বঙ্কিমের প্রবন্ধে লেখক হয়ে ওঠার দিকনির্দেশনা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকের বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, যিনি সাহিত্য সম্রাট বলেও খ্যাত। তাঁর রচনার মধ্যে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ন প্রবন্ধও রয়েছে। সেসব প্রবন্ধ আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক জাগরণে ভূমিকা রেখে চলেছে।

এরমধ্যে আলোচিত একটি প্রবন্ধ হলো ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ যা প্রথম প্রকাশিত হয় ‘প্রচার’ পত্রিকায় ১৮৮৫ সালে যা পরে তার ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাকে বাংলা উপন্যাসের জনকও বলা হয়। এত প্রবন্ধ থাকতে তার এই প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করার মূল কারণ হলো এই প্রবন্ধের লেখা এমন সত্য যা বর্তমান সময়ের লেখক লেখিকাদের ক্ষেত্রে প্রচণ্ডভাবে লক্ষণীয়।

আজকাল প্রচুর লেখক লেখালেখির জগতে আসছেন। বিপরীতে অধিকাংশই দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাচ্ছেন। পাঠকের কাছে পৌঁছানোর সময়টুকুও পাচ্ছেন না, ফুরিয়ে যাচ্ছেন। পাঠককুলও জানতে পারছেন না এসব লেখক-লেখিকা সম্পর্কে। লেখালেখি করার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত বা একজন নতুন লেখকের কোন বিষয়গুলোর দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন তা সর্বাগ্রে জানতে হবে। কারণ একজন লেখক হয়ে ওঠা সহজ কথা নয়। আজ যুগের কল্যাণে প্রচুর মাধ্যম হয়েছে যেখানে ইচ্ছে করলেই লেখা পাঠানো যায় আবার প্রকাশিতও হচ্ছে।

এক পত্রিকা না ছাপলে আরেক পত্রিকা ছাপছে। সেজন্য প্রিন্ট পত্রিকা আছে, অনলাইন পত্রিকা আছে, ওয়েবজিন আছে, ব্লগ এবং ফেসবুকের মতো অসংখ্য নতুন নতুন মাধ্যমের আবির্ভাব ঘটেছে। এরফলে লেখা প্রকাশ করা এ যুগে খুব কঠিন কাজ না। কঠিন কাজ হলো লেখা দিয়ে পাঠক তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে লেখক ব্যর্থ হচ্ছেন একথা বলা যায়। আর তাই বছরের পর বছর লিখলেও তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি একাধিক পুরস্কার পাওয়ার পরও। এই পুরস্কার নিয়েও আজকাল কম কিছু হচ্ছে না। সে কথা অন্য লেখায় আসবে। একজন লেখা প্রকাশ না করে বিমুখ করলেও অন্যজন মুখ রাখছেন। লেখার সাথে সাথে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার হচ্ছে। তিনি লিখছেন এই তথ্যটি জানতে পারছেন অনেকেই; কিন্তু কতজন পড়ছেন তার তথ্য অজানাই থেকে যাচ্ছে! অনেকে আবার নতুন একটি লেখা সম্পাদক বরাবর পাঠিয়েই অধৈর্য হয়ে ওঠেন। দেখা যায় তিনি সেই লেখাটি একইসাথে আরও কয়েকটি পত্রিকায় পাঠিয়ে বসে আছেন। এই যদি হয় অবস্থা তখন তার লেখক হওয়া সাজে না। 

লেখক হতে ধৈর্যের প্রয়োজন। অনেকে আবার তোষামোদির পথও বেছে নেন। যদি এতে কাজ হয়! সেখানে একেবারে যে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না তা নয়। তবে লেখা ছাপলেই তা পাঠক পড়বে এ আশা করা বৃথা। আর যদি লেখাটি একজন নতুন লেখকের উদ্দেশে রচিত হয়ে থাকে তাহলে এটাই ঠিক আছে। আর যদি ভালো লেখা দিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্য থাকে তাহলে এই পথ ভুল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই প্রবন্ধটি কোনো নতুন লেখক পড়েন তাহলে তিনি নিজেকে শুধরে নিতে পারেন। একজন নতুন লেখক হিসেবে কী কী করা উচিত বা কী করা উচিত নয় তা তিনি বিস্তারিতভাবে অকপটে লিখেছেন। বাস্তবে তিনি নিষেধ করলেও এটাই হচ্ছে। আর এ জন্যই প্রচুর লেখক লেখালেখির এই জগতে আসলেও তারা টিকতে পারছেন না। কারণ তাদের উদ্দেশ্য লেখা প্রকাশিত হওয়া, লেখক হওয়া নয়। এখানে আপত্তি আসতে পারে।

লেখা প্রকাশিত হলেই তাকে লেখক বলা চলে, একথাঠিক কিন্তু যদি সেই লেখা কেউ না পড়ে, বিরক্তির সাথে রেখে দেয় সেই লেখা লিখে কী ফল আছে? সবকিছুর একটা উদ্দেশ্য থাকে। লেখক হওয়া মানে শুধু সব পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়া নয় বরং অল্পস্বল্প পাঠকও তৈরি হওয়া। যদি কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর সিনেমা দর্শক না দেখে তবে সেই অভিনেতা বা অভিনেত্রীর অভিনয়ে লাভ কোথায়? পাঠক লেখা পড়বেন এবং লেখার আলোচনা-সমালোচনা হবে। তাহলেই লেখক আরও ভালো লেখা লিখতে উৎসাহিত বোধ করবেন। নতুন লেখকদের ধৈর্যধারণও যে একজন ভালো লেখক হয়ে ওঠার যোগ্যতা তা তো আজকাল প্রায় দেখাই যায় না। একটি লেখা সম্পাদকের দপ্তর বরাবর পাঠিয়ে তার অপেক্ষা থাকতেই পারে সেই লেখা প্রকাশের জন্য; কিন্তু তার স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে সম্পাদকের থাকে এবং সম্পাদককে এ ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। লেখার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে এ প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, ‘যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে।’

যদি এই অংশটুকুতে আলোকপাত করি তাহলে দেখা যাবে আজকাল একজন খাঁটি লেখক পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এ যুগে তো আবার নানারকম পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। সে আরেক কথা। এই বাণিজ্যিক প্রচারে কেউ কেউ ছুটছে। আবার কেউ ধৈর্য ধারণ করছে। তাছাড়া নিজেকে প্রচারেও ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। অর্থাৎ নিজেকে পরিচিত করানোই থাকে লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু তাতে ফল কী হয়? এ ধরনের লেখক কখনোই মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে না। আর লেখার সম্মানীর বিষয়েও তিনি বলেছেন, ‘টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপ এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে এবং টাকাও পায়; লেখাও ভালো হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোকরঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোকরঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।’ 

সেদিনের অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের সময় থেকে আজকের সময়ে তেমন কোনো পার্থক্য হয়নি। অর্থের জন্য কেউ লিখছে এটা আমার মনে হয় না। কারণ সেই সুযোগই তো নেই। তবুও লেখার এক পর্যায়ে সম্মানী লেখার গতি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে বলেই আমার বিশ্বাস। বঙ্কিমচন্দ্র তার প্রবন্ধে অর্থের জন্য লিখতে উৎসাহ দেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে এখনও সে দিন হয় নাই।’ তিনি আজ নেই। কিন্তু আজও সেদিন সৃষ্টি হয়নি। নেহায়েত শখের বশেই লিখতে হবে। পরবর্তীকালেকেউ কেউ অর্থের মুখ দেখেন বটে, তবে সকলে নন। তাই সেসময় বা এসময় লেখার বিনিময়ে অর্থ পাওয়ার পথ আজও সৃষ্টি হয়নি। অবশ্যই ব্যতিক্রম ছাড়া। লেখার উদ্দেশ্য মানুষ তথা সমাজের মঙ্গলসাধন করা। তার মানে সে উদ্দেশ্যেই লেখা উচিত। তিনি বলেছেন, যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, ‘তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।’ এই অন্য উদ্দেশ্য সাহিত্যের বিপরীত। 

একজন খাঁটি মানের সাহিত্যিক কেবল নিজের সৃষ্টি দিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছাতেই ব্যস্ত থাকেন, বাজারে সাহিত্য বিক্রি করতে নয়। নিজেকে কোন দলে ফেলবেন তা লেখক নিজে ঠিক করবেন। নীচ ব্যবসায়ী হলেও তিনি লিখতে পারেন। তাতে দেশের মঙ্গল হয় না, দশের উপকারে আসে না। এই প্রবন্ধে তিনি আরও একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা হলো অনুকরণ। আজ আমরা কথায় কথায় কাউকে অনুসরণ করতে চাই, অনুকরণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠি। আমরা বড় বড় লেখক,কবির মতো লিখতে আগ্রহী হই; কিন্তু আদতে এটা সাহিত্যিকের কাজ নয়। বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রবন্ধে বলেছেন, কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরেজি বা সংস্থা বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না। অনুকরণও আজকাল আমাদের অনেকের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরাসরি শব্দ অনুকরণ না করলেও ভাবটা অনুকরণ হচ্ছে ঠিকই। নিজস্বতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

ফলে একজন নিখুঁত সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায় তা তৈরি হচ্ছে হাতে গোনা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই প্রবন্ধ পাঠে নব্য লেখক-লেখিকাদের সত্যিকারের দিকনিদের্শনা রয়েছে, যা তাদের একজন উঁচুমানের লেখক হতে সাহায্য করতে পারে। এ ধরনের লেখা পাঠ এবং ভাবনার জগতে প্রবেশের মধ্য দিয়ে লেখক সমাজে পরিবর্তন ঘটতে পারে নতুনভাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //