সদ্য প্রয়াত কবি, গদ্যকার ও সাহিত্য সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার তেমন কোনো স্মৃতি নেই! তবু আমি লিখতে বসেছি। এই ‘না-হক’ কাজটি আমি করতে বসেছি। কারণ স্মৃতি বলতে তো এমন কিছু বোঝায় না যে, কারও লেজ ধরে টই টই করে ঘুরে বেড়িয়ে তবেই স্মৃতি প্রস্তুত করতে হবে। প্রত্যক্ষভাবে না জড়িয়েও মানুষ স্মৃতি তৈরি করতে পারে। কত কিছুর সঙ্গে মিশে যায় স্মৃতি। সে হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও আমার স্মৃতি আছে, যেমন আছে নজরুল ও জীবনানন্দের সঙ্গে।
আমার ক্ষেত্রে আবুল হাসনাত যত না প্রত্যক্ষ স্মৃতি, তার চেয়ে বেশি তিনি পরোক্ষ স্মৃতি। আর ওই পরোক্ষ স্মৃতিগুচ্ছই আমার কাছে প্রত্যক্ষের চেয়ে মূল্যবান। তবে স্মৃতি বলতে যেহেতু প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতাকেই গণ্য করে সবার আগে, তাই সেটুকু না বললেই নয়।
অদ্ভুত এই মানুষটির সঙ্গে আমার যোগাযোগ কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার সূত্রে। ফোনে তার সঙ্গে কথা হয়ে গেল প্রথম। বুঝলাম, দরকারি কথার বাইরে তিনি কথা বলেন না। পুরস্কার ঘোষণার দিন আমাকে ফোন করে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আবুল হাসনাত বলছি- কালি ও কলম অফিস থেকে। আপনি সুমন সাজ্জাদ? আপনি এ বছর প্রবন্ধে এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আগামী... তারিখে অনুষ্ঠান। সেদিন পুরস্কার দেয়া হবে। আশা করি, আপনি আসবেন। অফিসিয়ালি ঘোষণা হবে, আপনি চিঠি পেয়ে যাবেন শিগগিরই।’ কথা শেষ। আমি ধন্যবাদ জানালাম। তিনি ‘আচ্ছা রাখি। ভালো থাকবেন।’ বলে কথা শেষ করলেন। এক মুহূর্তে আমি বুঝে গেলাম, যেমন শুনেছিলাম, তিনি আসলে তেমনই। নিরেট সাদাসিধা দরকারি কথা বলার ভদ্র লোক। অতিরিক্ত, বাড়তি, অধিক- ইত্যাদি বিশেষণ তার সঙ্গে দেয়া যায় না।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের দুই-একদিন আগে ফোন করলেন, ‘আপনার ঠিকানায় কার্ড পাঠাচ্ছি। আপনার বাড়তি কার্ড লাগলে বলুন, পাঠিয়ে দেবো। আমি বললাম, ‘৫-১০টা দিলেই হবে।’ আবুল হাসনাত তা-ই করলেন। আর বললেন, ‘আপনার স্টুডেন্টদের আমন্ত্রণ জানাবেন। ওরা এলে সুন্দর দেখাবে। ঢাকায় আত্মীয়স্বজন থাকলে আসতে বলবেন। তারা খুশি হবেন। অনুষ্ঠানটাও সুন্দর হবে।’
তার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো অনুষ্ঠানে; গম্ভীর-প্রবীণ একজনকে দেখে মনে হলো উনিই হবেন আবুল হাসনাত। সূক্ষ্মভাবে চারদিকে দেখছেন। আদতে তিনিই ছিলেন। এই প্রথম দেখা- টেলিফোনের কণ্ঠস্বরের মতোই গম্ভীর ও স্বল্পভাষী তিনি। বললাম, ‘আমি সুমন সাজ্জাদ।’ বললেন, ‘ওহ, আসুন আসুন। গোছানো প্রায় শেষ, আশা করি, সময় মতোই শুরু করতে পারব।’ আমি সাধারণত মঞ্চের সামনের দিকে বসি না। একটু পেছনে বসেছিলাম। আবুল হাসনাত লোক পাঠিয়ে বললেন, সামনে এসে বসতে। আমি তার কথা অনুসরণ করলাম। বললেন, ‘আপনি এখানে বসুন।’ অনুষ্ঠান শেষে বললেন, বেঙ্গল গ্যালারিতে একটি অনুষ্ঠান হবে, সেখানে যেন যাই। শীর্ষেন্দু থাকবেন। আরেক দিন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে একটা ভিডিও সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে সেখানেও যেন উপস্থিত থাকি। দ্বিতীয়বার দেখা বেঙ্গলের ওই অনুষ্ঠানেই। ওখানে বোধ হয় পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। তৃতীয় ও শেষ দেখা, পুরস্কার ঘোষণার সম্ভবত সপ্তাহ খানেক পর। ফোনে জানিয়েছিলেন, কালি ও কলমের বিমানবন্দর রোডের ঠিকানায় পৌঁছে যেতে। অফিসে ঢুকতেই বসতে বললেন। অনুষ্ঠানের ছবিগুলো দেখতে দিলেন। বললেন, আগামী সংখ্যায় পুরস্কারপ্রাপ্তদের নিয়ে ফিচার বেরুবে। জিজ্ঞেস করলেন, আমি কী লিখি। বললাম, মূলত কবিতা আর মাঝে মাঝে গদ্য। বললেন, ‘আপনি কবিতা দিন। নিয়মিত লেখা পাঠাবেন। মেইলে লেখা পাঠিয়ে আমাকে একটু ফোনে জানাবেন। নিশ্চিত হওয়া যাবে।’ এক লাখ টাকার একটি চেক তিনি আমার হাতে তুলে দিলেন। সব মিলিয়ে ১০-১৫ মিনিটের মতো সময় লাগল।
কয়েক দিনের স্মৃতি যোগ করলে আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার স্মৃতি কয়েক ঘণ্টার মতো হবে। যার মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই দেখেছি আনমনা হয়ে চুপ থাকতে, কিছু ভাবতে। প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক কোনো কথার ধারে-কাছে প্রয়োজন ছাড়া বলতে দেখিনি। এটি সম্ভবত তার ব্যক্তিত্বের সিগনেচার স্বভাব। এইটুকুই আমার প্রত্যক্ষ স্মৃতি; কিন্তু এর বাইরে বৃহৎ একটি স্মৃতির ভাগ পড়ে আছে; যেখানে আবুল হাসনাত শরীরিভাবে হাজির নন।
সেজন্য আমাকে ফিরে যেতে হবে সেই কলেজপড়ুয়া সময়ে; যখন পত্রিকার সাময়িকী খুঁজে গোগ্রাসে সমকালীন সাহিত্য গিলি। আমার প্রয়াত বন্ধু অনুবাদক অমিত কুমার ধর একদিন বলল, ‘আরে মিয়া, সংবাদ সাময়িকী পড়। সিরিয়াস সাময়িকী।’ সংবাদ খুলে দেখলাম, সত্যিই সিরিয়াস। আমাদের সেই পাড়াগাঁ-মফস্বলেও শুনেছিলাম সংবাদের পাতা দেখেন, মানে সম্পাদনা করেন আবুল হাসনাত।
আবুল হাসনাত আমার কাছে ছিলেন একটি মিথ, সাহিত্য-সম্পাদকের মিথ; যেমন মিথ হয়ে আছেন কবি আহসান হাবীব। আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমার স্মৃতি মূলত ওই পাতার সূত্রে। সেই একদা-অতীতে দৈনিক পত্রিকার পাতাগুলোই ছিল সাহিত্য পড়ার প্রধান অবলম্বন। অনেক পাতা ঘুরে আমাদের মনে হয়েছিল সংবাদই সেরা। সাহিত্যকেন্দ্রিক দলাদলি-গালাগালির নোংরা তরঙ্গ শব্দ শুনিনি সংবাদের পাতায়। অন্য পাতাগুলোতে কান পাতলেই শোনা যেত কে কত ফুট ঢেউবিশিষ্ট লম্বা কবি বা লেখক! সংবাদের সাময়িকী পড়ে তেমনটা মনে হতো না।
এই সাময়িকীতেই উঠে আসত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাম্প্রতিক বিষয়গুলো। চিত্রকলাকে গুরুত্ব দিয়ে আবুল হাসনাতই ছেপেছিলেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ; সাহিত্য বিষয়ক ধারাবাহিক বিখ্যাত কলামগুলো। আজ সাহিত্য পাতা থেকে যা প্রায় পরিত্যক্ত ও বিসর্জিত। আবুল হাসনাতের স্মৃতি বলতে আমি বুঝি, অ্যাডভার্ড মুঙ্খ, পিকাসো, পল ক্লি, সালভেদর দালি ইত্যাদি; আমি বুঝি, সুন্দর কিছু ভ্রমণ সাহিত্য, আফ্রিকান সাহিত্য, আমোট টুটুওলা ইত্যাদি। বিশ্ব সাহিত্যের মজবুত পাটাতন তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন সংবাদের পাতায়।
কলেজপড়ুয়া নবীন হিসেবে ওই বয়সে এগুলোর খুব বেশি দরকার ছিল আমার জন্য। আমরা জানতাম প্রিয় আবুল হাসনাত সেই আয়োজনগুলো করছেন। আমার জন্য আবুল হাসনাতের সঙ্গে এই পরোক্ষ স্মৃতিগুলো অত্যন্ত মূল্যমান। যে আমিটা এখন বসে বসে লিখছি, সেই আমিটাই তৈরি হতো না তরুণ বয়সে হাতের কাছে ওইসব লেখাপত্র না থাকলে। এগুলো তো ঋণ-প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, এগুলো তো স্মৃতি, এগুলো শক্তিও- বেড়ে ওঠার শক্তি। আবুল হাসনাত আমার মনে ধ্রুব একটি শক্তি হয়ে আছেন। সাহিত্য সম্পাদনা করতে গিয়ে তরুণ বয়সে তাকেই মনে পড়ত, ইদানীং তাকেই মনে পড়ে, এরই মধ্যে চলে গেলেন তিনি অনন্ত প্রস্থানের দেশে। ভালো থাকুন তিনি।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh