কাজী আনোয়ার হোসেন স্মরণ

রানা চিরঞ্জীব!

মাসুদ রানা। স্বপ্নিল, আরাধ্য এক চরিত্র। দুর্ধর্ষ। দুঃসাহসী। দেশপ্রেমিক। প্রবল আত্মপ্রত্যয়ী। অসামান্য প্রতিভাধর। গুপ্তচরবৃত্তি তার পেশা। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, কুশলী। এক ড্রিম আইকন। কঠিন কঠিন অসম্ভব চ্যালেঞ্জ নিতে অকুণ্ঠ এই দাপুটে মানুষটি।

বাংলাদেশে দশকের পর দশক ধরে বর্ণিল এই চরিত্র মুগ্ধ, বিস্মিত ও সম্মোহিত করেছে তরুণদের। দিয়েছে অফুরান প্রেরণা। নতুনত্বের আস্বাদ। উদ্বুদ্ধ, উদ্দীপিত, বুদ্ধিদীপ্ত করেছে। মাসুদ রানা সিরিজের গ্রন্থাবলি আজও জনপ্রিয়, পাঠক আদৃত। এই ধারা ও পরম্পরা অব্যাহত রয়েছে। আপন ঔজ্জ্বল্যে, শক্তিতেই টিকে থাকবে আরো বহু বহু দিন। 

মাসুদ রানা নামের আশ্চর্য গুণান্বিত অবিস্মরণীয় চরিত্রের যিনি স্রষ্টা, তার নাম কাজী আনোয়ার হোসেন। মাসুদ রানা ও কাজী আনোয়ার সমার্থক শব্দ হিসেবে খ্যাতি ও পরিচিতি পেয়েছে। এই অর্জন এই কৃতী ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সাবলীল এবং অনায়াস। বাংলাদেশে রহস্যসাহিত্যের যাত্রারম্ভ তাঁর হাত ধরে। এই ধারাটির উন্মেষ, বিকাশ, বিস্তৃতি, ব্যাপক জন আদৃতির অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছে তাঁরই নিবিড় প্রযত্ন মমত্ব ও পরিচর্যায়। নতুন জেগে ওঠা কুমারী চরের মতো এই ভুবনের একমাত্র কলম্বাস, অনুকরণীয় অগ্রপথিক তিনি।

বাংলা থ্রিলারের জনক বলা হয় তাঁকে। শুধু রহস্য রোমাঞ্চের জন্যই সিদ্ধি, খ্যাতি, কীর্তি নয় তাঁর। তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই বহুমাত্রিক, বিরল এক প্রতিভা। ভীষণ কৌতূহল উদ্দীপক, বিচিত্র, চমকপ্রদ চরিত্রের এক মজার মানুষ। সামান্য কথায় সেসবের বিশদ বর্ণনা প্রকৃতই অসম্ভব। ছিলেন একাই একশ। পথিকৃৎ এই বরেণ্য লেখক ব্যক্তিত্ব ইন্তেকাল করেছেন সম্প্রতি, ১৯ জানুয়ারি ২০২২। তাঁর জন্ম তারিখ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই।

মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে প্রথম আলোতে কাজী আনোয়ার হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ছাপা হয়েছিল ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শিবব্রত বর্মণ ও রওশন জামিল। সেখান থেকে কয়েকটি প্রশ্নোত্তর এখানে উল্লেখ করি। তাহলে ব্যক্তিমানুষ ও  মাসুদ রানার স্রষ্টাকে কিছুটা হলেও জানা বোঝা ও চেনা সম্ভবপর হবে। 

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, থ্রিলারধর্মী সাহিত্যকে অনেকে সাহিত্য হিসেবে খুব গুরুত্ব দিতে চান না, লঘু মনে করেন। মনে করেন, এগুলো শুধুই জনচাহিদা মেটায়। এ ব্যাপারে আপনার কী মত?

তাঁর উত্তর ছিল থ্রিলার আমার ভালো লাগে। সেই কৈশোরে, আজ থেকে ৭৩ বছর আগে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত শ্রী হেমেন্দ্র কুমার রায়ের লেখা ‘ঘটোৎকচ’, ‘যখের ধন’, ‘আবার যখের ধন’, ‘নৃমুণ্ডু শিকারী’ ইত্যাদি থ্রিলার বইগুলো আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলে। তার পরপরই হাতে পেলাম ‘রবিন হুড’। লেখকের নাম জানি না, সেসব খেয়াল করার বয়স ছিল না। সে বইটি অনেক খুঁজেও হাতে পাইনি আর। অপূর্ব লেগেছিল।

রবিনের মৃত্যুতে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলাম; তার বীরত্ব, সাহস, নেতৃত্ব, বিপদগ্রস্ত ও ভাগ্যহতদের প্রতি দুর্বলতা, গরিবদের সাহায্য-সহযোগিতা, নারীর প্রতি সম্মান- এইসব গুণের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এই বইগুলো আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে আজও সে মোহের জাল কেটে বেরোতে পারিনি, চিরকিশোর রয়ে গেছি। লঘু বলেন বা বলেন অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য; আমি আমার ভালোবাসার জগতে দিব্যি আরামে ও আনন্দে বিচরণ করছি আজীবন।

প্রশ্ন ছিল প্রবল জনপ্রিয় মাসুদ রানার স্রষ্টা আপনি। ৫০ বছরেরও বেশি আগে লিখতে শুরু করেছিলেন এই সিরিজ। এখন তো দুনিয়া পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আজ থেকে ৩০ বছর পর মানুষ কি আর মাসুদ রানা পড়বে? পড়লে কেন পড়বে বলে আপনার মনে হয়?

কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, সুদীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে পাঠক মাসুদ রানা পড়েছে এবং মজা পেয়েছে। এখনো সেই প্রথম বই ‘কুয়াশা’, ‘ধ্বংস পাহাড়’এর মতোই নতুন বইগুলো যারা সাগ্রহে কিনে পড়ছে, তাদের মধ্যে নিত্যনতুন কিশোর আছে, তাদের স্বপ্নের বাগান ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করে দিচ্ছে সেবা প্রকাশনী; আগামী ৩০ বছরেই তাদের সব আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মনে করি না।

নিজে থাকব না; কিন্তু যাদের গড়ে-পিটে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি, আমি জানি, তারা আরও বহুদিন টিকিয়ে রাখবে সেবা ও তার সিরিজগুলোকে। তাছাড়া, আমার খাতিরে বা আমার মুখ চেয়ে পাঠকেরা এসব বই কিনে পড়ছেন, ব্যাপারটা তা তো নয়, নিশ্চয়ই এসব কাহিনীর ভেতর অন্তর্নিহিত বিশেষ কিছু আকর্ষণ ও আবেদন রয়েছে, যেগুলো সমালোচকদের চোখ এড়িয়ে গেছে। 

তা না হলে যেসব সুসাহিত্যিক এতদিন মাসুদ রানার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে নিজেদের অনেক উঁচুতে তুললেন, এতগুলো বছর চেষ্টা করেও তাঁরা কি পাঠকদের এসব বাজে লেখা থেকে সরিয়ে নিজেদের লেখার প্রতি টানতে পেরেছেন? না। তাঁদের বিচরণক্ষেত্র ভিন্ন, কৈশোর পেরিয়ে তবেই না পরিণত বয়সে পৌঁছাবে মানুষ। আমিই কি কিশোর পাঠকদের চিরকৈশোরে ধরে রাখতে পারছি, ঠেলে দিচ্ছি না তাদের দিকে? ৩০ কেন, আগামী ৬০ বছরেও সেবার প্রয়োজন ফুরাবে বলে মনে করি না।

জানতে চাওয়া হয়েছিল শুরুর কয়েকটি উপন্যাস বাদ দিলে আপনার মাসুদ রানার কাহিনীগুলো সবই ধার করা। বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বন। মৌলিক মাসুদ রানা লিখলেন না কেন?

উত্তরে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন মূল কারণ, আমার অভিজ্ঞতার অভাব। মাসুদ রানা বইয়ে যেসব দেশের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, ঘটনার কথা, জটিল পরিস্থিতির কথা থাকে, সেসব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একজন মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিদেশি কাহিনীর সাহায্য আমাকে নিতেই হয়েছে। কিন্তু বিদেশি সবকিছু আমাদের এখানে মানায়ও না।

মাসুদ রানার ৪৫৭তম সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে এখন। ৪৫৭! ভাবুন একবার। প্রথম দিকে মৌলিক রানা লেখার চেষ্টা করেছি। তারপরেই বুঝে গেলাম, বিদেশি কাহিনীর ছায়া না নিয়ে কোনো উপায় নেই। সবটা নেওয়া যাবে না; রগরগে যৌনতা আমাদের সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য নয়, যে বিষয়গুলো চলবে, তত টুকুর ছায়া নিয়ে নিজের মতো করে রচনা করতে হবে বাঙালি মাসুদ রানার চরিত্র।

এই একই সমস্যায় পশ্চিম বাংলার বড় বড় সাহিত্যিকও পড়েছিলেন বলে অকাতরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস, লেসলি চার্টারিসের দ্য সেইন্ট, অ্যান্থনি হোপের দ্য প্রিজনার অব- এমন আরও অসংখ্য বিদেশি লেখকের বই আত্তীকরণে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

শুধু থ্রিলার সাহিত্য কেন, এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, নাচ-গান-বাজনা-সিনেমা-ছবি-ভাস্কর্য, অর্থাৎ যা কিছু সুন্দর, সব ধরনের শিল্প সৃষ্টির ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে ক্রমে। কিসের করাল গ্রাস গিলে খাচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধ, সেটা বাঙালিকে বুঝতে হবে। আমি তো চলেই যাব, যাঁরা এখানে থাকবেন, তাঁদের সতর্ক হওয়ার কিন্তু এখনই সময়।

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডার বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরার কাজ দীর্ঘদিন ধরেই করছে আপনার সেবা প্রকাশনী। এর অনুবাদগুলোর ঝরঝরে ভাষা। কিন্তু অনেকে বলেন, এখন সেবা প্রকাশনী থেকে ভালো অনুবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ কী?

কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না। সেবা আর অনুবাদ ছাপছে না? নাকি, ছাপছে কিন্তু সেগুলো ভালো হচ্ছে না? যাকগে, এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আমি তো ভালো জেনেই ছাপছি। যাঁরা এ কথা বলেন, কারণটাও নিশ্চয়ই আমার চেয়ে তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।

ব্যাপারটা বনফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ গল্পের মতোও হতে পারে। যাঁরা আগে একসময়ে মুগ্ধ হয়েছেন, এখন তাঁদের কাছে ভালো না লাগারই তো কথা। তাঁরা তো আর সেই মানুষটি নেই, বয়স হয়েছে, মন-মানসিকতা ও বুদ্ধির বিকাশ হয়েছে, বদলে গেছেন। তিনি কেন এখন পড়তে যাবেন এসব?

প্রশ্ন ছিল স্পাই থ্রিলার ঘরানায় ইংরেজি ভাষায় অনেক সফল লেখকের দেখা মেলে। যেমন- ইয়ান ফ্লেমিং, জেমস হেডলি চেজ, টম ক্লেনেসি, ল্যাডলাম বা কিছু পরিমাণে জন লে কারে; কিন্তু বাংলায় কাজী আনোয়ার হোসেন ছাড়া আর সফল কাউকে দেখা যায় না। কারণ কী?

কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন কী বলব। মনে হয় আমাদের লেখকরা ঘাপটি মেরে থাকেন ভ্রুকুটির ভয়ে। সুসাহিত্যিকরা যদি এসব লেখাকে ছোট নজরে না দেখতেন, তাহলে হয়তো ইতোমধ্যেই আরও কয়েকটা কাজী আনোয়ার হোসেন গজিয়ে যেত।

একজন প্রকাশক হিসেবে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজটিকে আপনি কতটা গুরুত্ব দেন? সেবা প্রকাশনী এই কাজটি কীভাবে সম্পাদন করেন এই প্রশ্নের উত্তরে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন সম্পাদনার কাজটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ, একটি বই কেবল আনন্দই দিচ্ছে না, পাঠককে নানা ধরনের শিক্ষাও দিচ্ছে। তবে সম্পাদনা যিনি করবেন, তাঁর সে কাজের যোগ্যতা থাকা অপরিহার্য। প্রায় সব লেখকের লেখাতেই ভুল থাকে।

বিদেশের মতো আমরাও যদি সুশিক্ষিত, উপযুক্ত সম্পাদক নিয়োগ দিতে পারতাম, তাহলে ভালো হতো; কিন্তু আমাদের বাজার ছোট বলে পারি না। শ্রদ্ধেয় চিত্তরঞ্জন সাহা তাঁর প্রকাশনী মুক্তধারায় এই চেষ্টা করে দেখেছেন, কিন্তু তেমন ভালো ফল পাননি। একজন উপযুক্ত সম্পাদককে যে পরিমাণ সম্মানী দেওয়া উচিত, তার দশ ভাগের এক ভাগও তো আমরা দিতে পারি না।

অনুবাদ সাহিত্যেও অদ্বিতীয়

কাজী আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পরপর প্রকাশিত হয়েছে কথাশিল্পী শাহরিয়ার কবিরের একটি স্মৃতিচারণা। সেখান থেকেও খানিকটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করতে চাই। সেই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে স্পর্শকাতর অনেক প্রসঙ্গ। কাজী আনোয়ার হোসেনের বিশেষ প্রীতিভাজন, অনুজপ্রতিম কথাশিল্পী শাহরিয়ার কবির লিখেছেন,

“...‘মাসুদ রানা’ সৃজনশীল সাহিত্য নয় বলে সমালোচকরা যতই উপেক্ষা করুন, তিনি কখনো এ নিয়ে বিচলিত বোধ করেননি। অন্তর্মুখী প্রচারবিমুখ এই লেখকের যথার্থ মূল্যায়ন কখনো হয়নি। আমাদের বাংলাদেশের বইয়ের বাজার যখন পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেই সময় সেগুনবাগিচায় তিন মহলা পৈতৃক বাড়ির পাশে একটি টিনের চালায় সেবা প্রকাশনী স্থাপন করে প্রথমে গোয়েন্দা ‘কুয়াশা’ সিরিজ এবং পরে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ লেখা আরম্ভ করেন।

তরুণদের যেমন তিনি বই পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করেছেন, ঢাকায় ভারতীয় বইয়ের অবাধ বাজারও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে কিংবদন্তির জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, কাজী আনোয়ার হোসেন তাঁকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন।

তিনি পশ্চিমের বিভিন্ন ভাষার কালজয়ী সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যেও তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর মতো স্মার্ট গদ্য খুব কম লেখকই লিখেছেন। গল্প-উপন্যাসে চরিত্রাবলির সংলাপ কিংবা বর্ণনার বাক্যগঠনে তিনি নিজস্ব রীতি সৃষ্টি করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বহু লেখককে প্রভাবিত করেছে।

‘মাসুদ রানা’ সিরিজে বইয়ের সংখ্যা পাঁচ শ’র মতো। এর ভেতর প্রথম দুটি তাঁর মৌলিক রচনা, পরেরগুলো ইয়ান ফ্লেমিং, জেমস হেডলি চেজ, অ্যালিস্টার ম্যাকলিন, ডেসম-ব্যগলি, নিক কার্টার প্রমুখ জনপ্রিয় থ্রিলার লেখকদের বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বনে লেখা। একই বইয়ের জন্য তিনি একাধিক পশ্চিমা থ্রিলারের সাহায্য নিয়েছেন।

তবে নায়ক মাসুদ রানা কিংবা সিরিজের অন্যান্য প্রধান চরিত্র- জেনারেল রাহাত খান, কবীর চৌধুরী, সোনিয়া, গিল্টি মিয়া ইত্যাদি একান্তই তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। কাহিনীর দেশীয়করণে তিনি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন।

সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস পাহাড়’ লেখার আগে কাহিনীর পটভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার মোটরসাইকেলে চষে বেড়িয়েছেন। তাঁর রোমাঞ্চকর এই ভ্রমণের বর্ণনা শুনে মুগ্ধ হয়ে ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ লেখার সময় না দেখেই আমার প্রথম কিশোর রহস্য উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে কক্সবাজারকে বেছে নিয়েছিলাম। 

‘মাসুদ রানা’ প্রথম থেকেই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কাজী আনোয়ার হোসেন ভেবেছিলেন, বছরে একটা ‘রানা’ সিরিজ, একটা ‘কুয়াশা’ সিরিজ এবং অন্যান্য বই লিখবেন। ‘রানা’র অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তায় প্রথম দিকে কখনো তিন মাসে, কখনো চার মাসেও ‘মাসুদ রানা’র নতুন বই লিখতে হয়েছে।

পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে শ্রম লাঘবের জন্য তাঁকে লেখক ভাড়া করতে হয়েছে এবং কাহিনীর নতুনত্বের জন্য পশ্চিমা স্পাই থ্রিলার লেখকদের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। পশ্চিমের অনেক জনপ্রিয় লেখকের ‘ঘোস্ট রাইটার’ থাকে।

বাংলা রোমাঞ্চ-রহস্য-গোয়েন্দা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিদেশি সাহিত্য অবলম্বন করে লেখা অভিনব কোনো বিষয় নয়। আমাদের গোয়েন্দা ও রহস্য সাহিত্যের পথিকৃৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর দীনেন্দ্রকুমার রায়, জগদানন্দ রায়, পাঁচকড়ি দে কিংবা হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অনেক রচনাই বিষয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমা গোয়েন্দা সাহিত্যের শরণ নিয়েছে।

এদের ভেতর সবচেয়ে জনপ্রিয় দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯-১৯৪৩) তাঁর ‘রহস্য লহরী’ সিরিজের গোয়েন্দা রবার্ট ব্লেককে সৃষ্টি করেছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সিরিজ সেক্সটন ব্লেক সিরিজের নায়কের আদলে, যে সিরিজের লেখকসংখ্যা এক ডজনের বেশি।

কাজী আনোয়ার হোসেনের জোগান দেওয়া কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের বই লিখেছেন শাহাদত চৌধুরী, শেখ আবদুর রহমান, রাহাত খান, কাজী মাহবুব হোসেন, শেখ আবদুল হাকিম এবং আরও অনেকে।

এঁদের লেখার পর পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ পরিমার্জন করতেন ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। ভিন্ন ভিন্ন লেখকের ভাষারীতির তারতম্য যা থাকত, মূল লেখক সেগুলো ঘুচিয়ে দিতেন। যে কারণে পাঠকদের পক্ষে কখনো জানা সম্ভব হতো না, কাজী আনোয়ার হোসেন ছাড়া অন্য কেউ ‘মাসুদ রানা’ লিখেছেন।

শেষ জীবনে তাঁর বিরুদ্ধে ‘মাসুদ রানা’র একজন ঘোস্ট রাইটার বা ‘চুক্তিবদ্ধ লেখক’ শেখ আবদুল হাকিমের কপিরাইট মামলা তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। ১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ করার কারণে সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদকের পদ থেকে আমাকে বরখাস্ত করার পর মতিঝিল, সেগুনবাগিচা এলাকায় যাওয়ার তাগিদ কমে গিয়েছিল।

আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। তবে পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে শেখ আবদুল হাকিমের মামলার খবর শুনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনকে ফোন করে জানিয়েছিলাম, প্রয়োজন হলে আমি তাঁর পক্ষে আদালতে সাক্ষ্য দেব- ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা তিনি ছাড়া আর কেউ নন। অন্তর্মুখী কাজী আনোয়ার হোসেন এই মামলায় ব্যথিত হলেও খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি।’

ব্যক্তিত্বের বহুমুখিতা

বহু গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এক মানুষের মধ্যে এত বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য সত্যিই বিরল ঘটনা। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ছিলেন। বেতারে গান গাইতেন। প্লেব্যাক করেছেন সিনেমায়। রেডিওতে গাইতেন মূলত নজরুলসংগীত ও আধুনিক গান। জননন্দিত ছায়াছবি ‘সুতরাং’এ তিনি গেয়েছেন ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস...’ গান। উর্দু ছবি ‘তালাশ’এ তাঁর গাওয়া একটি গান ‘ম্যায় হু রিকশাওয়ালা বেচারা’ গানটি শ্রোতাদের মন জয় করেছিল। দারুণ বংশীবাদক ছিলেন। গিটারে সুরের ঝঙ্কার তুলতেও ছিলেন পারদর্শী।

সুগায়ক হিসেবে স্বীকৃতি ও কদর পাওয়া সত্ত্বেও গানের ভুবনে থিতু হন নি। বেশ বুঝতে পেরেছিলেন এই পেশায় জীবনযাপন সম্ভবপর নয়। চাকরিবাকরির ধরাবাঁধা পথে হাঁটলেন না। মোটেও পছন্দ ছিল না সেসব। স্বনির্ভরতা অর্জনই তাঁর স্বপ্ন। শুরু করলেন প্রেস ব্যবসা। সেটা ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।

বাবার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগান প্রেসের সূচনা। পরবর্তীকালে নাম পালটে সেটা হয় সেবা প্রকাশনী। আট হাজার টাকায় কিনলেন একটি ট্রেডল মেশিন। বাকি যা রইল, তা দিয়ে কেনা হলো টাইপ। কর্মীসংখ্যা দুই। এই সেবা প্রকাশনীই বাংলাদেশে পেপারব্যাক বই প্রকাশ শুরু করে। সুলভমূল্যে, সহজ ভাষা, নাটকীয় কাহিনী, আকর্ষণীয় বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে দুর্দান্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে সেবার যাবতীয় বই।

তারপর দীর্ঘ পথচলা। নতুন পথ। অপ্রচলিত সেই ধারা, যাত্রাপথ অতীব দুর্গম। অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠায় ভরপুর। সে এক দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ।  বাধা বিপত্তি, প্রতিকূলতা সব কিছু মোকাবেলা করলেন অদম্য মনোবল, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সৃষ্টিশীলতার অনন্য বৈভব দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের সেই যে গান আছে না- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে... একাকী, বন্ধুর অভিযাত্রায় অচিন সব চড়াই উৎরাই পার হওয়া।

কত নতুন লেখক যে তিনি তৈরি করেছেন, তার শুমার করা মুশকিল। পাঠকও সৃষ্টি করেছেন এন্তার। তরুণরাই নন শুধু, বয়স্করাও তাঁর স্বাদু রচনার অনুরাগী। দশকের পর দশক ব্যাপকসংখ্যক পাঠক সৃষ্টির কৃতিত্বও নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ এই মানুষটিকে দিতে হবে। সহজ প্রাঞ্জল  সুবোধ্য গদ্যরীতি তাঁর নিজের এবং তাঁর প্রকাশনীর লেখকমণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য। এই প্রকাশনীর প্রতিটি বই সুসম্পাদিত। 

গত শতাব্দীর ষাট দশকে কতটা পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল বাঙালি মুসলমানের সমাজ? এখন সেটা কল্পনা করাও কঠিন। সেই রক্ষণশীলতার দুর্গে আঘাত হানে মাসুদ রানা সিরিজ। লুকিয়ে লুকিয়ে ‘আউট বই’ পড়বার প্রবণতা বাড়ে তরুণসমাজে। দ্রুত সেটা ছড়িয়ে পড়ে দেশের সকল জনপদে। রক্ষণশীল সমাজে ‘মাসুদ রানা’ প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তৎকালে গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ সমাজ মোটেও আধুনিকমনস্ক ছিল না। রহস্য-রোমাঞ্চ- অভিযান তো আছেই।

তার সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী নানা উপাদান- হজম করা কঠিনই ছিল সমাজপতি অভিভাবকদের পক্ষে। কিন্তু তারুণ্যের উদ্যমতা এসবের থোড়াই কেয়ার করে। ফলত সর্বপ্লাবী হয়ে ওঠে থ্রিলারের জনপ্রিয়তা ও কদর। ক্রেতা-পাঠকের  বিপুল সমর্থন নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে কাজী আনোয়ার হোসেনের নতুনত্ব পিয়াসী আধুনিকতামণ্ডিত মিশন।

আজীবন পারফেকশনিস্ট ছিলেন। যে কাজই করতেন, মনপ্রাণ ঢেলে করতেন। ফলে সিদ্ধি ও সাফল্য ধরা দিতই। টেবিল টেনিস খেলতেন। পাকা শিকারি ছিলেন। সেই ঝোঁক ছিল মারাত্মক। শখ মেটাতে সঙ্গীদের নিয়ে প্রায়শই চলে যেতেন দূর দূরান্তে। যমুনার চর, বিল ঝিল, হাওর বাঁওড়ে। শিকারের কাজে তিনি ব্যবহার করতেন টু টু বোরের রাইফেল। কার্টিজ বন্দুক। সদস্য হয়েছিলেন শুটিং ক্লাবের। নিবিষ্ট মনোযোগের কারণে সিদ্ধি ও সাফল্য অর্জন করেছিলেন অনায়াসেই।

মাছ ধরা ছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের একসময়কার প্রবল নেশা। ব্যাপক পড়াশোনা করেছেন এই বিষয়ে। পড়তেন বিশ্বের নামকরা অ্যাংলারদের গল্পকথা। এক্ষেত্রে এতটাই ঝানু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন যে, পানির প্রবাহ দেখে বলে দিতে পারতেন, ওখানে কী ধরনের মাছ রয়েছে। মেডিটেশনে ব্রতী ছিলেন আমৃত্যু। নিয়মিত ধ্যান করতেন।

আমাদের এই বাংলাদেশে মেডিটেশনকে জনপ্রিয় করে তোলার কাজেও অবদান ও ভূমিকা তাঁর যথেষ্ট। গুণগ্রাহী ছিলেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের। এই সংস্থার সূচনাপর্বে প্রতি মঙ্গলবার মহাজাতকসহ প্রিয়জনদের সঙ্গে মেডিটেশন করতেন।  জেনে আশ্চর্য হতে হয় কাঠমিস্ত্রির কাজেও সৃষ্টিশীলতা ও নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন এক কালে। সব সময় তিনি ছিলেন আশাবাদী মানুষ। জীবনবাদী এই মানুষটি ছিলেন চিরতরুণ। সব সময় স্বপ্ন দেখতেন, অন্যদেরকেও স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসতেন তিনি।

তাঁর জীবসঙ্গিনী ছিলেন কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন। যিনি ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত তারকা নীলুফার ইয়াসমিন ও সাবিনা ইয়াসমিনের বোন। তাদের আরেক বোন ফওজিয়া ইয়াসমিনও ছিলেন নামী কণ্ঠশিল্পী। কাজী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন মারা যান ২০১৫ সালে। এই দম্পতির এক কন্যা ও দুই পুত্র।

পিতার অবর্তমানে তারা সেবা প্রকাশনীর হাল ধরেছেন। খুবই পরিতাপ ও জাতীয় লজ্জার বিষয়, জীবদ্দশায় খুব কম স্বীকৃতি সম্মাননাই জুটেছে এই গুণী মানুষটির। পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার, জাতীয় প্রেস ক্লাব সম্মাননা, সিনেমা পত্রিকা পুরস্কার, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।

কাজী আনোয়ার হোসেন বনেদি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী, পরিসংখ্যানবিদ, সাহিত্য সমালোচক, নজরুল বিশেষজ্ঞ, প্রখ্যাত দাবাড়–। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের পরম সুহৃদ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। কাজী আনোয়ার হোসেনরা চার ভাই, সাত বোন। তাঁর পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম নবাব।

কাজী আনোয়ার স্বনামে ও অন্য নামে লিখতেন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল বিদ্যুৎ মিত্র এবং শামসুদ্দীন নওয়াব। কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা আত্ম উন্নয়নমূলক বইগুলো বেশ পাঠকপ্রিয় ছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় ছিল এসব গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে ‘ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন’ বইটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।

তাঁর বোনেরাও একেকজন স্বনামধন্য। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যোবায়দা মির্জা, প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অধ্যাপক ড. সানজিদা খাতুন, অধ্যাপক ফাহমিদা খাতুন, শিল্পী মাহমুদা খাতুনের কথা অনেকেই জানেন। কাজী আনোয়ার হোসেন পড়াশোনা করেছেন ঐতিহ্যবাহী সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স পাস করেন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনী থেকে এখনো নিয়মিত বের হয় মাসিক রহস্য পত্রিকা। কিশোর পত্রিকা নামে শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা বেরুত একসময়, এখন সেই প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে।

কাজী আনোয়ার হোসেনের নিজের লেখা প্রিয় বই কোনগুলো ছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা জানতে পাচ্ছি, সে তালিকায় রয়েছে রবিনহুড, পঞ্চ রোমাঞ্চ, ছায়া অরণ্য, তিনটি উপন্যাসিকা। মাসুদ রানা সিরিজে তাঁর প্রিয় বই- স্বর্ণমৃগ, শত্রু ভয়ংকর। তাঁর প্রিয় লেখকের মধ্যে রয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ইয়ান ফ্লেমিং,অ্যালিস্টার ম্যাকলিন। তাঁর শখ: মাছ ধরা, সাঁতার কাটা।

এক্ষণে আমরা দৃকপাত করতে চাই তাঁর স্বজনদের চোখে কেমন ছিলেন তিনি। ছোট বোন মাহমুদা খাতুনের স্মৃতিচারণায় অজানা এক কাজী আনোয়ার হোসেনের পরিচয় আমরা পাই। মাহমুদা খাতুন লিখেছেন, “সেজ ভাই কাজী আনোয়ার হোসেন, যাঁকে আমি বড়দা বলেই ডাকি, তাঁকে আর নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

তিনি আইএ পড়ার সময় কুয়াশা সিরিজের দুটি রহস্য উপন্যাস লিখে বাবাকে পড়তে দেন। খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন বাবা। পাস করার পর বড়দা সে কথা মনে করে স্থির করলেন, রহস্য উপন্যাসই লিখবেন, তখন থেকে আমৃত্যু লিখেই গেছেন।

আমার বড়দা কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন একদম অন্য রকম। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার বা বাইরের ছেলেদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতেন। বাইরের জগৎ তাঁকে এতটাই টানত যে স্কুলে পড়ার সময়ই কয়েকবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। সাধারণত, কয়েকজন বন্ধু জুটিয়ে অজানা জায়গায় অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়ে যেতেন।

কখনো পাহাড়ে, কখনো সাগরতীরে, কখনো বনে। ৩/৪ দিন ঘুরে বেড়িয়ে আবার নিজেই ফিরে আসতেন। প্রথম প্রথম বাড়ির সবাই খুব চিন্তা করত। তারপর সবাই বুঝে গেল আনোয়ার ভাইয়ের স্বভাবটাই এ রকম, খুব শাসনে বেঁধে রাখা যাবে না। বড়দার এসব অ্যাডভেঞ্চারলব্ধ অভিজ্ঞতার কিছু ছোঁয়া তাঁর পরবর্তীকালের লেখার ভেতরে পাওয়া যায়।

বড় হওয়ার পর তাঁর দুটি বিষয়ে প্রবল আগ্রহ জন্মে। একটি হলো বাঁশি বাজানো। গভীর রাতে বড়দা যখন বাঁশি বাজাতেন, তার সুর পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করত।

বড়দার দ্বিতীয় শখ ছিল কবুতর পালন। এক সময় বাড়ির ছাদে শত শত কবুতর ছিল। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল সব কবুতর মরে পড়ে আছে। সম্ভবত বিড়াল কিংবা বেজিজাতীয় কোনো প্রাণী সেগুলো মেরে ফেলেছিল। ছাদ জুড়ে কবুতরের ছিন্নভিন্ন শরীর আর রক্ত। এ ঘটনা বড়দাকে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল। এরপর তিনি আর কখনো কবুতর পালেননি।

এমএ পাস করার পর সবাই যখন চাকরি খুঁজছেন, বড়দা তখন চুপচাপ বসে রইলেন। আসলে কারও অধীনে চাকরি করা তাঁর পছন্দ ছিল না; কিন্তু সবাই যখন চাকরি আর উপার্জনের কথা বলতে শুরু করলেন, ঠিক করলেন চা-বিস্কুটের দোকান দেবেন।

বাড়ির বাইরের দিকে এক কোণে একটি ঘর খালি পড়ে থাকত। তিনি সেখানে ‘বৈশাখী’ নামে চায়ের দোকান খুলে বসলেন। ওই দোকানে কতটুকু বিক্রিবাট্টা হতো আর বড়দা কাজটা কতটা পছন্দ করতেন জানি না, তবে কিছুদিন পর একদিন বাবা (কাজী মোতাহার হোসেন) তাঁর দোকানে গেলেন। বড়দাকে বললেন, ‘নবাব (বড়দার ডাকনাম), তুই যে আইএ পড়ার সময় দুটি গল্প লিখেছিলি, সেগুলো খুবই ভালো হয়েছিল। তুই সেগুলো নিয়ে ভেবে দেখতে পারিস। এখন থেকে তুই বরং রহস্য গল্পই লিখতে শুরু কর।’

বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের অনুপ্রেরণায় লিখেছিলেন ‘কুয়াশা’। বাবার অনুপ্রেরণায় বড়দার জীবন বদলে গেল। তিনি তাঁর গল্প দুটি দিয়ে নতুন একটি সিরিজ শুরু করলেন, নাম ‘কুয়াশা’। তার পরের ইতিহাস তো কমবেশি সবারই জানা। 

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //