কাজী নজরুল অনিবার্য এক মহৎ কবি

কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো সৃষ্টিসুখের উল্লাসে নিজেকে এক অনন্য স্থানে স্থাপন করেছিলেন। যুগ-যুগান্তরে তিনি স্মর্তব্য। তার শিল্পকুশলতা অসংশয়িত। অনেক অন্ধকারে আলোকদ্যুতি তিনি। ঘোরাচ্ছন্ন সময়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন একটা উঁচুস্থানে। তাকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যাবে না। বর্তমান সময়ে অনেকে নজরুলের গুরুত্বকে ক্ষুদ্র করে দেখার প্রয়াস পান। কিন্তু বাস্তবে নজরুল অনেক বড় কিছু। 

পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি আজীজুল হক বলেন, “নজরুল ইসলাম- এই শব্দ কটিকে উচ্চারণ করতে আমাদের কণ্ঠযন্ত্র যতখানি গর্জনমুখর হয়ে ওঠে, তার বিদ্রোহ-বিপ্লব ব্যঞ্জনাময় কবিতা, গান ও রচনাসমূহকে গুরুত্ব দেবার ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক চেতনা- বোধ ও শিল্পবোধ পরিমাণে তার চেয়ে অনেক বেশি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এই গর্জনমুখরতা এবং বর্ষণমুখরতা, এই উষ্ণতা এবং শীতলতার চতুর সহ-অবস্থানকে আমরা বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে সহজ করে তুলতে ক্রমাগত সক্ষম হচ্ছি। অথচ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের সামাজিক চেতনার প্রগাঢ় বিদ্রোহ-বিপ্লববাদী কবিতা-নিবন্ধ সঙ্গীতগুলোই মাত্র তার ওই কবি-নামের মহিমাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। তার প্রতিভার বহু প্রবণতা থাকলেও, এবং সেকালে ও একালে তাকে ভিন্ন-ভিন্নভাবে দোহন ও ব্যবহার করা হলেও, বাংলাসাহিত্যের ভুবনে নজরুল ইসলামের মুখ্য পরিচয়- তিনি বিপ্লব-বন্দনার কবি। শত শতাব্দীর কবি-সভায় এই পরিচয়েই তার বিশিষ্ট আসন।” (অস্তিত্বচেতনা ও আমাদের কবিতা, পৃ. ৮১।)

কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বহুদিন অবধি একই স্বভাবের শব্দকে ব্যবহার করে তার মধ্যে একটি গতানুগতিকতা এনেছিলেন। সেটাকে অতিক্রম করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এটা কীভাবে সম্ভব করেছিলেন তার বিবরণ দিচ্ছেন সৈয়দ আলী আহসান, “...রবীন্দ্রনাথ বহুদিন পর্যন্ত একই স্বভাবের শব্দকে ব্যবহার করে তার মধ্যে একটি গতানুগতিকতা এনেছিলেন, যার ফলে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কোনো কবির পক্ষে নতুন কোনো আবেগ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-প্রবর্তিত শব্দ ব্যবহারবিধি অবলম্বন করা সম্ভবপর ছিল না। অন্ততপক্ষে বলিষ্ঠভাবে না হলেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং মোহিতলাল মজুমদার রবীন্দ্রনাথের শব্দ ব্যবহার বিধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ। সত্যেন্দ্রনাথ আবেগকে প্রধানত ধ্বনিনির্ভর করে এবং বক্তব্যকে দৃশ্যমান বস্তু-নির্ভর করে। বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্রনাথের চিত্তগত তন্ময়তা থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্ত করেছিলেন। মোহিতলাল মজুমদার মানবদেহকে সকল অনুভূতির লালনক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এটাও রবীন্দ্রনাথের ইন্দ্রিয়াতীত সূক্ষ্ম অনুভূতি-বিলাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। নজরুল ইসলামের প্রতিবাদ আরো ব্যাপক এবং প্রবল।”(আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে, পৃ. ৮-৯।)

নজরুল ইসলাম আসলে অসম্ভব কথার কলগুঞ্জনে, একটি অবধারিত উচ্ছ্বাসের প্রতিষ্ঠায় তিনি বাংলা কবিতার জন্য একটি অনির্বচনীয় রূপলোক নির্মাণ করেছেন। সমকালীন বিশ্বসাহিত্যকে নজরুল দুভাগে ভাগ করেছেন। একদিকে রয়েছে স্বপ্নচারিতা আর তা ‘কেবলি উর্ধ্বে- আরো ঊর্ধ্বে উঠে স্বপনলোকের গান শোনায়।’ এ দলে রয়েছেন নোগুচি, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি “dreamers”। অন্যদিকে রয়েছে রূঢ় বাস্তবতা যা মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং যা “এই মাটির পৃথিবীকে অপার মমতায় আঁকড়ে ধরে থাকে, ধূলি-মলিন পৃথিবীর এই কর্দমাক্ত শিশু যে সুন্দরকে অস্বীকার করে, স্বর্গকে চায় না তা নয়। তবে সে এই দুঃখের ধূলির ধরাতে নামিয়ে আনবো।” আর এ শেষোক্ত দলে রয়েছেন গোর্কি, যোহান বোয়ার, বার্নাডশ, বেনাভান্তে প্রভৃতি। নজরুলও এ দলেই নাম লিখিয়েছিলেন। তাঁর রচনায় তিনি কোনদিনই এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। 

আমাদের জাতির মধ্যে যে একটি রোগ বিদ্যমান সেটা পরিষ্কার করে মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ বলেন, “‍নজরুল রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে জন্মের একজন মহৎ কবি এ সহজ সত্যটা আমরা এখনো গ্রহণ করতে পারিনি। সম্ভবত তাকে বিদ্রোহী কবি বলে সে সত্যটাকে এড়াতে চাই কে বড়, কে ছোট যে প্রশ্নটা একেবারেই অবান্তর। কবিদের মধ্যে ছোটবড় নেই। কোনো কোনো কবি আপন প্রতিভায় একটি ভাষার প্রচলিত কাঠামোকে ভেঙে, নতুন রূপকল্প সৃষ্টি করে নতুন সংগীতময়তার জন্ম দেন। কিন্তু তিনি সেটা করার আগে নিজে পূর্বসূরি অন্য একাধিক বড় প্রতিভার সবটুকু নিঙড়ে নেন, আত্মস্থ করেন- অক্ষম কবিরা যখন এটা করেন তখন তা হয় অনুকরণ, আর প্রকৃত কবি যখন এটা করেন তখন তা হয় প্রভাব; Andre Gide তার ‘সাহিত্যে প্রভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে একথাই বলেছেন। তার মহত্ত্ব বা greatness-এর পেছনেই পূর্বসূরিদের সম্পদ লোপাট করার একটা ইতিহাস থাকে। রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। নজরুল, শেলি, কীটস, হুইটম্যান, গোর্কি প্রমুখ বিদেশির সম্পদ তো লোপাট করেছেনই, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে তিনি ছোবড়াসুদ্ধ চিবিয়ে খেয়েছেন।... সমকালে নজরুলের মতো এমন একনিষ্ঠ রবীন্দ্রানুরাগী পাঠক আর কেউ ছিল না।” (ধর্মের নান্দনিকতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, পৃ. ১১২)

ড. হারুন শ্রী নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় এ দাবিরই সমর্থন উদ্ধৃত করেছেন। যেখানে নৃপেন বলেন, “‍নজরুল জন্মেছিল রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী নিশ্চিদ্র প্রতিভার পূর্ণ প্রভাবের সময়ে। সে আকণ্ঠ পান করেছিল রবীন্দ্রনাথের কাব্যসুধা। ... কিন্তু যুগে প্রতিভার অনন্য সাধারণ স্বাতন্ত্র্য হলো, যখন সে কবিতা লিখলো, যখন সে গান রচনা করলো, সুর সৃষ্টি করলো, তখন তার কবিতার একটা অক্ষরের মধ্যে... তার প্রকাশের ক্ষীণতম ভঙ্গির মধ্যে, এমনকি তার ভাষারীতির মধ্যে কোথাও দেখা গেল না রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। বাংলার কাব্য সাহিত্যে, বাংলার সঙ্গীতে, বাংলার সূব সৃজন-লোকে নজরুলের নেই কোনো পিতৃ-পুরুষ, নেই কোনো উত্তরাধিকারী। সে দাঁড়িয়ে আছে স্বতন্ত্র, একক, একটা সম্পূর্ণ নতুন ব্যক্তিত্ব ও শক্তি।” (প্রাগুক্ত)

প্রকৃতপক্ষে নজরুল ইসলাম সুন্দরের সাধনার মাধ্যমে কাব্যলক্ষ্মীর সন্ধান পেয়েছিলেন। আর তাই তিনি দেশ-কালের সকল সীমানাকে এমন নির্দ্বিধায় অস্বীকার করতে পেরেছিলেন। যে কারণে নজরুল স্বগতোক্তি করেন, “আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।”(অভিনন্দনের জবাবে : কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল কথা, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত, পৃ.৭৯।)

আসলে কবি নজরুল অনিবার্য এক কবি। যাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার ফুরসত নেই। ‘কোন নামে হায় ডাকব তোমায়, নাম না জানা অনামিকা’র মতো কবিকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি, বিদ্রোহী কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি- যে নামেই তাকে ডাকি না কেন, সেটা আমাদের আপন সংকীর্ণতা, সীমবদ্ধতা ও অক্ষমতার প্রকাশ। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি নিজেই দিয়েছেন। তিনি কবি, তবে আমরা বলি তিনি আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল একজন মহৎ কবি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //