিমল বিশ্বাস আরও লিখেছেন গোটা বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার শুরু হলো। যদিও রাশিয়ার বিপর্যয়ে চীনপন্থীদের আলোড়িত হওয়ার কোন কারণ ছিল না তবু কমিউনিস্ট মাত্রেরই মনোজগতে যে ওই ঘটনা বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। ২০০০ সালে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন বিমল বিশ্বাস। তার আগে পরেও অব্যাহত ছিল বাম দলগুলির ঐক্য প্রয়াস। যেমন, ৯৪ সালে হয় ৮টি কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দল মিলে গড়ে ওঠে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট।

 তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেই সময় সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টি অনেক কাছাকাছি চলে আসে। ২০০১ সালের পর সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টিকে একপার্টিতে সমাবেশিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মঞ্জুরুল আহসান খান ও বিমল বিশ্বাসেরা। কিন্তু সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশের বিরোধিতার কারণে দুই পার্টি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নাই। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার সভায় গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টি ১৪দল গঠনের ব্যাপারে আলাদা অবস্থান নেয়। বিএনপি জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে একুশ শতকের শুরুতে তৈরি হয় ১৪ দলের জোট। তখন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল বিএনপি সরকারের বিদায়। বিমল বাবু সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে দাঁড়ান পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে। লেখকের মতে, ওই কংগ্রেস থেকেই ওয়ার্কার্স পার্টি নীতিভ্রষ্টতার শুরু যার প্রকাশ নৌকা প্রতীকে নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের মতো বুর্জেয়া দলের সরকারে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ। সম্ভবত তখন থেকেই ক্ষমতা লিপ্সা, দলের ওপরে ব্যক্তিকে তুলে ধরা ইত্যাদি অ-কমিউনিস্ট কাজগুলি পার্টিতে প্রাধান্য পায়। 

পরবর্তী সংস্করণে বইটির ভালো করে প্রুফ দেখা এবং ভুলভ্রান্তি সংশোধন করা হবে বলে আশাকরি।

সবশেষে বলে রাখা ভাল, এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য কিন্তু কোন স্মৃতি চর্বণ নয়, কোন উচ্চাঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টিও নয়। যা দেখেছি যা করেছি নাম দিয়ে দুই খণ্ডের এই বইতে বিমল বিশ্বাস কমিউনিস্ট পার্টিতে তার দীর্ঘ অভিযাত্রার বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে সীমাহীন আত্মত্যাগের যে ঘটনা রয়েছে সেক্ষেত্রে বিমল বিশ্বাসও পার্টির জন্যে আত্মত্যাগ তিনি কিছু কম করেননি। তার উত্থানও হয়েছিল আশাতীত। যশোরের নড়াইল মহকুমার এক নিম্নবর্ণের হিন্দু সন্তান শেষ পর্যন্ত এক মধ্যবিত্ত প্রভাবিত কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ছিলেন। বিদায়ের সময়ও তিনি তার পদ আঁকড়ে থাকতে পারতেন কিন্তু বিমল বাবু তার শারীরিক ও আর্থিক দুরবস্থার কারণে তখন ছেড়ে দিতে পারলেই বাঁচেন। অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে এসেছিলেন লেখক কিন্তু পার্টি ছেড়ে যাওয়ার সময় তার আদর্শবোধ নিয়ে লেখালেখি করা ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছু রইলো না। 


যা দেখেছি যা করেছি (দ্বিতীয় খণ্ড)

প্রকাশক প্রান্তিকা, এপ্রিল ২০২৩

মূল্য ৪৮০ টাকা


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //