অনুবাদ ভীতি, অনুবাদ প্রীতি

আমি আমাকে অনুবাদ করি। ছড়িয়ে দেই ধুলাশূন্যতায়। বাতাসে বাতাসে পাক খেয়ে ওঠে ভাষা, আকাশ ছাড়িয়ে দিগন্ত পেরিয়ে সে বাণী পৌঁছে যায় বহমান সময়ের ভেতর। সময়কে আমি ঠিক কতটুকু ধারণ করতে পারি? কতটুকু বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে আমার চিন্তার সামর্থ্য, সেসব বিবেচনা করে আবার ধুলাশূন্যতা থেকে, বিশ্বময় স্বপ্নবিলাস ছেড়ে আবার সচেতনে আসলে আহত আমাকে পাই অহম ও অনিবার্য পতনের মুখে। দেখি, ভাষা নয়, ভাব নয়, শুধু ধুলা, শুধু শূন্যতাই ওড়ে আমার চারপাশে। দিগন্তের বিস্তৃতি ছেড়ে, আমি তখন আমাকে খুঁজতে থাকি আপন বৃত্তে। খুঁজে পাই না, খুঁজে পাই না। হারিয়ে যাওয়া অনুবাদের ভেতর কেমন যেন মুছে থাকে আমার স্পর্ধা।

আমি আমাকে হারিয়ে দিতে থাকি যতক্ষণ না মানচিত্র নিঃশেষিত হয়। বুকের দুয়ার খোলে অবারিত হৃদয়জ প্রান্তরে- যেখানে কোনো সীমানা থাকে না ভাষার, কিংবা ভাবের, সেখানে নিমজ্জন হতে দেই। সেই গহন অন্ধকারে ডুব দিয়ে আমি আমার তরজমাগুলোকে নিজের ভুল হিসেবে চিহ্নিত করি এবং লজ্জার পরে লজ্জা, হীনমন্যতা আর অনুতাপ আমার অহংকে তখন ডুবিয়ে মারে। তবু তো সহজাত প্রবৃত্তি, মনে হয় বিশ্ব জয় করে ফেলি, এই বুঝি ফেললাম, কিন্তু তবু দেখতে পাই বিশ্ব তো দূর অস্ত, নিজের মধ্যেই নিজেকে জয় করার ষোলো আনার মধ্যে দুই আনাও পেরেছি কিনা সন্দেহ। তখন পূর্বজ পদক্ষেপগুলো নিতান্ত হাস্যকর মনে হয়। মনে হয়, এত এক খেল্লো জীবন কামনা করলাম জীবনে? হয়তো তা নয়, এই ক্ষুদ্রতা, নির্লজ্জ জাতে ওঠার চেষ্টা, মূলত আমার লেখকজাত সত্তাটাকেই মেরে ফেলছে তিলে তিলে।

একবার আমি নোবেল কমিটির সুইডিস একাডেমিতে সরাসরি মেইল করে বসলাম। তাদেরে কিছু (কমপক্ষে ২০০) কবিতা পাঠিয়ে বললাম এই হচ্ছে আমার কবিতা। আর আমি আরিফুল হাসান, থাকি বাংলাদেশে, নোবেল পুরস্কার পেতে চাই সাহিত্যে। তারা আমার বালখিল্যতাকে মোটেও পরিহাস না করে আমার ইচ্ছার জন্য সাধুবাদ জানালেন। তার সাথে এও বললেন, আপনার কবিতা আপনাকে পাঠাতে হবে না। আপনার পাঠক, ও আপনার দেশই তুলে ধরবে আপনাকে সময় হলে আমাদের কাছে। কিছুটা লজ্জিত হলেও তখন আমার একটি শিক্ষা হয়েছে। আবার আমি কমনওয়েলথে যখন গল্প পাঠাই, ভাষা যেহেতু মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতে লিখে মজা পাই না, তাই বাংলাতেই পাঠাই। তারা আমার গল্পগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে, মনোনীত না হলেও প্রেরিত গল্পটা সম্পর্কে এমন ক্রিটিক পাঠায় যেন তারা আমার গল্পের আমার চেয়ে ভালো পাঠক। এ ব্যাপারটি আমার কাছে বিস্ময় লাগে!

আজকাল একটি রব উঠেছে- অনুবাদ চাই, অনুবাদ চাই। অনুবাদ করলেই যেন নোবেল পুরস্কারটি বাংলাদেশের স্থাণুর মতো কপালে এসে ধপাস করে পড়বে। এ ব্যাপারে লেখক এবং অনুবাদকের বিশ্রী রকম দৌঁড়ঝাপ ইতিমধ্যেই লক্ষ করে প্রকৃত সাহিত্য সাধকগণ লজ্জা পেয়ে হাসে। তারা আবার মাটির দিকে চায়। মাটির অভ্যন্তরে যেই অনন্তের ভাষা সেখান থেকে অনুবাদ করার চেষ্টা করে নিজের অন্তঃসারশূন্যতার। সেই শূন্যতার চেরাগে পুড়ে প্রেমের পতঙ্গের মতো সাহিত্য-সাধকগণ লিখে রাখেন মোহহীন, লোভহীন কোনো ব্রত নিয়ে। হয়তো তাদের পাঠকের সংখ্যা কমে আসে। সাহিত্যের বাজারিকরণের ধূর্ততায় তারা হয়তো পিছিয়ে পড়ে অনেক, কিন্তু তাদের সাহিত্যের যে সাধনা, তা আরও নিবিড় হয়ে ধরা দেয়।

যেহেতু গ্লোবালাইজেশনে দেশ-কাল-পাত্রের দূরত্ব আজকাল কমে এসেছে, তবু আন্তর্জাতিকতাবাদের চোরাগলিতে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছেন মৌলিক স্বপ্নবুনন থেকে। যে পাখিটি বাবুই পাখির বাসা বানানো একবার দেখেছে, তার কাছে তার যত মনোহর বাসাই হোক তাকে তার আস্তাকুঁড়ই মনে হবে এবং যে নৈপুণ্য বাবুইয়ের ঠোঁটে, সে নৈপুণ্যের গানও হয়তো ফোটে না তখন সে পাখিটির কণ্ঠে। ফলে একাধারে আত্মসৃষ্টিতে অসুখী হওয়া, আর পরসৌন্দর্যে মোহিত হওয়া যে একজন লেখকের ঠিক কাজটিতেই বাধা প্রদান করছে তা আমরা অনেকে জেনেও জানি না। জানতে চাই না। যেন মহাকালের কুলুপ এঁটে মুখে চুপ করে থাকি আর নিজে যখন কিছু শুনতে চাই পরিবর্তনের বাণী- তখন বলতে থাকি- আমরা অন্ধ, বধির ও বোধশক্তিহীন।

বিগত বছর কয়েক আগে চীনের উহান থেকে যে ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়েছিল সারা পৃথিবীতে সেও কিন্তু মূলত নিজেকে অনুবাদ করিয়ে চলেছে নানা কোষের অন্তরে অভ্যন্তরে। ফলে সে খুব সহজেই কাবু করে ফেলে পৃথিবীজোড়া মানুষকে এবং মানুষের তখন ঘরের বাইরে যাবার মতো কোনো কাজ থাকে না। সেই বন্দিত্বের দিনে আমরা আরও বেশি করে যুক্ত হয়ে পড়ি সীমানা ছাড়িয়ে (যদিও প্রকৃত কবিরা দেশ-সীমান্ত এসবের ঊর্ধ্বে)। তখন আমাদের সাথে আলাপ পরিচয় বাড়তে থাকে বহির্বিশ্বের কবি স্বজনদের। কিন্তু অচিরেই আমি দেখতে পাই যে, এই যে লিয়াজোঁ মেনটেন করে একধরনের সাহিত্য কর্ম (চাই তা দেশের অভ্যন্তরে হোক বা অন্য কোনো দেশের বা একাধিক দেশের সাথে যৌথ প্ল্যাটফর্মে) করার চেষ্টা করছে আমাদের বাংলাভাষার সাহিত্যিকরা অথবা কবিরা- তা আসলে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে। আমার ভাবনার উত্তর মেলে না। না, দেখছি তো, যাদেরকে মেধাবী বলে, বিজ্ঞ কবি বলে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের নবীন কবিরা, (বিশেষত নবীন কবিরাই। কয়েকজন অবশ্য বুড়োদের মধ্যেও আছেন) তারা সময় হারিয়ে এখন যেকোনো একটি খড়কুটো আশ্রয় করে বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে অথবা নবীনরা চাইছে তাদের পরিচিত মহলে তাক লাগিয়ে দিতে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমাদেরকে বুঝতে হবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রাপ্তি আর দেয়ার অংশটা কতটুকু? লেখক তার লেখাটি সর্বাঙ্গ সার্থক করে, যদি একটি মহৎ সাহিত্য করে পাঠককে দিতে পারেন তাহলে এরচেয়ে আর বেশি আনন্দ লেখক আর   কোথাও পান না। তার তখন কোনো স্বার্থচিন্তা থাকে না এ লেখার বিপরীতে। সত্যি বলতে কী, লেখার একটি নিজেরই সন্তুষ্টির জায়গা আছে। তা সবার আগে টের পান লেখক নিজে। আর তখন যদি তিনি সচেতন হোন- তবে সীমানা তো দূরের কথা, আপনাকে অতিক্রম করতেই তাঁর পায়ের ঘাম মাথায় উঠে আসার কথা।

অনুবাদ মানুষের সংযোগকে অবারিত করে। পাখিডানায় ভর করে দেখে আসা যায় এক বিশ্ব থেকে আরেক বিশ্ব। তবে বুঝতে হবে, কোন চোখে দেখবে পরিযায়ী? সে কি ঈগলের চোখ, নাকি ডানা ভাঙা গাংচিল। তখন ফাগুন বসন্তে, বৃষ্টি ও বর্ষায় ভিজে থাকা যায় বিশ্ববানের পললে। আর আপন অভ্যন্তর থেকে তুলে আনা যায় পঙ্কজ। লেখক নিজে আগে জানতে হবে সে অনূদিত হবার যোগ্য কিনা এবং এ ব্যাপারে সৎ থাকতে হবে। আপন চোখে যদি আপনকে না চেনা যায় তাহলে বিশ্বকে চিনবেন কীভাবে? অনুবাদকের ভূমিকায়ও অনুবাদ না জানলে, কী অনুবাদ করছে সেটি না জানলে, কাজের উদ্দেশ এবং যোগ্যতা সম্পর্কে সচেতন এবং সৎ না থাকলে- নিছক যোগাযোগ কিংবা বিস্তৃতির প্রয়াস প্রকৃতপক্ষে কুম্ভকর্ণতাই, অথবা কুয়োর ব্যাং তার আকাশ যতই দেখুক বৃষ্টিতে, সেখানে বর্ষা আসে না। জানতে হবে কাকে অনুবাদ করছেন, ভালোবেসে করছেন কি? সে ভালোবাসার পেছনে কোনো ভালো নিয়ত আছে কি? যদি না থাকে, বিশ্ব জঞ্জালের কিছু বিশুদ্ধ জঞ্জালই শুধু আপনি খরিদ করলেন, অথবা নিজেকে ছড়ালেন উলুবনে। এ জন্য লেখক তার কবিতাকে, সাহিত্যকে কাকে দিয়ে অনুবাদ করাতে তৃপ্তিবোধ করবেন, তার কলমের যোগ্যতা, তার দার্শনিক নিষ্ঠা কতটুকু সেটিও অনুধাবনের চোখে দেখবেন। না হলে বিশ্বভ্রান্তির ভেতর পড়ে যেতে আপনার সময় লাগবে না। পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা যার নেই, যে শুধু আপন সৌন্দর্য (সাহিত্য কিংবা অসাহিত্য) ছড়িয়ে যেতে উজ্জ্বল ফুলের মতো খোঁপায় ফুটে থাকে, তাকে আপনি কবি বলবেন, তার কেশে দ্বিতীয় ফুলের সৌন্দর্য ছড়াবেন, তবে আপনার সাহিত্য রুচি এবং কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন রাখা যায়। তার চেয়ে ভালো নিজের ভাষাতেই মৌলিক কাজটি করে যান আরও মনোযোগের (যেহেতু বিশ্বযোগের জন্যও মনোযোগ দিতে হচ্ছে, যাকে বলে লবিং। সে কাজটি এড়িয়ে যান) সাথে; বিশ্বযোগ আপনিই ধরা দেবে। কেননা, যা মানুষের জন্য মৌলিক, তা সকল পৃথিবীতে এক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //