কোডচোর

এসি রুমে বসেও তরু দরদর করে ঘামছে। এটা আজকের দিনের শেষ ক্লাস। থিওরি ক্লাস না ল্যাব। আজকে ফাইনাল প্রজেক্ট সাবমিশনের অফিসিয়াল লাস্ট ডেট। প্রজেক্ট বলতে একটা বড়সর কোড। যেটার একলাইনও তরু শুরু করতে পারেনি। কোর্সের নাম ‘কম্পাইলার’। ফ্যাকাল্টির নাম শাহেদা। তরুর দরদর করে ঘামার কারণ মূলত এটাই। 

কিছু মানুষকে ঈশ্বর সব বেশি করে দিয়ে পাঠান, কিছু মানুষকে দেন খুবই কম। আর কিছু কিছুদের এমনভাবে দেন যে, তারা আমৃত্যু দ্বিধাগ্রস্ত থাকে ঠিক কোন দলে তাদের অবস্থান তা নিয়ে। তরু সেই তৃতীয় দলের। তার বুদ্ধি মোটামুটি, মেধা মোটামুটি আর চেহারাও মোটামুটি। ক্লাসে প্রথম সারিতে তার সবসময় বসতে ইচ্ছা করলেও দেরি করে আসার কারণে আর কনফিডেন্সের অভাবে তা সে পারে না। আবার শেষ সারির হুল্লোড় করা কিংবা বেঞ্চিতে মাথা দিয়ে টিচারের সামনে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা বাহিনীর সঙ্গেও সে মিশে যেতে পারে না। তাকে বসতে হয় তৃতীয় সারির কোণার দিকে। সেখান থেকে লেকচার ঠিক করে বুঝতে না পেরে একটা পর্যায়ে তার মনে হয় পেছনে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকলেই বোধহয় বেশ হতো। 

কিন্তু আজ সে কোনো কোণায় গিয়ে বসলেও নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। অন্যান্য কোর্সগুলোতে যা অ্যাসাইনমেন্ট দিত তা সে গুগল করে, রিলেটেড টাস্কের কোড কপি করে, সেই কোড টুকটাক এডিট করে আর ফ্যাকাল্টির হেল্প নিয়ে কোনো মতে চালিয়ে দিতে পারত। সমস্যা হয়েছে এ কোর্সে এসে। মিস শাহেদার সঙ্গে তার পুরানো শত্রুতা। এই শত্রুতার জন্ম কোথায় কখন কিভাবে হয়েছে তা সে জানে না। সে শুধু জানে মিস শাহেদা তাকে দেখলেই এনার্জেটিক হয়ে যান। আয়োজন করে, সবাইকে শুনিয়ে, মোটামুটি কোনো কারণ ছাড়া তরুকে অপমান করা তার গত ৪ মাসের নতুন হবি সম্ভবত। তরু ঠিক কি করে তাকে রাগিয়েছিল সে বিষয়ে সে কিছুই মনে করতে পারে না। তবে করেছিল নিশ্চয়ই। নয়তো তার মতো তৃতীয় সারির কোণায় বসে থাকা নিরীহ একজনের ওপর মিস শাহেদার এত মনোযোগ কেন? 

আর সে কারণেই ভাঙাচুরা কোড করে সেটা মিস শাহেদার রুমে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি হেসে ‘বাকিটা কি করে ঠিক করব মিস?’ বলার সুযোগ তরুর নেই। অগত্যা এসি রুমে ঘেমে নেয়ে একাকার হওয়া ছাড়া তার কিছু করারও নেই। -স্টুডেন্টস! আমি আর ৫ মিনিট দিচ্ছি। এর মধ্যে সবাই টাস্ক কম্পিউটারে রেডি করে মনিটর অফ করে দিবে। আমি একেক করে সবার ডেস্কের সামনে যাব। তরু ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। আশেপাশের সবাই কে কি করছে সে দিকে মন দেয়ার চেষ্টা করল। বলাবাহুল্য, বরাবরের মত তার চোখ মুখোমুখি সারির কম্পিউটারে বসা আবীরে আটকে গেল। আবীর ঈশ্বরের তৈরী প্রথম দলের লোক। প্রকৃতি তাকে দু-হাত খুলে দিয়েছে। সে ডিপার্টমেন্টের ওয়ান অব দ্যা টপারস, অসম্ভব সুন্দর গান গায়। ভদ্র, বিনয়ী, পরোপকারী আর অসম্ভব অসম্ভব রূপবান। 

তরু আবীরকে প্রথম দেখেছিল ইনডোর গেমসের ফ্লোরে। তখন পুরোপুরি সন্ধ্যা। ৭টা কি ৭:৩০ হবে। ইউনিভার্সিটি বিল্ডিংয়ে তেমন কোনো স্টুডেন্ট আর তখন নেই। প্রায় সবাই বেরিয়ে গেছে। তরু কি এক প্রজেক্টের কাজ নিয়ে একাই অনেকক্ষণ ল্যাবে বসা ছিল। ফেরার পথে হঠাৎ শুনলো খুব চাপা গলায় কে যেন গান গাইছে। ইনডোরে উঁকি দিতেই সে আবীরকে দেখল। একটা কর্নারে দুটো চেয়ার একসঙ্গে করে ফর্সা, কোঁকড়া চুলের একটা ছেলে চোখ বন্ধ করে গান গাইছে। তার হাতে গীটার ফিটার নেই। রুমে তরু ছাড়া দ্বিতীয় কোনো জনও নেই। তরু যে এসেছে ছেলেটা সেটা টেরও পায়নি। অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে তরুর হঠাতই চোখে পানি চলে আসল। সে মুহূর্তেই রুমের বাইরে চলে এল। আর তারপর নিজের বোকামিতে তার আরেক দফা চোখে জল এলো। তখন বৈশাখ মাস। বাইরে তুমুল ঝড়। তরুর গাড়ি এখনো বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের গেইটের সামনে এসে পৌঁছায়নি। ঝড় মাথায় করেই সেদিন সে বের হয়ে গিয়েছিল। তরুর মনে হলো তার মাথায় বোধ ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মাত্রায় কম। নয়তো এখন মিস শাহেদার ল্যাবে বসে তার সেদিনের ঝড়ের কথা মনে করার কথা না। তার উচিত একমনে দোয়া ইউনুস পড়ে যাওয়া।

শাহেদা মিস প্রজেক্ট চেক করা শুরু করেছে। সে এখন আছে আবীরের পিসিতে। এখানে সে বেশি সময় নিবে না। কোনো টিচারই নেয় না। আবীর ও পাবে সে তো সবারই জানা কথা। তারপর সে বোধহয় যাবে রিমির ডেস্কে। রিমিও ২ মিনিটেই পুরোটা ব্যাখ্যাসহ দেখিয়ে দিবে। সে আবীরের বন্ধু কিংবা গার্লফ্রেন্ড। সেও ভালো ছাত্রী এবং দেখতে হুরপরীদের কাছাকাছি। 

আচ্ছা তরু তখন থেকে নানা লোকের চেহারা নিয়ে ভাবছে কেনো? তার কি মাথার সিস্টেম ক্র্যাশ করতে শুরু করেছে? নাকি...

-এই যে! হ্যালো! মিস তরু! উঠে দাঁড়ান।

তরু দেখল শাহেদা মিস তার দিকে আঙ্গুল তাক করে আছে। সে উঠে দাঁড়াল।

-আপনি এখন কোড দেখাবেন?

-মিস, আসলে আমি এখনও কমপ্লিট করতে পারিনি

-কমপ্লিট করার প্রশ্ন তখনই আসে যখন কেউ শুরু করে। আপনি কি শুরু করতে পেরেছেন?

তরু চুপ করে রইল। তার পরবর্তী এক মিনিট মিস শাহেদা যা যা বললেন তাতে তরুর ইচ্ছা করল ছুটে ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়ে কোনো ওয়াসরুমে ঢুকে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে। তরু কাঁদল না। শান্ত মুখে সবটুকু শুনে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। বসেই রইল। 

ক্লাস ফাঁকা হতে শুরু করেছে। মিস শাহেদা কালকে পর্যন্ত টাইম এক্সটেন্ড করেছে। সবাই ধীরে ধীরে পিসি অফ করে বের হরে যাচ্ছে। তরু আরও কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকল। তারপর বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। তখন ল্যাবে আর কেউ নেই। সবাই চলে গেছে।

হঠাৎ তার চোখে পড়ল আবীরের ডেস্কে একটা পেনড্রাইভ। এটা আবীরেরই পেনড্রাইভ। ছেলেটা ভুলে ফেলে গেছে।

তরুর কি মনে হল তা সে নিজেও জানে না। সে শুধু জানে সে আবীরের ডেস্কের কাছে এগিয়ে গেল। পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এল। 

গাড়িতে বসে সে মিস শাহেদা, কম্পাইলার, প্রজেক্ট সব চিন্তা বাদ দিয়ে পেনড্রাইভটা কেনো সে হাতে করে নিয়ে এসেছে তা নিয়ে ভাবতে লাগল। সে জানে আবীরের করা প্রজেক্টের ফাইলটা এতে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে কি সে কোড চুরি করার উদ্দেশ্যেই এটা হাতে করে নিয়ে এসেছে? 

বাসায় ফেরার পর মা রাবেয়া বেগম তাকে দেখেই রাজ্যের প্রশ্ন শুরু করল। ‘ক্লাস কখন শেষ হয়েছে রে? দুপুরে কোথায় খেয়েছিলি? কি খেয়েছিলি? ওমা! তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? এই তরু!’

তরু মায়ের সব ডাক উপেক্ষা করে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। রাতে খাবার টেবিলে ডাক পড়ার আগ পর্যন্ত সে পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে বসে থাকল। ওঠার কোনো শক্তি বাঁ ইচ্ছা সে পেল না। চুরি করল সে শেষ পর্যন্ত! তাও আবীরের করা কোডিং? 

কম্পাইলার কোর্সের আজকেই শেষ দিন। আজকেই সবাইকে গ্রেড দিয়ে দেয়া হবে। আবীরের গতকালই সাবমিশন শেষ হয়ে গিয়েছিল। গ্রেডও সে পেয়ে গেছে। তবু সে এসেছে। প্রতিদিনের মতো সবার আগে অবশ্য আজ সে আসতে পারেনি। তার ১০ মিনিট লেট হয়ে গেছে। তরু তার ডেস্কে চুপচাপ বসে আছে। পিসি অন করেনি। মুখে তেমন কোন ভাবলেশও নেই। আজ ল্যাবে স্টুডেন্ট কম। বেশিরভাগই গতকাল প্রজেক্ট সাবমিট করে ফেলেছে। মিস শাহেদা তার দিকে এগিয়ে আসছে। আশ্চর্য! আজকে তরুর তেমন ভয় করছে না। 

-তো মিস তরু! আপনি বলেন। আপনাকে কি দিব? ডি? নাকি এফ? তাড়াতাড়ি বলেন। আমি এত সময় এখানে দিতে পারব না। 

-মিস, এফ দিন

-থ্যাঙ্কইউ ফর সেভিং মাই টাইম 

মিস শাহেদা তার সামনে থেকে চলে গেলো। তরু আজকে আর বসল না। আজ সে আগে আগে বাসায় ফিরবে। ফিরে ঘুমাবে। বিকালে মা রাবেয়া বেগম চা করে দিলে তার সঙ্গে গল্প করবে। আজকে তার অনেক কাজ। তরু উঠে দাঁড়াল। ফাইল, খাতা গুছিয়ে ল্যাব থেকে বের হয়ে গেলো। 

-তরু যাচ্ছ এখন?

আবীর তাকে ডাকছে। তরু পিছনে ফিরে তাকালো 

-হ্যাঁ যাচ্ছি।

-আমি আমার পেনড্রাইভটা কালকে ফেলে গেছিলাম। 

-হ্যাঁ আমি জানি। আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। তোমার সঙ্গে ফেরার পথে আর দেখা হয়নি বলে দিতে পারিনি। তাই আজ সকালে তোমার ডেস্কে রেখে দিয়েছিলাম। পেয়েছো বোধহয়। 

-তুমি আমাকে সরাসরিও তো দিতে পারতে

-তোমার ডেস্কে রাখার কিছুক্ষণ পর তুমি চলে এসেছিলে। তাই আর আলাদা করে কিছু বলিনি। 

-আমি তো আজকে না ও আসতে পারতাম। না আসলে কি করতে? 

-তুমি না আসলেও তোমার কোনো না কোনো বন্ধু আসত। আমি তাদের কারোর কাছে তখন দিয়ে দিতাম। 

-আমার তেমন বেশি বন্ধু বান্ধব নেই। তোমার কাছেই রেখে দিতে। আমি পরে নিয়ে নিতাম। 

-হ্যাঁ দরকার হলে তাই করতাম হয়তো; কিন্তু সে যাই হোক। তোমার পেনড্রাইভটা হারায়নি সেটাই বড় কথা। আমি যাই এখন আবীর।

-তরু!

-বলো

-তুমি প্রজেক্ট করে জমা দিলে না কেনো?

-কেন আবার? আমি পারিনি। 

-পেনড্রাইভে কিন্তু পুরো কমপ্লিট প্রজেক্টা ছিল। 

-মানে? কি বলতে চাইছো? আবীর! আমি তোমার পেনড্রাইভটা একরাত নিজের কাছে রেখেছিলাম শুধু! তুমি কি...

-কালকে সন্ধ্যায় পেনড্রাইভটা খুঁজতে এসে তোমার লাল ডাইরিটা পেয়েছিলাম। ওটার কথা তুমি ভুলে গেছ বোধহয়। তরুর মেরুদন্ড দিয়ে কিসের জেনো একটা ঠান্ডা স্রোত বেরিয়ে গেলো। কোন ডাইরির কথা বলছে আবীর? 

-আমার ডাইরি?

হ্যাঁ! উপরে তোমার নাম লেখা। ওটা আমি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। ফেরত দিতে এসেছি

আবীর তরুর ছোট্ট লাল ডাইরিটা তার দিকে ধরে রেখেছে। তরু হাত বারিয়ে ডাইরিটা নিল। তারপর দ্বিতীয়বারের মত বলল, ‘আমি এখন যাই আবীর।’ 

-তরু!

-কি হয়েছে?

-আমার বিষয়ে তোমার একটু ভুল ধারণা আছে। ধারণাগুলো আমি শুধরে দিতে চাই। 

তরু আবীরের দিকে তাকালো। কি বলতে চাইছে ছেলেটা?

-আমি সিগারেট খাই না বলে তোমার হয়তো ছোট খাটো আক্ষেপ আছে। তোমার এই ধারণা ভুল। আমি সিগারেট খাই। টঙ্গে গিয়ে খাই না তবে খাই

তরু কিছু বলল না। তাকিয়ে থাকল। আবীর আবারো বলা শুরু করল

-তোমার দ্বিতীয় ভুল ধারণাটা ভাঙানো এই মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হল রেমি আমার গার্লফ্রেন্ড না। আমার ক্লাসমেটই। আমার কোনো প্রেমিকা নেই। 

-আবীর!

-বলো

-তুমি আমার ডাইরি খুলেছো। এই কাজটা কেনো করলে? আমি কিন্তু তোমার পেনড্রাইভ এক বারের জন্যও ওপেন করার চেষ্টা করিনি। তুমি এই অন্যায়টা কেনো করলে? 

-কারণ কোড কিংবা চুরির কোনোটাই তুমি করতে পারো না। আর আমি দুটোই পারি। 

তরু এখনো তাকিয়ে আছে। আবীরও তাকিয়ে আছে। তারা বোধহয় গোপন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কতক্ষণ চোখ না নামিয়ে থাকতে পারে তা নিয়ে। আবীরের ধারণা সে জিতে যাবে। দেখা যাক কি হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //