জিলাপির প্যাঁচ

জিলাপি ও জিলাপির প্যাঁচ বাঙালির খুবই প্রিয়। সব প্যাঁচ গিয়ে মিশেছে জিলাপিতে। অথচ জিলাপি অতি সুস্বাদু মিষ্ট দ্রব্য। যত দোষ নন্দ ঘোষ। আর তাই দোষের সব বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘোষদের বানানো জিলাপির ওপর; কিন্তু জিলাপি এলো কোত্থেকে? খাদ্যবিশারদদের মতে, সম্ভবত মোগলদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে জিলাপি এসেছে। জিলাপি যে মোগলদের খাবার, তা বোঝা যায় তাদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর রাজনীতির প্যাঁচ কষাকষি দেখে; সেই প্যাঁচে বাঙালি ধরা খেলেও জিলাপি খাওয়া বাদ দেয়নি। রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলীনকুলসর্বস্ব নাটকে উত্তম ফলারের আওতায় রাখা হয়েছে জিলাপিকে :
নিখুঁতি জিলাপি গজা ছানাবড়া বড় মজা।
শুনে সক্ সক্ করে নোলা।
মিলাদ মাহফিল, বাড়ির ভিত্তি স্থাপন ইত্যাদি আয়োজনে জিলাপি এসে হাজির। মিলাদে প্রদানকৃত খাবারের নাম হিসেবে তবারক শব্দটি ব্যবহার করা হয়। জিলাপি আর তবারক যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। আরবি তবররুক। এর অর্থ প্রসাদ। ইফতারে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যবস্তুর একটি জিলাপি।
জিলাপির অনেক নাম; আরবিতে জালাবিয়া, ফারসিতে জিলাবিয়া; ইরানে জুলাবিয়া ও জুলুবিয়া নামে পরিচিত। লেবাননে এক ধরনের খাবার আছে, নাম জেল্লাবিয়া। আফগানিস্তানে নাম তার জালেবি। মনে পড়ে, ক্যাটরিনার ক্যাটওয়াকওয়ালা বিখ্যাত গান :
আফগান জালেবি, মাশুক ফারেবি,
ঘায়েল হ্যায় তেরা দিওয়ানা
ভাই ওয়াহ্, ভাই ওয়াহ্।
হিন্দি জলেবী থেকে বাংলা জিলাপি এসেছে বলে অনুমান অভিধানকারদের। অসমিয়া ভাষায় আছে জিলাপি ও জিলেপি। বাঙাল মুলুকে জিলাপিকে আদর করে জিলিপিও বলা হয়। কবির সুমন যেমন গেয়েছেন, ‘ছেড়েছ তো অনেক কিছুই পুরনো অভ্যেস/ অসুখ বিসুখ হবার পরে জিলিপি সন্দেশ।’ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস জিলিপির উচ্চারণভেদ দেখিয়েছেন দুটি : জিলাপী ও ঝিলাপী। জিলাপি কী বস্তু? তিনি লিখেছেন, ‘চক্রাকারে পাকানো মিষ্টান্নবিশেষ।’ রাজশেখর বসু লিখেছেন, ‘চালের গুঁড়া ময়দা ইত্যাদির কুণ্ডলাকার মিষ্টান্ন বিশেষ।’ আদর্শ বাংলা অভিধানে সুবল মিত্র লিখেছেন, ‘কুণ্ডলী পাকান মিষ্টান্নবিশেষ।’
জিলাপিকে কেউ কেউ বলেন, অমৃতি, আমিত্তি; সংস্কৃত অমৃত থেকে আমিত্তি; কিন্তু আমিত্তিতে প্যাঁচ থাকলেও জিলাপির মতো লম্বা প্যাঁচ কষাকষি নেই। সে যাই হোক, আরবি-ফারসির সঙ্গে প্যাঁচ কষাকষি শেষেই জিলাপি শব্দটি বাংলা ভাষায় এসে ঢুকেছে। অবশ্য সংস্কৃতের কাছে হাত পেতে বলা যেতে পারত কুণ্ডলিনী, কারণ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে জিলাপি কুণ্ডলাকৃতি ধারণ করে। অধিকাংশ অভিধানকার চক্রাকার ও কুণ্ডলাকারকে জিলাপির প্রধান শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
জিলাপির একটি উনিশ শতকীয় বর্ণনা পাচ্ছি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবুবিলাস বইয়ে। বাবু হওয়ার কৌশল, কারণ ও লক্ষণ বর্ণনা করতে গিয়ে একজন ভূতপূর্ব বাবু জানাচ্ছেন, ‘বাবু হতে হলে বেশ্যাবাড়ি যেতে হবে, বেশ্যার কুচ বা স্তন বিমর্দ্দন করতে হবে; বই-পুস্তক-পুরাণ পড়ে কিছু হবে না। যারা পড়ালেখা করেছে তাদের অবস্থা করুণ :
দেখ তাহারা অপূর্ব্ব ঘৃতপক্ক মিঠাই মতিচুর জিলাপি পোলাও পানতুয়া প্রভৃতি ভোজন ও স্থূলনিতম্বিনী মধুরভাষিণী গজেন্দ্রগামিনী ঝটিতি চিত্তহারিণী কেশবিলাসিনী ক্ষীণকটি কঠোরকুচা বেশ্যাদি গমনে পাপ বোধ করিয়া কেবল সর্বাঙ্গে মৃত্তিকা লেপন পুরঃসর সিদ্ধ পক্ব ভোজনে অলৌকিক দেবপূজাদি করিয়া বৃথা কালক্ষেপণ করিতেছে।’
তারা ঘিয়ে বানানো অপূর্ব মিঠা, মতিচুর, জিলাপি, পোলাও, পানতুয়া প্রভৃতি ভোজন করতে পারছে না। স্থূল পশ্চাদ্দেশের অধিকারী, মিষ্টভাষী, চিত্তহরণকারী, কেশবিন্যাস করা, চিকন কোমরওয়ালি, নিটোল স্তনবতী বেশ্যার কাছে গমন করাকে পাপ বিবেচনা করে সারা শরীরে মাটি লেপন করছে। সিদ্ধ খাবার খাচ্ছে আর বৃথা অলৌকিক দেবদেবীদের পূজা করছে।
দেখা যাচ্ছে বেশ্যা, জিলাপি ভক্ষণ ও বাবুয়ানার বেশ একটা সম্পর্ক আছে; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হয় জিলাপি যত মিষ্টি, জিলাপির প্যাঁচ তত মিষ্টি নয়। ভুক্তভোগীমাত্র সে খবর ভালো করে জানেন। অধিক মিষ্টত্ব তিক্ততা সৃষ্টি করে। তবে প্যাঁচ যদি পছন্দই না হবে বাঙালি বলে কেন : ‘প্যাঁচ লাগানো’, ‘ত্যানা প্যাঁচানো’, ‘মাথা ভর্তি প্যাঁচ’, ‘প্যাঁচ কষা’। এখানে প্রতিটি প্যাঁচের অর্থ : কুটিলতা, জটিলতা; অভিধানের ভাষ্য মতে, জিলাপির প্যাঁচ মানে ‘অসরল ভাব।’ জিলাপি নিজেই যেখানে বঙ্কিম- বাঁকা- সেখানে ভাব সরল হবে কী করে!
প্যাঁচপ্রেমী আরব এক কবি অবশ্য বলেছেন ভিন্ন এক কথা; প্রেমিকার উদ্দেশে লিখেছেন, ‘তার গলায় পরিয়ে দিলাম জিলাপির হার/সুস্বাদু প্যাঁচগুলো দিয়ে বানিয়ে দিলাম কানের দুল।’ আহা, সাধু, সাধু! বাদ বাকিটা কল্পনা করে নিন, কেমন?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //