শ ব্দ র ম্য

কাম ও কামসূত্র

কামসূত্রের নাম শোনেনি এ রকম ‘আকাইম্যা’ লোক বোধ হয় নেই বঙ্গদেশে। শ্রী শ্রী বাৎসায়নের বাহাদুরি কলিযুগেও প্রভাবশালী। ইদানীং লাজলজ্জা কমেছে, রঙঢঙ বেড়েছে। রঙিন পর্দায় সানি লিওন আর মিয়া খালিফাদের আনাগোনার কারণে চোখে ঠুলি, মুখে ঘোমটা এঁটে কামসূত্রের নাম নিতে হয় না।
১৯৯৭ সালে মিরা নায়ারের কামা সূত্রা : অ্যা টেল অব লাভ যখন বের হলো তখন চার দিকে ছি-ছি শোনা গেল। এক টিকিটে দুই ছবি দেখনেওয়ালারা হতাশ হলেও গরম মসলা হিসেবে বাজার গরম করে তুলল নায়ারের ছবি। দেখার বেলায় মূলত কেউ-ই প্রায় বাদ গেল না। অনেকটা এখনকার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে সানি লিওন দেখে পর্নোগ্রাফির জাত উদ্ধার করার মতো। ফুটনোটে বলে রাখি, আমি আমার ভুলেভালে বান্ধবীদের কামসূত্রের মিরা নায়ারীয় রসদ জুগিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
দুই সময়কার পার্থক্য হলো তখন ট্যাবুর বাঁধন ছিল এখনকার চেয়ে তুলনামূলকভাবে খানিকটা শক্ত। আর প্লাটোনিক ইমান নষ্ট করার মতো উপাদান তখন এত সহজলভ্য ছিল না। অন্য দিকে এখনকার অবস্থা :
করি মানা, কাম ছাড়ে না মদনে
প্রেমরসিকা হবো কেমনে?
রসিক-রসিকা হওয়ার দাওয়াই এখন কাম। এটুকু পড়ার পর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ব্যাপার সুবিধাজনক নয়। ভয় পাবেন না। অন্য দিকে ঘুরে না হয় আবার এদিকে আসব। কেমন? তাছাড়া মাংশাসী ভোগবাদের পৃথিবীতে এত ভেজিটেরিয়ান হওয়ারইবা মানে আছে কোনো!
বাংলা ভাষায় কাম শব্দের দুটি প্রধান অর্থ; এক নম্বর অর্থ : কাজ, কর্ম। দুই নম্বর অর্থ : কামনা, ইচ্ছা, অভিলাষ; এর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত সম্ভোগ-বাসনা। কারও কারও কাছে হয়তো দ্বিতীয়টিই প্রথম ও প্রধান অর্থ। ওর বাইরে তাদের মাথাই খোলে না। ফ্রয়েড তাদের পরম প্রভু; কিন্তু কাজ করতে করতে যার কম্মকাবার, কর্ম করতে গিয়ে ঘর্ম ঝরাচ্ছেন, সে-ই জানেন কামের মানে।
সংস্কৃত কর্ম থেকে প্রাকৃত পর্যায়ে হয়েছে কম্ম, তার পর কাম। কৃ থেকে কর্মাণ- যার অর্থ কাজ, অংশগ্রহণ, কর্মকাণ্ড ইত্যাদি। কর্মাণের সূত্র ধরে কর্ম। আঞ্চলিক বাংলায় কাজের বদলে কামই বেশি চলে। আবার কাজ ও কাম একসঙ্গে বসে; যেমন : কাজকর্ম, কাজকাম, কামকাজ। অবশ্য কাজের উৎস অন্য আরেকটি সংস্কৃত শব্দ- কার্য। এর প্রাকৃত রূপ কজ্জ, বাংলায় কাজ।
আমরা কাজ অর্থে কর্ম, কাম, কাজ, কার্য- চারটিই ব্যবহার করি। যেমন : কর্মচারী, কামকাজ, কার্যক্ষেত্র ইত্যাদি। কাজ বা কর্ম করেন যিনি, তিনিই কর্মী। কাজের আলয় বোঝাতে লিখে থাকি কার্যালয় ও কর্মস্থল। খবরে শোনা যায়, কার্যালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। আবার কখনো শোনা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মস্থলে যোগ দেননি। যারা কাজের ক্ষেত্রে খুব মনোযোগী ও তৎপর, তাদের বলি কর্মযোগী। কর্মই তাদের ধ্যান ও যোগসাধনার অংশ। নিষ্ঠার সঙ্গে যারা কাজ করেন তারা কর্মনিষ্ঠ। কারও কারও নামের সঙ্গে বিশেষণ হিসেবে যুক্ত করা হয় কর্মবীর। অতি-তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন কাজকে বলা হয় কর্মকাণ্ড। তবে কখনো কখনো এই শব্দে নেতিবাচক কাজের সুর শোনা যায়। কাজ করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন বলি কর্মক্লান্ত। কাজ করতে সক্ষম ব্যক্তিকে বলি কর্মক্ষম। বিভিন্ন অফিসের সামনে এক সময় লেখা থাকত : কর্ম খালি নাই। মানে শূন্য পদ নাই। প্রচুর কাজ করতে সক্ষম পরিশ্রমী ব্যক্তিকে বলি কর্মঠ। কাজে দক্ষ ব্যক্তিকে বলি কর্মদক্ষ; কিন্তু কাজ ঠিকঠাক না হলেই বলি কামচোর। বিপদের আশঙ্কা কিংবা মনের মতো কাজ না হলে বলি, ‘কাম সারছে’। অভিজাত পরিমণ্ডলে কাজ অর্থে কামের প্রয়োগ সীমিত। কারণ তারা কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশে কর্ম সম্পাদন করে থাকেন, আদাড়ে বাদাড়ে ‘কাম কইরা খান না’। কর্ম যদি মাত্রাতিরিক্ত খারাপ হয়ে থাকে তাহলে সেই ব্যক্তির কপালে থাকে কর্মচ্যুতি। কাজ করতে যারা আলস্য বোধ করে তাদের বলা অকর্মা। হিন্দিতে উর্দুতে নিকম্মা। মির্জা গালিব যেমন বলেছেন :
ইশক নে গালিব নিকম্মা কার দিয়া।
ভারনা হাম ভি আদমি থে কাম কে ॥
প্রেম গালিবকে নিকম্মা করে দিয়েছে, নয়তো আমিও কাজের লোক ছিলাম। প্রেমের ওপর দায় চাপিয়ে গালিব পার পেয়েছেন।
    কার্য শব্দের সঙ্গে অন্যান্য শব্দ যোগ করে অনেক শব্দ ব্যবহার করি আমরা। কাজে দেয় বা দেবে, কাজে লাগে এমন বোঝাতে বলি কার্যকর। যেমন : আইন কার্যকর করা হবে। কার্য নির্বাহ বা বহন করেন যিনি, তাকে বলা হয় কার্যনির্বাহক। কোনো কাজে যখন নেতিবাচক প্রবণতা পাওয়া যায় তখন আমরা বলি কার্যকলাপ। এই শব্দে কলাপ অর্থ সমূহ; কার্যকলাপ- কার্যসমূহ। কাজের সময় ও পর্বকে বলি কার্যকাল। কাজের সাফল্য অর্থে এক কালে ব্যবহার করা হতো কার্যসিদ্ধি। সিদ্ধি অর্থ এখানে গাঁজা বা ভাং নয়, অর্জন বা ফললাভ। মুখের কথা নয়, কাজের বেলায়- এমন অর্থে আমরা ব্যবহার করি, কার্যত শব্দটিকে। মানে, মুখে অনেক কথাই বলি, কার্যত দেখা যায় মুখের কথার সঙ্গে কাজ মিলছে না। তখন কার্যত শব্দটি এসে আমাদের এই অনুভূতি প্রকাশে সহায়তা করে। কাজ শেষ হয়ে গেলে লোককে পাত্তা দেওয়ার প্রবণতা আমাদের কম থাকে; তাই বলি কার্যোদ্ধার হয়ে গেলে আর পায় কে! বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংস্থা, সংগঠনের একটি পর্ষদ থাকে, নাম তার : কার্যনির্বাহী পর্ষদ।
    কাজ শব্দ দিয়ে কর্ম ও কাজের মতো অত শব্দ বাংলায় নেই। তবে অনেক প্রয়োগ আছে বেশ মজার। যেমন : কাজের লোক। এই বাগ্বিধির দুটি অর্থ হতে পারে : এক. যিনি যে কোনো কাজে খুব দক্ষ, কৌশল ও বুদ্ধি দিয়ে কার্যোদ্ধার করতে পারেন; তখন বলি, লোকটা কাজের লোক। কিংবা লোকটা খুব কাজের। দুই. বাসা-বাড়িতে যারা পেশা হিসেবে কাজ করে জীবনযাপন করেন তাদেরও বলা হয় কাজের লোক।
কর্ম শব্দটির একটি দার্শনিক অর্থও আছে বাংলা ভাষায়। নিজের কাজ বা কর্মকে ভাবা হয় সমস্ত কিছুর মূল। নিজেকেই বহন করতে হয় কাজের দায়। জীবনের যোগফল সমান আর কিছুই নয় নিজ কর্মফল। ফল গঠিত হয় কার্য ও কারণের ভিত্তিতে। এই দার্শনিকতা থেকেই বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় কর্মদায় শব্দটি। রাজা মিলিন্দ নাগসেনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন কারণে মানুষের সব সমান হয় না? নাগসেন জবাব দিয়েছিলেন, ‘কম্মণাং ণাণা কারণে মণুস্সা ণ সব্বে সমকা।’ অর্থাৎ ‘কর্মের বিভিন্নতার জন্য সব মানুষ সমান হয় না।’ আর সে জন্যই বুদ্ধ বলেছেন, ‘মানুষ তার কর্মদায়জাত, কর্মযোনিপ্রাপ্ত, কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ এবং কর্মই তাদের শরণ। কর্মই তাদের হীন বা উচ্চ ইত্যাদিতে ভাগ করে।’ এ জন্য বাংলায় প্রয়োগ করা হয় কর্মদোষ শব্দটি; নিজের কাজ, অদৃষ্ট, পাপ ইত্যাদির কারণে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটার ইঙ্গিত দিতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। প্রায় সমার্থক শব্দ কর্মফল। কর্মফলের সঙ্গে আসলে যুক্ত কার্য ও কারণ। তাই কোনো কিছুর শেষ বিচার করতে গিয়ে হিসেব করা হয় হেতু ও ফলের।
কামসূত্রের কাম এসেছে কম্ থেকে। কাম- বাসনা, যৌনাকাঙ্ক্ষা, আনন্দ। কম্ থেকেই তৈরি হয়েছে কমনীয়, কমলা, কামজ, কামনা, কামাতুর, কামিনী, কামজ্বর, কামজ্বালা, কামরস। কামের কাম যেটা হয়েছে সেটা হলো বাংলায় কাম দিয়ে প্রচুর শব্দ আছে। তার কিছু ব্যবহৃত হয়, কিছু শব্দের প্রয়োগ নেই। এক সময় বাংলা বইপুস্তকে কামকলায় পারদর্শিতার কথা লেখা থাকত। যৌনশাস্ত্র, রতিশাস্ত্রই কামকলা। যে কদলী বা কলার খোসা ছাড়িয়ে আমরা ভক্ষণ করি তার সঙ্গে কামকলার সম্পর্ক নেই। বেশ্যার হাবভাবের নাম ছিল কামকূট। আবার যোনীর দরোজাকে বলা হয় কামকূপ। যৌন বা রতিক্রীড়ার নাম কামকেলি। যার মধ্যে কামের ভাব প্রবল, সে কামচারী। আবার কামকে যে জয় করেছে, সে কামজিৎ। মহাদেবের আরেক নাম কামজিৎ, কারণ কামদেবকে ভস্ম করেছিলেন তিনি। অনেকের মধ্যে কামের ভাব বা অনুভূতি প্রবল নয়, গন্ধমাত্রসার, তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় কামগন্ধ।
ত্বক-সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে যে-কমনীয়তার কথা বলা হয় তাতে কামগন্ধ নেই, এ-কথা বলা যাবে না মোটেও। কারণ বিজ্ঞাপন নিজেই কাম দিয়ে আমজনতাকে টেনে ধরে। তাদের কাম্য হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বস্তুর বহুল বিক্রয়। ম্যাঙ্গো জুসের একটি বিজ্ঞাপনে বলিউড-বিলাসিনী ক্যাটরিনাকে যেমন দেখা যাচ্ছে কামাতুরা ভঙিমায়; ওই ভঙিমা মনে করিয়ে দিচ্ছে, কামসূত্র যেমন রসালো, আমসূত্রও তেমন রাসিলে।
তবে হ্যাঁ, আমরা যখন কারও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কামনা করি, কিংবা বলি, ‘দেশের মঙ্গলই আমাদের কাম্য’ তখন যৌনাত্মক ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিই; কিন্তু কামাতুর, কামজ্বর, কামরস প্রতিটি শব্দ যৌন-ইশারায় শৃঙ্গার রসে ভরপুর। সে কারণে কমলার মানে কিন্তু অরেঞ্জ নয়; সংস্কৃতে বোঝাচ্ছে কাম-থরোথরো যৌনাকাঙ্ক্ষী নারী। পুরুষের বেলায় সেই ভাব ফুটিয়ে তুলতে দাঁড়িয়ে আছে কামুক শব্দটি। নারীর জন্য আছে আরও একটি শব্দ- কামিনী। বৈবাহিক সম্পর্কবিহীন নর-নারীর সন্তানকে বলা হয় কামজ সন্তান; সম্ভোগেচ্ছাজাত সন্তান। শরীরি আবেগ সম্পর্কিত আরও শব্দ : কামপ্রদ, কামবাণ, কামমোহিত, কামশক্তি, কামশর, কামাগ্নি, কামাচার, কামাতুর, কামানল, কামান্ধ, কামার্ত, কামাসক্ত। এ ধরনের সব শব্দের প্রয়োগ সাম্প্রতিক বাংলা ভাষায় নেই। তবে প্রাচীন বাংলা সাহিত্য ও উনিশ শতকের লেখাপত্রে এসবের প্রয়োগ ছিল অবিরল।
বাংলা ভাষার গোড়ার দিকেই যৌন প্রসঙ্গে কাম শব্দের ব্যবহার আছে। চর্যাপদের একটিতে বলা হয়েছে, দিবসে বউ কাকের ভয় পায়/ রাত হলে কামরূপে যায়। কামচণ্ডালী নামক একটি রাগের উল্লেখ আছে চর্যাপদে। কাম-অনলে রাধাকে পুড়তে দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। এই কাব্যে প্রেমই কাম, কামই প্রেম। হলুদ আর মরিচের কৌটার মতো আলাদা করে রাখা হয়নি।
কাম ও প্রেমের ব্যাপারে দারুণ তর্ক করে গেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। দুটির পার্থক্য নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামিয়েছেন। বলেছেন, কাম অন্ধ, সম্ভোগে তাৎপর্য খোঁজে। দুটি বাক্য তুলে ধরছি, ‘কাম প্রেম দোহাঁকার বিভিন্ন লক্ষণ।/ লৌহ আর হেম যৈছে স্বরূপে বিলক্ষণ।’ কাম যদি লোহা হয়, প্রেম হলো সোনা। বাংলা ভাষায় কামাচার যেমন আছে, তেমনি কামমদমুক্ততার কথাও আছে; লালন বলেছেন, ‘আগে কপাট মার কামের ঘরে।’ উত্তম প্রস্তাব; কিন্তু সমস্যা হলো, এখন তো কপাট-ই নেই। উদলা ঘরে কপাট লাগিয়ে কী হবে! এবার বলুন, নষ্টের গোড়ায় আসলে কে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //