সাহিত্যে মাতৃত্বের জয়গান

‘মা’কে আমার পড়ে না মনে/শুধু কখন খেলতে গিয়ে/হঠাৎ অকারণে/একটা কী সুর গুনগুনিয়ে/কানে আমার বাজে/মায়ের কথা মিলায় যেন/আমার খেলার মাঝে-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাকে নিয়ে লেখা এই কবিতা পড়লে মার কথা, মাকে হারানোর কথা মনে পড়ে। আবার কবিগুরুর সেই ছোট্টবেলায় পড়া ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি একটি ছোট ছেলের তার মাকে বিপদ থেকে কিভাবে সাহসের সাথে লড়াই করে রক্ষা করে সেই কাহিনি যা সকলের মুখে মুখে।

‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে/দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে/ আমি যাচ্ছি/রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।’ সেই বীরপুরুষ আসলে প্রতিটি সন্তানের হওয়া উচিত। আবার তিনিই তার ‘অন্য মা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার মা না হয়ে তুমি/আর কারো মা হলে/ভাবছ তোমায় চিনতেম না/যেতেম না ঐ কোলে?/মজা আরো হত ভারি/দুই জায়গায় থাকত বাড়ি/আমি থাকতাম এই গাঁয়েতে/তুমি পারের গাঁয়ে।’

‘মাতৃবৎসল’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মেঘের মধ্যে মা গো, যারা থাকে/তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে/বলে, আমরা কেবল করি খেলা/ সকাল থেকে দুপুর সন্ধেবেলা।’ কবিগুরুর কেবল কবিতাই নয় মাকে নিয়ে লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাসও। মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বন্ধু।

পৃথিবীর কোনো সম্পদ, টাকা-পয়সা, গাড়ি, বাড়ি হারানোর সাথে মাকে হারানোর তুলনা হয় না। শুধু কবিগুরুই নন, মাকে নিয়ে অন্তত একটা কিছু লেখেননি এমন লেখক কমই আছেন। মা নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। আরও বহু রচনা রচিত হবে নিশ্চিত। 

কারণ মা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ, সবচেয়ে বড় অধ্যায়। মোট কথা যত দিন এ বিশ্ব তার অস্তিত্ত বজায় রাখবে তত দিন মাকে নিয়ে অনুভ‚তির কথা, বেদনার কথা নানাভাবে উঠে আসবে। পৃথিবীর সব সম্পর্ক, সব ভালোবাসা একটি সম্পর্কের কাছে এসে মাথা নোয়ায়। তা হলো মা আর সন্তানের সম্পর্ক। কোনো ব্যাখ্যা নেই, কোনো নাম নেই, কোনো লাভ ক্ষতির হিসেব নেই, পাওয়া বা না পাওয়ার অতৃপ্তি নেই আছে কেবল পরিপূর্ণতা। এ এক নির্মোহ পবিত্র বন্ধন। যা কেবল মা আর সন্তানের মধ্যে হতে পারে। মাকে নিয়ে কবিতা লেখার শুরু সেই সাহিত্য শুরুর যুগ থেকেই। 

১৫ শতকের উল্লেখযোগ্য কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর তার ‘ইউসুফ জুলেখায়’ লিখেছেন, ‘পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিতে/কোল দিয়া বুক দিয়া জগতে বিদিত/অশক্য আছিলু মুই দুর্বল ছাবাল/তান দয়া হন্তে হৈল এ ধড় বিশাল।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘হেরিলে মায়ের মুখ/দূরে সরে যায় সব দুখ/মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান/মায়ের শীতল কোলে/সকল যাতনা ভোলে/কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।’ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর মার কাছে সন্তানের লেখা রক্তে ভেজা চিঠির কবিতা তো সকলের জানা। তিনি তার ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না/বলো, মা/তাই কি হয়?’

প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আজাদ মাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি/আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে/কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা/আমাদের বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে/মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি। একটি সম্পর্ক যা পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই একইভাবে বহমান তাকে আর কি দিয়েই পরিমাপ করা যায়! মাকে নিয়ে আলাদা একটি দিবসের প্রচলন হলেও বস্তুতপক্ষে কোনো নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে বা উপলক্ষ করে মার প্রতি ভালোবাসা হিসেব করা যায় না। এটি সর্বকালের, সর্বসময়ের। 

কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে/নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?/ হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে। মাতৃস্নেহ সকল গন্ডির ঊর্ধ্বে। মার আঁচল ছায়ার প্রশান্তি পৃথিবীর সব শান্তি আর সুখের উপরে। ঠান্ডা এসির বাতাসও বুঝি মায়ের আঁচলের ছায়ার প্রশান্তি এনে দিতে পারবে না।

কারণ এটি একদিকে প্রশান্তি অন্যদিকে নিরাপত্তার ছায়া। এ কারণেই কবি কাজী কাদের নেওয়াজ লিখেছেন, মা কথাটি ছোট্ট অতি/কিন্তু জেনো ভাই/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর/ত্রিভুবনে নাই। কোনো সংজ্ঞায়, কোনো মনীষীর লেখায় মার তুলনা সম্পূর্ণ উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না। তা কেবল খন্ডিতই থেকে যাবে। থেকে যাবে অপূর্ণতা। তাই মাকে স্রষ্টার পরেই স্থান দেয়া হয়েছে। সন্তানের সকল সুখ শান্তি, এমনকি স্বর্গ মায়ের পায়ের নিচেই নিহিত। 

আবার অনেক সন্তানও মায়ের ভালোবাসার জন্য সবকিছু করেছেন। এর উদাহরণ বায়েজিদ বোস্তামী। সেই কাহিনি তো আজ সকলের জানা। মাঝরাতে সন্তানের কাছে পানি খেতে চাইলে ঘরে পানি না থাকায় দূর ঝরনা থেকে পানি এনে মায়ের ঘুম না ভাঙিয়ে শিয়রের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। পল্লী কবি জসীম উদ্দীন তার কবিতায় মাকে উপস্থাপন করেছেন, দুঃখের সায়রে মায়ের এক মুখ/রঙিন ঝিনুকে পোরা মুক্তা এতটটুকু। কবি রজনীকান্ত সেন লিখেছেন, ‘স্নেহ বিহ্বল, করুণা ছলছল/শিয়রে জাগে কার আঁখিরে/মিটিল সব ক্ষুধা, সঞ্জীবনী সুধা/ এনেছে অশরণ লাগিরে। 

মাকে নিয়ে যে শুধু কবিতাই হয়েছে তা নয়। মাকে নিয়ে হয়েছে ছোটগল্প, বড়গল্প, উপন্যাস। যেখানে মায়ের জীবন সংগ্রামের কথা লেখা হয়েছে। এসব কাহিনি কোথাও না কোথাও মায়েদের জীবনের সাথে মিলে যায়। মা তো এমনই হয়। বাংলা সাহিত্যের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা কেন্দ্রিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ যা পরে চলচ্চিত্রে রূপ পেয়েছে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে নিজের সন্তানকে অবলীলায় পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা আমাদের নাড়া দেয়।

আবার ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ নামের বিখ্যাত উপন্যাসের কথা পাঠকমাত্রই জ্ঞাত। ম্যাক্সিম গোর্কির মা, শওকত ওসমানের জননীসহ কেবল মাকে কেন্দ্র করেই কত সাহিত্য উঠে এসেছে। জননী উপন্যাসের কাহিনিতে একজন মা সমাজের কুসংস্কার ও কর্তৃত্ববাদী সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তার জীবনযুদ্ধে নিজের সবটুকু দিয়ে টিকে থাকার প্রচেষ্টার একটি মুখ। এটি দেশের অনেক মার প্রতিচ্ছবি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুটি উপন্যাস বিন্দুর ছেলে এবং রামের সুমতি মাকে উপজীব্য করে লেখা হয়েছে।

আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও ‘জননী’ নামে একটি বিখ্যাত উপন্যাস রয়েছে। তিনি এই উপন্যাসে মাকে সংগ্রামরত একজন মহিলার মুখ হিসেবে তুলে ধরেছেন। একদিকে মায়ের অসহায়ত্ব এবং মার যত্নবান হওয়া এসবই উপন্যাসের উপজীব্য হয়েছে। আনিসুল হকের ‘মা’ একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মা। একজন মা বহু সংগ্রাম করে তার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেন।

এছাড়া একাত্তরের দিনগুলি, জ্যোৎস্না ও জননীর গল্পও মাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসটির কেন্দ্রেও রয়েছে মা। সাহিত্য রচনার অন্যতম একটি কেন্দ্র হলো মা। সাহিত্য মানেই মাতৃত্বের জয়গান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //