কবি শামসুর রাহমানের ৯২তম জন্মদিন আজ

আজ আমাদের সকলি লোপাট

ঘর-গেরস্থালী রাজা রাজ্যপাঠ

মঞ্চে শুধু ছিলেন একাই

রূপোলী চুলের বাঙালি সম্রাট

কবি শামসুর রাহমানের ৯২তম জন্মদিন আজ। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম নেয় এই কথাসাহিত্যিক। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশের পরপরই তিনি সচেতন পাঠকমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান যেন সচিত্র রূপ পায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই শামসুর রাহমানের কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক কবিতার সাথে তার পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯ সালে। প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার লেখা ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট ’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, এসব কবিতা তাঁকে ভিন্নভাবে চিনিয়ে দেয় আমাদের।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বেদনামথিত হয়ে লেখেন ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’সহ বেশকিছু কবিতা। স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর-পরবর্তী পট পরিবর্তনে আশাহত কবি সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে তার কলম চালিয়েছেন নিরন্তর। সাংবাদিক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য।

শামসুর রাহমানের ষাটের বেশি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়ও শিশুতোষ, অনুবাদ, ছোটগল্প, উপন্যাস, আত্মস্মৃতি, প্রবন্ধ-নিবন্ধের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৬৪ সালে নভেম্বর থেকে শুরু করে সরকারি দৈনিক পাকিস্তানের সহকারি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭-তে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ সময় তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অধুনার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

শামসুর রাহমানের বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে কবি ছিলেন চতুর্থ। পুরানো ঢাকার পোগোজ ইংলিশ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাস করে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশ নেননি।

প্রকাশিত কাব্য: প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০), রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নিলীমা (১৯৬৭), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), নিজ বাসভূমে (১৯৭০), বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২), দুঃসময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩), ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা (১৯৭৪), আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪), এক ধরনের অহংকার (১৯৭৫), আমি অনাহারী (১৯৭৬), শূন্যতায় তুমি শোকসভা (১৯৭৭), বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে (১৯৭৭), প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে (১৯৭৮), ইকারুসের আকাশ (১৯৮২), মাতাল ঋত্বিক (১৯৮২), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে (১৯৮৩), কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি (১৯৮৩), নায়কের ছায়া (১৯৮৩), আমার কোন তাড়া নেই (১৯৮৪), যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে (১৯৮৪), অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই (১৯৮৫), হোমারের স্বপ্নময় হাত (১৯৮৫), শিরোনাম মনে পড়ে না (১৯৮৫), ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই (১৯৮৫), ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ (১৯৮৫), এক ফোঁটা কেমন অনল (১৯৮৬), টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে (১৯৮৬), দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে (১৯৮৬), অবিরল জলভ্রমি (১৯৮৬), আমরা ক`জন সঙ্গী (১৯৮৬), ঝর্ণা আমার আঙুলে (১৯৮৭), স্বপ্নেরা ডুকরে উঠে বারবার (১৯৮৭), খুব বেশি ভালো থাকতে নেই (১৯৮৭), মঞ্চের মাঝখানে (১৯৮৮), বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮), হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো (১৯৮৯), সে এক পরবাসে (১৯৯০), গৃহযুদ্ধের আগে (১৯৯০), খন্ডিত গৌরব (১৯৯২), ধ্বংসের কিনারে বসে (১৯৯২), হরিণের হাড় (১৯৯৩), আকাশ আসবে নেমে (১৯৯৪), উজাড় বাগানে (১৯৯৫), এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা (১৯৯৫), মানব হৃদয়ে নৈবদ্য সাজাই (১৯৯৬), তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন (১৯৯৬), তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি (১৯৯৭), হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল (১৯৯৭), ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ (১৯৯৭), মেঘলোকে মনোজ নিবাস (১৯৯৮), সৌন্দর্য আমার ঘরে (১৯৯৮), রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যা রাতে (১৯৯৮), টুকরা কিছু সংলাপের সাঁকো (১৯৯৮), স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেঁচে আছি (১৯৯৯), নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে (২০০০), শুনি হৃদয়ের ধ্বনি (২০০০), হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে (২০০১), ভগ্নস্তুপে গোলাপের হাসি (২০০২), ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে (২০০৩), গন্তব্য নাই বা থাকুক (২০০৪), কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে (২০০৪), গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান (২০০৫), অন্ধকার থেকে আলোয় (২০০৬) এবং না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন (২০০৬)।

শিশু সাহিত্য: এলাটিং বেলাটিং (১৯৭৪), ধান ভানলে কুঁরো দেব (১৯৭৭), গোলাপ ফোঁটে খুকীর হাতে (১৯৭৭), স্মৃতির শহর (১৯৭৯), রংধনুর সাঁকো (১৯৯৪), লাল ফুলকির ছড়া (১৯৯৫), নয়নার জন্য (১৯৯৭), আমের কুঁড়ি জামের কুঁড়ি (২০০৪) এবং নয়নার জন্য গোলাপ (২০০৫)।

উপন্যাস: অক্টোপাশ (১৯৮৩), অদ্ভুত আঁধার এক (১৯৮৫), নিয়ত মন্তাজ (১৯৮৫) এবং এলো সে অবেলায় (১৯৯৪)।

স্মৃতিচারণ: স্মৃতির শহর (১৯৭৯) এবং কালের ধুলোয় লেখা (২০০৪)।

অনুবাদ কবিতা: ফ্রস্টের কবিতা (১৯৬৬), রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা (১৯৬৮) এবং খাজা ফরিদের কবিতা (১৯৬৮)।

অনুবাদ নাটক: হৃদয়ের ঋতু (মূল: টেনেসি উইলিয়মস), মার্কোমিলিয়ান্স্ (মূল: ইউজিন ও`নীল; ১৯৬৭) এবং হ্যামলেট (মূল: উইলিয়ম শেক্সপিয়র; ১৯৯৫)।

প্রবন্ধ: আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ (১৯৮৬), শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ (২০০১) এবং কবিতা এক ধরনের আশ্রয় (২০০২)।

সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, জীবনানন্দ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার, মিতসুবিসি পুরস্কার (সাংবাদিতার জন্য), স্বাধীনতা পদক, আনন্দ পুরস্কার।

১৯৮৭ সালে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এরপর তিনি অধুনা নামের একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শামসুর রাহমান আদমজি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন।

২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কবিকে তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকার বনানী কবরস্থানে, মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //