আম্মা আব্বা ড্যাডি মাম্মি

পাকিস্তান আমলের ঢাউস একটা ব্যাকরণ বই ছিল বাড়িতে; মলাট ছেঁড়া, রচয়িতার নাম নেই, প্রিন্টার্স লাইন উধাও। এমনই মোটা বই যে, ‘ছুড়িয়া মারিলে জওয়ান মানুষ খুন হয়।’ তবু ওই বইটা প্রিয় ছিল আমার। দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে পড়তাম। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তাম। বইটা ছিল আম্মার। ওই বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়া ছিল আমার। বিশেষ করে পড়তাম রচনা অংশটুকু। ওখানেই একদিন প্রিয় কবি নিয়ে লেখায় পড়ি :
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।

লাইন কয়টি মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। পরে মনে হয়েছিল কী দারুণ অদ্ভুত লাইন! সাহিত্য করতে এসে এখন আরও বেশি অদ্ভুত আর অসম্ভব মনে হয়। ‘আম্মা’ শব্দটিকে মনে রাখার মতো এর চেয়ে দুর্দান্ত সাহিত্যিক প্রয়োগ আমি আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। হয়তো দেখলেও মনে ধরে নি। দুই-এক দশক আগে একটি সিনেমার গান খুব বিখ্যাত হয়েছিল; লোকে বাজিয়েছে খুব। মনে ধরেছে বলেই হয়তো বাজিয়েছে :
আম্মাজান, আম্মাজান
আপনি বড় মেহেরবান
জন্ম দিছেন আমায়
আপনার দুগ্ধ করছি পান।

আম্মাজানের গুণকীর্তন করা হয়েছে গানটিতে। আমার প্রিয় শব্দসমূহের একটি আম্মা। আম্মাকে আমরা আম্মা-ই ডাকি। আব্বাকে আব্বা। চেনা পরিচিত কেউ ডাকে মা, বাবা, আম্মু, আব্বু। কেউ মাম্মি, পাপা। কেউবা আম্মি, বাপি। কারও কাছে মাম, মাম্মি, ড্যাড, ড্যাডি। আমরা যখন বড় হয়েছি তখন মাম্মি-ড্যাডি-পাপাদের দেখতাম সিনেমায়। বড় লোক চৌধুরী সাহেবের ছেলেমেয়েরা ডাকত। আব্বু-আম্মুও তখন এতটা চালু সম্বোধন ছিল না। হিন্দি, বাংলা সিনেমার দাপটে মাম্মি-ড্যাডি-পাপারা ঢুকেছেন বাংলায়। এক্ষেত্রে বলার বিষয় এই যে, নিজের জনক ও জননীকে যে যা ডেকে আনন্দ পায়, তার ওপর দ্বিতীয় বিচার চলে না। ব্যাকরণ-অভিধান, পাণিনি কিংবা চমস্কি মেনে কেউ বাপ-মাকে ডেকে আনন্দ পাবে না - এটাই স্বাভাবিক।
পিতা-মাতাকে লক্ষ্য করে এই যে এত এত শব্দ, এসবের উৎস কী? বুঝতেই পারছেন, চোরের নজর বোচকার দিকে। শব্দ-শব্দ খেলায় মত্ত হয়ে আমার নজর শব্দের উৎসের দিকে। তাই আম্মা, আব্বা জাতীয় শব্দ নিয়ে খানিকটা ভাবতে বসেছি।
আম্মা শব্দটির দুটি উৎসের কথা ভাবা হয়। প্রথমত সংস্কৃত অম্বা; দ্বিতীয়ত, আরবি উম্মুন। অম্বার অর্থ মা। নারীর জন্য সম্মানজনক উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হতো অম্বা। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় অম্বা বদলে গিয়ে নির্বিশেষ নারী বোঝাতে বলা হয় আম্মা। এই দাবি সংস্কৃত ভাষাবিদ মনিয়ের উইলিয়ামসের।
মা এসেছে সংস্কৃত মাতৃ থেকে। এই সূত্রে মাতা, তারপর মা। আব্বার উৎপত্তি আরবি আবুন থেকে। আরবি-ফারসি উৎসে আছে আব, মানে পিতা; আবা মানে পূর্বপুরুষ। সেখান থেকেই ঘুরে-ফিরে আব্বা। পিতা-মাতার উৎস খুঁজতে গেলে পিতামহ-প্রপিতামহ, মাতামহ-প্রমাতামহের কাছে যেতেই হয়। এ কারণে গ্রিক-লাতিনের সঙ্গেও পিতা ও মাতার দূর-সম্পর্কের আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়। পিতার সংস্কৃত রূপ পিতৃ, গ্রিকে আছে pater, লাতিনে pater, স্প্যানিশে padre, ডেনিসে fader, ইংরেজিতে father। অন্য দিকে মাতার গ্রিক রূপ meter, লাতিন mater, ডেনিসে moder, ইংরেজিতে mother।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে আছে মায়ের অর্থে মাএর, মাকে অর্থে মাঅক, মা অর্থে মাঅ। অন্নদামঙ্গল কাব্যে পাচ্ছি, ও মা ও মা বলি উমা কথা কন ছলে।’ ইউসুফ জোলেখা কাব্যে শাহ মুহম্মদ সগীর লিখেছেন :
দ্বিতীয়ে প্রণাম করোঁ মাও বাপ পাএ।
যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায় ॥
পিপিড়ার ভয়ে মাও ন থুইলা মাটিত।
কোল দিলা বুক দিআ জগতে বিদিত ॥
অশক্য আছিলুঁ মুই দুধক ছাবাল।
তান দয়া হন্তে হৈল এ ধর বিশাল ॥
ন খাই খাওয়ায় পিতা ন পরি পরাএ।
কত দুক্ষে এক এক বছর গোঞাএ ॥
পিতাক নেহায় জিউ জীবন যৌবন।
কনে বা সুধিব তার ধারক কাহন ॥

মাও, বাপ, পিতা ব্যবহার করেছেন সগীর। দ্বিতীয়ত, প্রণাম করি মা বাবার পায়ে, যার দয়া হতে জন্ম হলো এই বসুধায়। পিঁপড়ার ভয়ে মা মাটিতে রাখেননি। কোল দিল, বুক দিয়ে রাখলেন, জগতে সবাই জানে। অশক্ত ছিলাম আমি দুধের ছাওয়াল, তাদের দয়া থেকে আজ এ দেহ বিশাল। না খেয়ে খাওয়ায় পিতা, না পরে পরান। কত দুঃখে একেক বছর পার করেন। পিতার স্নেহে প্রাণ, জীবন যৌবন। কোথায় শোধ করব তার ধারের কাহন। বাবার উৎস পুরোপুরি ফারসি। যদিও সংস্কৃতে আছে বপ্র - যে বীজ বপন করে। নারীকে ভাবা হয় ক্ষেত্রভূমি, পুরুষ হলো আবাদকারী। নারীতে বীজ বপনের ভার পুরুষের, হয়তো তা-ই বপ্র থেকে বাপ! বাপ থেকে বাপা, বাপি, বাপু ইত্যাদি। হিন্দিতে দেদারসে চলে বাপুজি, বাপ। মহাত্মা গান্ধীকে যেমন ডাকা হতো বাপুজি। বাপ তুলে গালি দেওয়ার নাম বাপান্ত। চড় মেরে বাপের নাম ভুলিয়ে দেয়ার অভিপ্রায় এরই অন্তর্ভুক্ত। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘মায়ের রন্ধনে খাব ভাত’, ‘সত্বরে চলিলা মাতা’, ‘পিতা বড় পুণ্যবান’, ‘অন্যবুদ্ধি নাহিক বাবার’, ‘বাপের বসতি’, ‘বাপের গ্রাম’, ‘শুন বাপা’।
শিশু বোঝাতে বাবুর উৎসে পাওয়া যায় ফারসি বাবুস। ‘বাবুজি জারা ধীরে চলো’তে যে বাবুকে পাওয়া যাচ্ছে সেই বাবু আর তার বাবুগিরির উৎসও কারো কারো মতে বপ্র। কেউ কেউ ডাকেন বাজান; এটা আসলে বাপজানের সংক্ষিপ্ত রূপ। যেমন আম্মাজান থেকে মাজান।
মাম্মি সম্পর্কে ধারণা এই যে, শিশুদের আবোলতাবোলে বোল ফোটার সময় মাদারের মা থেকে মাম্মা, মাম্মি - এ-ধরনের শব্দের উৎপত্তি। তবে আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজেই প্রধানত মাম্মা, মাম্মির প্রয়োগ দেখা যায়।
এখন প্রশ্ন হলো ড্যাড বা ড্যাডি কি ডেড কেইস? কিংবা পাপার বিষয়ে কী বলছেন শব্দ পণ্ডিতরা? ড্যাড অনেক পুরনো শব্দ। সম্ভবত শিশুদের বোল থেকেই উৎপত্তি। পাপা সম্পর্কেও একই কথা; তবে এই বোল ফ্রান্সের শিশুদের থেকে জন্মেছে; কিন্তু গ্রহণ করেছে পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ। গ্রহণ না করে উপায় কি মানুষ জন্মানোর প্রাকৃতিক ল্যাবরেটরি তো ওই একটাই আব্বা-আম্মা, মা-বাবা। অথচ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গালিগুলো বাপ-মাকে ঘিরেই। যথা...। না, থাক, আজ আর অযথা গালাগালি নয়। অন্য দিন জমিয়ে গালি হবে। সেদিন কেউ চাইলে চড় মেরে বাপ-মার নাম ভুলিয়ে দিতে পারেন। আপাতত আম্মার জন্য :
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //