একজন লেখকের মনোজগৎ

একজন লেখকের জ্ঞানপিপাসু হওয়াটাই প্রকৃত গুণ। লেখক তখনই লেখক হয়ে মানুষের মনে জায়গা পায়; যখন তিনি মানুষের কথা বলেন। কথা বলেন বাস্তবতা, আশা-ভরসা, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মানুষের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব দেখে। সেই দীর্ঘ যাত্রার পথে হেঁটে অনেকেই পা পিছলে পড়ে থাকেন মধ্যপথে। কেউ আবার পথের শেষ ছুঁইয়ে ফেলেন নিজেকে চেনার আগেই।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাঁটি হাঁটি পা পা করেই লেখক নিজেকে দাঁড় করাতে পারেন লেখক শব্দটির বিবেচনায়। লেখক শব্দটি যেন এভাবে মহৎ শব্দে পরিণত হয়েছে। 

কিন্তু সম্প্রতি লেখক শব্দটি নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে। কথা হয় লেখকের উদাসীনতা, সময়ের সাথে লেখকের লেখার অসামঞ্জস্যতা নিয়ে। এটা হতেই পারে। হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সময়ের সাথে লেখকের মেলবন্ধন, সেতুবন্ধ সব সময় যে হয়েছে তা কিন্তু নয়। অনেক লেখক সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় কোলাহল থেকে দূরে থেকেছেন শুধু সময়কে ধারণ করতে গিয়ে। 

সময়কে ধারণ করে সময়ের কথা বলতে কেউ কেউ স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছেন। ফের অনেকেই সমসাময়িক সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালো চিন্তা করে আঁধারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। এই যে আলো-আঁধারের বিরুদ্ধে কলম কখনো সজাগ আবার কখনো নির্বাসনে এরও বৃহৎ কারণ রয়েছে।

বাংলা সাহিত্যসহ বিদেশি সাহিত্যে এই আলো-আঁধারের বিরুদ্ধে গিয়ে কলম ধরে অনেকেই হয়েছেন নির্বাসিত, অনেকের বইও নিষিদ্ধ হয়েছে। বাংলাসাহিত্য এক্ষেত্রে বিশেষ ভার কাঁধে বহন করে যাচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে সেটা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। বরং হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা সাহিত্যিকরা বিশেষ মেরুদণ্ড নিয়ে কলম ধরে।

বাংলাভাষায় কবিতা লিখে নির্বাসিত হয়েছেন কবি দাউদ হায়দার। সময়ের ঘাত-প্রতিঘাত, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কাজী নজরুল ইসলামের বইও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে হুমায়ুন আজাদের বই। নির্বাসনে রয়েছেন তসলিমা নাসরিন। অন্যদিকে সম্প্রতি ব্রিটিশ ভারতীয় লেখক সালমান রুশদির উপর হামলা হয়েছে।

পূর্বেই তার বই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। রুশদি বইটি মহানবি (সা.)-এর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লিখেছেন। বইটি নিষিদ্ধ করা ছাড়াও ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি তাঁকে হত্যার ফতোয়াও জারি করেন। এছাড়াও বইটি বিক্রি করায় বিভিন্ন দোকানে বোমা হামলার ঘটনা সাহিত্যানুরাগীদের বিস্মিত করতে পারে। 

কবিতা, গল্প, প্রবন্ধের মাধ্যমে সমাজের চিত্র তুলতে গিয়ে রাশিয়ান অনেক কবিকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ তালিকায় বিশ্বের নামকরা কয়েকজনের নাম উদাহরণে উল্লেখ করা যেতে পারে। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকা নোবেল বিজয়ী লেখক হেমিংওয়ে প্রথম সারির লেখক। সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতা করতেন। একটা সময় সংবাদ সংগ্রহের কাজে প্যারিসে যান এবং সেখানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। 

ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো। বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর একটি তার রচিত ‘লা মিজারেবল’। নির্বাসনের দিনগুলোতেই লেখা বিখ্যাত উপন্যাসটি। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমর্থন  থাকায় সম্রাটের রোষানলে পড়তে হয় হুগোকে। অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন এবং গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলায় সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে। পরে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। নির্বাসনে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে পরবর্তী নর্মান্ডি দ্বীপে যেতে হয়। নির্বাসিত জীবনেই তার বিখ্যাত লেখাগুলোর সৃষ্টি।

ভলতেয়ার ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এটি ছদ্মনাম। মূল নাম ফ্র্যাংকোইস ম্যারি আরকোইট। তৎকালীন ফরাসি রাজা লুই ও চার্চের সমালোচনা করে লেখালেখির অভিযোগে পর পর দুইবার কারারুদ্ধ হন। কারামুক্ত হয়ে চলে যান লন্ডনে। তিন বছর প্রবাসে নির্বাসিত থাকেন। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সে যান।

রোম সাম্রাজ্যের পক্ষে কথা বলা দান্তে আলিগিয়েরিকেও নির্বাসিত হতে হয়েছে। কারণ বিপক্ষশক্তি ব্ল্যাক গুয়েলফরা যুদ্ধে জিতলে দান্তেকে শহর ছাড়তে হয়। অথচ সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নাম। এমন অসংখ্য লেখক সাহিত্যিকের নাম যুক্ত করা যেতে পারে এই তালিকায়। তাতে তালিকাটাই ভারী হবে মাত্র।

কিন্তু এত লেখকের নির্বাসন, বই নিষিদ্ধ হওয়ার পরও তাদের লেখালেখি বন্ধ হয়নি। বরং বিপুল উৎসাহে তারা পরে তাদের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন। বলেছেন মানুষের কথা, মানবতার কথা। এত কিছুর পরও কি লেখকরা তাদের দায়বদ্ধতা থেকে দূরে সরে গেছেন? নিশ্চয়ই নয়। তাই তো কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-

“মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।”

আসলে বিষয়টি এমন যে, লেখকের কিছু দায় থাকে। থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা। সমাজ সচেতনতা, রাষ্ট্রীয় শাসনের ও শোষণের পর্যবেক্ষণ করে সাধারণের জন্য কথা বলাটা লেখকের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব যে লেখক যতটা সচেতনভাবে পালন করেছে সেই লেখক ততটাই মহৎ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মহৎ লেখকেরা নিজের দায়িত্ব ও সাধারণের চাওয়াকে বুঝতে পেরেছেন। নিজেই হয়ে উঠেছেন সাধারণ। বাংলা সাহিত্যের অমর কবি রফিক আজাদ হয়তো তাই সাধারণের কথা বলেছেন এভাবে-

দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে

অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা

গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত

চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী

উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী

আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ

ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।

হাজার বছরের বাংলা ভাষাকে যে সব মহৎ কবি সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের অধিকাংশই সাধারণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তাদের লেখা কবিতার অধিকাংশই অন্যায়-অত্যাচার এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে। 

কবি হেলাল হাফিজ যখন ‘রাডার’ শিরোনামে লেখেন-

‘একটা কিছু করুন।/এভাবে আর কদিন চলে দিন ফুরালে হাসবে লোকে/দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন/একটা কিছু করুন।/ চতুর্দিকে ভালোবাসার দারুণ আকাল/ খেলছে সবাই বেসুর-বেতাল/কালো-কঠিন-মর্মান্তিক নষ্ট খেলা/আত্মঘাতী অবহেলে নগর ও গ্রাম গেরস্থালি/বনভূমি পাখপাখালি সব পোড়াবে,/সময় বড়ো দ্রুত যাচ্ছে/ ভাল্লাগে না ভাবটা ছেড়ে সত্যি এবার উঠুন/একটা কিছু করুন।/ দিন থাকে না দিন তো যাবেই/ প্রেমিক যারা পথ তো পাবেই/ একটা কিছু সন্নিকটে, হাত বাড়িয়ে ধরুন/ দোহাই লাগে একটা কিছু করুন।’

রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ 

লেখক কখনোই লোভী, চাটুকার হতে পারে না। কারণ লোভের বিপরীতে লেখকের অবস্থান। সমাজের যাবতীয় বিত্ত-বৈভব পায়ে মাড়িয়ে চলে। পুরস্কারের নামে যে প্রহসন তাও অনেক লেখক অগ্রাহ্য করে। লেখকের বড় বৈশিষ্ট্য হলো সে আপসহীন, সাদা-কালোর পার্থক্য বোঝে। যা সত্য তাই ধারণ করে। মিথ্যেকে দূরে রাখে। লেখালেখিকে সনদ বানিয়ে কোথাও সুবিধা ভোগের আশা করে না। লেখালেখি একমাত্র সাধনা, ধ্যান-জ্ঞান। এ কারণেই অধিকাংশ লেখক একটা সময় গিয়ে একা হয়ে পড়েন।

আযাদ কালাম ‘শিল্পীর দায়বোধ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শিল্পকে চেনার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত এর নান্দনিকতা, যা সহজে মানুষকে মুগ্ধ করে। এর আবেশ মানুষকে মোহগ্রস্ত করে ফেলে। তারপর ভাবায়, তাড়িত করে, মানুষকে জাগ্রত করে, ন্যায়নিষ্ঠ করে, প্রতিবাদী করে, প্রাণিত করে, সর্বোপরি মানুষকে মানবিকভাবে বিকশিত হবার জন্য নেপথ্যের চালিকাশক্তি হয়ে কাজ করে।’ প্রাবন্ধিক আযাদ কালামের সাথে আমিও একমত। যুগে যুগে সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে লেখকদের উপর নানান প্রতিবন্ধকতা এসেছে।

লেখকদের বরাবরই কাঁটার উপর হেঁটে চলতে হয়েছে। কিন্তু লেখকরা কখনোই পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখেনি। কোনো প্রকৃত লেখক কখনোই অন্যায়ভাবে সমাজকে উত্তপ্ত করেনি। লেখকের দ্বারা সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, জুলুমের প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে কবিদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। এটাই প্রকৃত লেখকের চিত্র। এটাই লেখকের দায়বদ্ধতা নিজের কাছে তার লেখনী শক্তির কাছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছেও একজন প্রকৃত লেখক এভাবেই দায়বদ্ধ থাকেন। 

অনেক সময় দেখা যায় লেখকের অসৎ কর্মে দৌড়ঝাঁপ। রাষ্ট্রীয় পদক ও সুবিধা গ্রহণে সরকারদলীয় সনদ বহন করা। এটা হয়। অতীতেও হয়েছে। এদের অধিকাংশই মৃত্যুর পর কারও মনে জায়গা পায়নি। এই শ্রেণির লেখক তাদের জীবদ্দশায় খুব তৃপ্তির সাথে সময় অতিবাহিত করে। কারণ তাদের মনে শিল্প কখনোই সাধনার বিষয় ছিল না। তারা শিল্পকে ধারণও করেনি। বরং তারা লেখালেখিকে সনদ বানিয়ে সমাজের উঁচু স্থানে যাওয়ার পথ খোলে। যুগ যুগ ধরে এদের দৌরাত্ম্যও কম ছিল না।

বরং প্রকৃত লেখকরা এই শ্রেণির তথাকথিত লেখকদের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অনেক লেখক অভিমানে সাহিত্যের সাধনাকে সংকুচিত করেছে। বাংলা সাহিত্যে এর প্রভাব অনেক বেশি। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বলয়ের কারণে প্রকৃত লেখকরা অতিষ্ঠও। এই বলয়েই গড়ে ওঠে দৈনিকের সাহিত্যপাতা, মিডিয়ার প্রচার-প্রসারের প্ল্যাটফর্ম। 

অনেকেই প্রশ্ন করেন, কবিতার, উপন্যাসের, গল্পের দায় কী? প্রশ্নটির গুরুত্ব আছে। এড়িয়ে যাওয়াটা কঠিন। আমি মনে করি, যে কবিতা অসার, নীরব, আলোহীন সে কবিতা দায়মুক্ত। কিন্তু এমন অনেক ছড়া বা কবিতা আছে যা অসার, নীরব, আলোহীন কিন্তু পাঠকের মনোরঞ্জনে সফল। সেগুলোকেও দায়মুক্ত কবিতা বলা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে----

‘হাট্টিমাটিম টিম

তারা মাঠে পাড়ে ডিম

তাদের খাড়া দুটো শিং

তারা হাট্টিমাটিম টিম।’ ছড়ার অংশটুকু পড়লে পাঠক তা থেকে কিছু শিখতে পারবে বলে মনে হয় না। ছড়া-কবিতাটির এই অংশ দিয়ে না প্রেম ছড়াবে, না রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে সংস্কার বা শিখতে পারবে পাঠক। কিন্তু ছড়াটি ব্যাপকভাবে পাঠকের মনোরঞ্জনে ভ‚মিকা রেখেছে। এরকম অনেক গল্প ও উপন্যাসের কথা আপনারা পড়লেই বুঝতে পারবেন। এর থেকে আমরা সহজেই বলতে পারি, কবিতার দায়, গল্পের দায় মূলত লেখকের উপরই বর্তায়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //