বইমেলার শতবর্ষী গান

১৯৯২ সালের একুশের বইমেলার কথা মনে আছে। খুব কষ্ট করে ঢাকা যেতে হতো তখন। রাজশাহী থেকে ঢাকা আঠারো ঘণ্টা সময়। উদ্দেশ্য, বইমেলা ঘোরা। বইমেলা করা। তবুও ভালো লাগতো আমাদের সেই আনন্দময় বইমেলা। সে অর্থে, তখন তো অল্পদিনের বয়স ছিল বইমেলার। বাংলা একাডেমির পুকুরপাড় ঘিরে খুব চিপাচিপি করে বইমেলাটা হতো। তখনও বইমেলার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। 

সংস্কৃতি তো ‘সহজ’ কথা নয়! চলমান জীবনের বৈচিত্র্য আর স্পন্দ্যমান স্বপ্ন সংস্কৃতির সৌধ গড়ে তোলা। তাতে একপ্রকার দ্বন্দ্ব আছে। বাস্তবতাও আছে। কিন্তু তার ভেতর থেকেই উৎসবের রঙ চিনে নেওয়া যায়। উৎসবের তুলোয় ওঠে কঠিন-কঠোর সব রক্ষণশীলতার রুদ্ধতা। সেটি পেরিয়ে যায়। আর পেরোনোর পথও তৈরি করে দেয় ওই সংস্কৃতি।

সংস্কৃতির দুপাড় বেয়ে আমাদের রক্ত উতলা পথ বেয়ে বইমেলা আসে। অনেক বই তখন। মচমচে বই। নতুন বই। ছেলেদের বই, বাচ্চাদের বই, কিশোর বই। নারীদের বই। তার সাথে মিলিয়ে রঙিন সাজ সবার। বসন্তের সাজ। ওই সাজেই প্রকৃতির আগলভাঙা উদাত্ত আহ্বান গড়ে ওঠে। এই সংস্কৃতি তো আমাদের বইমেলার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি আমাদের পাঠের দিকে নিয়ে যায়। অনুরাগী করে তোলে। প্রেমবন্যায় ভাসায়। অন্তরের সাড়া তৈরি করে। একসুতোয় বেঁধে ফেলে।

কেনোকিছুই আটকে থাকে না। রাখতেও পারে না। উদার-উদাত্ত সব আহ্বান। এই তো মেলা! বইয়ের মেলা। বইয়ের সংস্কৃতি। মানুষজন ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে চলা এই বইমেলা দেখেই বইমেলার কৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়। এখন বইমেলার যে বিস্তৃতি ঘটেছে তার অবদান অবশ্যই এই বইমেলা। এখন তো এর পরিসর বেড়েছে, যোগাযোগ বেড়েছে। প্রকাশনার উৎসবও এখন বইমেলাকে ঘিরেই। এইটিই এখন ‘প্রকাশনার সিজন’।

এখন বাঙালিদের মধ্যে বইমেলার একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। নিউইয়র্কে বইমেলা, লন্ডনে- কানাডায় বইমেলা কিংবা কোনো প্রকাশনীর বইমেলা। ঋতুভিত্তিক বইমেলাও হচ্ছে, কোনো অকেশন এলেই বইমেলা। পাড়ায়, থানায়, জেলায়, বিভাগীয় শহরে বইমেলা এখন অগণ্য, বইকেনাও চলছে- হচ্ছেও। তাই আগের সংস্কৃতি এখন আর নেই।

প্রকাশনার গুণ-মান-জৌলুস বেশ এখন। গেটআপ মেকআপে নান্দনিকতা আছে। দ্রুততায় বই বের করা সম্ভব। প্রযুক্তির কল্যাণে গ্রাফিক্স এখন নিছকই বিন্যাসমাত্র। রঙ, রেখা লাগিয়ে অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু বানানো সহজ, কম সময়ে হয়ে যায় কতকিছুই। অথচ সবটা কাজই আগে কত কঠিন ও সময়ের ব্যাপার ছিল। মনোযোগ ও গভীরতার সম্পর্কও ছিল কতই না! নির্বাচনও হতো সেভাবেই। রুচি আর বিবেচনা এক না হলে তখন বই হতো না।

এসব মিলে বই, বইমেলা ও প্রকাশনার সেকাল একাল। কিন্তু প্রশ্ন, বইমেলা আমাদের কী দিচ্ছে? কার্যত প্রশ্নটি এরকম- শিক্ষার ক্ষেত্রে, গুণ-মান, চিন্তার বিবর্তন ও রুচির সীমানায় বইমেলা আমাদের কী দিচ্ছে, কতটুকু আমরা এগোতে পারছি! কীভাবে আমাদের প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে ইত্যাদি। প্রশ্নগুলো আমাদের চলতিপথের কিনারা ঘিরে ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে। কতটা সন্তুষ্ট আমরা এখন? 

ফাঙ্কফুর্ট বইমেলার কথা আমরা জানি। অনেকেই গেছেন সেখানে। বইয়ের প্রকাশ, প্রকাশনা, পাঠক, পাঠবিবেচনা, প্রদর্শনী সব মিলে সেখানে কী হয়? আর এখানে কী হয়। আমাদের বইমেলায় বই বিক্রি হয়। ক্রেতাগণ বই কেনেন। বই কিনে যে কেউ দেউলিয়া হয় না- এটা বিশ্বাস করেন। বিক্রেতাদেরও বই বেচে অখুশি হতে দেখা যায় না। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তিটা কী? প্রাপ্তি মানে বৃহৎ অর্থে সম্ভাব্য প্রজন্মের ভেতরের অর্জনটুকু কী- কতটুকু? কল্পনা ছাড়া কৃষ্টি তৈরি হয় না।

বিজ্ঞানী কিংবা লেখক, প্রকৌশলী-ডাক্তার হয় না। কল্পনাই মনুষ্যশক্তির আধার। সেইটিই তাকে জীবিত রাখে। মানুষকে বিনির্মাণে সহায়তা দেয়। এগুলো সাধারণ গৎবাঁধা কথা। মোটা দাগের এসব কথা বরাবর বলতেই হয়। কিন্তু বই প্রকাশের কিছু নিয়ম আছে। প্রকাশনারও আছে। ইচ্ছে করলেই কোনো বইয়ের প্রকাশক হওয়া যায় না।

আর একটি বই জাতির মেরুদণ্ড গঠনের সহায়ক শক্তি। সেটি কীভাবে প্রকাশ পেল, কী তাতে লেখা আছে, লেখকের দায়বদ্ধতা কতটুকু, প্রকাশক কোন শর্তে বইটি বের করছেন- ইত্যাকার প্রশ্নগুলো এদেশে অচল, নির্বাসিত। ইচ্ছে করলেই যে কেউ প্রকাশক বনে যেতে পারেন, বইয়ের লেখকও হতে পারেন। ফলে বই প্রকাশ করা একটা ‘অকাজের কাজ’ বলে পরিগণিত।

ফলে প্রকাশক ও লেখকের সম্পর্কের মধ্যে কোনো ‘সততা’ নেই। রয়্যালটি একদম অনিয়মিত। মর্জিমাফিক। এ নিয়ে কারও কিছু বলারও নেই। কোনো নিয়ম নেই। যদি কেউ নিয়ম মানেন- সেটা নিয়মের প্রতি একধরনের করুণা-ধরনের কিছু। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি রয়্যালটি পান- তাতেও ফাঁকি আছে। সেটিও মান ও উপযোগমাফিক নয়। আর আমজনতা তো কিছুই পায় না।

তবে এক্ষেত্রে কাউকেই একপাক্ষিক দায়ী করা যায় না। আজকাল বই প্রকাশটা কারও কারও নিকট অনেকটা শখে দাঁড়িয়েছে। এই শখ মেটানোর জন্য অকাতরে অর্থ ক্ষয় করে, প্রকাশকের কাছে ধরনা দিয়ে কিংবা নির্ধারিত পরিমাণ বই বিক্রির মুচলেকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হতেও দ্বিধা করেন না। এ অংশটা আজকের বাজারে নেহায়েৎ কম নয়। ফলে প্রকাশকগণ পেয়ে বসেন।

এই যে অনৈতিক কর্মকাণ্ড এর পেছনে লাভালাভের বিকার যেমন আছে তেমনি বঞ্চনার বিষয়টিও আছে। এতে করে প্রকাশনা তথা বইয়ের জগৎ কলুষিত হচ্ছে। উৎকর্ষজ্ঞাপক বই হাতে গোনামাত্র। যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তাদের কথা অন্য। তবে এটা বিবেচ্য যে, প্রতিষ্ঠিত লেখকরা সারাকাল প্রতিষ্ঠিত থাকেন না। বা যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তারাই শুধু মানবসমাজের ভার বহনে সক্ষম হবেন, সেটাও অচল কথা। তাই নতুন লেখক, মেধাবী লেখক, উৎকর্ষজ্ঞাপক লেখক তৈরি করতে হবে, পৃষ্ঠপোষণা দিতে হবে।

প্রকাশনার নিয়মে তাদের বড় করে তুলতে হবে। এক ধরনের ‘ফেয়ারনেস’ বজায় রাখতে হবে। বড় প্রকাশনা হয়তো কিছু করেন কিন্তু অনেকেই করেন না। তবে এক্ষেত্রে বড় বা প্রতিষ্ঠিত লেখকের মতো বড় প্রকাশক নেতৃত্বশীল কাজ করবেন কিন্তু পাশাপাশি তো উঠতি বা নতুন প্রকাশকদেরও জায়গা ও রুচির শিক্ষাটা দেবেন তারা। যেখানে ঔদার্যটুকু বহাল থাকবে।

ছোট লেখক বা অপ্রতিষ্ঠিত লেখক, অপ্রতিষ্ঠিত প্রকাশক বা ছোট প্রকাশক যেমন নির্ধারিত রুচি চিন্তা ও মননের ভেতর দিয়ে বড় হবেন- সেই বড় হওয়ার পথে বড়রা সহায়তা দেবেন- এই তো সত্য! সেটি হচ্ছে না। বইমেলা সে সংস্কৃতিটুকু তৈরি করতে পারত। কিন্তু তা হচ্ছে না। বইমেলায় অসৎ প্রকাশ অসৎ লেখকগণ লাগামহীন, দায়সারাভাবে যা খুশি তাই করে যাচ্ছেন। কেউ কোনো ন্যূনতম নিয়মের তোয়াক্কা করেন না, করছেন না। আর বইমেলা নিয়ে আদৌ কোনো স্বপ্নও নেই।

কর্তব্যক্তিরা এইসব মেলার সংস্কৃতি গড়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেন না। আজকাল তা তেমন দেখা যায় না। সময় নেই তাদের। সময় খুব কম। ফলে বছর ঘুরে বইমেলা আসে কিন্তু লেখক-প্রকাশকের কিছু নেই- শুধু ব্যবসায়িক চিন্তা ছাড়া, বইবিক্রির সামর্থ্যটুকুর ভাবনাচিন্তা ছাড়া। বাংলা একাডেমি নতুন কিছু করছে না। মান-গুণ পড়ে গেছে। পুরস্কার নিয়ে সমাজে আছে নানা অসন্তুষ্টি।

বই প্রকাশেও সততা নেই। ভালো বইয়ের চেয়ে বড় কথা ‘সম্পর্ক’, সেভাবেই বইপত্র প্রকাশ হয়। বাংলা একাডেমির প্রকাশনাও নান্দনিকতা হারিয়েছে। বরং এর বাইরে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া প্রকাশকদের মান ও রুচি বেশ উন্নত। তারা ঝুঁকিও নেন। বস্তুত এখন আস্থার জায়গা ব্যক্তি উদ্যোগের ক্ষেত্রটিতে। ব্যক্তি উদ্যোগে ভালো কাজ হচ্ছে। যেখানে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় হার মানছে।

বইমেলার আয়োজন করে বাংলা একাডেমি- এ নিয়ে এতকাল পর এ নিয়ে একাডেমির গর্ব করার কিছু নেই। এটার সাফল্য বা ব্যর্থতার পেছনেও বাংলা একাডেমি নিয়ন্তা নয়। সবটাই ব্যক্তি উদ্যোগ ও সামষ্টিক মানুষের সংস্কৃতির প্রশ্নে যা দৃশ্যমান হচ্ছে তাই। এর বাইরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কৃতিত্ব নেই, বলা যায়। তবুও এইটুকুই অর্জন। সবকিছু ভেঙে পড়ার মুখে এইটুকুই আশা ও উন্নতি। তবে অনেক কিছু হতে পারতো।

আমরা ১৯৯২ থেকে আজ পর্যন্তও যদি ধরি কতগুলো বছর- লেখক-প্রকাশক-পাঠক কতটুকু এগিয়েছে- এই সময়ে- কিংবা এই বইমেলা কী দিয়েছে, এ প্রশ্নটা করা অসমীচীন নয়! এর উত্তর কী? বইমেলায় অনেক মানুষ আসছে, বাচ্চাদের বই বিক্রি হচ্ছে- অভিধান বিক্রি হচ্ছে কিংবা বিক্রির তালিকা হচ্ছে- এই কি বইমেলার অর্জন? আমরা কি এতেই সন্তুষ্ট? একুশের চেতনার প্রতিষ্ঠা কি এতেই সম্পন্ন? বইমেলাকে ঘিরে এমন প্রশ্নের এখন সময় এসেছে। কারণ এর বয়স নেহায়েৎ কম হয়নি! 

প্রকাশক তৈরি হওয়া, লেখক তৈরি হওয়া- তবুও এই বিচ্ছিন্নতার ভেতর সুখের খবর। কিন্তু সে সুখে আনন্দ নেই। কারণ অধিকাংশ কর্মেই সততা কম। আত্মপ্রচার, বাহুল্য, বিকৃতির দার্ঢ্য বেশি। জবাবদিহিতা নিজের কাছে যেমন নেই, সমাজের কাছেও নেই। শুধু নিজের লাভ- ব্যবসায়িক লাভ- এই ‘লাভ’ চিন্তাটাই সর্বক্ষেত্রে সর্বনাশ ডেকে আনছে। বইমেলার সেখানেই হার হয়েছে। এটা আজকাল টের পাওয়া যায়।

সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই যা ঘটছে, এখানেও হয়তো তাই ঘটছে- কিন্তু বাংলা একাডেমির তাবৎ কর্মকাণ্ড, প্রকাশকদের কর্মকাণ্ড, নানারকম লেখক গজানোর ও পৃষ্ঠপোষণার হাল, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের স্বার্থপরতা- সবকিছু মিলেই বইমেলার রুগ্নরূপটি এখন চোখে পড়ে। যে রুগ্নতা সমাজে- সেই রুগ্নতা বইমেলায়। এটা এখন অদৃশ্যমান নয়। অস্বীকৃতও নয়। অনস্বীকার্যই বটে। কিন্তু এ থেকে ফেরার উপায় কোথায়! পার্টি/দল/রাজনীতিও এ রুগ্নতার পথকে আরও টেনে নিম্নগামী করছে। সবটাই ব্যবসা।

ব্যবসায়ীর চরিত্র প্রত্যেককেই গ্রাস করছে, আর অপচ্ছায়া নেমে আসছে তাতে। কারও নাম নেওয়ার অবকাশ নেই- কিন্তু যা চলছে, তাতে শ্রদ্ধা-বিবেকের অপচয় কীভাবে ঘটছে- আমরা কি তা জানি! এসব থেকে যতদিন আমরা না বেরুব ততদিন বইমেলা জৌলুস হারাবে, পিছিয়ে যাবে, পেছনমুখো হবে। তখন হয়তো আমরা দেখব বিবেকবান মানুষজনও তখন বইমেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই হল্লারোল মুষ্টিমেয় প্রথাগত একই মানুষের চলাফেরায় অনতিক্রান্ত বৃত্তে পরিণত হচ্ছে।

কিছু ভোল ধরা পোশাকী মানুষ কোনো অনুৎপাদিত অনুসন্ধানে কিছু উচ্ছিষ্ট চেটেপুটে খাওয়ার লোভে অনাহূত কোনো কারণ ছাড়াই ঘোরাফেরা করছে। আর নান্দনিকতা বা সংস্কৃতিবা মানুষ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য পথে চলছে- সে পথে বইমেলা নেই, বইয়ের উৎসব নেই, আলোচনা-আড্ডার সুখ নেই আছে শুধু পেছন ফেরানো হাহাকার, হৃতোচ্ছ্বাস। এমনটা আমরা কায়মনোবাক্যে চাই না। 

বইমেলা প্রকৃতসত্যে ফিরুক; ফিরে আসে, বিশাল ঔদার্যে পুনর্গঠিত হোক, মানুষের মিলনমেলায় জীবন ও কৃষ্টি গড়ে উঠুক। এক কথায় প্রাণের যোগটুকু থাক, অমলিক হোক, কোথাও যেমন মুখ থুবড়ে না পড়ে। সবাইকে নিয়ে সকলের হোক। সেটাই আমাদের বইমেলা, একুশের চেতনা, মাতৃভাষা রক্ষার চেতনা- আর সেটাই তো শতবর্ষী আয়ুর গান- এর বাইরে এ মুহূর্তে আর কী বলার আছে! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //