মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রাবন্ধিক ও কবি

কালজয়ী কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯ মে ১৯০৮। জন্মস্থান বর্তমান ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকায়। পৈতৃক বাস ছিল বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। মৃত্যু কলকাতায় ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। কলেজে পড়বার সময় বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন মানিক। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে জিতেছেন। বাজি ধরা হয়েছিল গল্প ছাপা নিয়ে। সফল হওয়ার পরে চলেছে দিনরাত সাহিত্যচর্চা। 

অবিশ্রাম সাধনায় মণ্ডিত সেই সৃষ্টিশীলতার পর্ব। পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই তার। পরপর দুবার বিএসসিতে অকৃতকার্য হলেন। সে সময়ে তার পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করতেন বড় ভাই। ছোট ভাই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। দিনরাত মত্ত হয়ে আছে সাহিত্যচর্চা নিয়ে। এ খবর কানে গেছে তার। তিতিবিরক্ত হয়ে ছোট ভাইকে লিখলেন, ‘তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে। গল্প লিখতে আর রাজনীতি করতে নয়! ফেল করেছ কেন?’

দৃঢ়চেতা মানিক উত্তরে লিখলেন, ‘গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ বাহুল্য বলা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এই কথা মোটেও পছন্দ করেননি। প্রত্যুত্তরে লিখলেন, ‘তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি টাকা দিতে পারব না। নিজেরটা নিজেই দেখো!’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও হার মানবার পাত্র নন। বড় ভাইকে প্রত্যয়দৃপ্ত উত্তর দিলেন। চিঠিতে লিখলেন, ‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’

তেজস্বী এই লেখকের বয়স তখন মাত্র ১৭, এরই মধ্যে মাতৃবিয়োগ ঘটেছে। বড় ভাই কথামতো টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। মানিক পড়লেন বিপদে। ছাড়তে হলো কলেজের হোস্টেল। কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি মেসে গিয়ে উঠলেন। তখন তার বাবা মুঙ্গেরে ছোট ভাই সুবোধের কাছে থাকেন। মানিক লেখালেখিতে ব্যস্ত। দিনরাত একাকার। জেদি মানুষটি নাওয়া খাওয়া ভুলে তখন শুধু লেখা আর লেখায় ব্যস্ত। প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘোরাঘুরি চলছে নিত্যদিন। নিজের শরীরের কথা বেমালুম ভুলে থাকলেন। অমানুষিক পরিশ্রমের ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষমাণ ছিল। হায়! কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না সেদিকে। ছোটবেলায় যে মানুষটি দারুণ কুস্তি লড়তেন, সেই মানুষটির শরীর অসম্ভব পরিশ্রমে ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগল।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস। বিখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ এর চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন। মানিকের তৃতীয় উপন্যাস ছিল এটি। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। বাবার চাকরির সুবাদে টাঙ্গাইলে থাকেন মানিকদের পরিবার। বাঁশি এই তরুণের সর্বক্ষণের সঙ্গী। মাঝে মাঝেই বাঁশি হাতে বেরিয়ে পড়েন একা। প্রকৃতিলগ্ন হয়ে এখানে ওখানে নদীর ধারে ঘুরে বেড়ান মানিক। বাড়ি ফেরার কথা মনেই থাকে না। 

ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান কিংবা নৌকোর মাঝিদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে দেদার আড্ডা। বয়স তখন কত আর? ১৪ কিংবা ১৫ হবে। একদিন হঠাৎই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। পার হয়ে গেল কয়েকটা দিন। মানিকের কোনো খোঁজখবর খবর নেই। বাড়ির সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। মা তো কেঁদেকেটে অস্থির। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হদিস পাওয়া গেল। টাঙ্গাইলের নদীর ধারে যে নৌকোগুলো নোঙর করা রয়েছে, সেখানে মাঝিদের সঙ্গে। দুই বেলা তাদের সঙ্গে গল্প, গান খাওয়া-দাওয়া করে দিব্যি সময় কাটছে তার। একটা সময় বুঝিয়েসুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো হলো তাকে। তখন আর কে জানত এই স্মৃতিই পরবর্তীকালে‘পদ্মা নদীর মাঝি’ লেখার ক্ষেত্রে বড় কাজে দেবে! ১৯৩৬ সালে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়েছিল পদ্মা নদীর মাঝি।

সেই বছরই ছাপা হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। যার নাম ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। অবশ্য এটি লেখা হয়েছিল আরও এক বছর আগে। সেও আরেক নাটকীয়তায় ভরপুর কাহিনি। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় এসেছিল বিখ্যাত একটি পুতুল নাচের দল। সেই কার্নিভালের নাচ দেখে ভীষণ মুগ্ধ হলেন তরুণ প্রতিভাধর এই লেখক। সেই পুতুলদের সঙ্গে মানুষের জীবনের মিশ্রণ ঘটিয়ে লিখতে শুরু করলেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রন্থাবলি: উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে-দিবারাত্রির কাব্য, জননী, জীবনের জটিলতা, অমৃতস্য পুত্রাঃ, শহরতলী, অহিংসা, ধরাবাঁধা জীবন, চতুষ্কোণ, প্রতিবিম্ব, দর্পণ, চিন্তামণি, শহরবাসের ইতিকথা, চিহ্ন, আদায়ের ইতিহাস, জীয়ন্ত, পেশা, স্বাধীনতার স্বাদ, সোনার চেয়ে দামী, ইতিকথার পরের কথা, পাশাপাশি, সার্বজনীন, নাগপাশ, ফেরিওয়ালা, আরোগ্য, চালচলন, তেইশ বছর আগে পরে, হরফ, শুভাশুভ, পরাধীন, প্রেম, হলুদ নদী সবুজ বন, মাশুল, শান্তিলতা।

ছোটগল্প : অতসী মামী ও অন্যান্য, প্রাগৈতিহাসিক, মিহি ও মোটা কাহিনী, সরীসৃপ, বৌ, সমুদ্রের স্বাদ, ভেজাল, হলুদপোড়া, টিকটিকি, হারানের নাতজামাই, আজ কাল পরশুর গল্প, পরিস্থিতি, খতিয়ান, মাটির মাশুল, ছোট বড়, ছোট বকুলপুরের যাত্রী, ফেরিওলা, লাজুকলতা, আত্মহত্যার অধিকার।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু মর্মচেরা জীবনবাদী কথাশিল্পীই ছিলেন না। তার লেখা অনেক প্রবন্ধও রয়েছে। একটি প্রবন্ধের নাম ‘লেখকের সমস্যা’। তা থেকে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃতি :

“সত্যই কি নাম করার পরেও বাংলায় শুধু লিখে দিন চালানো যায় না? যায়। লেখাকে পেশায় পরিণত করলে অর্থাৎ সাহিত্যিকের পালনীয় প্রথম ও প্রধান নীতিটা বাতিল করে দিয়ে নিজেকে পেশাদার লেখকে পরিণত করলে সপরিবারে মোটামুটি বেঁচে থাকার মতো অর্থ উপার্জন করা যায়।

সাহিত্যের আদর্শ বিক্রয় করে, আত্মবিক্রয় করে করা যায়। এই জন্যই তো জীবিকাটা সমস্যা। নইলে সাহিত্য সৃষ্টির জন্য লড়াই করতে করতে নাম হলে অনেক দিকেই আত্মবিক্রয়ের সুযোগ সাহিত্যিকের জুটে যায়।

শিল্প সাহিত্যকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করলে খাঁটি শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না-আমি এই মূলনীতির কথাই বলছি। স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক টাকার জন্য লিখলে লেখকের ক্ষমতা অনুসারে লেখার যে মান হওয়া উচিত লেখা তার চেয়ে নিচু স্তরের হয়ে যাবেই। সকল সাহিত্যিকের পক্ষে এই নীতি প্রযোজ্য।

এই নীতিটাকে ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ দুর্নীতিটার সঙ্গে অনেকে একাকার করে ফেলেন। টাকার জন্য না লেখার মানে দাঁড় করান নিছক সাহিত্যের জন্য সাহিত্য করা। এটা ভুল ধারণা। মূলনীতিটা মোটেই ফাঁকা আদর্শবাদিতা থেকে আসে না। খাঁটি বাস্তব কারণেই নিজের সাধ্যমতো খাঁটি সাহিত্য সৃষ্টি করতে চাইলে সাহিত্যিককে এই নীতি মানতে হয়।

সাহিত্যকে পেশা করা মাত্র সাহিত্যিক তার সাহিত্য চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা অনেকখানিই হারিয়ে ফেলেন। যথেষ্ট সময় দিয়ে এবং অন্য হিসাব না করে এবং নিজের জীবন দর্শনের সত্যটিকে রূপায়িত করার স্বাধীনতা সংকীর্ণ হয়ে যায়। কতটা সময় দিয়ে কতটা লিখলে পেট চলবে শুধু এই হিসাব নয়, যারা তাকে পেট চালাবার টাকা দেবে তারা তার বক্তব্য কিভাবে নেবে এই ভাবনাও ভাবতে হয়।...”

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কবিতাও লিখেছেন। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা প্রায়-প্রথম গদ্যরচনার সমসাময়িক। নিজের সাহিত্য সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “সাধ করলে কবি হয়তো আমিও হতে পারি; কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়াটাই আমার পক্ষে হবে উচিত ও স্বাভাবিক।” মানিক গ্রন্থাবলীর ত্রয়োদশ খণ্ডের (ড. সরোজমোহন মিত্র ও শ্রী নিরঞ্জন চক্রবর্তী সম্পাদিত, গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৭৬) পরিশিষ্টে যুগান্তর চক্রবর্তী লিখেছেন,“...একমাত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই, তাঁর অমানুষিক আত্মচেতনার প্রমাণস্বরূপ,এমন অব্যর্থ উক্তি সম্ভব ‘আড়াই বছর বয়স থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস আমি মোটামুৃটি জেনেছি।’

এতৎসত্ত্বেও, আধুনিক বাংলা উপন্যাসসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমরত্ব নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হবার পরও, লেখকজীবনের বিভিন্ন সময়ে কেন কিছু কবিতার অভিজ্ঞতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, তার ব্যাখ্যা ও কারণ নিশ্চয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র অন্তঃপ্রকৃতির জটিল ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

তাই কবি হবার সাধ থেকে ঔপন্যাসিকের ঔচিত্য ও স্বাভাবিকতায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্থান, নিছক আত্মোপলব্ধির চেয়েও কিছু বেশী। বস্তুত, কবিতার সাধ ও উপন্যাসের স্বাভাবিক ঔচিত্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখকজীবনের এক মৌলিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের যুক্তিগত সমাধান যদিও তাঁর উপরোক্ত প্রবন্ধে পাওয়া যায়, তবু তার কল্পনাময় ইতিহাস একমাত্র ‘দিবারাত্রির কাব্য’র রূপকের ‘নূতন রূপের’ মধ্যেই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব।” 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //