দুর্লভ রচনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: ১৯২৭-১৯৩১

বুদ্ধদেব বসু- একজন বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী অন্যতম কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত। তবে সাহিত্য সমালোচনা ও কবিতা পত্রিকার প্রকাশ ও সম্পাদনার জন্য তিনি বিশেষভাবে সম্মানীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশাতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে এসে যারা লেখালেখি করেছেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসুকে ‘সব্যসাচী লেখক’ বলা হয়।বুদ্ধদেব বসুর জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৯০৮ সালে কুমিল্লায়। তিনি ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। অধ্যাপনার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি জীবনের শেষ অবধি নানা কাজ-কর্মে জড়িত ছিলেন। শিক্ষকতাই তার মূল পেশা। কবিদের অভিভাবক এই কবি ও সাহিত্য সমালোচক ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ জগতের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান।

লেখাটি ১৯৭৩ পূজা-সংখ্যা ‘দেশ’-এ প্রকাশিত ‘আমার যৌবন’ থেকে নেয়া হয়েছে:

কার্জন-কল্পিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে তৈরি হয়েছিলো রমনা- অনেকের মুখে তখনো নাম ছিলো ‘নিউ টাউন’। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমলে এখানেই অধিষ্ঠিত ছিলো ঢাকা কলেজ; বঙ্গভঙ্গ ভেস্তে যাওয়ার প্রায় দেড় দশক পর, সেই পুরনো বিদ্যাপীঠকে কেন্দ্র করে, স্থাপিত হলো নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়- নবনির্মিত অব্যবহৃত হর্ম্যসমূহ প্রাণপ্রাপ্ত হলো।

রেল-লাইন থেকে শহরের উত্তরতম প্রান্ত পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি; উত্তর অংশটি সরকারি কেষ্টবিষ্টুদের বাসভূমি, মধ্যিখানে আছে বিলেতি ব্যসন, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, গল্ফ-খেলার মাঠ, আছে ঢাকার নাগরিকদের পক্ষে অপ্রবেশ্য ঢাকা ক্লাব, যেখানে মদ্যবিলাসী বল-নৃত্যপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষ ও নারায়ণগঞ্জের পাটকল-চালক ফিরিঙ্গিরা নৈশ আসরে মিলিত হন, আর আছে কাননবেষ্টিত উন্নতচূড়া একটি কালীমন্দির, যেখানে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অর্ঘ্য দিতে আসেন শাহ-বাগের মাকে- সেই দিব্য ভাবান্বিত ব্রাহ্মণী, যিনি পরবর্তীকালে ‘মা আনন্দময়ী’ নামে সর্বভারতে বিখ্যাত হন।

কিন্তু দক্ষিণ অংশটি পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারভুক্ত; সেখানে ছাত্র এবং অধ্যাপক ছাড়া ভিড় দেখা যায় শুধু শীতে ও বর্ষায় শনিবারগুলির অপরাহ্ণে, যখন ‘জুয়াড়ি’ এবং বেশ্যায় বোঝাই খড়খড়ি তোলা ঘোড়ার গাড়ি ছোটে অনবরত ‘রেস-কোর্সের’ দিকে-শান্ত রমনাকে মুর্দিত ক’রে, কলেজ-ফেরত আমাদের চোখে-মুখে কর্কশ ধুলো ছিটিয়ে দিয়ে। আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ অন্তরঙ্গ ক্যাম্পাসটিতে ঐ একই বই অপলাপ ছিলো না।

ভিতরে বাইরে জমকালো এক ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নিখিল বাংলার একমাত্র উদ্যান-নগরে পনেরো কুড়িটি অট্টালিকা নিয়ে ছড়িয়ে আছে তার কলেজ-বাড়ি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রাবাস- ফাঁকে-ফাঁকে সবুজ মাঠ বিস্তীর্ণ। ইংল্যান্ডদেশীয় পল্লী কুটিরের মতো ঢালু ছাদের এক-একটি দোতলা বাড়ি- নয়নহরণ, বাগানসম্পন্ন: সেখানে, কর্মস্থলের অতি সন্নিকটে বাস করেন আমাদের প্রধান অধ্যাপকেরা; অন্যদের জন্যও নীলক্ষেতে ব্যবস্থা অতি সুন্দর।

স্থাপত্যে কোনো একঘেয়েমি নেই, সরণি ও উদ্যান রচনায় নয়াদিল্লির জ্যামিতিক দুঃস্বপ্ন স্থান পায়নি। বিজ্ঞানভবনগুলি আরক্তিম ও তুর্কি শৈলীতে অলঙ্কৃত। অন্যান্য বিভাগ স্থান পেয়েছে একটি বহুপক্ষযুক্ত দীর্ঘাকার শাদা দোতলার একতলায়- সরকারি সেক্রেটারিয়েট হবার জন্য তৈরি হয়েছিলো বাড়িটি। সর্বত্র প্রচুর স্থান, ঘেঁষাঘেঁষি ঠেলাঠেলির কোনো কথাই ওঠে না। ভিতরকার ব্যবস্থাপনাও উচ্চাঙ্গের। ঘরে ঘরে বিরাজ করছেন নানা-নামাঙ্কিত কর্তৃবৃন্দ: ডিন, প্রভোষ্ট, প্রক্টর এবং বিভাগীয় শীর্ষস্থানীয়েরা ক্বচিৎ-দৃষ্ট, ক্বচিৎ-শ্রুত ও ক্বচিৎ-কথিত উপাচার্য মহোদয়ের কথা ছেড়েই দিচ্ছি।

এঁদের কোনজনের সঙ্গে বিদ্যার্থী ঠিক কোন সূত্রে যুক্ত হয়ে আছে, তা সমঝে নিতে নতুন-ভর্তির বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। আক্ষরিক অর্থে আবাসিক নয়, কিন্তু গড়ন কিছুটা সেই ছাঁদের; যে-সব ছাত্র স্বগৃহবাসী শহরের নানা অঞ্চল থেকে সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসে, তাদের সংলগ্ন থাকতে হয় কোনো-না কোনো হল্ অথবা হুস্টেলে- তাদের প্রাচীরাতিরিক্ত ক্রিয়াকর্মের সেটাই হ’লো ঘটনাস্থল। সেখানে আছে গ্রন্থাগার ও রঙ্গালয় ও ক্রীড়াঙ্গন; অনুষ্ঠিত হয় বিতর্ক-সভা, 

সঙ্গীত-প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ভোজ ও আরো অনেক সময়োচিত অধিবেশন; সেখানকার নাট্যাভিনয় দেখতে নগরবাসীরাও সোৎসাহে সমবেত হন। ক্লাশ ফুরোনোমাত্র কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক চুকলো, এমন এখানে হতেই পারে না- কেননা প্রায়ই আমাদের ফিরে আসতে হয় কোনো না-কোনো সান্ধ্য অনুষ্ঠানে- মনোজ্ঞ না হোক অন্ততপক্ষে কৌতূহলজনক। আর যেহেতু ছাত্রেরাই এই অনুষ্ঠানগুলির আয়োজক ও প্রযোজক, এবং মাস্টারমশাইরাও কেউ-না-কেউ উপস্থিত থাকেন ও অংশও নেন মাঝে-মাঝে, তাই ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটি পারিবারিক সান্নিধ্যবোধ অনুভূত হয়। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের খাশমহলেও মনোরঞ্জনী উপাচার ছিলো। মনে পড়ে, ছাত্রদের কমনরুমটিতে প্রথম ঢুকে আমি চমকে গিয়েছিলাম, আমাদেরই বিশ্রামের জন্য এই ব্যবস্থা তা প্রায় বিশ্বাস করতে পারিনি। ঘরটি দুই কামরায় বিভক্ত, আয়তনে বিশাল ও আসবাবপত্রে ঋদ্ধিশালী। প্রধান কক্ষটিতে সারি-সারি আরাম-কেদারা সাজানো, টেবিলে-টেবিলে ছড়িয়ে আছে সব সম্ভ্রান্ত বাংলা মাসিক ও ‘পাঞ্চ’ থেকে ‘রিভিয়ু অব রিভিয়ুজ’ পর্যন্ত রং-বেরঙের লন্ডনি চালান- দুই ক্লাশের মধ্যবর্তী পঞ্চান্ন মিনিট চমৎকার কেটে যায় সেগুলি উল্টে-পাল্টে।

আর যারা ভিন্ন ধরনের বিনোদপিয়াসী, তাদের জন্য আছে দেয়াল ঘেঁষে তাসের টেবিল, দাবার ছক, ছোটো কামরায় পিংপঙের সরঞ্জাম। ছেলেরা আড্ডা গল্প সিগারেট চালায় যথেচ্ছ, কর্তৃপক্ষ এতটাই সুবিবেচক যে যথেষ্টসংখ্যক ছাইদানও জুগিয়েছেন; যৌবনকণ্ঠের কলরোল ঠেকাবার জন্য ভিতরদিকের দরজাগুলি স্থায়ীভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এই কমনরুমে বসেই আমি প্রথম পড়েছিলাম ‘প্রবাসী’র পৃষ্ঠায় ধারাবাহিক ‘শেষের কবিতা’ আর বিচিত্রায় ‘তিন পুরুষ’ দু-কিস্তি পরে রবীন্দ্রনাথ যার নাম বদলে ‘যোগাযোগ’ রাখলেন; ‘য়ুনিভার্সিটি জার্নাল’-এর কার্যালয়ে, ইংলন্ডজাত কিছু উঁচকপালে ও আধা-উঁচকপালে পত্রিকাও চেখেছিলাম।

তুলনায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দ্বিতীয় রঁদেভূ, আদিত্যের দোকানটি বড়ো দরিদ্র। কম্পাউন্ডের এক  প্রান্তে টিনের চালওলা দর্মার ঘর, ভিতরে মলিনবর্ণ টেবিলের পাশে লম্বা ন্যাড়া টুল পাতা: এখানেই আমরা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ ক’রে থাকি, যেহেতু সারা তল্লাটে দ্বিতীয় কোনো চা ঘর নেই। আদিত্যের ভোজ্যতালিকা অতি সীমিত, কোনো কোনোদিন তার স্বহস্তে প্রস্তুত মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছুই সে দিতে পারে না চায়ের সঙ্গে; কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না আমাদের, গদ্য-পদ্য সমস্ত খাদ্যই আমাদের পক্ষে উপাদেয় ও সুপাচ্য, সেগুলির রাসায়নিক গুণাগুণ নিয়ে চিন্তিত হবার মতো দুর্দিন তখনও বহুদূর।

আমরা জুটি সেখানে বন্ধুর দল- টুনু, অমল, পরিমল, আরো অনেকে- ছুটির ঘণ্টায়, বা কখনো কেউ ক্লাশ পালিয়ে; বসি গোল হয়ে ঘন সবুজ ঘাসের উপর ঘনিষ্ঠ, ফরমাশের পর ফরমাশ ছাড়ি আদিত্যকে; অনেকখানি মাঠ পেরিয়ে আমাদের কলহাস্য ধ্বনিত হয় এক ক্লাশঘরে, যেখানে চারু বন্দ্যোপাধ্যায় কবিকঙ্কণ পড়াচ্ছেন। দাম দেবার জন্য পকেট হাৎড়াবার প্রয়োজন নেই, ‘লিখে রেখো’ বলাই যথেষ্ট। এই আদিত্যের, এবং আমার পুরানা পল্টনের মুদিখানায় সিগারেটের দেনা সম্পূর্ণ শোধ না ক’রেই আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম, সে-কথা ভেবে আজকের দিনে আমার অনুশোচনা হয়।

একটি সুখস্থান, আমার টিনের ঘরের পরেই আমাদের প্রধানতম মিলনকেন্দ্র- এমনি ছিলো আমাদের পক্ষে এই বিদ্যালয়। আমরা কয়েকটি পূর্বপরিচিত বন্ধু পড়ছি এখানে, একই সময়ে নতুন দু-একটি সঙ্গীও পেয়েছি মনোমতো। আমাদের পাঠাভ্যাস-সংক্রান্ত ক্রিয়াকর্ম চলে সুনিয়মিত ও স্বচ্ছন্দ; মৌলিক শৃঙ্খলার যেটুকু দাবি তা আমাদের পক্ষে কখনোই পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে না। আমাদের সাবালকত্ব এখানে স্বীকৃত, আমাদের স্বাধীনতা বহুদূর পর্যন্ত অবাধ।

পরীক্ষার খাতায় নিজস্ব মতের ঘোষণা, মাস্টারমশাইয়ের অনুমোদিত ভাষ্যের প্রতিবাদ লাইব্রেরির অন্দরমহলে ঢুকে যথেচ্ছবিহার- এই সবই আমাদের অধিকারভুক্ত; আমাদের সহজ অনুভূতিগুলি অসম্মানিত হয় না, আমাদের ব্যক্তিত্ব বিকশিত হবার সুযোগ পায়। সাহিত্যবিভাগে দ্বৈতীয়িক গ্রন্থের ব্যবহার অল্প; কোন প্রথিতযশা সমালোচক কী বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী হ’লো মূল লেখকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা। আবহাওয়াটি সত্যি উদার, কিন্তু এর একটি ব্যতিক্রম উল্লেখযোগ্য।

একমুঠো ছাত্রীও আছেন আমাদের সঙ্গে- আছেন, এবং অনেক বিষয়ে নেই। যেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, পৃথক্কৃত ও সুরক্ষিত এক অতি সুকুমার উপবংশ, তাঁরা অবকাশের প্রতিটি মিনিট যাপন করেন তাঁদের পর্দায়িত বিশ্রাম-কক্ষে, অধ্যাপকদের নেতৃত্বে ছাড়া সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হন না। প্রতি ঘণ্টার শুরুতে এবং শেষে করিডরগুলি বিভিন্নমুখী মিছিলে ভ’রে যায়; মহিলাগুচ্ছকে পশ্চাৎবর্তী করে চলেছেন এক একজন অধ্যাপক, পুনশ্চ নির্বিঘ্নে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের কমনরুমের দোরগোড়া পর্যন্ত।

ক্লাশে তাঁদের জন্য বসার ব্যবস্থা আলাদা, আমাদের বেঞ্চিগুলো থেকে দূরে-বসানো চেয়ারে: সেখানে তাঁরা চক্ষু নত রাখেন পুঁথির উপর, কোনো প্রশ্ন করেন না অধ্যাপককে, পাঠ্যবিষয়ে হাসির কথা থাকলেও তাঁদের গাম্ভীর্যে টোল পড়ে না। এমন নয় যে, করিডরে বা ক্লাশের মধ্যে কোনো দৃষ্টি ভ্রমর কখনো ছুটে আসে না আমাদের দিকে- কিন্তু দর্শন পেরিয়ে শ্রবণে তাঁরা কখনোই প্রায় ধরা দেন না, শুধু মূক শ্রোতার ভূমিকা নেন নাট্যাভিনয় বক্তৃতা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার  বছরে আমি প্রকাশ্যে ছাত্রী-কণ্ঠ শুনেছিলাম একবার মাত্র- শুধু মেয়েদেরই জন্য আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায়: একটি সুন্দর মুখের মেয়ে পুরস্কৃত হয়নি বলে বিচারক অধ্যাপক-পত্নীর কাছে প্রতিবাদও জানিয়েছিলাম।

ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যবর্তী এই স্বচ্ছ দেয়ালটিকে একেবারে নীরন্ধ্র ভাবলে কিন্তু ভুল হবে: বেয়ারার হাতে চিরকুট  পাঠিয়ে ‘লেডিজ’ কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে, কোনো বাসন্তী সেন বা অমিতা চন্দর সঙ্গে দু-চার মিনিট কিছু অর্থহীন কথা বলা এবং শোনা যায় না তা নয়- কোনো-কোনো বদ্ধপরিকর ছাত্র তা করেও থাকে- কিন্তু দেখে মনে হয় উভয় পক্ষই অপ্রতিভ স্বাচ্ছন্দ্যরহিত, আলাপ ঠিক জমছে না, অথবা একে আলাপ বলাটাই ভুল।

ব্যাপারটা খুবই কৌতুক শোনাবে আজকের দিনে, কারো কারো পক্ষে অকল্পনীয়; কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী আগেকার বাঙালি সমাজে, হাজার খানেক নবযুবার মধ্যে পনেরো কুড়িটি বিদ্যার্থিনী তরুণী নিয়ে এই ব্যবস্থাই স্বাভাবিক ও সংগত ছিলো তা মানতেই হবে। ‘আমরা জন্মেছিলাম স্ত্রীলোকহীন জগতে’- এই কথাটা রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে বলেছিলেন, সে-অর্থে আমাদের জীবনেও প্রযোজ্য।

সেই সময়কার কথা ভাবলে আমি নিজেকে দেখতে পাই রমনার একটি রাস্তায়, যা চ’লে গেছে পুরানা পল্টনের মোড় থেকে সোজা পশ্চিমদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বার পর্যন্ত এক মাইল। এইমাত্র খেয়েছি দিদিমার রান্না অতি তৃপ্তিকর মাছের ঝোলভাত, হাঁটছি হালকা পায়ে প্রফুল্ল, হাতে দু-একটি বই খাতা মেঘলা অথবা রোদালো দিনের বেলা দশটায়। সাইকেলটাকে আস্তে করে দিয়ে আমার কাঁধে হাত রাখলো পরিমল, তার টাটকা তৈরী কোনো ছড়া শুনিয়ে এগিয়ে গেলো।

পাঁচ মিনিট পরে মেয়েদের হস্টেল-রমনার সব সুন্দরের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সেই তথাকথিত চামারিয়া হাউস সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন পাঁচটি অথবা সাতটি সহপাঠিনী, আমি চলার গতি শ্লথ ক’রে দিলাম যাতে অন্তত পিছন থেকে তাঁদের নিরীক্ষণ করা যায়।

সৈনিক অথবা খ্রীষ্টান সন্ন্যাসিনীদের মতো শ্রেণীবদ্ধ হয়ে হাঁটছেন তাঁরা সমতালে পা ফেলে-ফেলে- মাথা আঁচলে ঢাকা, চওড়া-পাড়ের শাদা শাড়ি পরনে, যৌবনসুলভ চাঞ্চল্যের কোনো লক্ষণ নেই, আর পা-ফেলা এমন ঢিমে লয়ের যে একটু পরেই তাঁদের অতিক্রম না-করে আমার উপায় থাকে না। পথে-পথে আরো অনেক চেনা মুখ; কখনো দেখি বিজ্ঞানবিখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ বসু চলেছেন মন্দচরণে- হাতে গোল্ড ফ্লেকের টিন, জামা বোতামহারা, চুল উশকোখুশকো, ছাঁটা চুল।

চোখে সোনার চশমা, গিলে করা চুড়িদার পাঞ্জাবিতে সুপ্রশাধিত- সেই যখন বিরল পথেও অতি সর্তক সাইকেল চালিয়ে আস্তে আমাকে ছাড়িয়ে যান ডক্টর দে সংস্কৃত-বাংলার অধিনায়ক সুশীলকুমার। বা হয়তো দেখা যায় জগন্নাথ হল-এর দিক থেকে বেঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে ঢুকলেন ইতিহাস-বিশারদ রমেশচন্দ্র মজুমদার, যুবকদের চেয়েও দ্রুত এবং বলিষ্ঠ তাঁর পদক্ষেপ। অথবা, আমি যখন কলেজের গাড়ি-বারান্দায়, ঠিক তক্ষুনি সাইকেল থেকে নামেন আমাদের ইংরেজি বিভাগের সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁর তুল্য লাজুক অধ্যাপক আর নেই- আমাদের দেখে ঈষৎ লাল হন তিনি, মৃদু কেশে নরম আওয়াজে বলেন, ‘এই যে বুদ্ধু, ভালো আছো?’

আমি করিডর দিয়ে যেতে যেতে শুনি ঘণ্টার শব্দ; নানা ধরনের উৎসাহ বা বিরসতা নিয়ে চারটে অবধি বেলা কেটে যায়- তারপর আবার সেই একই পথে আমার বাড়ি ফেরা পড়ন্ত রোদে, প্রায় প্রত্যহই সবান্ধবে। প্রচুর চা, টিনের মাখনের সঙ্গে বাড়িতে-দিয়ে-যাওয়া টাটকা গরম পাউরুটি, মুড়মুড়ে ষোলো-পৃষ্ঠার ‘স্টেটস্ম্যান,’ ডাকের চিঠি, কাগজপত্র, কলকাতার সাহিত্যিক গসিপ, ‘প্রগতি’র জন্য প্রার্থিত বা অযাচিত কিছু রচনা।

তখনই এক দফা পঠিত এবং আলোচিত হয় সেগুলো, কিন্তু সম্পাদকীয় বিলি-ব্যবস্থা আমি সমাধা করি বেশি রাত্রে- লিখি চিঠির উত্তর, হয়তো বা ইতালিয়ান ছাঁদের একটি বা দুটি সনেট, বা জাপানি ধরনে একগুচ্ছ তানকা। লিখে সুখ পাই, পরে সেগুলো বিশ্রী লাগলেও দ’মে যাই না, কেননা আমার অনবরতই লেখা ‘আসছে’। 


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //