আল মাহমুদ এক দূরগামী পাখি

হাওয়ার পরতে হাওয়া ভেসে যায় আমি কি কোথাও আছি!/আমাকে নিয়ে কি খেলা করে তবে ইতিহাস-কানামাছি?/কতবার বলি একটু দাঁড়াও আমি অনন্তকাল/আমাকে ছুঁয়েই পার হয়ে যাই সময়ের মহাকাল। (‘ইতিহাস কানামাছি’/তোমার রক্তে তোমার গন্ধে); 

ঘটনাক্রমে, কবিতার সারাৎসারে আল মাহমুদ চির জাগরূক। বোধের  কানামাছি খেলতে খেলতে আমরা পুনর্বার ফিরে আসি তাঁর কবিতার বাঁকে। পাঠক হিসেবে, লেখক হিসেবে মাহমুদের পঙ্ক্তির কাছে এক মহান বিস্ময় লক্ষ করি। নিজেই নিজেকে নিয়ে সংশয়ে, আবার নিবিড় প্রত্যয়ে কবি আমাদের দার্ঢ্য কণ্ঠস্বর শুনিয়ে যান। কবি উচ্চারণ করেন- যে পথে চলিনি আমি সে পথে আমার পায়ের ছাপ/চলে গেছে দেখে যখন আঁতকে উঠি, মনে হয়/ আমি এক শূন্য ভিটেবাড়ি। আমি নেই, আমার ভিতর থেকে/কোন এক শুকুর মামুদ রগ-রেশা ছিন্ন করে চলে গেছে/অন্তহীন দিগন্তবিস্তৃত পথ ধরে/অন্তিমের দিকে। কোথায় অন্তিম তবে? (আল্লার কসম/ তোমার রক্তে তোমার গন্ধে)। কবি আল মাহমুদ একদা এক অস্পষ্ট কুয়াশার মধ্যে যাত্রা শুরু করেন। তথাপি দিগন্তে আলোর ঝলকানিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছেন এই লোকালয়ে। কবি আমাদের সবার হৃদয়ে নিসর্গের এক অপরূপ ছবি হয়ে ভেসে আছেন। অনন্তের দিকে ধাবমান কবির দিকে চেয়ে থাকি অনবরত বর্ষণের জন্য, সেই বর্ষণ ঘনবৃষ্টির নয়; শুধু আকাঙ্ক্ষামাত্র- আবার একটি নতুন কবিতা জন্ম দিবে কবি; কিন্তু তা তো আর হবার নয়, তিনি বিগত হয়েছেন। রেখে গেছেন সোনালি অক্ষরগুলো। 

‘...কিন্তু একজন কবিকে কি দেবে তোমরা? যে ভবিষ্যতের দিকে/দাঁড়িয়ে থাকে বিষণ্ণ বদনে? অঙ্গুলি হেলনে যার নিসর্গও/ফেটে যায় নদীর ধারায়। উচ্চারণে কাঁপে মাঠ,/ছত্রভঙ্গ মিছিল, মানুষ, পাক খেয়ে এক হয়ে যায়।/যখন সে ফিরে, দেখে, আচ্ছন্ন উঠোন। সে দেখে/শিশুর শব নিস্পৃহ মায়ায়। সে দেখে ধর্ষিতার শাড়ি/ছিন্ন ভিন্ন, হত্যায় ছাপানো। স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে/ইতিবৃত্ত ভেঙে পড়ে রক্তবর্ণ অক্ষরের স্রোতে। (স্তব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে/সোনালি কাবিন)। কবির সেই স্বদেশভূমি জাগ্রত হয়ে উঠেছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে আছেন তাই তিনি এখনো। ‘হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর।’- এই মন্ত্রে ‘ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ’ নিয়ে প্রাণ উজাড় করে লিখেছেন আল মাহমুদ। এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছিলেন,... আমি তো মনে করি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো যোগ্য কবি জসীমউদ্দীও ছিলেন; কিন্তু নেবেল পুরস্কার পাওয়ার ভাগ্য সবার কী হয়? জসীমউদ্দীনের মতো সমকক্ষ কবিরাই বিশ্বে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। জসীমউদ্দীনের মতো কবি যদি অন্য ভাষায় থাকত তাহলে তাকে ঠিকই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো।’ সমকালের পাঠক এবং সমালোচকগণ আমরা মনে করি, জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের মিলিত স্বর, শৈলীর উত্তুঙ্গ প্রকাশ আর মধুসূদনের নিপাট সাহসের সম্মিলন আল মাহমুদ। কবিতার শব্দ-ব্যবহারের নিপুণতাই নয়; কিন্তু স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে আল মাহমুদ নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার একজন অগ্রগামী কবি। 

‘আমাকে শিখতে হবে।/যেমন আমি একদা বৃক্ষের আওয়াজ থেকে বের করে নিতাম।/নদীর কাছ থেকে রপ্ত করেছিলাম তরঙ্গের ভাষা।/আমি গোখরো সাপের হিস্হিসানির মধ্যেও কোনো জটিলতা দেখি না।/কিন্তু মানুষ যখন রাজনীতি, মানবকল্যাণ ও গণতন্ত্রের কথা বলে/তখন যেন মনে হয় একটা আস্ত দেশকে কতিপয় গূঢ়ার্থবাদী পিশাচ/ছারখার করে দিচ্ছে?/মানুষের ভাষার মত দুর্বোধ্য পৃথিবীতে আর কিছু নেই।’(বিপরীত উচ্চারণ/কবিতা সংগ্রহ);

তাঁর সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, ‘আধুনিক জীবনের কর্মকাণ্ডের মালটিপ্লিসিটি (Multiplicity) বা বহুলীকৃত অজস্রতা অনেক কবিকে অস্থির করেছে, তাই তাঁদের কবিতায় ভাষার অস্পষ্টতা এবং জটিলতা এসেছে। আল মাহমুদের কবিতা এ-সংকট থেকে মুক্ত। আন্তরিক সত্যের সামীপ্যে তাঁর কবিতা স্পষ্টবাক প্রকৃতির মতো উন্মুক্ত ও স্বাভাবিক। কোনো অঘটনে নয় কিন্তু হৃদয়ের লোক-লোকান্তরে তার বসতি; তাই তিনি উজ্জ্বল, স্বতন্ত্র এবং একনিষ্ঠ।’ মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মীর আব্দুর রব, মাতা রওশন আরা মীর। জীবনস্মৃতির প্রকাশধর্মী গ্রন্থ-‘যেভাবে বেড়ে উঠি’তে তিনি বাল্যকাল এবং তাঁর পরিবারের ঐতিহ্য এবং পরিবেশ বর্ণনা করেছেন তাতে তিনি তাঁর এবং পরিবার সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বলেন তা হচ্ছে- ‘আমার দাদা মীর আব্দুল ওহাব ছিলেন কবি। আরবি-ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত। সংস্কৃতও জানতেন।... লাঠিখেলা ও তরবারি চালনায় ওস্তাদ। পশু-পাখি ইত্যাদি পোষার অত্যন্ত শখ ছিল। ...তিনি ছিলেন ধর্মভীরু, অতিথিপরায়ণ ও অপরিণামদর্শী। ...সামান্য জমিজমা থেকে তার পরিবার সংসারের আহার্যের সংস্থান হতো। তাছাড়া তিনি বাড়ির সামনেই যে হাইস্কুলটি ছিল তাতে শিক্ষকতা ও প্রধান কেরানির চাকরি করতেন।... গান-বাজনা ভালোবাসতেন। কোরআন তিলাওয়াতের সময় মনে হতো এক অপার্থিব কণ্ঠ সুষমার অধিকারী তিনি।’

এই সত্যতার মাঝে ক্রমশ তৈরি হয়েছে কবির মানস গঠন। তাঁর সমগ্রসৃষ্টিশীলতা আরো বহুকাল চিন্তাশীল মানুষকে আলোর পথ  দেখাবে এ প্রত্যাশা আমাদের। ‘আল্লার কসম’ কবিতায় কবি বলছেন-

‘শুকুর মামুদ আর ফিরবে না। কিন্তু তার অসম্ভব কবিতার বোঝা/রেখে গেছে আমার শয্যায়। এখন এ হারামজাদি পার্শ্বচারী/নদীটিকে বলি- খাও এই অস্থি মজ্জা মেদ মাংস মাত্রা বোধ,/ছত্রাকসমূহ।/দোষারোপ কাকে করো? বলো, কার বিরুদ্ধে নালিশ?/

হিসহিস শব্দে শূন্য কানে কত আর ভরে দেবে গলিত তামার/ মতো তোমার তাপিত স্তনভার।/উরত উদোম করে গলিত লাভার মধ্যে জোর করে ঠেসে ধরা/

আমার মস্তক আমি তো তুলতে পারব না। এই লাভা ঠান্ডা হয়ে/ 

এখন কি হবে না পাথর।/

এই খেলা শেষ হোক, শেষ করো অন্তত এখন।/ 

আল্লার কসম আমি আর আসব না। ভাসব না পৃথিবীর/

রক্ত পুঁজ ক্লেদের ভিতরে।/

আল মাহমুদ বরাবরই উচ্চারণ করেছেন কবিতার ভেতরে তাঁর সাহসিকতার কথা। যেমনটি ’শিকদারের প্রতি’ কবিতায় উচ্চারণ করেন- ‘সাহসই তোমার শক্তি। সাহসের অন্য নাম জেনো কাব্যরস;/ কী বা আসে যায় বলো কত হলো তোমার বয়স?’ ‘দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করে দুটি ছত্র লিখে দিই আমি/আমি কেউ নই বটে কিন্তু এক পাখি দূরগামী।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //