সাহিত্য ও দর্শন

এক.

সাহিত্যিক আহমদ ছফা তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়। তার গদ্যের সাবলীলতা এবং সহজ-সরলভাবে নিজের কথা হাজির করবার পারদর্শিতার জন্য তরুণরা তাকে ভালোবাসে। একই কারণে হুমায়ূন আহমেদের সরলভাবে গল্প বলার স্টাইলও গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যের দিক থেকে এই অর্জনগুলো বাংলাদেশের জন্য মূল্যবান। 

তবে ভাষাশৈলীর তর্ক শুধু সহজ-সরলভাবে লিখতে পারার তর্ক নয়, সাহিত্যের জগৎ ছেড়ে আমরা যখন মৌলিক চিন্তার জগতে প্রবেশ করি, তখন প্রকাশের সরলতার চেয়েও নতুন চিন্তাকে ভাষায় গ্রেফতার করতে পারার বিষয়টি প্রধান হয়ে ওঠে। তার জন্য দার্শনিককে প্রচলিত ভাষার ওপর নির্ভর করলে চলে না, তাকে নতুন ভাষা তৈরি করতে হয়, সেই ভাষাকে জবাবদিহি করতে হয়েছে খোদ চিন্তার কাছে। সাহিত্য বা নন্দনতত্ত্ব সেই ভাষায় আগ্রহী হয় বটে; কিন্তু দর্শনের ভাষাকে সাহিত্যের মানদণ্ড দিয়ে বিচার করলে সেটা সাহিত্যের বিচার হয়, দর্শনের পর্যালোচনা হয় না। কোনো ভাষাই সাহিত্যগুণ বর্জিত নয়। দার্শনিক লেখালিখিও সাহিত্য বর্জিত নয়। সে কারণে সাহিত্যের ভাষা আর দর্শনের ভাষা এক নয়। বাংলাদেশে শক্তিশালী দর্শন গড়ে না ওঠার কারণে এই ভেদ জ্ঞান এখনো আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেনি। 

প্রশ্ন উঠতে পারে সাহিত্যে কি দর্শন থাকে না? অবশ্যই থাকে। কীভাবে থাকে সেটা দর্শন নিজেও বোঝার চেষ্টা করে। দর্শনের সেই শাখার নাম নন্দনতত্ত্ব। নন্দনতত্ত্বের প্রথম অনুমান হচ্ছে সাহিত্যে সাহিত্য ছাড়াও এমন কিছু থাকে যাকে দার্শনিক বিচারের জায়গা থেকে আলাদা করা সম্ভব। সেই বিষয়কে আলাদা করা এবং আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা দর্শনের কাজ। কিংবা আদৌ আলাদা করা সম্ভব কিনা তা নিয়েও দর্শনে তর্ক চলতে পারে, যেমন একালের দুই দার্শনিক জাক দেরিদা এবং ইয়ুর্গেন হাবেরমাসের মধ্যে চলেছে। তবে সেই তর্ক সাহিত্যের তর্ক নয় দর্শনেরই তর্ক।  

আরেকটি প্রশ্ন প্রায়ই করা হয়। সাহিত্যিকদের বিশেষত কবি, গল্পকার, উপন্যাস লেখক, রম্য রচনা রচয়িতা, ভ্রমণ কাহিনী রচনাকার, আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যের লেখক এদের কি দর্শন পড়া বাধ্যতামূলক? না, মোটেও না। যদি তারা পড়েন তাহলে তাদের সাহিত্য দর্শনের গুণে গুণান্বিত হতে পারে বৈকি; কিন্তু নাও হতে পারে। সাহিত্যের সাধনা দর্শন না, সাহিত্য। সৃষ্টিশীল সাহিত্যে মানুষের লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। অতএব, দর্শন পড়ে সাহিত্য করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। 

মানুষ যা কিছুই করুক তার মধ্যে চিন্তা কোনো না কোনো রূপে হাজির থাকে। হোক তা রান্না করা, ঘর গোছানো, বাগান করা, স্থাপত্যগিরি বা ঘরামির কাজ, কিংবা নগর পরিকল্পনা সব কিছুর মধ্যে মানুষের চিন্তা নিজেকেই মূর্ত করে। সব কিছুই দর্শনের বিষয়। আমি দার্শনিক তাগিদ থেকে কৃষিকাজ করি, তার নাম ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’। বাংলার ভাব বা দর্শনের ঐতিহ্যের ওপর নয়াকৃষি দাঁড়ানো। আমি আজ কিছুক্ষণ আগে একটি লেখা পড়ছিলাম। শিরোনাম হচ্ছে, ‘Parmaculture: A Garedening Philosophy’ বা ‘পার্মাকালচার, একটি বাগানের দর্শন’। পার্মাকালচার নয়াকৃষির মতোই প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের উপযোগী পদ্ধতি আবিষ্কার ও চর্চা। তবে তারা কৃষিকাজকে উদ্যানবিদ্যা গণ্য করেন এবং সাজানো-গোছানো বাগানের জন্য উন্নত ও কার্যকর নকশা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা ‘পার্মাকালচার’-এর বৈশিষ্ট্য। সেই কাজের পেছনে বিপুল সৃষ্টিশীল চিন্তার দরকার আছে। কৃষিকাজ কিংবা বাগান করা যদি সক্রিয় মানুষের চিন্তার অভিপ্রকাশ হয় তাহলে সেটা শুধু দর্শনের বিষয় নয়, দর্শন চর্চার ক্ষেত্রও বটে। ঠিক তেমনি, রান্নাবান্নাও। ছেলেবেলায় আমার স্বপ্ন ছিল আমি রাঁধুনি হব। পরবর্তীতে কবিতা লেখা আর রান্না করার মধ্যে আমি বিশেষ ফারাক করতে পারতাম না। এখনো পারি কিনা সন্দেহ হয়। এটা আমার শৈশব থেকেই বিস্ময়কর মনে হতো যা আমি সরাসরি খেতে পারি না, তাকেই  কীভাবে রান্নার গুণে ‘খাদ্য’ হিসেবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়। রান্না শুধু শৈল্পিক বা নান্দনিক ব্যাপার হিসাবে বিচার্য নয়, রান্নার পেছনে মানুষের বিজ্ঞানবুদ্ধি কাজ করে। অজ্ঞানে কিংবা সজ্ঞানে। ফলে রান্না বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঙ্গেই তুলনীয়। রাঁধুনি তার রান্নার রসায়নাগারে সব সময়ই নতুন কিছু আবিষ্কার করছেন। একই কথা কৃষি সম্পর্কেও খাটে। ভাবুন, আমাদের পূর্ব-পুরুষরা কমপক্ষে ১৫ হাজার জাতের ধান আবিষ্কার করেছিলেন। অন্য আবিষ্কারের কথা নাই বা বললাম। 

দর্শন চর্চার জন্য দর্শনের বই লিখতে হবে এমন কোনো কথা নাই। আবারও বলি, মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী, মানুষের সব কাজের পেছনেই চিন্তা আছে। সেটা প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান নয়। দর্শনের অনেক কাজের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে চিন্তাকে দৃশ্যমান করা এবং চিন্তাকে চিন্তার স্বরূপে হাজির করা, যাতে দর্শনকে আমরা সাহিত্য, কিংবা রন্ধন প্রণালি হিসেবে না বুঝে চিন্তার নিজস্ব রূপ হিসেবে চিনতে পারি। আমাদের চিন্তা কীভাবে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কিংবা বাগান চর্চায় নিজেকে প্রকাশ করেছে, সাহিত্য অথবা উদ্যানের ভাষায় ভেবেছে, সেটা দেখিয়ে দিয়ে তার রূপটা চিনিয়ে দেওয়া দর্শনের একটি বড় কাজ।  

তাহলে দর্শন না পড়লেও যে কোনো সফল বা মহৎ সাহিত্য চিন্তা থাকেই। না থেকে পারে না; কিন্তু আবারও বলি, সাহিত্য দর্শন নয়। দর্শনের একটা কাজ হতে পারে সাহিত্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই চিন্তাকে চিন্তা হিসেবেই ধরিয়ে দেওয়া। সচেতন থাকুক বা অচেতন, মানুষ মাত্রই চিন্তাশীল প্রাণী। মানুষের যে কোনো কাজের মধ্যে চিন্তা থাকে, আছে। 

কিন্তু ‘চিন্তার স্বরূপ’ কথাটার মানে কী? এর অর্থ আমরা সহজে ধরতে পারি না। চিন্তার স্বরূপে যদি আমরা চিন্তাকে হাজির করতে না পারি তাহলে তাকে দর্শন বলা যায় না। সেটা ধর্মতত্ত্ব, সাহিত্য বা বিজ্ঞান হতে পারে কিন্তু দর্শন না। যখন মানুষ সজ্ঞানে চিন্তা করে এবং নিজে যা ভাবে সেই ভাবনাকে চিন্তার স্বরূপে পেশ করতে সক্ষম হয় তখন তাকে আমরা আলাদা করে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে চিনতে পারি। সেটা কীভাবে ঘটে? প্রথম ধাপ হচ্ছে সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে চিন্তার প্রতিটি অনুমান, পদ্ধতি ও পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক ও যথাসাধ্য স্পষ্ট থেকে; দ্বিতীয়, চিন্তার নিজের অনুমান, যুক্তি ও যুক্তিপরম্পরা ছাড়া বাইরে কোনো কিছুর বরাত দেওয়া যাবে না। অন্য কিছুর বরাত দিয়ে নিজের অনুমান, পদ্ধতি বা সিদ্ধান্তের অনিবার্যতা বা ন্যায্যতা প্রমাণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন, আল্লাহ আছেন কি নাই এই তর্কে দর্শন দাবি করে না যে ধর্মতত্ত্বে কিংবা কোরআন-হাদিসে আছে আল্লাহ আছেন, অতএব, সেটা সত্য। যদি সেই তর্ক কেউ করে তাহলে সেটা হলো চিন্তার বাইরের কোনো বরাতের ওপর নির্ভর করে আগাম সিদ্ধান্তে আসা। এটা ধর্মতত্ত্ব, দর্শন নয়। বাইরের বরাত দিয়ে যদি কেউ তার সিদ্ধান্তের সত্যাসত্য পেশ করে, তবে তার রূপ দর্শন নয়। এই জন্য বলা হয়, দর্শন কোনো আগাম অনুমান মাথায় রেখে চিন্তা করে না। কেউ যদি বলে অমুক বৈজ্ঞানিক কিংবা অমুক বিজ্ঞান প্রমাণ করে আল্লা নামে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নাই, তাহলে সেটাও দর্শনের কাছে পরাবিদ্যা। কারণ বিজ্ঞান দাবি করে ইন্দ্রিয়নির্ভর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই মান্য এবং সত্য; কিন্তু দর্শন প্রশ্ন তুলবে মানুষ শুধু ইন্দ্রিয়োপলব্ধি দিয়ে জগতকে নিশ্চিতভাবে জানে সেটা স্রেফ অনুমানও হতে পারে। এই ক্ষেত্রে আমরা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বরাতে সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করছি। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট দেখিয়েছেন জগৎকে জানার ব্যাপারটা শুধু ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা দিয়ে ঘটে না। মানুষের বুদ্ধিও কিছু আগাম শর্ত (a priori) অভিজ্ঞতার ওপর আরোপ করে যেন জানাটা আমাদের নিশ্চিত এবং সার্বজনীন মনে হয়। তাহলে অভিজ্ঞতার বরাত দিয়ে সত্যমিথ্যা নির্ণয়, সেটাও ধর্মতত্ত্বই; কিন্তু এই ধর্মতত্ত্বের প্রচলিত নাম বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের চরিত্র মোটা দাগে ধর্মতত্ত্ব থেকে আলাদা নয়। কোরআন-হাদিসের বরাত দেওয়া আর বিজ্ঞানের বরাত দেওয়া একই কথা। চিন্তা নিজের স্বাধীন ও সার্বভৌম পরিমণ্ডলের বাইরে অন্য কোনো তত্ত্ব, বিদ্যা বা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল নয়। বিজ্ঞান এবং দর্শন যেমন আলাদা, তেমনি সাহিত্যের রূপ আর দর্শনের রূপের মধ্যেও বিশাল পার্থক্য বর্তমান।  

দুই.

আহমদ ছফা,  হুমায়ূন আহমেদ কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, এরা কেউই দার্শনিক নন। মহৎ সাহিত্যিক হবার জন্য তাদের দার্শনিক হবার কোনো দরকারও নেই। তারা কোনো দার্শনিক জিজ্ঞাসা হাজির করেননি, কোনো দার্শনিক প্রশ্নের মীমাংসার জন্য চিন্তিত ছিলেন না। নতুন কোনো দার্শনিক প্রস্তাবনা দ্বারা আমাদের চিন্তাগ্রস্ত করেননি। তাতে কিছুই আসে-যায় না। দার্শনিক বা চিন্তক না হওয়াটা সাহিত্যের জন্য জরুরি যেমন  নয়, মন্দও নয়। অনেকে বরং দাবি করবেন সেটা বরং ভালো; কিন্তু তারপরও সাহিত্য দর্শনকে চিন্তিত করে তোলে। কারণ জ্ঞানতত্ত্ব আর নন্দনতত্ত্বের কিংবা দর্শনে ও সাহিত্যের ফারাক কী, কিংবা আদৌ কোনো পার্থক্য আছে কিনা, এ প্রশ্ন দর্শন বারবারই তোলে, তুলতে বাধ্য; কিন্তু সাহিত্য এই জিজ্ঞাসা নিয়ে আদৌ  চিন্তিত না হলেও মহৎ সাহিত্য রচনা করা সম্ভব। 

সমাজ-বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনা করলে হয়তো আমাদের কথা আরও স্পষ্ট হবে। সাহিত্য সমাজের মধ্যে থেকে সামাজিক মানুষই রচনা করে। অতএব. সাহিত্যে সমাজের প্রতিফলন থাকবে। থাকবেই। এটা সহজেই আমরা অনুমান করতে পারি। এই জন্য কোনো সমাজ-বিশ্লেষণে বা সমাজের ইতিহাস লিখবার সময় কোনো সমাজ-বিজ্ঞানী কিংবা ঐতিহাসিক সাহিত্যকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিবেচনা করেন। বিশেষ সময়ের সাহিত্য দিয়ে বিশেষ সময়ের সমাজ ও ইতিহাস চেনা এবং বোঝা সহজ হয়। সাহিত্যে সমাজ বা ইতিহাস কীভাবে ছায়া ফেলে সেটা বিশ্লেষণ করা সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাসের কাজ। সেই ছায়া আমাদের ধরিয়ে দিয়ে সমাজ বা ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিচ্ছন্ন করবার চেষ্টা তারা করেন; কিন্তু মজা হচ্ছে তারপরও সাহিত্য সাহিত্যই থেকে যায়, সাহিত্য ইতিহাস কিংবা সমাজ-বিজ্ঞান হয়ে ওঠে না। ইতিহাস বা সমাজ-বিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে সাহিত্য পর্যালোচনা তাই একটি সমাজকে বুঝতে কাজে লাগে। সমাজ সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার হয়। যে সমাজে এই কাজগুলো এগিয়ে থাকে সেই সমাজকে আমরা আত্ম-সচেতন সমাজ বলতে পারি; কিন্তু তার পরও সমাজ-বিজ্ঞানকে আমরা সাহিত্য বলি না। ইতিহাসকেও সাহিত্য বলি না। 

অথচ সমাজ-বিজ্ঞানী বা ঐতিহাসিকদের রচনায় সাহিত্যগুণ থাকতে পারে। বিনয় সরকার কিংবা বিনয় ঘোষের ভাষা চমৎকার; কিন্তু তারা সমাজ-বিজ্ঞানী। তপন রায়চৌধুরীর গদ্যে আমরা সাহিত্যের স্বাদ পাই; কিন্তু তিনি ঐতিহাসিক। তাহলে সাহিত্যের গুণ আছে বলে সমাজ-বিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদদের রচনা আমরা সাহিত্য হিসেবে পড়ি না। সাহিত্য থেকে তাদের রচনা আমরা আলাদা গণ্য করি। তাদের লেখার সাহিত্য গুণকে আমরা আলাদা মর্যাদা দিয়ে থাকি; কিন্তু তারপরও সাহিত্যগুণসম্পন্ন সমাজ-বিজ্ঞান বা ইতিহাসকে সাহিত্য বলা হয় না। সমাজ-বিজ্ঞান বা ইতিহাস রচনার যে উদ্দেশ্য, ঐতিহ্য, বিধিবিধান বা নিয়মকানুন- বিদ্যাচর্চার যে বিশেষ ধারা হিসেবে গড়ে উঠেছে তারা সেই পরিমণ্ডলেরই চর্চা করে। সাহিত্যের ঐতিহ্য, বিধিবিধান নিয়মকানুন ভাবভঙ্গি তারা অনুকরণ করে না।

এই ফারাকগুলো মনে রেখেই আমরা সাহিত্য থেকে আলাদাভাবে ইতিহাস ও সমাজ-বিজ্ঞান চর্চা করি। কবিতা চর্চা কিংবা উপন্যাস রচনাকে আলাদা কাজ গণ্য করি। এই অনুমান সঠিক নাকি বেঠিক সেই তর্ক উঠতেই পারে। সেই তর্ক আবার সাহিত্য বনাম বিজ্ঞান বা ইতিহাস শাস্ত্রের বিরোধ নয়। সেই তর্ক দর্শনের কারবারের অন্তর্গত।  বিপরীতে সাহিত্য যতই ইতিহাস বা সমাজ-বিজ্ঞানের উপাদান হয়ে উঠুক সাহিত্য তারপরও সাহিত্যই থেকে যায়, সমাজ-বিজ্ঞান কিংবা ইতিহাস হয়ে যায় না।

দর্শনের ক্ষেত্রেও একই কথা; কিন্তু পার্থক্য আছে। প্রথমত ভাষা প্রশ্ন। সাহিত্য ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। পরিচিত ভাষাকে সাহিত্য ভাংচুর করে। কবিতা এই ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। ছোটগল্প কবিতার স্বভাবের অনুগামী। কবিতা বাক্যের মধ্যে কিম্বা একটি গোটা কবিতায় যেভাবে বিভিন্ন বাক্যকে সাজায় তার উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠকের মধ্যে এমন একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করা যা প্রচলিত ভাষায় ঘটানো সম্ভব না। কাব্য এমন ভাবে শব্দ বাক্য উপমা উৎপ্রেক্ষা প্রতীক ইশারা ইত্যাদিকে সাজায় যাতে লেখক নিজেই তার মধ্যে বুঁদ থেকে পেশ করে। পাঠকের মধ্যে তার বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয়। পাঠক বিশেষ বিশেষ উপলব্ধির দ্বারা সংক্রমিত হয় যা প্রচলিত ভাষায় ঘটে না। কিংবা ঘটানো সম্ভব হয় না বলেই কবিরা কবিতা লেখে এবং মানুষের ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিন লিখে যাবে।

দর্শন ভাষার এই ভাঙাগড়ার সুবিধা গ্রহণ করে। প্রথমত নতুন উপলব্ধি নতুন চিন্তার সম্ভাবনা তৈরি করে। দর্শন কাব্য কিংবা সাহিত্য থেকে চিন্তার নতুন সূত্র পেয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ভাষার যে ভাঙন বা রূপান্তর ঘটে সেই ভাঙন সমাজে নতুন চিন্তার সম্ভাবনা তৈরি করে। এর দ্বারা দর্শন উপকৃত হয়। এই জন্য অনেক সময় বলা হয় কাব্যে যা যা ঘটে তা দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। কিংবা যে কোনো যুগের দর্শন মূলত তার কালের কাব্য যে ভাবগুলো ধরতে সক্ষম হয়েছে তারই চিন্তাশীল বর্ণনা। মানে, কবিতায় নতুন চিন্তা আগে ধরা দেয়, দর্শন তা অনুসরণ করে কিম্বা শিশুর অস্ফুট মুখের কথাকে যেন ব্যাকরণসম্মত পূর্ণ বাক্যে রূপ দেয়।

সাহিত্যে চিন্তা থাকে; কিন্তু সেটা দর্শন নয়, সাহিত্য। চিন্তার স্বরূপ সাহিত্য নয়, ফলে অনেক বড় বড় চিন্তক বা দার্শনিকদের ভাষা দুর্বোধ্য এবং কঠিন। প্রচলিত সাহিত্যের ভাষায় তারা তাদের নতুন চিন্তা হাজির করতে পারেন না। তাই তারা নতুন শব্দ, ধারণা এবং বর্গ তৈরি করেন, যা সাধারণ পাঠকের অগম্য থেকে যায়। 

আহমেদ ছফা সাহিত্যিক, দার্শনিক নন; কিন্তু আবদুর রাজ্জাক একজন চিন্তক ছিলেন। তিনি চিন্তা করতে জানতেন। তার বিষয় সরাসরি দর্শন নয়, সে কারণে তাকে হয়তো ‘দার্শনিক’ বললে অনেকে আপত্তি করবেন; কিন্তু তিনি অবশ্যই একজন চিন্তাশীল অনুসন্ধানী। তিনি খুব কমই লিখেছেন; কিন্তু চিন্তক হিসেবে তার অবদান হচ্ছে ইতিহাস অনুসন্ধান এবং ইতিহাস পুনর্নির্মাণের পদ্ধতি। তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত আকর্ষণ হচ্ছে সাহিত্য কীভাবে সমাজতত্ত্ব এবং ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পাঠ করতে হয়, সেই বিদ্যা তিনি দুর্দান্ত আয়ত্ত করেছিলেন। আমি তাকে অল্প কিছু সময় পেয়েছি। ছফার মতো ঘনিষ্ঠভাবে পাইনি। সেই অল্প সময় আমার ব্যয় হয়েছে মার্কস ওয়েবারের মার্কস পাঠ এবং কৃষি সভ্যতা বিচারের পদ্ধতি  নিয়ে। স্বল্প দেখা সাক্ষাৎ হলেও কৃষির প্রতি আমার আগ্রহ তিনি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কৃষি এবং নদী বিধৌত সভ্যতা হিসেবে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনার তাড়না সম্ভবত আমি আমার অজান্তে আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকেই পেয়েছি; কিন্তু  তার সঙ্গে আমার আগ্রহ ম্রিয়মাণ হবার একটা কারণ দর্শনে তার আগ্রহ কম থাকা। জার্মান ভাবাদর্শের দার্শনিক মীমাংসা কার্ল মার্কস কীভাবে অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা হিসেবে হাজির করেছেন, সেটা অধিকাংশের মতো তিনিও বুঝতে পারতেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি মার্কসের অর্থশাস্ত্রীয় পর্যালোচনার তাৎপর্য ধরতে পারতেন বলেও আমার মনে হয়নি। মার্কসকে তিনি স্রেফ সমাজতাত্ত্বিক মনে করতেন। তুলনা করতেন মার্কস ভেবারের সঙ্গে। সেই দিক থেকে সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে কার্ল মার্কস নন, তার জ্ঞানকাণ্ডের গুরু ছিলেন মার্কস ভেবার।  মার্কসের অন্দর মহলের দিশা যারা খানিক খুঁজে পেয়েছেন তারা ব্যাপারটা সহজে বুঝতে পারবেন। সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে তার বুদ্ধিমান নিরীক্ষণ যে কোনো বুদ্ধিমানকেই প্রবল আকৃষ্ট করত; কিন্তু তার সঙ্গে আমি কথা বলতে গিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। 

ইদানীং দেখছি বেশ কয়েকটি পাঠচক্রে আহমদ ছফাকে নিয়ে আলোচনা চলছে। খুবই আনন্দ পেলাম। হয়তো আমার আলোচনা তাদের আলোচনার সহায়ক এবং চিন্তার খোরাক হবে। একটি পাঠচক্র ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ নিয়েও আলোচনা করছে। যদি তাই হয়, আশা করি তরুণরা আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কেও আগ্রহী হবে। তাহলে সাহিত্যচর্চা আর চিন্তকের কাজ এবং ভূমিকার পার্থক্যও তারা ধরতে পারবে। আহমদ ছফা তার কাছে থেকে যা গ্রহণ করতে পেরেছিলেন, সেটা সাহিত্য রচনার উপাদান। তাকে নিয়ে ছফা গোটা একটা পুস্তিকা লিখে ফেলতে পেরেছিল, কারণ আবদুর রাজ্জাক নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয় ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু যারা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ পড়বেন, তাদের মনে রাখতে হবে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ একজন চিন্তককে একজন সাহিত্যিক কীভাবে দেখেছেন এবং আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং মুগ্ধতা দিয়ে তার সঙ্গে কথোপকথন ও বর্ণনাকে কীভাবে সাহিত্য করে তুলেছেন তার ভালো একটি নজির। বাংলা সাহিত্যে এতো চমৎকার কাজ আর হয়নি; কিন্তু শেষমেশ এটা সাহিত্যই। বাংলাদেশের চিন্তার জগতে এর আদৌ কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। পড়বার সম্ভাবনাও নাই। 

শেষের কথাটা অনেকের কাছে তর্ক সাপেক্ষ মনে হতে পারে। একটু ব্যাখ্যা করে বলি। ছফা বইটি লিখেছিলেন নব্বই দশকের শেষের দিকে। মুখবন্ধের তারিখ হচ্ছে ১ ফাল্গুন ১৪০৪ (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)। বইটি দীর্ঘদিন ধরেই জনপ্রিয়; কিন্তু বইটি সাহিত্য পাঠের আনন্দের অধিক কোনো চিন্তাশীল জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়নি। এমনকি বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে অধ্যাপক রাজ্জাকের পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করা নিয়ে ছফার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন রয়েছে, তারও কোনো দৃশ্যমান প্রভাব  বাংলাদেশে সমাজ, ইতিহাস চিন্তা কিংবা রাজনীতিতে আমরা দেখিনি। বইটির শিরোনামও  কথোপকথনের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে কেন্দ্র করে।  

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক ভয়ংকর মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। এরা যে বাঙালি জাতিবাদ ধারণ করতে শুরু করে, তার সঙ্গে এই দেশের জনগণের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কোনো সম্পর্ক নাই। এদের কাছে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ে ওঠে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। যেন এর আগে বাংলাদেশের আর কোনো ইতিহাস নাই। ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নাই, জমির জন্য কৃষকের লড়াই নাই। জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম নাই। ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির দীর্ঘ সংগ্রাম নাই, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভাজন নাই এবং সর্বোপরি পাকিস্তান আন্দোলন নাই। এটাই প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পাকিস্তান আন্দোলন ভুল ছিল।  

যেখানে বইটিতে চিন্তার শুরু সেখানে দু’জনের ইতিহাস বোধের ফারাক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আহমদ ছফা একজন সৎ এবং উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে সাম্প্রদায়িক এবং ইসলাম বিদ্বেষী রূপ আমরা দেখেছি, তা আহমদ ছফার মধ্যে নাই, থাকবার প্রশ্নই আসে না; কিন্তু তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাইরে নন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক মুহূর্ত ধারণ করে ছফা অগ্রসর হতে চেয়েছেন। এখানে তার সঙ্গে অন্যান্য বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের পার্থক্য; কিন্তু জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে তিনি সতর্ক ছিলেন না। তাই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে কিছু সময় যোগদান আহমদ ছফার সেই সময়ের অসতর্ক এবং অদূরদর্শী মনের পরিচয়। ফলে সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়ে তার অবস্থান আবদুর রাজ্জাক থেকে আলাদা। সেই পার্থক্য তিনি ‘যদ্যপি আমার গুরু’ পুস্তিকাটিতে লুকাননি। এখানেই ছফার মহত্ত। 

‘বাঙালি মুসলমান কেন পাকিস্তান চেয়েছিল?’ এটি গুরুতর প্রশ্ন। ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ের অষ্টম অধ্যায় এই জন্য বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছফা লিখছে-

“-একদিন আমি উত্তেজিত হয়েই স্যারের কাছে গেলাম। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। স্যার বাড়িতেই ছিলেন। সারাশরীর চাদরে ঢেকে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন। আমি বসবার আগেই বলে ফেললাম, কাল টিচার্স ক্লাবে শুনেছি, আপনি ইসলামিক একাডেমিতে নাকি একসময়ে কেন আমি পাকিস্তান চেয়েছিলাম এ বিষয়ের ওপর একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

রাজ্জাক স্যারের চোখেমুখে কৌতুকবোধ ঝিলিক দিয়ে উঠল : বক্তৃতা একটা দিছিলাম, তো আপনে চটছেন ক্যান?

আপনি পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করবেন চটবো না তো কী?

আমি তো পাকিস্তান চাইছিলাম, হেই কথাডা বলতে দোষ কী? তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি যখন আহত বোধ করেন, তার চোখ থেকে এ ধরনের দৃষ্টি বিচ্ছুরিত হয়। আমি একটুখানি ভয় পেয়ে গেলাম। খেয়ালই ছিল না আমার জন্মের বহু পূর্বে ঘটে-যাওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার জন্য আমি স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছি। স্যার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমিও সাহস করে কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। এই নীরবতা আমার কাছে একটা দুর্বহ বোঝা হয়ে উঠেছে। ইচ্ছা হচ্ছিল পালিয়ে চলে আসি; কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। (ছফা, ২০০৭, পিপি ৫৭-৬০)

পুস্তিকার এই অংশটি তাৎপর্যপূর্ণ। সিম্পল অথচ সাহিত্যের মহিমায় মহিমান্বিত। ছফা একটি গুরুতর বিষয়কে সাহিত্যের ধাঁচে পেশ করছে। যার সঙ্গে ছফা নিজে একমত নয়; কিন্তু তাকে জায়গা দিতে সে কসুর করছে না। এই অংশের সাহিত্যিক মহিমা এত সহজে বোঝা যাবে না। মনে রাখতে হবে বইটির নাম ‘যদ্যপি আমার গুরু’। বইয়ের নাম পুস্তিকার এই অংশটিকেই ধারণ করবার জন্য দেওয়া হয়েছে। ছফার নিজের আত্মসমালোচনা একই সঙ্গে বাঙালি জাতিবাদী চিন্তার আত্ম-সমালোচনা ও পর্যালোচনা : আমাদের জন্মের বহু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার পক্ষে যারা আমাদের বর্তমান অবস্থানের বিপরীত অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের আমরা ‘অভিযোগ’ করতে পারি না? আমাদের কাজ হচ্ছে, কেন তারা ভিন্ন অবস্থান নিয়েছিলেন সেটা বোঝা। বইয়ের এই অংশে আহমদ ছফা তার গুরুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। তার স্বগতোক্তি :  ‘আমি একটুখানি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার খেয়ালই ছিল না আমার জন্মের বহু পূর্বে ঘটে-যাওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার জন্য আমি স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছি’।

এখন ‘যদ্যপি আমার গুরু’ কথাটার মানে কী? পুস্তিকার শুরুতেই উদ্ধৃতি দিয়েই ছফা লিখতে শুরু করেছে। ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়/তথাপি তাহার নাম নিত্যানন্দ রায়’। গৌরাঙ্গ বা চৈতন্যের সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত নিত্যানন্দ বাংলার ভক্তি আন্দোলনের মহাপুরুষ। গৌরাঙ্গ বাংলা ছেড়ে গিয়েছিলেন, ফিরে আসেননি; কিন্তু ভক্তি আন্দোলনকে বাংলায় ধরে রেখেছিলেন নিত্যানন্দ। বাংলা গৌরের নাম একা উচ্চারণ করে না, নিত্যানন্দ সঙ্গেই আছেন। গৌর-নিতাই একসঙ্গে জয়ধ্বনি হয়।

এই দুটি পদ নিয়ে রামকৃষ্ণের একটা ব্যাখ্যা আছে। 

“শুনিসনি- ‘এই মাটিতে খোল হয়’ বলে চৈতন্যদেবের ভাব হয়েছিল? এক সময়ে এক জায়গা দিয়ে যেতে যেতে তিনি শুনলেন যে সেই গ্রামে হরিসংকীর্তনের সময় যে খোল বাজে লোকে সেই খোল তৈয়ার ও উহা বিক্রয় করে দিনপাত করে। শুনেই তিনি বলে উঠলেন, ‘এই মাটিতে খোল হয়!’ - বলেই ভাবে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হলেন। কেন না! উদ্দীপনা হলো; ‘এই মাটিতে খোল হয়, সেই খোল বাজিয়ে হরিনাম হয়, সেই হরি সকলের প্রাণের প্রাণ - সুন্দরের চাইতেও সুন্দর।’- একেবারে এত কথা মনে হয়ে হরিতে চিত্ত স্থির হয়ে গেল। সেই রকম যার গুরুভক্তি হয় তার গুরুর আত্মীয়-কুটুম্বদের দেখলে তো গুরুর উদ্দীপনা হবেই, যে গ্রামে গুরুর বাড়ি সে গ্রামের লোকদের দেখলেও ঐরূপ উদ্দীপনা হয়ে তাদের প্রণাম করে, পায়ের ধুলো নেয়, খাওয়ায় দাওয়ায় সেবা করে! এই অবস্থা হলে গুরুর দোষ আর দেখতে পাওয়া যায় না। তখনই এ কথা বলা চলে-

‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়।

তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়

নইলে মানুষের তো দোষ-গুণ আছেই। সে তার ভক্তিতে কিন্তু তখন আর মানুষকে মানুষ দেখে না, ভগবান বলেই দেখে! যেমন ন্যাবা-লাগা চোখে সব হলুদবর্ণ দেখে- সেই রকম; তখন তার ভক্তি তাকে দেখিয়ে দেয় যে, ঈশ্বরই সব- তিনিই গুরু, পিতা, মাতা, মানুষ, গরু, জড়, চেতন সব হয়েছেন।” (সারদানন্দ)

এই হলো রামকৃষ্ণের একটা ব্যাখ্যা। ছফা গুরুবাদী ছিলেন না। তার গুরুভক্তি প্রবল ছিল বলা যাবে না; কিন্তু কথাটা ছফা যে অর্থে বলতে চেয়েছেন, সেটা বোঝা দরকার। 

আমরা জানি বৈষ্ণব নিরামিষ সেবা নিয়ে থাকে, মদ, মাংস, মাছ, পেঁয়াজ, রসুন কিছুই গ্রহণ করেন না; কিন্তু বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের মহাপুরুষ নিত্যানন্দ ছিলেন অবধূত। তিনি মদ মাছ মাংস সবই খেতেন। কেন? বাংলার ফকির বা ভক্তি আন্দোলনের নিত্যানন্দের এই খাদ্যাভ্যাসের বিশেষ মানে আছে। সেটা হলো সাত্ত্বিক বা নিরামিষ সেবার সঙ্গে উচ্চবর্ণের সম্পর্ক রয়েছে, নিরামিষ সেবার মহিমা তারা অস্বীকার করে না; কিন্তু যখন নিরামিষ সেবাকেই  সাধকের একমাত্র সেবায় পর্যবসিত করে ফেলা হয় তার মানে খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যেও জাতপাতের বিভাজন আরোপ করা। অন্যান্য জাতের জন্য, বিশেষত চণ্ডালের জন্য অধর্ম না হলেও ব্রাহ্মণ মাছ মাংস গ্রহণ করেন না। ফলে নিত্যানন্দের মদ, মাংস, মাছ গ্রহণ স্রেফ উচ্ছৃংখলতা নয়, খাদ্য ব্যবস্থা একই সঙ্গে জাতপাতবিরোধী লড়াইয়ের মর্ম ধারণ করাও বটে। বঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে জাত-পাত বিরোধিতাকে নিত্যানন্দ আরও নিম্ন বর্গের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। 

দ্বিতীয়ত, গুরুভক্তিকে শাস্ত্র বা আইন হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ারও এটা বিরোধিতা। কারণ প্রেমই মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন দৃঢ় করে। আইন, শাসন বা কোনো বিধিবিধান যান্ত্রিকভাবে আরোপ করে মানুষকে সুপথে আনা যায় না, সামাজিক বন্ধনও দৃঢ় করা যায় না। তাহলে নিত্যানন্দ মদের দোকানে যাক, কিংবা অন্যত্র নিষিদ্ধ কোনো স্থানে, তাতে তার ভক্তদের কিছুই আসে যায় না। কারণ গুরু জানেন তিনি কি করছেন, গুরুকে বিদ্যমান কোনো আইন, বিধিবিধান, শাস্ত্র বা অনুশাসন দিয়ে বোঝা যাবে না। তিনি নিয়ম বা আইনের অবতার নন,  তিনি সদাই আইন বা বিধিবিধানের অতীত। তিনি শুঁড়ি খানায় গেলেন কি না গেলেন, সেটা নিরর্থক তর্ক। তিনি সবসময়ই গুরু। ঠাকুর রামকৃষ্ণ যে ব্যাখ্যা করেছেন, সেটা নদীয়ার ব্যাখ্যা নয়। কথাগুলো বলে রাখলাম যাতে আমরা বড় পরিসরে বাংলার গুরু-শিষ্য পরম্পরার অর্থ বুঝতে পারি। ব্রাহ্মণ্যবাদ বা জাতপাত বিরোধিতার প্রশ্ন বাদ দিয়ে নদীয়ার ফকিরদের বোঝা যাবে না। 

এখন আবদুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রে এই কথাটা কীভাবে খাটে?  তাদের দু’জনের কেউই ভক্তিবাদী নন; কিন্তু বাংলাদেশে জাতিবাদী চিন্তার আধিপত্যের কারণে আমাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস, যদি আমরা বাংলাদেশ ভালোবাসি, তাহলে পাকিস্তান আন্দোলন কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারি না। করবার কোনো প্রশ্নই আসে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী আহমদ ছফাও সেটাই ধরেই নিয়েছিলেন। তার গুরু আবদুর রাজ্জাক কেন পাকিস্তানের পক্ষে বললেন, তাতে ছফা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, সন্দেহ নাই। এরপর ছফা যা লিখেছেন তার একটা বড় উদ্ধৃতি আমাকে দিতে হবে। বড় উদ্ধৃতি দেবার বাড়তি কারণ হলো, সাহিত্য কীভাবে সমাজতত্ত্ব এবং ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পাঠ করতে হয়,

“এরই মধ্যে কাজের ছেলেটি তামাক দিয়ে গেল। হুকোতে দু-তিন টান দেওয়ার পর স্যার মুখ খুললেন। মনে হলো বেঁচে গেছি। স্যার বললেন, ওই বক্তৃতায় আমি কী কইছিলাম হেইডা আপনে দেখছেন কি না?

আমি বললাম, না।

স্যার বলতে শুরু করলেন, আমি কইছিলাম আপনেরা বাংলায় যত উপন্যাস লেখা অইচে সব এক জায়গায় আনেন। হিন্দু লেখক, মুসলমান লেখক ফারাক কইরেন না। তারপর সব উপন্যাসে যত চরিত্র স্থান পাইছে রাম শ্যাম, যদু মধু, করিম রহিম নামগুলো খুঁইজ্যা বাইর করেন। তখন নিজের চোকেই দেখতে পাইবেন, উপন্যাসে যেসব মুসলমান নাম স্থান পাইছে তার সংখ্যা পাঁচ পার্সেন্টের বেশি অইব না। অথচ বেঙ্গলে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি। এই কারণেই আমি পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানাইছিলাম।

আমার তর্ক করার ইচ্ছাটি তখনো দমে যায়নি। তাই জিজ্ঞেস করলাম, উপন্যাসে মুসলমান চরিত্রের উপস্থিতির স্বল্পতার কারণে আপনি কিন্তু একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমর্থন দিতে পারেন না।

আপনে এখন ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা কইতাছেন তখন সিচুয়েশন আছিল এক্কেরে অন্যরকম। আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন, উপন্যাস অইল গিয়া আধুনিক সোশিয়াল ডিসকোর্স। বেঙ্গলে হিন্দু-মুসলমান শত শত বছর ধইরা পাশাপাশি বাস কইরা আইতাছে। হিন্দু লেখকরা উপন্যাস লেখার সময় ডেলিবারেটলি মুসলমান সমাজরে ইগনোর কইরা গেছে। দু-একজন ব্যতিক্রম থাকলেও থাকবার পারে। বড় বড় সব হিন্দু লেখকের কথা চিন্তা কইরা দেখেন। তারা বাংলার বায়ু, বাংলার জল এসব কথা ভালা কইরাই কইয়া গেছে; কিন্তু মুসলমান সমাজের রাইটফুল রিপ্রেজেনটেশনের কথা যখন উঠছে সকলে এক্কেরে চুপ। মুসলমান সমাজরে সংস্কৃতির অধিকার থেইক্যা বঞ্চিত করার এই যে একটা স্টাবর্ন অ্যাটিচিউড হেই সময়ে তার রেমেডির অন্য কোনো পন্থা আছিল না।

একসঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পর স্যার একটু দম নিলেন। কাজের ছেলেটি চা দিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দেওয়ার পর স্যার আবার মুখ খুললেন। আরেক হিসেব অবসর সময়ে কইরা দেইখেন। নাইনটিন ফরটি সেভেন থেইক্যা সেভেনটি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমাগো এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেইক্যা লেখালেখির ক্ষেত্রে যতগুলান মানুষ বাইর অইয়া আইছে, নাইনটিন টুয়েনটি ওয়ান থেইক্যা শুরু কইরা ফরটি সেভেন, এই কোয়ার্টার সেঞ্চুরি হিসেব কইরা দেখেন মুসলমান সমাজের মধ্যে থেইক্যা সেইরকম একজনও মুসলমান লেখক বাইর অইছেন কি না। ফরটি সেভেনের পরে যেসব মুসলমান লেখক বাইর অইছে আউটলুকের দিক দিয়া সকলে আউট অ্যান্ড আউট সেক্যুলার। পাশাপাশি পশ্চিমবাংলার আধুনিক লেখকদের মধ্যে দেখবেন, সেক্যুলার লেখক অধিক পাইবেন না। হ তবে কথা উঠতে পারে আর্টিষ্টিক একস্প্রেশন সম্পর্কে।

আমি বললাম, হিন্দুসমাজে সেক্যুলার চিন্তা-ভাবনা তো অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছে।

স্যার বললেন, কথাটা ঠিক আবার ঠিকও না। যেই জিনিসটারে আপনেরা বেঙ্গল রেনেসাঁ কইবার লাগছেন, হেইডা মানতে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। আপনেরা রামমোহনরে রেনেসাঁর মানুষ কইবেন; কিন্তু হে কামডা কী করছে। তার মতো এমন ধর্মপ্রচার আগেও ইন্ডিয়ায় অনেক মানুষ কইরা গেছেন। আমি ত তার বাংলা ভাষা চর্চা ছাড়া উল্লেখ করার মতো আর কোনো কিছু খুঁইজ্যা পাই না। এন্টায়ার নাইন্টিনথ সেঞ্চুরিতে পুরুষ সিংহ ওই একজনই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর মশায় ছাড়া দেবেন ঠাকুর বলেন, বঙ্কিম বলেন, কেশব বলেন, সকলে তো নতুন কইরা রিভাইভিলিজমের বিকাশ ঘটাইছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটা মূল্যবান বই লিখছিলেন। নামটা জানি কী। তিনি দেখাইছেন, যে সময়ে বঙ্কিমের উপন্যাসগুলা প্রকাশ পাইবার লাগছিল, একই সময়ে বটতলার মুসলমানি পুথিঁগুলাও মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা অইয়া বাইর অইতে আছিল। বঙ্কিমের উপন্যাস দুইশ’ আড়াইশ’র বেশি ছাপা অইত না। কারণ আধুনিক সাহিত্য পড়ার পাঠক আছিল খুব সীমিত; কিন্তু বইটা পড়লে দেখতে পাইবেন মুসলমানি পুঁথি ছাপা অইতাছিল হাজারে হাজারে। বঙ্কিমের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পুঁথির বিষয়বস্তুর তুলনা করলে ডিফারেন্সটা সহজে বুঝতে পারবেন। পুঁথির বিষয়বস্তু এক্কেরে সেক্যুলার; কিন্তু চিন্তাপদ্ধতি মধ্যযুগীয়। বঙ্কিমের চিন্তা আধুনিক কিন্তু বিষয়বস্তু ধর্মীয়।

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, বঙ্কিমের সব রচনার বিষয়বস্তু তো ধর্মীয় নয়।

স্যার বললেন, ওই অইল একই কথা, রিভাভিলিস্ট স্পিরিট অ্যান্ড মডার্ন স্পিরিট এ ওর পায়ে ঠেস দিয়া খাড়াইয়া আছে।

স্যারের কথাটা পুরোপুরি মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। তাই বললাম, মাইকেল, বঙ্কিম ওনাদের হাতেই তো বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার সূত্রপাত।

স্যার বললেন, ‘আধুনিকতা জিনিসটারেও তো ভালা কইরা বুঝন লাগব। আধুনিকতা জিনিসটা বেবাক দুনিয়ায় একই সময়ে আইছে। দশ বছর আগে কিংবা দশ বছর পরে। বিলাতে রেলগাড়ি অওনের দশ বছর পরে ইন্ডিয়াতে রেল আইয়া গেছে। বঙ্কিম মারা গেছেন আঠারশো তিরানব্বই সালে। আর টলস্টয় মারা গেলেন উনিশশ’ এগারো সালে। বঙ্কিমের তুলনায় টলস্টয় দীর্ঘ জীবন পাইছিলেন। সেই দিক দিয়া দেখতে গেলে টলস্টয় বঙ্কিমের কন্টেম্পরারি। দু’জনের লেখার কন্টেন্ট মিলাইয়া দেখেন। টলস্টয় কমন ম্যানকে কী চোখে দেখছেন। শুধু টলস্টয় আর বঙ্কিম কেন ইউরোপের লিটারারি স্টলওয়ার্ট ফ্লবেয়ার, মোপাসাঁ, চেখভ, টুর্গেনিয়েভ, গোগল, জোলা সকলে একটা বিশেষ সময়ের মানুষ। এদের লগে আপনে রবীন্দ্রনাথরেও ধরবার পারেন।’

আমি বললাম, স্যার, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু বলেন।

স্যার বললেন, রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ঠিকই আছিল। বাংলা ভাষাটি তো রবীন্দ্রনাথের হাতেই পুষ্ট অইছে। এক হাতে বিচিত্র বিষয় নিয়া লিখছেন, এইটাই রবীন্দ্রনাথের সবচাইতে বড় ক্রেডিট। আদার দ্যান লিটারারি ট্যালেন্ট অন্যান্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের যদি বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের সঙ্গে তুলনা করেন, হি কামস নো হোয়ার নিয়ারার টু দেম।

স্যারের কথা শুনে আমার ভালো লাগল না। আমি রবীন্দ্রনাথকে খুব বড় একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তাই জিজ্ঞেস করলাম, রবীন্দ্রনাথ কি খুব বড় একজন মানুষ নন?

স্যার বললেন, রবীন্দ্রনাথ বড় লেখক, মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর কিংবা তার মতো মানুষদের ধারেকাছেও আসতে পারেন না। বড় লেখক এবং বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে। বড় মানুষরা আসলেই বড় মানুষ। লেখক কবিরা যা বলে সেরকম আচরণ না করলেও চলে। হের লাইগ্যা প্লেটো তার রিপাবলিক থ্যাইক্যা কবিগো নির্বাসনে পাঠাইবার কথা বলছিল।

আমি বললাম, একথা কি রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও প্রযোজ্য?

স্যার বললেন, রবীন্দ্রনাথ ব্যতিক্রম অইল কেমনে। তিনিও তো এই ক্যাটাগরির মধ্যে পড়েন।

আমার মনের মধ্যে একটুখানি খুঁতখুঁতানি থেকে গেল। সেজন্য পালটা প্রশ্ন করলাম, রবীন্দ্রনাথ কি বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষাকে উৎকর্ষের একটা বিশেষ স্তরে নিয়ে যাননি?

স্যার বললেন, ‘বাংলা ভাষাটা বাঁচাইয়া রাখছে চাষাভুষা, মুটেমজুর- এরা কথা কয় দেইখ্যাই তো কবি কবিতা লিখতে পারে। সংস্কৃত কিংবা ল্যাটিন ভাষায় কেউ কথা কয় না, হের লাইগ্যা অখন সংস্কৃত কিংবা ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য লেখা অয় না।’

অধ্যাপক রাজ্জাক  নিজে কেন পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মূলত বাঙালি মুসলমান কেন পাকিস্তান সমর্থন করেছিল তার একটা সাহিত্যকেন্দ্রিক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন। আমাদের প্রথাগত চিন্তা বা অভ্যাসের মধ্য দিয়ে আমরা যা বিশ্বাস করি বা করতে শিখি গুরু সেই অনুমান বা বিশ্বাসের অধীনস্ত নন। ছফা একাত্তর দেখেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াই দেখেছেন, এরই মধ্যে তিনি গড়ে উঠেছেন। গুরু তাই পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করবে, সেটা ছফার কাছে ছিল অসম্ভব কল্পনা। ‘শুঁড়িখানা’ যেমন নিন্দার জায়গা, তেমনি পাকিস্তান সমর্থন দূরে থাকুক সমবেদনা প্রকাশও মহা পাপ। আহমদ ছফা বলতে চাইছেন, আবদুর রাজ্জাক পাকিস্তানের সমর্থক হলেও, তিনিই গুরু।  গুরু পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করলেও তিনি গুরুই থাকেন। 

এটা পরিষ্কার অধ্যাপক রাজ্জাক যেভাবে সাহিত্য পড়েছেন, কিংবা পড়বার পদ্ধতি নিজে তৈরি করে নিয়েছেন, আমরা সেভাবে সাহিত্য পড়ি না। সাহিত্যে সমাজ হাজির থাকে সেটা আমরা কথা হিসেবে মুখস্ত জানি; কিন্তু সেই সমাজকে কিভাবে চিনে নিতে হয় সেটা আলাদা বিদ্যা। সেখানে রসবোধের ভূমিকা কম, চিন্তাশীলতার ভূমিকা প্রধান। সাহিত্যের রসাস্বাদন বা সাহিত্য রসের বিচার করে সেটা বোঝা যায় না। আবদুর রাজ্জাক বাংলা সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে তাকে স্রেফ সাহিত্য হিসেবে রসাস্বাদন করে ক্ষান্ত দেননি। সাহিত্য নিয়ে আরও গভীর ভাবে ভেবেছেন। উপমহাদেশ বলি, কিংবা সারাবিশ্ব বলি, বাংলাভাষীদের মধ্যে বাঙালি মুসলমানই সংখ্যায় বেশি। তাহলে বাংলা সাহিত্য নামে ঐতিহাসিকভাবে সাতচল্লিশ অবধি যা কিছু লেখা হয়েছে সেখানে মুসলমানদের জীবন, তাদের সাধ-আহ্লাদ, পরিবার, জীবনের অভিজ্ঞতা, আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার কোনো প্রতিফলন তখনকার বাংলা সাহিত্যে প্রায় অনুপস্থিত দেখে তিনি চিন্তিত হয়েছেন। তাকে ভাবিয়েছে। তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো ফারাক করেন নাই- চেতনে বা অবচেতনে যা করি। পুরা বাংলা উপন্যাস এক সঙ্গে বিচার করে তিনি দেখেছেন মুসলমানের সংখ্যা পাঁচ পার্সেন্ট না, অথচ তারা অবিভক্ত বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, অর্ধেকেরও বেশি; কিন্তু এটা ভাববার কারণ নেই যে, তিনি এর জন্য পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। বলাবাহুল্য, মুসলমান শিক্ষা পেলে এবং আধুনিক সাহিত্য রচনায় অগ্রসর হলে এই ব্যবধান দ্রুতই কমে আসত। তাহলে রাজ্জাক আসলে কেন পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন? ছফার চোখে যে সমর্থন ছিল একটি ‘ধর্মতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন।

চিন্তক হিসেবে অধ্যাপক রাজ্জাকের সাহিত্য পাঠের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার। তিনি জানেন উপন্যাস হচ্ছে ‘আধুনিক সমাজের ডিস্কোর্স বা বয়ান’। সেখানে মুসলমানদের অনুপস্থিত থাকাটা তিনি আশঙ্কা করেছেন  ‘আধুনিক’ রাজনৈতিক পরিসরেও মুসলমানদের অনুপস্থিত রাখা হবে। তার প্রমাণ তিনি সাহিত্য থেকেই দিয়েছেন। 

বঙ্গে হিন্দু মুসলমান শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বাস করে আসছে। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গত অভিযোগ হচ্ছে আধুনিক বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকরা উপন্যাস লেখার সময়  সজ্ঞানে, ইচ্ছা করেই মুসলমান সমাজকে উপেক্ষা করে গেছে, তারা ‘আধুনিক’ হতে পারেনি। বর্ণ হিন্দু সাহিত্যিকরা বাংলার বায়ু, বাংলার জল ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় চাপাবাজি করে গিয়েছে; কিন্তু সেই বাংলায় তারা কখনই বাংলাভাষী মুসলমানদের  স্থান দেয়নি। তাতেও সম্ভবত অসুবিধা ছিল না। মুসলমান সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে গেলে তার সমাধান হয়তো হতো; কিন্তু তার জন্য দরকার ছিল রাজনৈতিক পরিসরে মুসলমানদের ‘রাইটফুল রিপ্রেজেন্টেশান’। নিজের রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করবার অধিকার। আবদুর রাজ্জাকের কাছে বড় ক্ষমার অযোগ্য সবচেয়ে অপরাধ হচ্ছে মুসলমান সমাজের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকার বর্ণ হিন্দু ও অভিজাত শ্রেণির অস্বীকার করা। আবদুর রাজ্জাক মুসলমান সমাজকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে অনুপস্থিত করে রাখাকে দেখেছেন একই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিসরে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সমূহ বিপদ হিসেবে। ফলে মুসলমান সমাজকে শিক্ষিত, আধুনিক ও প্রগতিশীল করবার ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। এটা স্রেফ ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমর্থনের ব্যাপার না, ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে পড়ে বাঙালি মুসলমান সমাজকে এগিয়ে যাবার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক শর্ত তৈরি করা।  

আহমদ ছফা এবং আবদুর রাজ্জাকের মধ্যে সাহিত্য এবং সজ্ঞান চিন্তার এই ফারাক বুঝলে আমরা সাহিত্য এবং দর্শন উভয়েরই গৌরব বুঝতে পারব। কারণ আহমদ ছফা সৎভাবে নিজের গুরুর সঙ্গে চিন্তার পার্থক্য এভাবে সাহিত্য হিসেবে যেভাবে তুলে ধরেছেন অন্য কেউই সেটা তুলে ধরতে সক্ষম হননি। যারা চেষ্টা করেছেন তাদের নাম এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

সাহিত্য আর দর্শনের পার্থক্য নিয়ে আশা করি এই অতি প্রাথমিক আলোচনা আমাদের ভাবনাকে গোছাতে সহায়ক হবে; কিন্তু সতর্ক করে দেওয়া দরকার আধুনিক দর্শন এই ফারাক অনুমান করেছে চিন্তা ও ভাষার পার্থক্য আগাম অনুমান করে। অর্থাৎ চিন্তা ভাষা থেকে আলাদা। ভাষা চিন্তার মাধ্যম মাত্র। এই অনুমান এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আজকাল পোস্ট-মর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতা নামে দর্শনের যে ধারা কমবেশি পরিচিত তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ভাষা ও চিন্তার ভেদ বা পার্থক্য রেখা মানতে রাজি নয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে ভাষামাত্রই চিন্তা এবং  চিন্তা বাক্যে নিহিত আগাম অর্থ হয়ে হাজির থাকে না। বরং পাঠের গুণে বিভিন্ন অর্থ তৈয়ার করে; কিন্তু সেই তর্ক দর্শনের তর্ক। আমরা এখানে তা আলোচনা করিনি। তবে আজও দর্শনকে  সাহিত্য হিসেবে এবং সাহিত্যকে দর্শন হিসেবে পড়বার পার্থক্য মনে রাখার ওপর সাহিত্য ও দর্শনের বিচার নির্ভর করে। সাহিত্যিক এবং দার্শনিক দু’জনে একই ভাষাকে আশ্রয় করলেও ভাষার ব্যবহার দুই ক্ষেত্রে আলাদা এই সত্য মুছে ফেলা আজ অবধি সম্ভব হয়নি। আদৌ সম্ভব হবে কি-না তা একটি তর্ক হিসেবেই থেকে যাবে। মীমাংসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //