সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার ভূগোল

মলয় রায় চৌধুরীর উক্তি- ‘ইতিহাস এগিয়ে চলেছে প্রগতির দিকে, উত্তরণের দিকে, সর্বজনীনতার দিকে। মানুষ হয়ে উঠছে আলোকপ্রাপ্ত, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী, ইত্যাদি। মানুষ সুসভ্য হয়ে চলেছে, লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।

কবিতাও এগিয়ে চলেছে, আরো, আরো জোরে। ইত্যাদি।...’ এটাকে মেনে নিয়ে আমরা সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার ভূগোলটা আসুন একটু দেখি। তাঁকে আমাদের মনে হয়- তারুণ্যের সুকোমল ছায়া। তিনি আমাদের সাহসের একচির নবীন সহিস, তিনি চলতে চলতে, অনেক অনেক সমুখের পানে গেছেন। আত্মজৈবনিক কবিতা ‘আমার পরিচয়’-কবিতাটি সৈয়দ হকের শৈল্পিক ভুবন কিংবা তাঁর মানস গঠন তৈরি হয়েছে কীভাবে, তাঁর কবিতার ভূগোলটা কী বোঝার জন্য- যথোপযুক্ত। আত্মমগ্নতার গভীর অন্তর্দেশ থেকে গড়ে উঠেছে তাঁর পংক্তির বুনন। সব্যসাচী লেখক হিসেবে প্রতিপন্ন করার আগেভাগে তিনি সবার পহেলায় নিজেকে কবি নামে গণ্য করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে বলেন, ‘কবিতাই হলো আমার লেখালেখির নাভি। মূল কেন্দ্র পরে তা ছড়িয়েছে অন্য শাখায়। এর মধ্যদিয়ে জীবনকে দেখার ভঙ্গি, ব্যাখ্যার নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে চেয়েছি।’ 

সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যযাত্রার সূচনায় নিসর্গমগ্ন এক তরুণের দেখা পাওয়া যায়। যেন ধুলোমলিন এক গ্রামীণ বাউল নাগরিক বৈদগ্ধ্য ও ব্যক্তিমুখী চেতনার রন্ধ্র দিয়ে স্মৃতিলোকের ক্রমভগ্ন নিসর্গলোক প্রত্যক্ষ করছে। নিসর্গমগ্নতা নির্জনতম মানুষকেও যে পূর্ণতার আনন্দ দেয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতা তার প্রমাণ; কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক জীবনানন্দীয় আবহের কবি নন, বরং মননশীলতা ও মিথকথন বৈশিষ্ট্য যে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার ধাঁচ তার মধ্যে কখনও কখনও লক্ষ করা যায় প্রথম পর্যায়ের কবিতায়। তার কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তিনি বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় কবিতা থেকেই আত্ম-উন্মোচন ও আত্মপ্রকাশের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে মিশে ছিল তাঁর ব্যক্তি সংবেদনার স্বতন্ত্র গড়ন। এই পাঠকৃতি ও মানসক্রিয়া তাঁর নিজের ও বাংলা কবিতার জন্য যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছিল।

‘একদা এক রাজ্যে’র (১৯৬১), ‘বুনোবৃষ্টির গান’, ‘কবিতার উন্মোচনী অংশের চিত্র ও ধ্বনির অন্তরালে ভিন্ন এক কবিকণ্ঠের  দেখা মেলে- ‘বৃষ্টি এসে  ভেজায় কখন নাগেশ্বরীর মাঠ/দূরত্ব এক বাতাস নাড়ে বুনো চালতা ফল/হৃদয় যেন।’ ব্যক্তিমন ও ভূগোলের দ্বৈরথে তৃতীয় কারও অনুপ্রবেশটাও নাগরিক রহস্যের স্পর্শে দ্বিধা থরথর- ‘ইচ্ছা আছে মেঘের মতো অন্ধ সীমানায়/একলা এক জানালা খোলা বাংলাবাড়ির ঘর/একলা এই রঙ্গপুরে হঠাৎ কি যে হয়।/পাবো না জানি  তোমায়  পেলে হৃদয়  দেখা যায়।/বৃষ্টি এসে  ভেজায় আবার  সেই দুরাশার মাঠ।’

‘খঞ্জনি’ কবিতায়ও  দেখি ধ্বনি ও চিত্রের মধ্যে মৃন্ময় এক অনুভূতিলোক, সেখানেও ব্যাপ্ত সমগ্র- বাংলার অন্তরিত মানচিত্র : ‘আকাশে উদাসী  মেঘ, মর্ত্যে তুমি বাজাও খঞ্জনি;/ধুলোর বাউল তুমি, তাকে তুমি ব্যাপ্ত করে আছো।/নিজের আড়াল আর কামরাঙা ছায়া,/সেখানে দাঁড়াও এসে।’ ‘বুনোবৃষ্টির গান’ (১৯৫৯) থেকে ‘অধোগামী দিনের পঞ্জিকা’ (’৯৮)- এই দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় সময়স্বভাবের সবগুলো স্তরকেই কবি স্পর্শ করেছেন। সেই সঙ্গে নিজের সৃষ্টিসত্তাকেও সময়ের দ্বন্দ্ব ও জঙ্গমের অগ্নি-পরীক্ষায় যাচাই করে  নিয়েছেন। নিসর্গলগ্ন চেতনা কীভাবে সমষ্টিবিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্মরতি ও বিকারের জগতে প্রবেশ করে, কীভাবে রক্তিম অনুভূতিপুঞ্জের মধ্যদিয়ে ব্যক্তি সচেতনভাবে সমষ্টিলগ্ন হয়; অতঃপর সমাজ রাজনীতি, ইতিহাস ও সভ্যতাভাবনা কবিতার শিল্পশীলিত অবয়বে রূপ পায়, সৈয়দ হকের কবিতা তার প্রমাণ।

‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ (১৯৬৯) শব্দপ্রবাহের নায়কের স্বগতোক্তির এই প্রকাশ ভঙ্গিও অভিনব বাংলা কবিতায়- ‘আবার উঠব জেগে খরচৈত্রের চর/হয়ে তোমার পদ্মায়। পিঙ্গল জটায়/স্রোতের প্রপাত নিয়ে হেঁটে যাব আমি,/স্মৃতির সাগরে। জন্মে জন্মে বারবার/কবি হয়ে ফিরে আসব আমি বাংলায়।’ ব্যক্তির পূর্ণায়ত ভূগোলকে একমাত্র কবিতাই তার বহুস্বরসহ ধারণ করতে পারে। চৈতন্যবিবর্তনের অকপট সত্য  সেখানে বিধৃত হয়। সৈয়দ শামসুল হকের মধ্যবিত্ত নাগরিক-মনের বিবর্তনের ধারায় বাঙালি জীবনের ক্রমায়ত যাত্রার যে শব্দ-বর্ণ-ধ্বনি ও চিত্রময় স্বরূপ প্রত্যক্ষ করি, তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপর্ণ।

বিশেষ করে, ‘পরানের গহীন ভিতর’ (১৯৮০) কাব্যগ্রন্থ  থেকে তাঁর কবিতার বিষয়ের লোকব্যঞ্জনা আঙ্গিকের নতুনত্বে পাঠককে নতুন অভিরুচির দীক্ষা দিয়েছে। কবি তাঁর আত্মশনাক্তকরণ ও জীবনসন্ধানের নতুন যাত্রা এভাবেই শুরু করেন- ‘কি কামে মানুষ দ্যাখে মানুষের বুকের ভিতরে/নীল এক আসমান- তার তলে যমুনার ঢল,/যখন সে দ্যাখে তার পরানের গহীন শিকড়ে/এমন কঠিন টান আচানক পড়ে সে চঞ্চল?/কিসের সন্ধান করে মানুষের ভিতরে মানুষ?’ (পরানের গহীন ভিতর-১৪)।

এই জিজ্ঞাসাধ্বনির মধ্যেই থেমে যেতে পারেন একজন কবি। অথবা এগিয়ে যেতে পারেন অনন্তকালের পথ ধরে। কেননা, মানবসন্ধানের মধ্যদিয়ে শিল্পীর আত্মসন্ধান ও আত্মজিজ্ঞাসার এই প্রক্রিয়া মহৎ কবিতার চিরকালের স্বভাবধর্ম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //