অলকানন্দা
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:৩৭ পিএম
আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:৪৭ পিএম
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:৩৭ পিএম
অলকানন্দা
আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:৪৭ পিএম
ভাষার মাসে আমাদের দেশের তরুণ চিত্র শিল্পীদের মুখোমুখি হয়েছিলাম সাম্প্রতিক দেশকালের শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগ থেকে। প্রত্যেক চিত্রশিল্পীর জন্য ছিলো সাতটি প্রশ্ন। সেই সকল প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তারা। পর্যায়ক্রমে সেইসব সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবে। এবার প্রকাশ করা হলো মো. মনজুরুল ইসলাম লিয়নের সাক্ষাৎকার। যিনি চারুকলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা সম্পন্ন করেছেন। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন-অলকানন্দা।
১. সাম্প্রতিক সময়ে চিত্রকলায় বর্তমান বাংলাদেশ কিভাবে উঠে আসছে?
সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পীদের ছবি আঁকার বিষয় বস্তু গুলো যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে যে, শিল্পীরা এখন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেই তাদের ক্যানভাসে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর কারণ হলো, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে সারাবছরই কোন না কোন এক্সজিবিসন, আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়ে থাকে আর বিশেষ করে আর্ট ক্যাম্পগুলোতে মূলত বিষয়বস্তু উল্লেখ করা হয়ে থাকে, যার কারণে শিল্পীরা সেই বিষয় কেন্দ্র করে ছবি একে থাকেন। এইসব বিষয় বস্তুগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ সময়েই বাংলাদেশ বর্তমান প্রেক্ষাপটই প্রাধান্য পেয়ে থাকে, যেমন- সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, নারীর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি। এছাড়া দেশের নবীন ও প্রবীণ শিল্পীরা তাদের ছবি আঁকার বিষয়বস্তু হিসেবে বাংলাদেশর বর্তমান অবস্থা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে। এখানে রাজনৈতিক বিষয়টা যেমন গুরুত্ব পাচ্ছে তেমনি আমাদের দেশের শিল্প, সংস্কৃতি ও গুরুত্ব পাচ্ছে ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে। তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, শিল্পীরা বাংলাদেশ ঐতিহ্যগত দিককেই বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছে তাদের ছবির মাধ্যমে।
২. আপনার তুলিতে দেশের মুভমেন্টগুলো কতটা জায়গা নিয়েছে?
আমি সাধারণত কাজ করি উড কার্ভিং নিয়ে। কাঠ এর পাটাতনে শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে আমি একদিকে নিজেকে উপস্থাপন করি যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা যা কিনা আমাকে শিল্পের জগতে বিচরণ করতে সাহায্য করে। জঙ্গিবাদ বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টিতে বেশ কয়েকটি শিল্পকর্ম তৈরি করেছি। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। জঙ্গিবাদ একটি দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর যা আমাকে ভাবিয়েছে বিশেষভাবে।
৩. একজন শিল্পী হিসেবে ‘ভাষা আন্দোলন ও চিত্রকলা’ এই দুই আপনার দৃষ্টিতে কেমন?
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশের যে গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, তা খুব কমই উঠে এসেছে শিল্পীদের ক্যানভাসে। ভাষা আন্দোলনের সময় যেসব শিল্পীরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম। শিল্পী বিজন চৌধুরী ও মুর্তজা বশীর ভাষা আন্দোলন ও শাসকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ড্রইং ও কাঠখোদাই, লিনোকাট মাধ্যমে বেশ কিছু ছবি তৈরি করেছিলেন। স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী কাজী আবুল কাশেম ‘দোপেয়াজা’ ছদ্মনামে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক কার্টুন এঁকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। শিল্পীদের এসব ছবি
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, তথা নিজেদের অধিকার আদায়ে জনগণকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ইতিহাসের অংশ। শহীদমিনারের স্থপতিও একজন চিত্রশিল্পী। তিনি শিল্পী হামিদুর রাহমান। তাঁকে সেই সময় সহযোগিতা করেছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে চলেছে- তাদের প্রচারে, পোস্টার আকা, কার্টুন আঁকা, প্রচারমূলক নানারকম ছবি আঁকা, ফেস্টুন ও ব্যানার তৈরি করা, বক্তৃতা ও আন্দোলনের মঞ্চ সজ্জা, সবকিছুতে শিল্পীরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতেন। সাধারণ ছাত্র জনতাকে শিল্পীরা তাদের চিত্র শৈলীর মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে অরো বেগবান করেছে।
৪. দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রকলা সম্পর্কে জানতে চাই- এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রকলার অবস্থা কেমন?
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ তাদের নিজস্ব কাহিনী প্রকাশ করতে বিভিন্ন শৈল্পিক মাধ্যম ব্যবহার করেছেন যা বহু শতাব্দী আগের কথা। দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলা হ’ল ভাস্কর্য, লোককাহিনী, আর্কিটেকচার এবং চিত্রণ নির্ভরশল্পচর্চায় বাংলার ঐতিহ্য কয়েক হাজার বছরের। হরপ্পান ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার যুগে, খৃস্টপূর্ব অষ্টম শতকেই বাংলায় শিল্পকলা চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। পাস্ডুরাজার টিবিতে পাওয়া মৃৎপাত্রের গায়ের অলঙ্করণ যারা করেছেন, তাদের শিল্পবোধ ও অঙ্কন-দক্ষতা ছিলো, এ কথা অনস্বীকার্য। সেই থেকে শুরু করে বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রতিটি বাকে বাকেই দিক বদলেছে বাংলার চিত্রকলা চর্চাও। বর্তমানে বাংলাদেশে যে চিত্রকলার রীতি চলছে তা আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও পশ্চিমা শিল্পধারার সংমিশ্রণ।
৫. আমাদের চিত্রকলায় পশ্চিমা প্রভাব কেমন, ইজমের ঘেরাটোপে এদেশে চিত্রকলার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
আসলে বলতে গেলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন যখন ১৯৪৮ সালে এদেশে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তখন আমাদের নিজস্ব রীতি ও ঐতিহ্যের সাথে পশ্চিমা রীতির সংমিশ্রণ ঘটে। কারণ জয়নুল আবেদীন নিজেও সে সময় পশ্চিমা ধারায় প্রভাবিত। এর মূল কারণ হলো, অবনীন্দ্রনাথের বেঙ্গল স্কুলের সাথে যখন ই.বি হ্যাবেল যুক্ত হলেন, তখন বেঙ্গল স্কুলের সাথে পশ্চিম ধারাও প্রভাবিত হয়, যার ফলপ্রসূ পরবর্তীতে কলকাতা আর্ট স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পশ্চিমা প্রভাব বিস্তার লাভ করে। শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও সেই পশ্চিমা শিক্ষায় প্রভাবিত। জয়নুল আবেদীন যখন আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তখন থেকেই আমাদের দেশের চিত্রকলায় পশ্চিমা প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এখন অনেক শিল্পী আছেন যারা দেশীয় নিজস্ব স্টাইল তৈরি করে ছবি আঁকছেন। দেশিও সংস্কৃতিকে বজায় রাখছেন কিন্তু তারপরও এদেশের চিত্রকলায় পশ্চিমা প্রভাব সুস্পষ্ট।
৬. একটা সময় ছিলো চারুকলার শিক্ষার্থীদের সমাজে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হতো, সে সময় বদলেছে বলা হয়; সত্যিই কী তাই?
বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে পৃথিবীর ইতিহাসে শিল্প সাহিত্যের যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তার প্রত্যেকটির মূলে একটি বিষয় উঠে আসে তাহলো সেই অঞ্চল বা সমাজের মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে উন্নত ছিলো যেমন, মিশরীয় সভ্যতা, গ্রীক, সুমেরীয় সভ্যতা এমনকি ইতালিতে যখন রেনাসার সূত্রপাত ঘটে তখনো একই অবস্থা বিদ্যমান ছিলো। বর্তমানে শিল্পীদের অবস্থা আগের চেয়ে বদলেছে তবে আরো অনেক পরিবর্তন হবে সামনের বাংলাদেশে তা আমি আশা করি।
৭. চিত্রকলা একটি শিল্প এই শিল্প সৃষ্টির সাথে শিল্পীর জীবন ধারণের সম্পর্ক রয়েছে সেই জায়গাটা দেশীয় প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে কী?
দেখুন, শিল্প আসলে সাধনার বিষয়। একজন শিল্পী যখন একটি ছবি আঁকেন তখন তিনি শুধু সেখানে তার পরিশ্রম টুকুই দেন না, সেখানে তিনি তার আবেগ, ভালোবাসা, অভিজ্ঞতা সব কিছু দিয়েই ছবিটা আঁকেন। একজন শিল্পী যখন ভাবেন যে তিনি একটা ছবি আঁকবেন তখন শুধু ছবিটাই আঁকেন না, সেখানে তিনি তার মনের ভাব, স্বপ্নকেও লালন করে থাকেন। শিল্পীর প্রতিটি শিল্পকর্ম তার জীবনের সাথে সম্পর্কিত। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন আমাদের দেশে অনেক শিল্পী আছেন যারা তাদের শিল্পকর্ম বিক্রি করে জীবন ধারণ করে থাকেন তবে তার সংখ্যা খুবই কম। তবে নবীন শিল্পীদের জন্য বর্তমান বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি যে সে চাইলেই শিল্পকে জীবীকার উপজীব্য নিতে পারেন। আমাদের দেশে শিল্প ভালোবাসে সবাই কিন্তু সেই শিল্পের বাজার তৈরি হয়নি এখনো, যার ফলে শিল্পীদের জীবন ধারণের ক্ষেত্রে পড়তে হয় নানা বিধ প্রতিকুল অবস্থায়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh