বুদ্ধদেব বসু, প্রভাতকালের মুখ

আমাদের বাসায় লেখকদের একটা পোস্টার ছিল। পোস্টারের একটি ইতিহাসও আছে। কোনো এক প্রকাশনী পোস্টার বের করে সকল কলেজে দিয়েছে। একসাথে এত লেখকের ছবি আগে আর দেখিনি। ভাইস প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে পোস্টারটি চেয়ে বসলাম। তিনিও লেখকদের পছন্দ করতেন। পোস্টারটি পেলাম না। বাসায় এসে মনখারাপ করে বললাম কথাটা, যেন জীবন, মরণ সমস্যা। কয়েকদিনের ভেতরেই পোস্টারটি হাতে এসে গেল, ঢাকার বাংলাবাজার থেকে।

এখন কাজ হলো প্রিয় লেখকদের পরিচিত করা সন্তানদের কাছে। যেন ঐ বিশেষ মুখগুলোর ভেতরে লুকিয়ে ছিলো জগতের অপার আলো। পাঁচ বৎসর বয়সের আমার ছোট ছেলে নিমগ্ন যখন জোব্বা পরা রবীন্দ্রনাথকে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিত, বিদ্যাসাগরকে, মধুসূদন, নজরুল, বিভূতিভূষণকে চিনতে শিখলো মনে মনে ভাবতাম সে যেন তাদের একজন হয়ে বাঁচে। নিমগ্নের প্রিয় ছিলো বুদ্ধদেব বসুর ছবি। বুদ্ধদেবের একটি বিশেষ ছবি সবজায়গায় ছাপা হতো, গভীর বিষন্ন দীঘল চোখের রাজপুত্র যেন। আমিও সেই ৮২ সাল থেকে এই ছবির ভক্ত।

তখন লেখার আগে প্রেমে পড়তাম লেখকের চেহারার। একটি বিষয়ে আমাদের মিল ছিল। বুদ্ধদেবের মতো আমারও জন্মদিন ৩০ শে নভেম্বর। বুদ্ধদেব ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, আমি বাংলা সাহিত্য। তিনিও কলেজে পড়াতেন, আমিও কলেজে পড়াই। তিনি বিখ্যাত লেখক, আমি সামান্য হলেও লিখি। আহা কার সাথে কাকে মেলাচ্ছি? কোথায় তিনি তিরিশের রবীন্দ্র বলয় ভাঙার নায়ক, কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক ও সফল সম্পাদক আর আমি? তবু ভাবতে ভালো লাগে, পড়তে ভালোলাগে, দেখতে ভালো লাগে বুদ্ধদেব বসু নামের আধুনিক সাহিত্যরুচির অন্যতম রূপকারকে। অনন্য এক কবিকে।

তার শৈশব ভেবে কষ্ট পেলাম যখন জানলাম জন্মের চব্বিশ ঘন্টার ভেতরে তার মা চলে গেলেন পরপারে।বাবাও বিচ্ছিন্ন থাকলেন দ্বিতীয় বার বিয়ে করে। মাকে হারিয়ে এবং পিতা থেকেও না থাকার কারণে মাতামহ-মাতামহী চিন্তাহরণ সিংহ ও স্বর্ণলতার স্নেহ যত্নে বড় হয়ে ওঠেন। দাদামশায় আর দিদিমাকেই তিনি বাবা-মা মনে করতেন। আত্মজীবনী মূলক রচনা ‘আমার ছেলেবেলায়’ লিখেছেন, ‘আমি আমার দাদামশাইকে ডাকতাম’ দা’, দিদিমাকে ‘মা’ বলতাম। শুধু যে মুখে মা বলতাম তা নয়, তাঁকে মা ছাড়া অন্য কিছু আমি ভাবিনি কখনো, ভাবতে পারিনি। কিছুটা তোৎলা ছিলেন তখন। মিশতে পারতেন না কারো সাথে। সেই একা একজন মানুষ, বিষন্ন মানুষের মুখ মনে করে আমারও কষ্ট হতো, কষ্ট পেতাম।

শৈশবে বুদ্ধদেব খুব অসুখে ভুগতেন আর নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইতেন। সেই সময় সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-

‘‘আমি আত্মসচেতন হয়ে উঠছি, নিজের অনেক প্রকৃতি প্রদত্ত ত্রুটি আবিষ্কার করে ক্ষুন্ন হ’য়ে আছি মনে মনে-সমবয়সী অন্য ছেলেদের তুলনায় আমি বেঁটে, আমি রোগা এবং দুর্বল-ফুটবল দূরে থাক, ব্যাডমিন্টনেও আমার অল্পেই দম ফুরিয়ে যায়।আমার স্বাস্থ্য ভালো নয়-ঘুরে ঘুরে ভুগি জ্বরে, সর্দিতে, দাঁতে ব্যথায়, আমাকে গিলতে হয় বিস্বাদ বার্লি, আর তীব্র তেতো কবরেজি পাঁচন-পর পর দুটো শীত ঋতু ভ’রে কুৎসিত চর্মরোগে কষ্ট পেলাম। তার উপর আমি তোৎলা; হঠাৎ কোনো অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমার যন্ত্রণা দুঃসহ হয়ে ওঠে, কোনো তর্ক উঠলে আমার চোখা চোখা যুক্তিগুলোকে কণ্ঠনালী থেকে টেনে বের করার ব্যর্থ চেষ্টায় আমি হাঁপাতে থাকি।’’ শৈশবের এই সীমাবদ্ধতা, অবয়বগত খর্বতা, তোৎলানো স্বভাব বুদ্ধদেবকে করে তোলে নির্জন।

২.

বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পড়ার আগে পড়েছি তাঁর উপন্যাস ‘তিথি ডোর’। ‘তিথি ডোর’ আমাকে এতটাই আক্রান্ত করেছিল যে আমিও হতে চেয়েছিলাম ‘স্বাতী মিত্র’। নিজে হতে পারিনি বলে বন্ধু সেঁজুতি বিশ্বাসকে ডাকতাম ‘স্বাতী মিত্র’। সাদা শাড়ি, আত্মমগ্ন সেই স্বাতীমিত্র যে দেখে যায় চারপাশের জগৎ সংসার অথচ সকলের থেকে আলাদা। স্বাতীমিত্রকে বুকে নিয়ে বাস করেছি তারই মতো কল্পলোকে। সমাজ, সংসার পরিবার থেকে এক নির্বাসিত জীবন কাটাতে ভালোবাসা স্বাতী নিজের ভেতরে সম্পূর্ণতা সন্ধানে ছিল নিমগ্ন। বিষণ্ণ এক লাবণ্য জড়িয়ে থাকা স্বাতীকে আমি তখন পাঠ করি গভীর নৈঃশব্দ্যে। তাঁর উপন্যাসের  নামগুলো খানিকক্ষণ চুপ করিয়ে দেয়। লাল মেঘ, রাত ভরে বৃষ্টি, নীলাঞ্জনের খাতা, পাতাল থেকে আলাপ, নির্জন স্বাক্ষর একটা চমক উৎপাদন করে। ‘রাত ভরে বৃষ্টিতে’ বিয়ে সম্পর্ক সনাতন বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছেন কবি। মানিয়ে নেয়া চিন্তা, আপোষপ্রবণ মানসিকতা জীবনকে অস্তিত্বশূন্য করে দেয়। স্ত্রী মালতীকে আধুনিক করে তুলতে চাইলেও, মালতী যখন ঠিকঠাক নারী হয়ে উঠতে থাকে তখন দেখা দেয় নয়নাংশুর মানসবিকৃতি।

মালতী ভেতরে সনাতন ধারণা পোষণ করে বাইরে আধুনিক। এই দ্বন্দ্বের রক্তক্ষরণ তাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে। মালতী গভীর বিষাদে বলে- ‘আমি এখন বুঝতে পারি সাত সন্তানের মা হয়েও কোনো মহিলা কুমারী থেকে যেতে পারেন-হয়তো ঘরে-ঘরে এমন গৃহিণী অনেক আছেন যাঁরা একটা বোবা শরীর নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবন, আর তা তাঁরা জানেন না পর্যন্ত। আমিও কি জানতাম আমার গোপন রহস্য জয়ন্তর সঙ্গে দেখা না হলে?’

‘রাত ভরে বৃষ্টি’ নতুন ভাবনা নতুন মানসিকতার উপন্যাস। এ উপন্যাস অশ্লীলতার অভিযোগে আদালতে যায়। মেয়েদের পরপুরুষে গমনের উৎসাহ দেয়ার পক্ষে বিপক্ষে চলে আন্দোলন, আলোচনা, আদালতের নানা আয়োজন।

বুদ্ধদেব নানা ক্ষেত্রে সাহসী ছিলেন। আই এ পরীক্ষায় প্রাপ্ত বৃত্তির টাকা সম্বল করে অনেক আগেই একটা দুঃসাহসী কাজে নেমেছিলেন। বের করেছিলেন প্রগতি পত্রিকা। তার সাথে ছিলেন অজিত দত্ত, অমলেন্দু বসু, পরিমল রায়। প্রগতি বের হয় ১৯২৭ সালের জুন মাসে। ১৯৩৫ সালের ১অক্টোবর প্রগতির পর বের হয় কবিতা পত্রিকা। যা বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা এনে দেয়। এটি তাঁর জন্য এক অনন্য সংগ্রাম।

বুদ্ধদেব বসুর নানা রকম প্রবন্ধ রয়েছে। ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ আর ‘কালের পুতুল’ বাংলায় পড়তে গিয়ে অনেক কাজে লেগেছে।

‘আমার ছেলেবেলা’ ‘আমার যৌবন’ তাঁকে চিনতে হলে খুব খুব প্রয়োজন। লেখকের আত্মজীবনী বিশেষ সময় মাপার যন্ত্র হয়ে যখন আয়না দেখায় তখন তা অমূল্য। বুদ্ধদেব রবীন্দ্র বিরোধী হয়েও রবীন্দ্র অনুরাগী। কবিদের কবি। মন খারাপ লাগলে বুদ্ধদেবের একটি কবিতা বার বার পড়ি। ১৯৩৪ সালের ২ মে লিখেছে, ‘সন্ধ্যায় শান্তি’ কবিতাটি। ছুঁড়ে ফেলো তোমার সব অভিযোগ/ আর অভিমান আর আক্রোশ আর বিদ্বেষ/ যা নেকড়ের পালের মতো তোমাকে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলছে।/ ভুলে যাও, ভুলে যাও এই পৃথিবীকে/ যা চাবুক মারছে তোমার মুখে।/ ভুলে যাও মানুষ, আর মানুষের কথা-/ তুমি কি এত বড় দুর্ভাগা যে মানুষের হাতে মরবে?/ বাইরে তাকাও।/ নীল কাঁচের মতো সন্ধ্যার আকাশ।/ আর চেয়ে দ্যাখো, তোমার জানালার বাইরে রাত্রি চুপ করে দাঁড়িয়ে/ যেন কোনো মেয়ে প্রিয়তমের চুম্বনের অপেক্ষায় স্তব্ধ।

‘নীল কাচের মতো সন্ধ্যার আকাশ’ নিয়ে বুদ্ধদেবের কবিতা অতপর আমার নরম কৌতুহলকে বহুদিন জাগাতে থাকে, বাড়াতে থাকে।

৩.

বুদ্ধদেব বসুর জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায়। পিতা ছিলেন ভূদেবচন্দ্র বসু ঢাকা বারের উকিল। যৌবনের প্রথমভাগ কাটে পিতামহের কর্মস্থল কুমিল্লায়, নোয়াখালী ও ঢাকায়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।ঢাকার পুরানা পল্টন থেকেই তাঁর ‘প্রগতি’ পত্রিকা বের হয়। বুদ্ধদেব বসুর কৈশোর, যৌবনের স্বপ্নময় দিনগুলো কেটেছে ঢাকা শহরে।ঢাকা শহরই ছিলো তাঁর নরম পলিমাখা হৃদস্পন্দন। বুদ্ধদেব বলেছেন, ‘আমি ধারাবাহিক ভাবে ঢাকায় ছিলাম মাত্র সাড়ে-নয় বৎসর; কিন্তু ছিলাম ঠিক সেই বয়সটয় যেটা মানুষের জীবনে সবচেয়ে সগর্ভ ও প্রভাবশীল।ভাবলে মনে হয়-আমার মধ্য-তিরিশ থেকেই তা-ই মনে হচ্ছে-যেন কতকাল ছিলাম আমি সেখানে, ঢাকার বছরগুলি ভ’রে যেন অনেক কিছু ঘটেছিল, আমি অনেক কিছু করেছিলাম। মনে হয় যেন দিন রাত্রি ঋতু বৎসর অমন বিচিত্রভাবে ও প্রগাঢ়ভাবে আমার চেতনায় আর প্রবিষ্ট হয়নি।’ পরবর্তী জীবনে নানা লেখালেখিতে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ঢাকা শহরকে রূপ দিয়েছেন নানা মাত্রায়। ‘পুরানা পল্টনের যে জিনিসটি আমি কখনো ভুলবো না,তা হচ্ছে তার বর্ষার রূপ।’ (পুরানা পল্টন/হঠাৎ আলোর ঝলকানি)

বুদ্ধদেবের কবিতা, প্রবন্ধ আর স্মৃতিকথায় নরম পালক ফেলে রঙিন হয়ে আছে যেমন তার প্রিয় ঢাকা শহর, তেমনি আছে উপন্যাসে। ‘বুলবুল, কোনো চৈত্রমাসের দুপুরবেলায় শাঁখারিবাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটেছো কোনোদিন? কী আশ্চর্য সেই সরু, ছোট্ট, পুরোনো গলিটি, দু-দিকে গায়ে গা ঠেকানো, তেতলা-চারতলা চক মিলানো বাড়িগুলি, রোদ ঢুকতে পারে না সেই গলিতে-পা দেয়া মাত্র কেমন একটা সোঁদা, ভ্যাপসা, স্যাঁৎসেঁতে গন্ধ, শাখের করাতের ধারালো আওয়াজ সবসময়।’ (গোলাপ কেন কালো)

বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসে পুরানো ঢাকার স্মৃতিই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আধুনিক ঢাকা সেখানে নেই। তাঁর বর্ণনায় কলকাতার চেয়ে ঢাকার প্রতিই বেশি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। ঢাকার পুরানা পল্টন, এক আলোকময় দীপ্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা রকম লেখায়। যা আমাদের অহংকারকেও জাগ্রত করে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //