জুলিয়া গ্রিলো: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কারিগর

স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কারিগর হয়ে নিজের জগৎ তৈরি করছেন জুলিয়া গ্রিলো। ইতালিতে জন্মালেও শিল্পের টানে চলে এসেছেন লন্ডনে। ২০১৮ সাল থেকে সেখানে আছেন ২৭ বছর বয়সী এই নারী। ফটোগ্রাফির মাধ্যমে পরাবাস্তবতা তুলে ধরছেন। সর্বশেষ গেল বছর নভেম্বরে আমেরিকাতে করেছেন একক প্রদর্শনী।

শিল্পের এক অদ্ভুত শৈলী দর্শকের সামনে এনেছেন। খুদে পুতুলের চেহারায় বড় বড় চোখ সমেত মোহনীয় নিজের প্রতিকৃতি (self portrait) প্রদর্শন করছেন। যখন তিনি দর্শকের সামনে আসেন তার আগে নিজেকে সাজাতে ঘণ্টা তিনেক সময় নেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ ফটোগ্রাফি বাদেও ভিডিও নিয়ে কাজ করছেন গ্রিলো।

পথের প্রস্তুতি

কীভাবে এ পথে শিল্পী নেমেছিলেন প্রশ্ন ছিল এক শিল্পরসিকের। তখন তাকে জানান, ‘আমি একটা পেটিট ডল বা খুদে পুতুল বলতে পারেন। আমি সেইসব পপ-পরাবাস্তববাদী পুতুলের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাই যার বড়, নাটকীয় চোখ যা কার্টুন থেকে এসেছে বলে মনে হয়। আমার স্ব-প্রতিকৃতিতে, আমি একটি স্বপ্নের মতো মাত্রা তৈরির জন্য একটি পুতুলের চেহারা অনুকরণ করার চেষ্টা করি যা বাস্তব ও কী নয় তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আমিও খুব ছোট, তাই আমি নিজেকে খুদে বলে সংজ্ঞায়িত করি!’

জুলিয়ার অনুপ্রেরণা প্রথাগত পরাবাস্তববাদী শিল্পীরা। এদের মধ্যে আছেন, সালভাদর দালি, ম্যাগ্রিৎ, আর্নেস্ট, ডেলভাক্স। এছাড়া আছেন প্রথম পরাবাস্তববাদী ফটোগ্রাফার ডোরা মার, মানরে, হ্যান্স বেলমার, মার্ক রাইডেনের মতো সমসাময়িক পপ-পরাবাস্তববাদী চিত্রশিল্পী আর কিমি শিমির মতো সমসাময়িক ভাস্কররা।

জুলিয়া ইতালিতে গ্রাফিক ডিজাইনে প্রথম ডিগ্রি নেওয়ার সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এটা তার জীবনে অত্যন্ত পরীক্ষামূলক পর্যায় ছিল। ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ ভাষা খুঁজে পেতে তার কিছু সময় লেগেছিল। তিনি যখন লন্ডনে চলে আসেন, তখন ইউনিভার্সিটি অব আর্টস লন্ডনে ভর্তি হন। তখন তার শৈলী উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়েছিল। এখান থেকে তার প্রতিভা বিচ্ছুরিত হতে থাকে। বিভিন্ন শৈল্পিকসুযোগ পেয়ে নিজের কাজকে অনেক পেশাদার স্তরে উন্নীত করেন।

নয়া সৃজনে স্বীয়প্রতিকৃতি

যখন নয়া সৃজনে মত্ত হলেন জুলিয়া গ্রিলো, তাজ্জব বনে গেলেন আমেরিকা ইউরোপের শিল্প রসিকরা। ফটোশিল্পে আনলেন জাগরণ। এই নয়া সৃজন নিয়ে পরিষ্কার বললেন শিল্পী, ‘আমি ফটোগ্রাফির সাথে পরাবাস্তবতাকে একত্রিত করি, নিজেকে বিভিন্ন অদ্ভুত চরিত্রে রূপান্তর করি। প্রতিটি কাজ জটিল ধারণার সম্পূর্ণ প্রকাশ বহন করে, অস্থির থেকে সুন্দর পর্যন্ত, আর যা সম্ভব তার সীমানাকে ঠেলে দেয়।’

তিনি একজন শিল্পী হিসেবে নিজস্ব বার্তা পৌঁছাতে স্বীয়প্রতিকৃতিকে সেরা মাধ্যম মনে করেছিলেন। একসময় খুব এলোমেলোভাবে নিজের ছবি তুলতে লাগলেন। যখন তার কাছে ছবি তোলার জন্য কোনো মডেল ছিল না, তখন তিনি নিজেকে একটি বিষয় হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন তার শিল্পের উদ্দেশ্য, চরিত্রগুলো তৈরি করার জন্য সাজসজ্জাসহ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। আর এটি নিজেকে প্রকাশ করার এক ধরনের কর্মক্ষমতা ও উপায় হয়ে ওঠে।

প্রথম দিকে তার শিল্পকর্মের অংশ হিসেবে বৈশিষ্ট্যযুক্ত করার এমন কিছু ছিল না যা গ্রিলো সর্বদা করেছিলেন; প্রাথমিকভাবে, তিনি বন্ধুদের ছবি তোলা শুরু করেছিলেন কিন্তু দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন যে তার পরীক্ষা করার ইচ্ছাকে এগিয়ে নেওয়ার উপায় হিসেবে স্বীয়প্রতিকৃতি (self portrait) তোলা কতটা সহজ।

প্রেরণা যেখান থেকে

তিনি তার চারপাশের সবকিছু থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেন, শিল্প থেকে দৈনন্দিন জিনিস পর্যন্ত। যেটা কিনা একটি অনুভ‚তি বা স্বপ্ন হতে পারে, যা চিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চান। কখনো কখনো এটি কেবল একটি দৈনন্দিন বস্তু থেকে শুরু হয়, যা দৃশ্যত আকর্ষণীয় ও তারপরে এটিকে ঘিরে একটি ধারণা তৈরি হয়। তিনি তার মস্তিষ্কে দৃশ্য নিয়ে খেলা করেন। এটা তাকে তার কল্পনাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। তার বিশ্বাস সৃজনশীলতা একটি পেশির মতো। এটি যত বেশি ব্যবহার করা যাবে, তত বেশি নিজের কাছে থাকবে।

এই শিল্পী সর্বদা পরাবাস্তববাদী আন্দোলন দ্বারা মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক সৌন্দর্য আর জাদু খোঁজেন; যেটা একই সময়ে আকর্ষণীয় ও বিরক্তিকর। আসলে পরাবাস্তবতা হলো সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যে অচেতনের উদযাপন। শিল্পী মনের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নিজের সবচেয়ে খাঁটি অংশ প্রকাশ করতে স্বাধীন।

কাঁকড়াবালিকা

ক্র্যাব গার্ল বা কাঁকড়া বালিকা নামে তার একটি সিরিজ ফটোগ্রাফি রয়েছে। যেটা তিনি শুরু করেছেন ২০১৯ সাল থেকে। ‘দ্য গার্ল উইথ লবস্টার হ্যান্ডস’ তার সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র, আর সেটা তার প্রিয় পরাবাস্তববাদী বস্তুগুলোর মধ্যে একটি, সালভাদর দালির লবস্টার টেলিফোন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এটা করেন। তা ছাড়া গলদা চিংড়ির চিত্রটি দৃশ্যত আকর্ষণীয় বলে মনে করেন। কারণ তার কাছে এটি শক্তি ও বৈচিত্র্যেরও প্রতীক। 

ফটোশুটের জন্য প্রপস ও লুক তৈরি করা প্রক্রিয়াটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যখন তিনি তার সৃজনশীলতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন তখন তিনি তার আইডিয়াগুলো জীবন্ত করার চেষ্টা করেন। যদিও তিনি একজন পেশাদার ভাস্কর বা মেকআপ শিল্পী নন, তথাপি তিনি অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পছন্দ করেন! তিনি তার কাজের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ও কৌশল ব্যবহার করেন, যেমন পলিমার কাদামাটি, এসএফএক্স প্রস্থেটিক্স, রজন, প্লাস্টার ইত্যাদি। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে তিনি আসলে ফটোশপে কাজ করছেন। কিন্তু তিনি যেটা করেন সেটা হচ্ছে, সবসময় বাস্তববস্তু ব্যবহার করেন। এটার কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন এ প্রক্রিয়া বস্তুগততার অনুভ‚তি দেয়। যা সবসময় ডিজিটালভাবে অর্জন করা যায় না। 

প্রতীকবাদেও আসক্তি

তার কাজের পিছনে প্রতীকবাদের প্রভাব রয়েছে। তার ছবি রূপক ও প্রতীকীপূর্ণ। তিনি পরিচিত পরিস্থিতিগুলোকে অসাধারণ কিছুতে পরিণত করতে চান, তার ধারণা এটি সক্রিয়ভাবে দর্শকের কল্পনাকে উদ্দীপিত করে। ভিজ্যুয়াল প্যারাডক্স তার কাজের অন্যতম প্রতীকী উপাদান। যদি জুলিয়ার শিল্পকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা হয় তবে দেখা যাবে সবকিছুতে বৈসাদৃশ্য তৈরি করেছেন। তিনি বিপরীতের মধ্যে একটি চাক্ষুষ ভারসাম্য তৈরি করেন যা কিনা সুন্দর ও অদ্ভুত, যুক্তিযুক্ত আর অযৌক্তিক, ইচ্ছা ও বিকর্ষণ, সূ²তা ও বর্বরতা, বাস্তবতা ও স্বপ্ন। কাজের সৌন্দর্য সম্পর্কে শিল্পী যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তা এমন, ‘আমি অস্বাভাবিক, অদ্ভুত ও অপ্রচলিত সৌন্দর্য খুঁজে নিই। ঐতিহ্যগত সৌন্দর্যমান আমার কাছে বিরক্তিকর।’

শেষকথা

জুলিয়া গ্রিলোর কাজ সমসাময়িক সমাজকে প্রতিফলিত করার নিমিত্তে বেশ ব্যঙ্গাত্মক, কখনো কখনো অযৌক্তিকতার সীমানা পেরিয়ে ও ডিস্টোপিয়ান দৃশ্যকল্প উপস্থাপন করে। শিল্পী তার কাজগুলো বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতেও শেয়ার করতে শুরু করেছেন। তিনি মনে করেন সোশ্যাল মিডিয়া কথোপকথন ও সংলাপের জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। সৃজনশীল কাজ সহজে প্রদর্শন করার জন্য এটি একটি দরকারি টুল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //