এলিসিও দিয়েগো

পূর্ণ-অপূর্ণ

কিউবার কবি ও গল্পকার এলিসিও দিয়েগোর জন্ম ১৯২১, মতান্তরে ১৯২০ সালে, হাভানায়। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বিস্তীর্ণভাবে ঘুরে বেড়াবার অবকাশ পান। রূপকধর্মী, কখনো বা হালকা বিদ্রুপের ছলে উপকথা ধরনের ছোট ছোট স্কেচগুলো একসময়ে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘দিভারটিমিয়েনটস’ ১৯৪৬ তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গল্পসংকলন। 

আজন্ম অন্ধ একটা মানুষ ঘটনাচক্রে এমন একটা জিনিস পেয়ে গিয়েছিল, যেটা শেষঅবধি পৃথিবীতে তার একমাত্র সম্পদ হয়ে উঠল। জিনিসটা আসলে কী, তা কোনোদিনই তার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। তবু মানুষটা তৃপ্তি পেতো তার কিছু কিছু অংশে আঙুল ছুঁইয়ে, অবিশ্বাস্য সুষমার দানে তিলে তিলে গড়ে ওঠা তার সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে; কিন্তু এতে সে পুরোপুরি খুশি হতে পারতো না। কারণ যেটুকু সে জেনেছে, তা শুধু অজানায় হারিয়ে থাকা অংশগুলোকে জানার তৃষ্ণাকেই জাগিয়ে তোলে। জিনিসটাকে কোনোদিনই সম্পূর্ণ আপন করে পাবে না জেনে, সেটাকে সে একজন বধির মানুষকে দিয়ে দিলো। বধির মানুষটাকে সে শিশুকাল থেকেই চিনতো- সেদিন বিকেলে সে অন্ধের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

‘কী সুন্দর মেয়েগুলো!’ বধির উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

‘কোন মেয়ে?’ অন্ধ চিৎকার করে জানতে চাইল।

‘এই তো, এগুলো!’ জিনিসটার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করেই জবাব দিলো বধির; কিন্তু অবশেষে সে বুঝতে পারলো, এভাবে কোনোদিনই তারা একমত হতে পারবে না। তাই জিনিসটাকে সে অন্ধের হাতে তুলে দিলো। অন্ধ সেই পরিচিত বস্তুটাতে আঙুল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে যেন নতুন করে তাকে অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো প্রাণপণ।

‘হ্যাঁ, মেয়েই তো!’ অন্ধ অস্ফুটে বিড়বিড় করে জিনিসটা ফিরিয়ে দিলো বধিরকে।

বধির জিনিসটাকে বাড়িতে নিয়ে গেলো। জিনিসটা হাতে হাত ধরে থাকা তিনটি মেয়ের মূর্তি। তাদের চুল, হাত আর পোশাক এক অসীমকোমল লাবণ্যে একাকার হয়ে মিশে গেছে। প্রায় স্বচ্ছ মর্মর পাথরে গড়া ওদের অবয়ব। ভেতর থেকে ফুটে ওঠা আলোর আভায় ওরা আলোকিত। ঈগলের মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টি বধিরের, মূর্তিটার বেদিতে সে একটা স্প্রিং আবিষ্কার করে ফেলল। স্প্রিংটা টিপে দিতেই নাচতে শুরু করে তিন কন্যা; কিন্তু বধির মর্মে মর্মে অনুভব করে, ওদের সে কোনোদিনই সম্পূর্ণ আপন করে পাবে না। তাই তিন নর্তকীকে সে তার এক বন্ধুকে দিয়ে দেয়।

মেয়েগুলোর দিকে আঙুল তুলে লোকটা বলল- ‘কী অপূর্ব সুর!’ 

বধির জিজ্ঞেস করে- ‘সেটা কী?’ 

‘নাচের বাজনা,’ বন্ধুটি তাকে বুঝিয়ে দেয়।

‘হ্যাঁ,’ বধির বলে, ‘আমি জানতাম বাজনা থাকতেই হবে; কিন্তু সেটা কেমন, তা আমি জানতে পারিনি।’ তিন নর্তকীর মূর্তিটা সে তার বন্ধুকেই দিয়ে দেয়।

বন্ধুটি মূর্তিটাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাজনাটা যেন বেতবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। নিজে থেকে সেটা শুরু হয়, নিজে থেকেই ফুরিয়ে যায়। অবাক হয়ে নর্তকীদের শরীর, ওই সুর আর ওদের নাচের অপরূপ একত্বের কথা চিন্তা করে মানুষটা; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে অনুভব করে, ওদের সে কোনোদিনই সম্পূর্ণ আপন করে অধিকার করতে পারবে না। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে আসা একজন প্রাজ্ঞ মানুষকে মূর্তিটা দিয়ে দেয় সে।

‘এ যে তিন মূর্তিময়ী সুষমা!’ পণ্ডিতপ্রবর উচ্ছ্বসিত সুরে বললেন, ‘এ কোন রত্ন তুমি পেয়েছো, জানো? এঁরা সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী তিন গ্রিক দেবী- ডিউক অব বার্গাণ্ডির জন্য বল্ডউইন এটা তৈরি করেছিলেন!’

মানুষা তখন বুঝতে পারল, নামের মধ্যেই জড়িয়ে আছে ওই নর্তকীদের রহস্যময় নির্বিকার অভিব্যক্তির ব্যাখ্যা।’ মূর্তিটার দিকে দেখিয়ে মানুষটা বলল- ‘তাহলে আপনিই ওঁদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করুন।’ পণ্ডিত তখন তিন সুষমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

বন্ধ পাঠাগারে বসে প্রাজ্ঞ মানুষটি ওঁদের নাচ দেখতে দেখতে সরবে ওঁদের কথা চিন্তা করতে থাকেন। চিন্তা করেন ওঁদের আসল নাম...নাচে আত্মহারা ওঁদের শরীর...ওঁদের নাচ আর ওই বাজনার মধ্যে গড়ে ওঠা গোপন সম্পর্কের কথা। চিন্তা করেন ওঁদের দেহের অলৌকিক জন্মকথা, যা গড়ে উঠেছে স্রষ্টার অসীম ভালোবাসা আর ঈশ্বরের স্বর্গীয় আশীর্বাদে; কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই প্রাজ্ঞ মানুষটি মারা গেলেন- মারা গেলেন এক অস্বস্তিকর অনুভূতিকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবিত অবস্থায় তিনি কোনো দিনই ওঁদের সম্পূর্ণ আপন করে পাবেন না।

প্রাজ্ঞ মানুষটির অজ্ঞ পরিজনরা তাদের মতোই অজ্ঞ এক ব্যবসায়ীর কাছে তিন সুষমাকে বিক্রি করে দিলো। ব্যবসায়ী অন্যান্য খেলনার সঙ্গে জানলার কাছে কাচের আড়ালে রেখে দিলো তিন কন্যাকে। একদিন একটি ছেলে মূর্তিটা দেখতে পেল। কাচের সঙ্গে নাক ঠেকিয়ে বহুক্ষণ ধরে তিন কন্যাকে দেখতে দেখতে সে বিষণ্ণ হয়ে ভাবল ওদের সে কোনোদিনও নিজের করে পাবে না। এবং বাস্তবে ঠিক তা-ই ঘটল- ছেলেটি বাড়িতে চলে যাবার খানিকক্ষণের মধ্যেই এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দোকানটা ধ্বংস হয়ে গেলো আর সেই সঙ্গে দোকানের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেলো সেই তিন সুষমা।

সেদিন রাতে ছেলেটি ওদের স্বপ্ন দেখল। স্বেপ্নে সে দেখল- ওরা তার,সম্পূর্ণ তার, চিরদিনের জন্য শুধু তার।


ভাষান্তর : সুদেষ্ণা ঘোষ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //