সৈয়দ মুজতবা আলীর গদ্যে ভাব ও রম্যরস

‘বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না।’
‘আমার চাকরের নাম কাট্টু, কেননা সে পকেট কাটে, মাছের মাথা কাটে, আর প্রয়োজন হলে মনিবের মাথা কাটে।’ 
‘যে ডাক্তার যত বড় তার হাতের লেখা তত খারাপ।’ 

এই কথাগুলোর মালিক আর কেউ নন, তিনি আমাদের রম্যসাহিত্যের দিকপাল সৈয়দ মুজতবা আলী। তার লেখার বাচনিক তৎপরতা পাঠককে এক আলাদা ভাবের জগতে নিয়ে যায়। তিনি তার লেখায় শুধু হাসান না, মানুষকে ভাবান। গদ্যের সত্যিই তিনি এক দারুণ ওঝা। কীভাবে খেলতে হয় গদ্য নিয়ে, তা তিনি দেখিয়েছেন তুমুল মুন্সিয়ানায়। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে বিপুল জ্ঞানরাশির কারণে। তিনি তার গদ্যে যে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন তা অনায়াসে সাধ্য নয়। শিল্প বা সাহিত্যের ইতিহাস মূলত তার আঙ্গিকগত নিরীক্ষারই ইতিহাস। এ সত্য কথা যথার্থ আলাদাভাবে প্রতিপন্ন করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। এ কারণে সমালোচকরা বলতে বাধ্য হয়েছেন, বাংলা গদ্যের প্যাটার্ন তছনছ করে দিয়েছেন তিনি। সত্যি বলতে কী বাংলা ভাষার সব প্রচলিত বাক্য বিন্যাসকে তছনছ করে, যে অনবদ্য সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি করেছেন মুজতবা আলী, তার তুলনা আজও অমিল! আরবি, ফারসি, সংস্কৃতির ফোড়ন দেওয়া এমন উমদা বাংলা আর কেউ লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই। তার ভাষা সাহিত্য নিয়ে যে গভীর আলোচনা প্রয়োজন ছিল, সেটা হয়নি।

তার গল্পের পাঠক সমঝে নেবেন, বিশেষত ‘রসগোল্লা’ পড়ার তৌফিকওয়ালারা, অন্য যাদের রম্য লেখার কথা মনে হয়, শুরুতেই তাদের মনে পড়বে সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা। বিশেষ করে এই বাংলায়। যদিও বঙ্কিমচন্দ্র বা প্রমথ চৌধুরী তত দিনে বাংলা সাহিত্যে রম্য রচনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু ‘রম্য সাহিত্য’ নতুন বৈশিষ্ট্য পেয়েছে মুজতবা আলীর হাতে। রম্য লেখক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ মুজতবা আলী। যদিও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও তার প্রভাব বেশ বলিষ্ঠ। তিনি একাধারে একজন লেখক, শিক্ষক, ভাষাবিদ, সংগঠক- সর্বোপরি একজন সফল মানুষ। যারা রম্যরচনা লেখেন, তাদের একটা গুণ থাকা দরকার। নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করার ক্ষমতা! যেটি অনেকেরই থাকে না। মুজতবা আলীর সেই গুণটি ছিল। কেননা ৭টা ভাষা ছেঁচে নানা তাকলিফের বিনিময়ে তিনি যে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, তা হাসিচ্ছলে পাঠকদের অনায়াসে উপহার দিয়ে বহুত ফায়দা হাসিল করিয়েছেন। তাকে একবার এক জার্মান পণ্ডিত জিজ্ঞেস করেছিলেন, শেক্সপীয়রের কোন লেখাটা আপনার ভালো লাগে? ঝটিকা উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যামলেট! তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ঐ একটা বই-ই পড়েছি কিনা!

ঢাকার কুট্টি সমাজকে সাহিত্যে এনেছিলেন- আমাদের এই আলীই। কুট্টিদের রসিকতা প্রায় কিংবদন্তিতুল্য। আর সেটা মুজতবা আলী এমন উচ্চাঙ্গে নিয়ে গেছেন যে, কহতব্য নয়! হাজির জবাব বা Repartee এদের সহজাত ক্ষমতার মধ্যেই পড়ত। ‘ঘোড়ায় হাসব’, ‘আহা পড়সেন দেহি, ব্যথাও পাইসেন, কিন্তু লামসেন খুব তাড়াতাড়ী’, ‘ছাত দিয়া পানি পড়ব নাকি শরবত পড়ব?’

এই জাতীয় হাজির জবাব, মুজতবা সাহেব না থাকলে জানারই জো ছিল না, কী অফুরন্ত রসিকতা বুদবুদিয়ে উঠিয়ে দেয় মনের মন্দিরে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলীর (৩য় খণ্ড) ভূমিকাতে লিখেছেন,

 “আমাদের ছেলেবেলা থেকেই এ রকম ধারণা ছিল যে, গুরু-চণ্ডালী মেশামেশি হলে সেটা একটা খুব দোষের ব্যাপার। ভাষাকে শুদ্ধ রাখার জন্য বঙ্কিমের আমল থেকেই এ রকম একটা শমন জারি হয়েছিল। আসলে কোনটা যে গুরু ভাষা আর কোনটা যে চণ্ডালী ভাষা সে সম্পর্কে স্পষ্ট আলাদা কোনো সীমারেখা কেউ টানতে পারেনি এ পর্যন্ত। এককালে সাধু ক্রিয়াপদ এবং চলতি ক্রিয়াপদের একটা ব্যবধান ছিল। এখন সাধু ক্রিয়াপদ প্রায় লুপ্তই বলা যায়- অন্তত সাহিত্যে। আবার রবীন্দ্রনাথ যখন তার অত্যন্ত পরিশীলিত নায়ক নায়িকার মুখে- করিনে, পারিনে, যাইনে, কিংবা বললেম, করলেম, গেলেম... এই রকম ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন, তখন আমরা খেয়াল করিনি, ওগুলো আসলে বীরভূমের গ্রাম্যভাষা থেকে নেওয়া। এখন আমরা জেনেছি, ভাষা বহতা নদীর মতো। যদি তার স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তা হলে যেখান থেকে যাই-ই সংগ্রহ করুক, কিছুতেই তার অঙ্গে মলিনতার স্পর্শ লাগে না।

এই ব্যাপারটি আমাদের সবচেয়ে স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। এই দিক থেকে তিনি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর সার্থক উত্তরাধিকারী। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষাশিল্প সম্পর্কে গভীর আলোচনা হওয়া উচিত। আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিদের ওপর সে ভার রইল।”

এক সময় ঠাট্টা করে বলা হতো, যে লেখা পড়লে কিছুই মানে বোঝা যায় না, তারই নাম আধুনিক কবিতা। সেই রকমই এক সময় এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, যখন, যে লেখা পড়তেই ইচ্ছে করে না, তারই নাম ছিল প্রবন্ধ। সৈয়দ মুজতবা আলীই প্রবন্ধকে সেই অকাল মৃত্যুদশা থেকে বাঁচিয়েছেন। তিনি অন্তত একশটি বিষয়বস্তু সম্পর্কে, অন্তত সাতটি ভাষা সেঁচে যে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, তা-ই বিতরণ করেছেন তার রচনায়। এগুলো প্রবন্ধ ছাড়া আর কী? তার অনেক বক্তব্য সম্পর্কে মতান্তর আছে, তাতে কী আসে যায়? কোন প্রাবন্ধিক অমোঘ বাক্য উচ্চারণ করতে পারেন? তার রচনার পর থেকেই তথাকথিত প্রাবন্ধিকদের দুর্বোধ্য, কষ্টকল্পিত বাক্যের রচনা পাঠকরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। যথার্থ পণ্ডিতেরাও এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন, শুধু নিজের বিষয়ের ওপর দখল থাকাই বড় কথা নয়, সাবলীল ভাষায় তা প্রকাশ করতে না জানলে লেখক হওয়া যায় না।

বিচারপতির মতন একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকবেন লেখক, আর সেখান থেকে পাঠকদের উদ্দেশে জ্ঞান বা উপদেশ দান করবেন, সাহিত্যের এই ভূমিকা আর নেই। সারা পৃথিবীতেই পাঠকরা আর সাহিত্যিককে গুরু হিসেবে দেখতে চায় না, বন্ধু হিসেবে চায়। লেখার সময় আমরা ভুলে যাই, আমরা যা জানি, তা প্রতিদিনের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আর সেই সত্যটাকে মানতে পারি না বলে, অনর্থক একটা ঝগড়া তৈরি হয় নিজের মধ্যে।

সৈয়দ মুজতবা আলী এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘তিনি চাকরি পেলে লেখেন না! চাকরি না থাকলে লেখেন।’ এই চাকরি তিনি বারবার কেন খুইয়েছেন, এই নিয়ে একটা গল্পের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। দরখাস্ত নামে একটা রচনায় তিনি লিখছেন, 

‘একবার ফ্রান্সে ঢোকবার ফর্মে লেখা ছিল- তোমার জীবিকা নির্বাহের উপায় কী? উত্তরে লিখেছিলুম- কিছুদিন অন্তর অন্তর চাকরি রিজাইন দেওয়া!

তা হলে চলে কী করে? তুমি রেজিগনেশনগুলো দেখছ সাহেব, আমি চাকরিগুলো দেখছি!’

এটা তিনি লিখেছিলেন! আর এটা সত্যি ঘটনা!

একবার আলী লিখলেন, “পেটের দায়ে লিখছি মশাই, পেটের দায়ে! ... খ্যাতিতে আমার লোভ নেই। যেটুকু হয়েছে, সেইটেই প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নাহক লোকে চিঠি লিখে জানতে চায়, আমি বিয়ে করেছি কিনা, করে থাকলে সেটা প্রেমে পড়ে না কোল্ড ব্লাডেড, যে রকম কোল্ড ব্লাডেড খুন হয়- অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন ঠিক করে দিয়েছিলেন কিনা?- শবনমের সঙ্গে আবার দেখা হলো কিনা, “চাচা”টি কে, আমি আমার বৌকে ডরাই কিনা- ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কেউ কেউ আসেন আমাকে দেখতে। এখানকার বাঘ সিঙ্গি নন্দলাল, সুধীরঞ্জনকে দেখার পর আমার মতো খাটাশটাকেও এক নজর দেখে নিতে চান! কারণ কোলকাতার ফেরার ট্রেন সেই বিকেল পাঁচটায়; ইতোমধ্যে আর কি করা যায় এবং এসে রীতিমত হতাশ হন...!”

এই মনীষী ১৯০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তখনকার সিলেট জেলার অন্তর্গত (বর্তমানে ভারতের আসামে) করীমগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট সফরে এলে সৈয়দ মুজতবা আলী কবির বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন এবং তার ভক্ত হয়ে যান। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়ালেখায় আগ্রহী ছিলেন এবং এ জন্য তিনি ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন। শান্তিনিকেতনে পাঁচ বছর অধ্যয়নের পর ১৯২৬ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরই তিনি বাংলায় লেটারসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। আলীগড়ে আইএ অধ্যয়নকালে তিনি আফগানিস্তানের শিক্ষা বিভাগে চাকরি নিয়ে কাবুল গমন করেন। ১৯২৯ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জার্মানিতে গমন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৪-৪৫ সালে সৈয়দ মুজতবা আলী আনন্দবাজার পত্রিকায় কিছু দিন সাংবাদিকতা করেন এবং দেশ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। ১৯৪৮ সালে সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের আলোচনা সভায় পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি উর্দু ভাষার পক্ষের শক্তির হাতে নাজেহাল হয়েছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ভারতে চলে যান এবং কিছু দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

এরপর উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স’-এর সচিব পদে নিযুক্ত হন। অতঃপর তিনি ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-এর স্টেশন ডাইরেক্টর পদে কিছু দিন চাকরি করেন এবং সেই চাকরিতেও ইস্তফা দেন ১৯৫৬ সালে। এরপর তিনি বিশ্বভারতীতে কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকার পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। সৈয়দ মুজতবা আলী পরিণত বয়সে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাগদেবীর বরমাল্য জয় করে নেন অর্থাৎ ‘দেশে বিদেশে’ প্রকাশনার মধ্য দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে তার অক্ষ প্রতিষ্ঠা। মুজতবা আলীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত পেয়েছিলেন এবং সম্ভবত তার একাধিক অপ্রকাশিত কিংবা হস্তলিখিত পত্রিকায় প্রকাশিত রচনার প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ মুজতবাকে সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানের বিশ্বভারতী নামের হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন।

পরবর্তীকালে তিনি ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখতেন। যেমন : দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী প্রভৃতিতে। তার বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণকাহিনি। এ ছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহার, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //