মোগল হারেমের কবিরা

বহু বৎসরব্যাপী মোগল হারেম থেকে এমন কাব্যদ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়েছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে বাদশাহ আলমগীরকন্যা জেবুন্নিসার দুটি চরণ উল্লেখ করা হলো মাত্র। 

মোগল যুগের ইতিহাস চর্চায় সবচেয়ে জল্পনা ও কৌতূহলের বিষয় হলো মোগল হারেম। রাজদরবারের মহিলা এবং তাঁদের সখি ও সহযোগিনীদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ‘হারেম’ নামে পরিচিত। হারেম শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘হারাম’ থেকে, যার অর্থ নিষিদ্ধ। মোগল রমণীদের বসবাসের স্থানে বিশেষ কারণ ছাড়া, যেমন: শিক্ষা ও চিকিৎসা, পরপুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। হারেমের তুর্কি প্রতিশব্দ সেরাগলিও, পারসিক প্রতিশব্দ জেনানা, আর সংস্কৃত প্রতিশব্দ অন্তঃপুর।

মোগল হারেমের ব্যাপারে খুবই অল্পসংখ্যক তথ্য পাওয়া যায়। কোন প্রত্যক্ষ বিবরণ নেই। যেটুকু পাওয়া যায় তার প্রধান উৎস ইউরোপীয় পর্যটকদের কাহিনী, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মনগড়া কথা লিখে গেছেন এবং সেগুলোকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখান থেকে সত্য উদ্ধার করা সহজ নয়।

অনেকেই বলে থাকেন যে, সম্রাটের হারেমের সব মহিলাই তাঁর স্ত্রী, উপপত্নী, নর্তকী, বাইজি, গায়িকা ও বাঁদি। এই ভাবনা সঠিক নয়। এই ধরনের মহিলা অবশ্যই থাকতেন। তবে তারাই সব নয়। সম্রাটের মাতা, সৎমা, দুধমা, দাদি, নানি, খালা, চাচি, ফুফু, বোন, কন্যা, পুত্রবধূ ও নানা আত্মীয়স্বজন সেখানে থাকতেন। এমনকি শিশু শাহজাদারাও হারেমে বড় হতো। জাহাঙ্গীর প্রথম শাহজাদা হিসাবে হারেমে বড় হয়েছিলেন। রানি এবং রাজপরিবারের মহিলা সদস্যদের পোষ্য ও সখিরাও হারেমের বাসিন্দা হিসেবে থাকতেন। 

এ ছাড়া হারেমের নানা প্রয়োজনে নানা পদে মহিলা নিয়োগ করা হতো। পাহারা দেওয়ার জন্য খোঁজা সৈনিক নিযুক্ত করা হতো। শাহজাদা এবং শাহজাদীদের শিক্ষক শিক্ষিকারাও মহলে অনেক সময় থাকতেন। খবরা-খবর সম্রাটের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গোয়েন্দা রাখা হতো। এমনকি রানী, শাহজাদীদের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীও থাকত।

মোগল হারেম ছিল শহরের মধ্যে ভিন্ন একটি শহর। হারেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট আঁটসাঁট। এলাকাটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকত। মহলের গেটে থাকত পাহারাদার সশস্ত্র নারী সৈনিক। গেটের বাইরে থাকত খোঁজা সেনাবাহিনী। আর কিছু দূরে মোতায়েন থাকত বিশ্বস্ত রাজপুত সেনা দল। তারপর থাকতো মূল সেনাবাহিনী। পুরো হারেমকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হতো। প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে মহিলা কমান্ড্যান্ট।

খুব প্রয়োজন না পড়লে অন্দরমহলের লোকজন বাইরে আসতেন না। তবে হারেমের ভিতরে তাঁরা ইচ্ছে মতো চলাফেরা করতে পারতেন এবং ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের যথেষ্ট সামগ্রী সেখানে থাকত। প্রত্যেক অ্যাপার্টমেন্ট বা মহলে পৃথক বাসস্থান, বাগান, হাম্মামখানা, ঝরনা ও চৌবাচ্চা ছিল। পড়াশোনা করার জন্য একেকজনের লাইব্রেরি ছিল। 

শেখ সাদির গুলিস্তা ও বোস্তা ছিল জনপ্রিয় পুস্তক। দরবারি কারখানা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং বিলাস সামগ্রী আসত। হারেমে অবসর বিনোদনের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। সংগীত, নৃত্য, ইনডোর গেম এর ব্যবস্থা ছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল লুকোচুরি, এর ব্যবস্থাও করা ছিল।

ইতিহাসের নির্জলা সত্য, সর্বোপরি মুঘল হারেমে পারস্পরিক সমঝোতা ও সৌহার্দ্য বজায় ছিল। একে অপরের প্রতি শত্রুতা থাকলেও কেউ প্রকাশ করতেন না। মাতা, স্ত্রী ও কন্যাদের প্রতি মোগল শাসকদের সম্ভ্রম, মর্যাদা ও স্নেহ থাকত। নিজের মা ছাড়াও তারা দুধমা, সৎমার প্রতিও যথেষ্ট মর্যাদাশীল থাকতেন।

একথা ভাবা ভুল যে, অন্তঃপুরের মহিলারা কেবল জৈবিক কাজকর্মেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। রাজনীতিতে মোগল মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে মাহাম আনগা, নূরজাহান, জাহানারা এবং রওশন আরার নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গুলবদন বেগম এর স্মৃতিকথা মোগল ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। মমতাজ মহল ছিলেন একজন সাহিত্যরসিক। নুরজাহান ছিলেন একজন কবি ও চিত্রকর। ছদ্মনামে তিনি কবিতা লিখতেন। আওরঙ্গজেবের অন্যতম কন্যা জেবুন্নেসা ছিলেন কোরআনে হাফেজ। তাঁর আরবি ও ফার্সি ভাষার দক্ষতা উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘দিওয়ানে মাখফি’। তিনি একজন ভালো ক্যালিগ্রাফারও বটে। এ ছাড়া আরো অনেকগুণী কবি ছিলেন। এসব নিয়ে আমরা আলোচনা করব। 

হারেমের কবিদের নিয়ে নিরবধি গবেষণা হচ্ছে। তাঁদের সাহিত্যপ্রেম ও কবিতাবিষয়ক বেশ কয়েকটি নজির আমাদের হস্তগত হয়েছে। মোগলনারীদের কাব্যপ্রেম সত্যিকার অর্থে বিস্ময় জাগিয়েছে।

অবগুণ্ঠনে থেকেও স্বীয় প্রতিভা জলাঞ্জলি দেননি হারেমের কবিরা। বরঞ্চ দিকে দিকে তাদের কাব্যকলার মুন্সিয়ানার খবর রটেছে। অন্তঃপুরের বিকশিত আলো আজ ইতিহাসের গৌরবগাথা। তাঁদের গুণপনার খবর জানার বাসনার কমতি হয়নি একটুও। কাব্যের পাশাপাশি বিভিন্নকলায় তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। চিত্র, নৃত্য ও সংগীতচর্চাও করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। 

ষোড়শ শতাব্দীতে ফারগানার তৈমুরি শাহজাদা জহিরুদ্দিন বাবর মোগল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেযুগে সম্রাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল ফার্সি। তখন গদ্যের চেয়ে কদর ছিল কবিতার। যে কারণে ফার্সি কাব্যচর্চায় নিবেদিত ছিলেন রাজ্যের লোকজন। আমরা জানি সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আলমগীর বা আওরঙ্গজেবসহ সকল মোগল শাসক তৈমুরের বংশধর। মোগল বাদশা, রাণী, রাজকুমারী ও রাজকন্যাদের বলা হতো তিমুরিদ। তিমুরিদের রাজা ও রাজকুমাররাও চারুকলার পাশাপাশি নৃত্য, সংগীত ও কবিতার ভক্ত ছিলেন। অনেক গুণের মধ্যে তিমুরিদের বেগম ও রাজকুমারীদের আরেকটি গুণ ছিল মার্শাল আর্টে পারদর্শিতা। কতিপয় বেগম সবসময় দুর্গে সশস্ত্র অবস্থায় থাকতেন। 

এবার মোগল হারেমের কবিদের কথা শোনা যাক। আমাদের আলোচ্য হারেমের প্রথম কবি হলেন- আমতা আল হাবিব। 

আমতা আল-হাবিব তুর্কি খলিফার ইসলামিক আর্মিতে একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। তিনি পুরুষালি পোশাকে থাকতেন। বন্দি সৈন্যদের জীবন বাঁচাতে তিনি তৈমুরকে বিয়ে করেন। তৈমুর তার নাম রাখেন হামিদা বানো বেগম।

আরবি, ফার্সি এবং তুর্কি ছাড়াও, তিনি চীনা এবং জরথুষ্ট্রীয় ভাষায় সাবলীল ছিলেন। তুর্কি ও আরবি ভাষায় তিনি কবিতা রচনা করেছিলেন।

‘তুর্কি খাওয়াতিন’ ও ‘আমির তৈমুর কি ফুতুহাতে হিন্দিয়া’ কিতাবে তার কথা উল্লেখ আছে।

এবার আসুন আরামজান বেগমের কথা বলি। নূরুদ্দীন জাহাঙ্গীরের পঞ্চম স্ত্রীর নাম আরামজান বেগম। আরাম জান বেগম আরবি ও ফার্সিতে কবিতা লিখতেন। তবে সাহিত্য সমালোচকরা তার আরবি কবিতা অতি নিম্নমানের বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ফার্সি কবিতা খুবই প্রশংসনীয়।

‘বার মজারে মা গরীবাঁ না চিরাগে না গুলে

না পরে পর্ওয়ানে আয়্দে না সদায়ে বুলবুলে।’

-‘গরিব-গোরে দীপ জ্বেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে।

শামাপোকার না পোড়ে পাখ্ দাগা না পায় বুলবুলে।’

-কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত)

এ দুটি লাইন উৎকীর্ণ আছে মোগল হারেমের প্রভাবশালী নারী নূরজাহানের সমাধিতে। জাহাঙ্গীরের গুণবতী বধূ নূরজাহান। আসলে নূরজাহান ছিলেন বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সুন্দরী। তিনি শুধু বহুভাষিকই ছিলেন না, তিনি ফার্সি ভাষায় কবিতাও লিখেছেন। তিনি একজন সুরকার ছিলেন। তাঁর সাহিত্যিক দক্ষতা সম্পর্কে, মৌলভী জাকাউল্লাহ দেহলভী তার তারীখে-হিন্দুস্তান গ্রন্থে লিখেছেন, “কথিত আছে যে তাঁর সাহিত্যিক মন ছিল; আর তিনি মাখফি নাম ব্যবহার করে লিখতেন। আজ অবধি লোকেরা অভিজাত ও অভিজাতদের সমাবেশে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে অনুলিপি করে। একদিন সম্রাট চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দিগন্তে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে’। নুরজাহান তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘দণ্ডের হারানো চাবি পাওয়া গেল।’ তিনি কবিদের সার্থকতা বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন, তিনি তালেব আমালির সঙ্গে দেখা করলেন যিনি জাহাঙ্গীরের যুগে মালিকুল শুআরা (কবি সম্রাট) ছিলেন। তাঁকে বললেন যে আপনি আমার প্রশংসা করার জন্য কিছু লেখেননি। উত্তরে তালেব আমালি বললেন, যার দিকে চোখ পড়েনি তার প্রশংসা কীভাবে করা যায়। উত্তরে নূরজাহান শ্লোক পাঠ করেন, ‘বাগানে চোখ রাখলে বুলবুল ফুল ছাড়বে। আমাকে দেখলে ব্রাহ্মণ মূর্তি পূজা করা ছেড়ে দেবে। ফুলে সুবাসের মতো আমি আমার কবিতায় আবৃত।’ 

মোগল হারেমের আরেক কবি হলেন আরজুমান্দ বানু বেগম। যার অন্য নাম মমতাজ মহল। শাহজাদা খুররম পরে সম্রাট সাহজাহান। তাঁরই প্রিয়তম স্ত্রী আরজুমান্দ। বাদশা জাহাঙ্গীরের দরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তি আসফ খানের কন্যা। আসফ খান অপরদিকে নূরজাহানের ভ্রাতা। মমতাজ যেমন ছবি আঁকতে পারতেন তেমনি সাহিত্যের অঙ্গনেও তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল। ফার্সি কবিতা রচনার নিয়ম-কানুন মেনেই তবে লিখতেন কবিতা। তাঁর কবিতায় রোমান্টিসিজমের প্রবল প্রভাব। পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে জড়িয়ে আছে প্রেমের আরক।

শাতিয়ুন নেছা। তিনি শিক্ষার প্রথম পাঠ নেওয়ার পর ফার্সিতে কবিতা লেখায় পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। তাঁর আচার- সেবায় তুষ্ট হয়ে মমতাজ মহল এক সময় নিজের সেবায় তাঁকে নিযুক্ত করেন। শাতিয়ুন কবি নাসিরার স্ত্রী ছিলেন। তাঁর জ্ঞান গরিমায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল তাঁকে জাহানারার শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দেন। 

এবার শুনুন জাহানারা বেগমের কথা। সম্রাট শাহজাহানের অতিপ্রিয় কন্যা জাহানারা বেগম। হারেমের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। অকৃতদার এই নারী আরবি ফার্সিতে অনেক কবিতা লিখেছেন। খুব সুন্দরী ছিলেন। 

জাহানারার যখন ১৭ বছর বয়স, তখন তাঁর মা মমতাজ মহল ওরফে আরজুমান বানু বেগমের মৃত্যু হয়। বেগমের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন সম্রাট সাহজাহান। বাবাকে সামলানো, ছয় ভাইবোনকে মানুষ করা, দরবারের কাজে বাবাকে সাহায্য করা, সবটাই নিজের কাঁধে তুলে নেন জাহানারা। ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয় জাহানারার। সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁকে ‘সাহিবাতুল জমানি’ হিসেবে অভিহিত করেন।

জাহানারা পুরুষদের সঙ্গে সাহিত্য, শিল্পকলাতেও টেক্কা দিতেন। দিল্লিতে চাঁদনি চকের নাম সকলেরই জানা। খুব কম মানুষই জানেন এই চাঁদনি চকের পরিকল্পনা করেছিলেন জাহানারা; কিন্তু ধনসম্পদ ছেড়ে সুফি ভাবধারায় মন দেন। গরিবদের কল্যাণের কথা ভাবতে শুরু করেন। সুফি সাধক নিজামুদ্দিন অউলিয়ার গরিবদের জন্য কাজকর্ম মনে ধরে যায়। কথিত আছে, নিজামুদ্দিনের সমাধি নিজের চুল দিয়ে পরিষ্কার করতেন সম্রাট-তনয়া। ইচ্ছা ছিল, তাঁকেও যেন ওই চত্বরেই কবর দেওয়া হয়। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের পাশেই দাফন করা হয় সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তম কন্যা জাহানারা বেগমকে।

জাহানারার কবিতা বিধৌত হয়েছে সুফি চিন্তার আরকে। তার পত্র বা রিসালাহ্র পরতে পরতে সুফি চিন্তাকে বিবৃত করেছেন অন্যদের কাছে। আর রুবাই বা অন্য সবফর্মেই তিনি তাঁর চিন্তাকে বিকশিত করেছেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি ও নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে মুর্শিদ মেনে।

মোগল বাদশা জালালুদ্দিন আকবরের পুত্র দানিয়েলের স্ত্রী ছিলেন যানান বেগম (মৃ-১৬৫৯)। সপ্তদশ শতকে তিনিই প্রথম উপমহাদেশে মেয়েদের মধ্যে কুরানের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তাফসির লিখেন।এই তাফসিরটির পাণ্ডুলিপি শ্বশুর আকবর বাদশা পঞ্চাশ হাজার দিনার দিয়ে কিনে নেন। যানান বেগম মন্ত্রী আবদুর রহিম খানের দুহিতা ছিলেন। তিনি তাঁর সময়ের অন্যতম কবি ছিলেন। এ ছাড়া তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য লোকজন তাঁকে সমীহ করতেন। তিনি সমালোচক ও প-িত ছিলেন। তাঁর স্বামী দানিয়েলের মৃত্যুর সময় ক্ষমতার মসনদে ছিলেন বাদশা জাহাঙ্গীর। স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও সতীত্বের জন্য জাহাঙ্গীর অনেকবার তাঁকে পুরস্কৃত করতে চেয়েছেন।

হামিদা বানো বেগম সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যার স্বামী মোগল বাদশা নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ুন আর মহান মোগল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবরের মতো পুত্র পেয়েছেন। তিনি ফার্সি ভাষায় খুব বিখ্যাত কবিতা আবৃত্তি করতেন। একইভাবে কবিতা লিখতেন। তার পুরো নাম হামিদা বানো মরিয়ম মাকানি। স্বামী হুমায়ুনের মৃত্যুর পরে আরো ঊনষাট বছর বেঁচে ছিলেন। হামিদা বানোর ‘দিওয়ান’ বা কবিতা সংকলনের আলোচনা আমাদের হস্তগত হয়েছে। তাঁর দিওয়ানের নাম-‘দিওয়ানে হিজরি’।

বাদশাহ শাহজাহানের এক কন্যা ছিলেন জাবিন্দা বেগম নামে। তিনি লাহোরে শিক্ষা-দিক্ষা অর্জন করেন। জাবিন্দা মিস্টিক বা রহস্যবাদী কবিতা লিখতেন। আসলে এসব তথ্য জানার পর মনে হয়-হারেম যেন কবিতার ঝর্নাধারা ছিল। ইতিহাস থেকে মোগল যেসব বেগমের নাম আমরা জানতে পারছি তাঁদের অধিকাংশই কাব্যকলায় পারদর্শী ছিলেন।

এবার আমরা বলব মোগল হারেমের সেই নারীটির কথা, যার সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিস্তর আলোচনা হয়েছে। জেবুন্নেসা মাখফি। বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের প্রথম সন্তান জেবুন। বদিউজ্জামান ওরফে শাহ নেওয়াজ খান সাফাভির কন্যা দিলরাস বানো বেগমের গর্ভে তার জন্ম। তিনি কবিতা ও গদ্য লেখার পর সাধারণত মোল্লা সাঈদ আশরাফ মাজনুনীর কাছে সম্পাদনা করতে পাঠাতেন। সারা জীবনে তিনি শাদি করেননি। জেবুন্নেসা আরবি ও ফার্সিতে সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ভালো একজন ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। নাস্তালিক, নাসখ ও শাকিস্তাতে ‘হরফের শিল্পকলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ‘মাখজানি গারায়েব’ এর লেখক আহমদ আলী সান্দেলভি বলেন, ইমাম আল রাজি লিখিত কোরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তাফসীরে কবীরের অনুবাদ ছাড়াও অসংখ্য বই রচনা করেছেন। আওরঙ্গজেব যখন কবিতাকে দরবার থেকে বহিষ্কার করেছিলেন, তখন জেবুন্নিসাই কবিতার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, কবিদের দুর্গে নিয়ে এসেছিলেন। পয়ষট্টি বছর বয়সে জেবুন মারা যান। তাঁর সমাধি পাকিস্তানের লাহোরে।

জেুবন্নেসাকে নিয়ে বাংলাতেও অনেক চর্চা হয়েছে। তিনি মাখফি নাম নিয়ে লেখা-লেখি করতেন। 

বাংলা ১৩১৬ সালে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘ভারতীয় বিদুষী’ বইতে অনেক বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া ১৩২৬ সালে ‘মোগল বিদুষী’ রচনা করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। এখানে জেবুন্নেসাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা আমাদের নজরে এসেছে। বিশেষ করে তার সাহিত্য প্রতিভার বিষয়টি দৃকপাত করা হয়েছে ফারসি উদ্ধৃতির মাধ্যমে।

শেষোক্ত বইয়ের বদৌলতে জানা যায়, জেবুন কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এক্ষণে বই থেকে উদ্ধৃতি করছি-‘যাঁহার প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্য্যরে তুলনা নাই, জেব্-উন্নিসা সেই মহাভাগ্যবান্ ভারতেশ্বরের আদরিণী কন্য,-ইচ্ছা করিলে যে কোনরূপ বিলাসব্যসনে আমরণ নিমগ্ন থাকিতে পারিতেন; কিন্তু এই বিদুষী বাদশাহ্ দুহিতা সে সকলকে একান্ত অকিঞ্চিৎকর মনে করিয়া, জ্ঞানানুশীলন ও সাহিত্য-চর্চাকেই তাঁহার পুণ্যময় জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। পুস্তকাগারে সংগৃহীত ধর্ম ও সাহিত্য-সম্বন্ধীয় বহুগ্রন্থ তাঁহার জ্ঞানার্জন-স্পৃহা ও পবিত্র জীবনযাপনের সাক্ষ্যস্বরূপ বিদ্যমান ছিল। আবার এই সাহিত্য-চর্চা শুধু যে তাঁহার নিজের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল, এমন নহে; তিনি নিজেও যেমন সাহিত্যানুরাগিণী, সাহিত্যিকগণের সাহিত্যানুরাগেরও তেমনই উৎসাহদাত্রী। বহু দুস্থ লেখক তাঁহার নিকট সাহায্য পাইয়া সাহিত্য-সেবার সুযোগ লাভ করিতেন। সাহিত্যের উন্নতিকল্পে জেব অনেক সুপণ্ডিত মৌলভীকে যোগ্য বেতনের নূতন পুস্তক-প্রণনয়নের জন্য, অথবা তাঁহার নিজের ব্যবহারার্থ দুষ্প্রাপ্য হস্তলিখিত পুঁথির নকল-কার্য্যরে জন্য নিযুক্ত করিয়াছিলেন। যে সকল লেখ তাঁহার যত্ন ও চেষ্টায় যশস্বী হন, তন্মধ্যে মুল্লা সফী-উদ্দীন অর্দ্দবেলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি আরবিতে কোরআনের মহাভাষ্যের অনুবাদ করেন; এই গ্রন্থের নাম ‘জেব-উৎতফসির’। সফী-উদ্দীন্ গ্রন্থখানি জেব-উন্নিসার নামে প্রচার করেন। ...প্রকৃতি জেব-উন্নিসাকে সৌন্দর্য্যের ললাভূতা করিয়া সৃষ্টি করিয়াছিলেন। বাহিরের রূপ, আর অন্তরের পাণ্ডিত্ব ও কবিত্ব-প্রতিভা তাঁহার অসামান্য গৌরবের কারণ হইয়াছিল। মোগলের নিভৃত অন্তঃপুরে ঘনঘোর পর্দ্দান্তরালে বসবাস করিয়াও জেব্, পত্রাবগুণ্ঠনে বিকশিত, সুরভি-সৌন্দর্য্য-মণ্ডিত গোলাপ পুষ্পের ন্যায় আপনাকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে লুক্কায়িত রাখিতে পারেন নাই-দেশদেশান্তরে তাঁহার যশ পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল।’

বাদশা আলমগীরের দ্বিতীয় কন্যা জিন্নাতুন্নেসা (জ.১৬৪৩)। তাঁর মা দিলরাস বেগম। বাদশাহের কড়া তত্ত্বাবধানে ইসলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পারদর্শী হন। তবে জেবুনের মতোই একই পথে হেঁটে ছিলেন। তিনিও কবিতা রচনা মশক করেছিলেন।

বাদশাহ আলগীরের আরেক কন্যা জুবদাতুন্নিসা বেগম। তিনিও কবি, বাগ্মী ও চারুকলায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি সাবলীলভাবে তুর্কি ও আরবি বলতে পারেন। দাদা সম্রাট শাহজাহান দারা শিকোহ্র কনিষ্ঠ পুত্র সেপেহার শিকোহ্র সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বিয়ের বছর আলমগীর বাদশা মারা যান।

মোগল হারেমের আরো একজন বিখ্যাত কবি সালিমা সুলতানা বেগম। তাঁর বাবা নুরুদ্দিন। আর তাঁর চাচা ছিলেন বাদশাহ হুমায়ুন। স্বভাব ছিল খুবই ভালো। সালিমা সুলতান বেগমের কাব্য; মধুর অলঙ্কার ও সমাপ্তি শব্দ সমকালের কবিদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। তাঁর কবিতা ছিল খুবই তথ্যবহুল ও উপভোগ্য। তিনি একজন সুপ-িতও ছিলেন। বাদশাহ আকবর তাঁকে বৈরাম খান ওরফে খান বাবার সঙ্গে বিয়ে দেন।

হারেমের আরেক কবি হলেন আবাসা বেগম। আরাম জানের গর্ভে তাঁর জন্ম। তার পিতা মোহাম্মদ মির্জা। মায়ের মতো তিনিও একজন কবি ছিলেন ও খুব ভালো কবিতা লিখতেন।

আশরাফ জামানি বেগম ছিলেন একজন মোগল হারেমের কবি। তিনি ছিলেন মূলত বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের পুত্রবধূ। আর যুবরাজ মুহাম্মদ মোয়াজ্জম শাহ আলম বাহাদুর শাহের প্রথম স্ত্রী। তাঁর পিতার অনুগ্রহ, সাহচর্য এবং শিক্ষার প্রভাব তাঁকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। তিনি সবচেয়ে কঠিন কবিতাগুলো সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারতেন। তিনি নিজেও ফার্সি কবিতা আবৃত্তি করতেন ও লিখতেন। বাদশাহ বেগম নামে আওরঙ্গজেবের আরো একটি কন্য ছিল। তিনিও কাব্যচর্চা করতেন। তাঁর দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ ও প্রশস্ত। সম্রাট তাঁর এই মেয়েকে কবিতা থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর মেয়েকে বলেন, সম্রাট ও অভিজাতদের কাজ কবিতা লেখা নয়।

এ পর্যন্ত যেসব কবির কথা উল্লেখ করেছি তাঁরা ফার্সি (বা আরবি বা তুর্কি) কবি। আগেই বলেছি, তখন ফার্সি ছিল ভারতের সরকারি ভাষা। বাদশা আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিমুরিদ রাজবংশের অবক্ষয় শুরু হয়। কিন্তু উর্দু ভাষার শন আখতার মুহাম্মদ শাহ (রঙ্গিলা) হলেন প্রথম তিমুরিদ সম্রাট যিনি শ্রদ্ধা জানাতে উর্দুকে অবলম্বন করেছিলেন। শাহ আলম ছিলেন তিমুরিদ সম্রাটদের মধ্যে প্রথম উর্দু কবি। নীচে তিমুরিদ রাজবংশের উর্দু কবিদের একটি তালিকা দেওয়া হলো-

নবাব আখতার মহল আখতার : তিমুরিদ রাজবংশের শাহযাদি। ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। তাঁর কবিতার চরণ এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে-

‘লিখে যে আমার নাম মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে-

তার চতুরতা আমি অনলে দিয়েছি জ্বালিয়ে;

বন্ধুর তীক্ষ্ণ নজর আমার বুকের দুদিকে!

আসলে একদিকে আমার কলিজা,

আরেক দিকে রয়েছে হৃদয়।’

মহল আখতার ‘খামসা শায়েরী’ বা পাঁচ পঙ্ক্তির নাত (নবির শানে প্রশংসা মূলক কবিতা) লিখেছেন অনেক। এর একটি উদ্ধৃত করা হচ্ছে-

‘তোমাতে আমি কুরবানি হে হাশেমি ও মুতালেবি

তোমার উচ্চবংশের কারণে দোজাহানের হয়েছ বাদশা।

পদমর্যাদা রোশনায় উদ্ভাসিত হয়েছে আকাশজুড়ে

ও আমার মক্কার সাইয়্যেদ, ও আমার মদিনার আল-আরাবি

তোমার জন্য আমার সমস্ত ত্যাগ, তোমার কারণে ছুটেছে সুরভী।”

১২৯০ হিজরিতে ইশক নামে হারেমের এক কবি মারা যান। তিনি দিল্লির হারেমে ছিলেন। ইশক তাঁর ডাক নাম। আসল নাম কী আমরা তা জানতে পারিনি।

আমার মন ভোলানো, ভুবন ভোলানো কথা আসে না।

তুমি হলে অবিশ্বাসের প্রতিমা, তাইতে এতো ভয়!

কীভাবে বুঝব বলো প্রেমিকের ইচ্ছে আমাকে চুম্বনের?

শুধুই তো ঘুর ঘুর করো, কাছে তো আস না!’

ইশক-এর এই কবিতায় পুরুষবাচক একটি বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। ‘মাইনে না মানো গা’। এটি নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন- এটি ইশক-এর কবিতা কি না? কারণ সে সময় পুরুষ কবিরা সাধারণত এ ধরনের বাক্য প্রয়োগ করতেন। এর উত্তরে একজন এ সময়ের সাহিত্য সমালোচক উল্লেখ করেছেন, এটাতে আমি তো কোনো সমস্যা দেখিনা। আধুনিক সময়ে দুজন খ্যাতিমান উর্দু কবি পারভীন শাকের ও ফাহমিদা রিয়াজ তাদের কবিতায় এমন পুরষবাচক বাক্য অনেক প্রয়োগ করেছেন। ফলে সংশয় অপনোদন হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।

সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের হারেমে নবাব জিনা বেগম বিনতে মির্জা বাবর গুরগানি নামে একজন কবি ছিলেন। তিনি সম্রাটের খাসমহলেই বড় হয়েছেন। তার চরণ-

‘না মন আমার শান্ত আছে, না হৃদয়

তোমাতে মিলব বলে আছি যে উতলা।’

নবাব হায়াতু্ন্নেসা বেগম ওরফে ভুরা বেগম নামে দ্বিতীয় শাহ আলমের হারেমে আরেকজন কবি ছিলেন। তিনি শাহ নাসির দেহলভীর ছাত্রী ছিলেন। হায়াতুন সারা জীবন আল্লাহ স্মরণে কাটিয়েছেন এবং বিয়ে করেননি। বয়সও যথেষ্ট হয়েছিল। বাহাদুর শাহ জাফরের শাসনামলে মারা যান।

নবাব কুদসিয়া বেগম, তাঁর আরেক নাম আদম বাই। মোহাম্মদ শাহ-এর হারেম ছিল রঙ্গশালা। স্বামী তাদের নিজের রঙে রাঙিয়েছিলেন। তিনি খুব সচেতন ও ফ্যাশানদুরস্ত ছিলেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ মতামত শায়েরীতে ধরাশায়ী হয় বহু ছেলে। কিন্তু মুহম্মদ শাহের মত তিনিও রাতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর পুত্র আহমদ শাহ বাদশাহের শাসনামলে সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা তাঁর হাতে ছিল। দিল্লির বিখ্যাত কাশ্মীরি গেটের কাছে একটি সুন্দর বাগান তৈরি করা হয়েছিল আর সেখানে একটি মসজিদও তৈরি করা হয়েছিল। উর্দু ছাড়াও, তিনি ফার্সি ও হিন্দিতেও তার হাত মশ্ক করেছিলেন। 

নবাব শরফিউন্নিসা বেগম নামে আরেক কবির কথা জানা যায়। যুবরাজ ওয়াজিহউদ্দিন মির্জার চক বাহাদুরে একটি বিশেষ প্রাসাদ ছিল। সেখানে থাকতেন তিনি। খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। তিনি কবিতার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন, তবে তিনি খুব কমই কবিতা লিখেছেন। নাতে রাসুল ছিল তার বিশেষ বিষয়। কাফি নামে একজন শাহাজাদি ছিলেন। তিনি নিজেকে তিমুরিদের রাজকন্যা বলতেন। ইতিহাসের বইয়ে তাঁর সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত উল্লেখ নেই। তিনি ১৮৫৭ সালের আগে মারা যান। হাদিসে কুদসি নিয়ে তার অনেক খুমসা বা পঞ্চম চরণের কবিতা রয়েছে। 

গীতি আরা নামে একজন হারেমের কবি ছিলেন। তাঁর সম্পর্ক বিশেষ কিছু বলতে পারেন না তেমন কেউ। দিল্লির এই ভদ্রমহিল নিজেকে দাবি করেছিলেন রাজকন্যা বলে। তাঁর কবিতার প্রতি আগ্রহ ছিল।“তাজকিরায়ে নিসওয়ানে হিন্দ”-এ তাঁর একটি কবিতা সংরক্ষিত আছে। নবাব সুলতান জাহান বেগম মাখফি নামে একজন কবির কথা উল্লিখিতগ্রন্থে রয়েছে। মির্জা কাদির বখশ গুরগানির বিশেষ প্রাসাদে তিনি থাকতেন। সে সময়ের তিনি একজন চমৎকার কবি ছিলেন।

‘এতে কি জানি কি লুকিয়ে আছে

আল্লাহই জানেন ভালো,

জুলুমে খুশি তুমি খুশি হয়েছ খুব

ভেবেছ এতেই তোমার জিৎ!’-তাঁর শায়েরির দুটি পঙ্ক্তি।

হারেমের অন্য এক কবির নাম নবাব আলম আরা বেগম নাজ। তিনি ছিলেন তৈমুরিদ পরিবারের এক বিস্ময়কর রাজকন্যা। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের আগে, কবি ও রাজকন্যাদের মধ্যে তার উচ্চ অবস্থান ছিল। 

‘এই যে অবিশ্বাসের শোরগোল হচ্ছে-

এখানে তো প্রবেশের অধিকার নেই তোমার,

ঝগড়া করো না বাছা-

তুমি তো আলীর যে দাস-

তারও এক খ্যাতিমান দাস।

যদিও রাজ্য পেয়ে হয়েছ বাহাদুর খুব,

একদিন জানি তোমার জন্য আমাকে কাঁদতে হবে

কারণ তুমি যে সেইদিন মারা যাবে রাজা।

আবেগ তো মৃত্যুর লক্ষণ- জেনে রাখ তবে!’

দ্রষ্টব্য. ‘তাজকিরা বাহারেস্তান নাজ’ এর লেখক লিখেছেন, এই মহিলা ছিলেন দিল্লির রাজকন্যাদের একজন। বিবাদের সময় তিনি একটি লেখা লিখেছিলেন। তার কিছু পঙক্তি শোনা গিয়েছিল, আর কিছু কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পাননি।

সেইসব সুখদস্মৃতি আর থাকল কই 

চলে যাচ্ছে সবই

গোসল ও কাফন শেষে বসে 

আছে মরণাপন্ন সকলি।

যুগ যুগ ধরে হারেমের কবিরা তাদের অনুপম কবিতার অনেক নজির রেখে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় মোগল এসব বিদুষী কবিতার মাধ্যমে যুগের গভীর অন্ধকারে আলোকবর্তিকা জ্বেলেছেন। আমরা এতক্ষণে জানতে পারলাম হারেমের রমণীরা কেমন উজ্জ্বল, কেমন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলো। বুদ্ধি জ্ঞান গরিমায় তাদের জুড়ি মেলা ভার। স্রেফ এসব কাহিনী নয়। এসব দৃষ্টান্ত আশা করি সকলের চেতনায় নাড়া দেবে। সে কারণে উচ্চারিছি- ‘এ নহে কাহিনী, এ নহে স্বপন, আসিবে সেদিন আসিবে।’ আশার ছলনে তাই আপাতত ভুলে থাকা ছাড়া গত্যন্তর কী আছে? আসুন এক্ষণে বিজয়কৃষ্ণের অনুবাদে জেবুন্নেসার কয়েকটি পঙ্ক্তি উচ্চারণ করি-

‘যাক্ বা থাকুক প্রাণ-হোক্ লাভ, কিম্বা হোক্ ক্ষতি,

চলে যা’-ভ্রুক্ষেপহীন, বেদনায় রহি অবিচল;

খুঁজিস্ নে তীর কিম্বা তল

অপার, অপরিসীম প্রেম-সিন্ধু-সলিলেতে আর।

 (দিওয়ানে মাখফি : জেবুন্নেসা)  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //