মুজিব ও নজরুল অভিন্ন হৃদয়ের সারথি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম- এই দুই জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্বের জাতীয়তাবাদের শেকড় প্রোথিত একই জমিনে। তা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়তে এই দুই জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। একজন সাহিত্যের কবি অন্যজন রাজনীতির কবি।

১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। কলকাতার অ্যালবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র তাঁর ভাষণে বলেছিলেন যে, আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব, তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনো তাঁর গান গাইব। বঙ্গবন্ধুও এভাবেই হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন নজরুলকে দ্রোহে এবং বিদ্রোহে। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, “বাংলা বাঙালির বাংলা’য় ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতের মাটিতে নজরুল গর্ব প্রকাশ করেছে নিজেকে বাঙালি বলে। বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।” রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু সেখান থেকেই উজ্জীবিত হয়ে কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর সেই বজ্রকণ্ঠের অমর স্লোগান ‘জয়বাংলা’। বাঙালির মুক্তির মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু। তিনি উজ্জীবিত হতেন নজরুল পাঠ করে। তিনি জানতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কবি নজরুল ছিলেন নিরন্তর প্রেরণার উৎস। নজরুলের কবিতা, গান, লেখা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখে মুখে ঘুরেছে।

কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ভারত যৌথ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসিকতার দিক থেকে সমান্তরাল অবস্থানে রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছে ছিল শোষণহীন বাংলাদেশ গড়া। নজরুলও চেয়েছেন বঞ্চনাহীন, শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে। দুজনের স্বপ্ন ছিল এক ও অভিন্ন। দুজনই ছিলেন বিদ্রোহী। একজন সাহিত্যের, অন্যজন রাজনীতির। এজন্য একজনকে বলা হয় ‘পোয়েট অব লিটারেচার’, অন্যজনকে বলা হয় ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’।” নজরুল নিজেকে বীর এবং বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছিলেন। সে ঘোষণা কোনো অক্ষমের দাম্ভিকতা ছিল না, ছিল একজন যথার্থ বীরের এবং প্রকৃত বিদ্রোহীর আত্মঘোষণা। প্রতিবাদী হওয়ার জন্য জেল খেটেছেন। বীরত্ব ও বিদ্রোহের এই দুই বৈশিষ্ট্য শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। নজরুল জানতেন সমাজ চলে রাষ্ট্রের শাসনে, তাই রাষ্ট্রকেই তিনি প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিলেন। রাষ্ট্র যে বৈরী তা বঙ্গবন্ধুও জানতেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই কিশোর, লম্বা সবার উপরে মাথা তোলা ছেলেটি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন বিদেশি শক্তির হাত থেকে বাংলার জনগণের অধিকার; অধিকার থেকে স্বায়ত্তশাসন এবং তা থেকে স্বাধীনতা। তিনি বাংলার মানুষের বুকের স্পন্দনকে স্বধীনতা লাভের আন্দোলনে রূপান্তর করেছিলেন। 

নজরুলের মতো দুঃখকেই বঙ্গবন্ধু সুখের বিষয় বলে বিবেচনা করেছিলেন। ৫৫ বছরের জীবনে ১১ বছরের বেশি জেল খেটেছেন, পুলিশের হুলিয়া মাথায় নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, জনপদের পর জনপদ চষে বেড়িয়েছেন, গ্রেপ্তার হলে অনেকটা হাসতে হাসতেই জেলে গেছেন। সবকিছুর মূলে লক্ষ্য একটিই- পরাধীনতার নিগড় থেকে বাঙালিকে মুক্ত করা। দেশ স্বাধীন হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে শ্রদ্ধাভরে দেখতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কবি একুশ বছরের বড় ছিলেন, তবু এই দুই বাঙালির চিন্তায় ছিল বাঙালির স্বাধীনতা এবং সর্বস্তরের মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষার মিল। কাজী নজরুল যা চিন্তা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে চিন্তার ধারাবাহিকতা এনেছেন আর বাঙালিকে যথাযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে। সেই সূত্রেই বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আদর্শিক ধ্রুব তারার মতো। ১৯৪১ সালের কোনো একদিন নজরুলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয় বলে জানা যায়। এ তথ্য পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনী থেকে। ফরিদপুরের জেলা ছাত্রলীগের আয়োজনে একটি সম্মেলন আয়োজন হয়। সেই সম্মেলনে কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইবরাহীম খাঁর মতো সাহিত্যিকরা উপস্থিত ছিলেন। সে সময়ে সরকারের ১৪৪ ধারা জারির কারণে প্রকাশ্য সভা হতে পারেনি; কিন্তু ঘরোয়া সভায় কবি নজরুল ইসলাম গান শুনিয়েছিলেন; সে সময় শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্পর্কে বক্তব্যও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যে হবে ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁরা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইবরাহীম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না। ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে।’ 

কাজী নজরুলের সেই বক্তৃতা ও গান অন্যদের মতো বঙ্গবন্ধুকেও অনুপ্রাণিত করেছিল নিশ্চয়ই। নজরুল বেশ আগেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার তরুণদের কাছে আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠতার প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। যে কারণে তিনি বারবার পূর্ব বাংলায় আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। পরাধীন বাংলার সর্বত্র চষে বেড়িয়েছিলেন বিদ্রোহের গান গেয়ে, মূক মানুষের মুখে ভাষা ফুটিয়ে ছিলেন। জাগিয়ে তুলেছিলেন ঘুমন্ত বাঙালিকে- স্বাধীনতার মন্ত্রে। দেশমাত্রিকার মুক্তির পথে কবির সেই স্বদেশ ভূমি আজ মুক্ত স্বাধীন।

নজরুলের চোর-ডাকাত, নারী, সাম্য কবিতাগুলো বঙ্গবন্ধুর মুখস্থ ছিল। তিনি তা প্রায়ই আবৃত্তি করে শোনাতেন গুণমুগ্ধদের। নজরুলের নারীর সমাধিকার, জগতে সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ছিল বঙ্গবন্ধুরও আদর্শ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র ছিল ‘জয়বাংলা’। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে গগনবিদারী উচ্চস্বরে বাঙালির সামনে ঘোষণা করেন এই স্লোগান। এরপর থেকেই বাঙালির পরিচয়ের অপর নাম ‘জয়বাংলা’। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মে মঙ্গলবার স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনাটা হলো কাজী নজরুল ইসলামের অমর সংগীত ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’সহ একাধিক গান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে ১০ই জুন বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন দেশে পা রাখলেন তখনও তিনি ভোলেননি বিদ্রোহী কবিকে। তিনি স্বাধীন দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। নানা দিক সামলে দ্রুত সংবিধান প্রণয়ন করলেন। সেই সঙ্গে মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সেই সময়েই বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। কবির রচিত ‘চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মার্চ সংগীত হিসেবে মর্যাদা দান করা হয়।

১৯৭২ সালে ২রা মে নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে কবিকে আনা হলো স্বাধীন বাংলাদেশে। নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বললেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পারাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নি-মন্ত্র বাঙালি জাতির চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা-শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প। শুধু  বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ক্ষেত্রেই নয়, শান্তি ও প্রেমের নিকুঞ্জেও কবি বাংলার অমৃতকণ্ঠ বুলবুল। দুঃখের বিষয়, বাংলা ভাষার এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবদান সম্বন্ধে তেমন কোনো আলোচনাই হলো না। বাংলার নিভৃত অঞ্চলে কবির বিস্মৃতপ্রায় যে সব অমূল্য রত্ন ছড়িয়ে আছে তার পুনরুদ্ধারের যে কোনো প্রচেষ্টাই প্রশংসার যোগ্য নয়।’

বঙ্গবন্ধু কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, তিনি নজরুলের চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যগবেষণা ও তাঁকে সম্মাননার ব্যাপারটিতে জোর দিয়েছিলেন। সরকারি অর্থায়নে বাংলা একাডেমি থেকে নজরুল-রচনাবলি প্রকাশ অব্যাহত থাকে। ১৯৭৪ সালে শহীদ দিবস স্মরণে ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির সভায় নজরুল প্রধান অতিথির আসনে মঞ্চে বসেন। বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সমাবর্তনে নজরুলকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি প্রদান করে বাঙালি জাতি সম্মানিত হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট চিকিৎসার সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে কবি চলে যান না ফেরার দেশে। বঙ্গবন্ধু ও নজরুল ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন আজীবন। বঙ্গবন্ধু প্রিয় কবিকে কাছে এনে যে শান্তি পেয়েছিলেন তা তিনি বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম গুলি কেড়ে নিয়েছিল তাঁকে। এ বেদনা গোটা বাঙালি বহন করবে আজীবন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //