মাসুদ রানার স্রষ্টা

অন্তিম স্যালুট নিঃসঙ্গ নক্ষত্র

কাজী আনোয়ার হোসেন। জন্ম ১৯৩৬, মৃত্যু ২০২২। কিংবদন্তি লেখক। মাসুদ রানার স্রষ্টা। কে এই মাসুদ রানা? বাংলা রহস্য সাহিত্যের অসম্ভব জনপ্রিয় এক চরিত্র। বলা হয়, কাজী আনোয়ারের জাদুস্পর্শে, মমতায় বাংলা রহস্য সাহিত্য সাবালক হয়ে উঠেছে। পেয়েছে নান্দনিক পাঠকপ্রিয়তা। এই ক্ষেত্রে মাসুদ রানার স্রষ্টাকে আমরা অনায়াসে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ বলতে পারি। একমেবাদ্বিতীয়মের মানে হলো এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি ছিলেন বর্ণিল এক মানুষ। ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার যাকে বলে।

প্রচণ্ড অন্তর্মুখী ও প্রচারবিমুখ ছিলেন। তাঁর জীবনসত্তায় একের মধ্যে বহু গুণের সংমিশ্রণ আমরা দেখতে পাই। কণ্ঠশিল্পী, বংশীবাদক, লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক, সম্পাদক, মৎস্যশিকারি, মেডিটেশনে নিয়োজিত- কত কী পরিচয় তার। জীবদ্দশায় জাতীয় পর্যায়ের কোনো স্বীকৃতি তাঁকে দেওয়া হয়নি। সে কলঙ্ক ও লজ্জা এই কূপমণ্ডূক জাতিরই, তাঁর নিজের নয়। ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন ১৯ জানুয়ারি ২০২২। তার জন্ম তারিখও ১৯। 

গত শতকের ষাটের দশকে শুরু। তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রম। বিশাল এক পাঠকগোষ্ঠী তিনি গড়ে তুলেছেন তিল তিল করে। বাঙালি মুসলিম সমাজে সৃজনশীল গ্রন্থের পাঠক তখন ছিল খুবই কম। ভারতীয় বাংলা চটি বইয়ের জগৎ থেকে তিনি একক প্রয়াসে ছড়িয়ে দিলেন মুক্তির আলো। দিলেন নতুন এক ভুবনের সন্ধান ও স্বাদ। পরিচয় করিয়ে দিলেন বিশ্বসাহিত্যের ঋদ্ধ ভাণ্ডারের সঙ্গে। তাঁর অনুপম গদ্যশৈলী, সহজ, নির্মেদ ঝরঝরে গদ্য বুঝতে পারা মোটেও কঠিন ছিল না। যে পাঠকের সামান্য সাক্ষরজ্ঞান আছে, তার পক্ষেও বিশেষ কঠিন ছিল না থ্রিলার সাহিত্যের রোমাঞ্চ শিহরণ উপভোগের নির্মল আনন্দে অবগাহন করা।

উঠতি বয়সে মাসুদ রানা সিরিজ ছিল অবশ্যপাঠ্য। সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক বই ছিল সহজলভ্য, সুলভ। রেল স্টেশনের বুক স্টলে এই গ্রন্থ থাকতই। দেশব্যাপী লঞ্চে-স্টিমারে-বাসে পথচলতি পাঠকের বিনোদন জুগিয়েছে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা, কুয়াশা, ওয়েস্টার্ন সিরিজ। আরও ছিল মাসিক রহস্য পত্রিকা (সৌভাগ্যক্রমে এখনো অব্যাহত আছে পত্রিকাটির প্রকাশনা), কিশোরপত্রিকা (দুর্ভাগ্য, এই পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে)। সেবা প্রকাশনীর আত্ম উন্নয়নমূলক গ্রন্থসমূহও আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল, দীপ্যমান। ‘বিদ্যুৎ মিত্র’ ছদ্মনামে লিখেছেন অনেক দরকারি তথ্যবহুল, শিক্ষণীয় বই। বাংলা সাহিত্যে এসবের সংযোজন তিনি করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রমে, সাধনা ও নিষ্ঠায়। এসবের ক্ষেত্রেও তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম!

সেবা প্রকাশনীর বইগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে কিছু। প্রতিটি বই-ই সুসম্পাদিত। কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন তাঁর সময়ের চাইতেও অগ্রসর একজন মানুষ। স্বাপ্নিক, প্রবলভাবে দেশপ্রেমিক, স্বনির্ভর, রুচিস্নিগ্ধ। কত লেখক অনুবাদক যে তিনি সৃষ্টি করেছেন, সুপ্ত প্রতিভা খুঁজে বের করেছেন, মাতৃমমতায় লালন করেছেন তাদের, সেসবের শুমার করা মুশকিল। লেখক সম্মানী নিয়মিত দেওয়ার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিরিয়াস ও যত্নশীল- সামগ্রিকভাবে এই গুণটি আমাদের প্রকাশকমণ্ডলীর মধ্যে অনুপস্থিত দেখি।

বরাবরই আশাবাদী মানুষ ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। বন কেটে বসত গড়েছেন। বড়ই নিঃসঙ্গ ছিল তাঁর অভিযাত্রা। তাঁর উদ্ভাবনী, শ্রম, আধুনিক মনস্ক সৃজনপ্রতিভা নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছে বাঙালি মুসলিম পাঠকদের। মুসলিম বলছি সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থে। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে সেই আশাবাদী মানুষটির স্বপ্নে চিড় ধরেছে। এই পরিবর্তনটি আমরা খুবই বিষাদ ও নৈরাশার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করি। মৃত্যুর অল্প কয়েক দিন আগে ৪ জানুয়ারি ২০২২ তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক প্রথম আলোর ‘অন্য আলো’তে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘সব মিলিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ খুব ভালো-এমনটি বলতে পারছি না, দুঃখিত। শুধু থ্রিলার সাহিত্য কেন, এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা, নাচ-গান-বাজনা-সিনেমা-ছবি-ভাস্কর্য, অর্থাৎ যা কিছু সুন্দর সব ধরনের শিল্পসৃষ্টির ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে ক্রমে। কিসের করালগ্রাস গিলে খাচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধ, সেটা বাঙালিকে বুঝতে হবে। আমি তো চলেই যাব, যাঁরা এখানে থাকবেন, তাঁদের সতর্ক হওয়ার কিন্তু এখনই সময়।’

বড় হয়েছেন উদার মুক্ত পরিবেশে। বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন অলোকসামান্য ব্যক্তিত্ব। ১১ ভাইবোন ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেনরা। বাড়িতে গানবাজনার চর্চা ছিল। ভাইবোনরা অনেকেই নিজস্ব প্রতিভায় দীপ্ত, খ্যাতিমান। তাঁর দুই বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। ছোটবেলায় এক ভাইয়ের সঙ্গে পুকুরে নেমে অন্যরকম এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। কে কতক্ষণ বেশি সময় ডুবে থাকতে পারে- সেটা ছিল প্রতিযোগিতা। কাজী আনোয়ার হোসেনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হলেও অন্যজন কাজী সুলতান হোসেন পানিতে ডুবে মারা যান। ছোট এক বোন মাহমুদা খাতুনের (বিশিষ্ট নকশাবিদ) স্মৃতিচারণায় এক্ষণে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারি আমরা। মাহমুদা খাতুন লিখেছেন- ‘বড় হওয়ার পর দুটি বিষয়ে প্রবল আগ্রহ জন্মে। একটি হলো বাঁশি বাজানো। গভীর রাতে বড়দা যখন বাঁশি বাজাতেন, তার সুর পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করত।

বড়দার দ্বিতীয় শখ ছিল কবুতর পালন। এক সময় বাড়ির ছাদে শত শত কবুতর ছিল। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল সব কবুতর মরে পড়ে আছে। সম্ভবত বিড়াল কিংবা বেজিজাতীয় কোনো প্রাণী সেগুলো মেরে ফেলেছিল। ছাদ জুড়ে কবুতরের ছিন্নভিন্ন শরীর আর রক্ত। এ ঘটনা বড়দাকে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল। এরপর তিনি আর কখনো কবুতর পালেননি।

এম এ পাস করার পর সবাই যখন চাকরি খুঁজছেন, বড়দা তখন চুপচাপ বসে রইলেন। আসলে কারও অধীনে চাকরি করা তাঁর পছন্দ ছিল না; কিন্তু সবাই যখন চাকরি আর উপার্জনের কথা বলতে শুরু করলেন, ঠিক করলেন চা-বিস্কুটের দোকান দেবেন।

বাড়ির বাইরের এক কোণে একটি ঘর খালি পড়ে থাকত। তিনি সেখানে ‘বৈশাখী’ নামে চায়ের দোকান খুলে বসলেন। ওই দোকানে কতটুকু বিক্রিবাট্টা হতো আর বড়দা কাজটা কতটা পছন্দ করতেন জানি না, তবে কিছুদিন পর একদিন বাবা (কাজী মোতাহার হোসেন) তাঁর দোকানে গেলেন। সেজদাকে বললেন, ‘নবাব (বড়দার ডাকনাম), তুই যে আইএ পড়ার সময় দুটি গল্প লিখেছিলি, সেগুলো খুবই ভালো হয়েছিল। তুই সেগুলো নিয়ে ভেবে দেখতে পারিস। এখন থেকে তুই বরং রহস্য গল্পই লিখতে শুরু কর।’

বাবার অনুপ্রেরণায় বড়দার জীবন বদলে গেল, তিনি তাঁর গল্প দুটি দিয়ে নতুন একটি সিরিজ শুরু করলেন, নাম ‘কুয়াশা’। তার পরের ইতিহাস তো কমবেশি সবার জানা।

নতুন এক পথে হাঁটলেন। পথচেনা নেই। প্রবল আত্মপ্রত্যয়, স্বপ্নচারিতা, অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করল। চির কিশোর এই মানুষটি ছিল সবক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী। প্রচলিত নিয়মরীতি, বিধিবিধান তাঁর পছন্দ ছিল না। কৈশোরেই কলকাতার লেখকদের প্রণীত থ্রিলার মন কেড়ে নেয় তাঁর। বাংলাদেশের সাহিত্যে সেই ধারারই জন্ম দিলেন তিনি। প্রাণপণ প্রয়াসে সাধ্যমতো বিকশিতও করলেন। কিশোর বয়সে পড়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ঘটোৎকচ, যখের ধন, আবার যখের ধন, নৃমুণ্ডু শিকারি ইত্যাদি থ্রিলার ও অন্যান্য লেখকের রহস্য রচনা। পড়লেন রবিনহুড। মুগ্ধ, চমৎকৃত, প্রাণিত হলেন। এসব গ্রন্থপাঠের অভিজ্ঞতা তাঁর মানসগঠনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কাজী আনোয়ার হোসেনের নিজের ভাষায়- ‘এই বইগুলো আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে আজও সে মোহের জাল কেটে বেরোতে পারিনি, চিরকিশোর রয়ে গেছি। লঘু বলেন বা বলেন অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য; আমি আমার ভালোবাসার জগতে দিব্যি আরামে ও আনন্দে বিচরণ করছি আজীবন।’

কী হবে মাসুদ রানা সিরিজের ভবিষ্যৎ? কাজী আনোয়ার হোসেনের পরিবারবর্গ জানিয়েছেন, তারা অব্যাহত রাখবেন এর যাত্রা। কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেও খুব আস্থাবান ছিলেন সেবা প্রকাশনীর ব্যাপারে। বলে গেছেন, ‘সুদীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে পাঠক মাসুদ রানা পড়েছে এবং মজা পেয়েছে। এখনো সেই প্রথম বই কুয়াশা, ধ্বংস পাহাড়-এর মতোই নতুন বইগুলো কিনে পড়ছে, তাদের মধ্যে নিত্যনতুন কিশোর আছে, তাদের স্বপ্নের বাগান ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করে দিচ্ছে সেবা প্রকাশনী; আগামী ৩০ বছরেই তাদের সব আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মনে করি না। ... ৩০ কেন, আগামী ৬০ বছরেও সেবার প্রয়োজন ফুরাবে বলে মনে করি না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //