কাবার গেলাফের ক্যালিগ্রাফার বাংলাদেশের মোখতার আলম শোকদার

বিভিন্ন মাধ্যমে একজন ক্যালিগ্রাফার বা আরবি লিখনশিল্পী তার কাজের মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করেন। আর এই লিখনশিল্পের কাজটি যদি হয় পবিত্র কাবার গেলাফ বা কিসওয়ার ওপর, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এটাতো তখন পরম পাওয়া, সম্মানের বিষয়। 

এখানে একজন শিল্পী কাজের মাধ্যমে চূড়ান্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সম্মান অর্জন করে। তেমনি এক সম্মাননীয় ভাগ্যবান লিখনশিল্পী বাংলাদেশের মোখতার আলম শোকদার। তার জন্মভিটে চট্টগ্রামে। 

আরবিতে কাবার গেলাফকে কিসওয়া বলা হয়। মক্কার পবিত্র কাবার কিসওয়া বা গেলাফ কারখানার লিখনশিল্পী তিনি। খুব অল্প বয়সেই এই লিখনশিল্পের প্রেমে পড়েন। আজকের পর্যায়ে আসতে তাকে বছরের পর বছর নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে। ফলে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। তার জীবনে তাই বড় প্রাপ্তিও ঘটেছে। কারণ পরিশ্রমই সফলতার চাবিকাঠি।

১৯৭৭ সালের এক গরমকালে মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে লিখনশিল্পের ওপর তিন মাসের একটি কোর্স করেন। শুরুতেই তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন। এতে শিক্ষকরা মুগ্ধ হন। পরের বছর তাকে লিখনশিল্পের শিক্ষক করা হয়।


শোকদার এই শিল্পের প্রতি আরো বেশি প্রেমে পড়েন। নিরন্তর অনুশীলন ও দৃঢ় মনোভাবের কারণে করণকৌশলে প্রভুত উন্নতি করেন। 

এ সম্পর্কে শোকদারের নিজের কথা, ‘প্রতিদিন একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমি অনুশীলন করতাম। কারণ আমি লিখনশিল্প পছন্দ করতাম। আমার সহপাঠীরা এসে পরামর্শ চাইত-কীভাবে তারা হাতের লেখার উন্নতি করবে। দক্ষতাকে নিপুণ করতে যা কিছু করেছি তার জন্য আমার খুব আনন্দবোধ হচ্ছে।’

ইসলামি লিখনশিল্পে তার খুব পছন্দ 'নসখ' পদ্ধতি। এটা এই শিল্পের একেবারে গোড়ার দিকের বলে বিবেচিত। নসখ লিপি হলো- আরবি লিপির একটি শৈল্পিক লিখন পদ্ধতি। ইবনে মুকলা বাগদাদী (৮৮৬-৯৪০) এর উদ্ভাবক বলে ধারণা করা হয়। নসখ শব্দটির আরবি মূল নাসখ বা অনুলিপি। 

সুলুস লিপির কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে নসখ লিপির উদ্ভব হয়েছে। কুরআন, হাদিসের অনুলিপি তৈরির জন্য এই লিপির ব্যবহার হতো। এছাড়াও কুরআনের তাফসির ও কবিতা সংকলন যেমন দিওয়ানের জন্যও নসখের ব্যবহার ছিল। লিপিসমূহের মধ্যে এর ব্যবহার ছিল খুব বিস্তৃত। 

তবে তিনি সুলুস লিপি প্রায়শই ব্যবহার করেন, কারণ এটি কুফিক লিপির সরল কৌণিক রূপকে এই লিপিতে বক্র ও তির্যক রূপ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। সুলুসে হরফের এক তৃতীয়াংশ ঢালু হয়। এ থেকে নাম সুলুস (আরবি- তৃতীয়াংশ) এসেছে। মধ্যযুগে মসজিদের অলংকরণে এই লিপি ব্যবহৃত হতো। সুলুসের রীতিতে পরিবর্তন এনে অন্য কিছু লিখনশৈলীর উদ্ভব হয়েছে।

সুলুস আরবি লিখনশিল্পের একপ্রকার শৈলী। আগেই বলেছি ইবনে মুকলা এর উদ্ভাবন করেছেন। কিসওয়ার ওপর লেখার জন্য এই লিপি ব্যবহৃত হয়।

লেখক:  মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

শোকদার বেশ কয়েকজন লিখনশিল্পীর দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ করে উনিশ শতকের উসমানীয় লিখনশিল্পী সামি ইফেন্দির (১৮৩৭-১৯১২) কাজ তার খুব পছন্দের। তিনি মনে করেন, সামি ইফেন্দি সব লিখনশিল্পীর জন্য সত্যিকার একজন আদর্শ।

গ্র্যান্ড মসজিদে কয়েক বছর লিখনশিল্প শেখানোর পরে, তিনি তার দক্ষতা বাড়াতে ১৯৮৯ সালে উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি বিভাগীয় অধ্যাপক মুহাম্মদ হাসান আবু আল-খায়েরের কাছ থেকে বেশি উপকৃত হন।

শোকদার বলেন, ‘কিসওয়ার ওপর শৈল্পিক এ কাজের জন্য অনেক ধৈর্য ও নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়। উদাহরণস্বরূপ- লিপিশৈলি ব্যবহার করে পাঁচটি শব্দ লিখতে দুই থেকে তিন মাস, কখনো কখনো আরো বেশি সময় লাগতে পারে। এটি দীর্ঘ সময় নিয়ে করতে হয়। কিছু লোক মনে করেন যে তিনটি শব্দযুক্ত এই জাতীয় শিল্পকর্ম এক ঘণ্টার মধ্যেই করা সম্ভব। কিন্তু এটা সত্য নয়।’ 

লিখনশিল্পীদের আসলে অনেক সময় ও কঠোর অধ্যবসায় করতে হবে। বছরের পর বছর অনুশীলন ও প্রশিক্ষিণই পরিণত করে শিল্পীকে। তাছাড়া চাপ সহ্য করতে হয়। 

তার জীবনে সফলতার আরো একটি পালক যুক্ত হয় ২০০৩ সালে। সেবছর তিনি কিসওয়ার একমাত্র বিদেশি লিখনশিল্পী নিযুক্ত হন। তার পিতা একদিন স্বপ্নে এমনটিই দেখেছিলেন। আর এটাই তিনি গভীরভাবে লালন করে আসছেন। তাই এ আনন্দঘন মুহূর্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি আমার জীবনে অন্যতম সুখময় ঘটনা। খোদার তরফ থেকে বিরাট প্রাপ্তি। এজন্য তার শুকরিয়া আদায় করছি। আমার বাবার স্বপ্ন সত্য হয়েছিল।’ 

কিসওয়ার ওপর লেখার পদ্ধতিগুলো বছরের পর বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। মোখতার শোকদারের পূর্বসূরী প্রয়াত লিখনশিল্পী আবদুর রহিম আমিন বোখারী রেশমের কাপড়ে লিপি লিখতে চকের ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তী বছরগুলোতে সিল্ক-স্ক্রিন প্রিন্টিং চালু হয়েছিল। এর ফলে একজন লিখনশিল্পী এগুলো কম্পিউটারে সংরক্ষণের অনুমতি পায়।

এর আগে নিয়ম ছিল- স্বচ্ছকাগজ কালো কিসওয়ার ওপর রেখে সুঁই দিয়ে ছিদ্র করে করে সাদা পাউডার ব্যবহার করার। ফলে কাজের ক্ষেত্রে লিপিগুলো উদ্ভাসিত হতো। সেখানে সূচিকর্ম সম্পাদন করা হতো।

সূত্র: আরব নিউজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাক্ষাতের ভিত্তিতে রচিত

লেখক: কবি ও আরবি গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //