সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে...।

কবিতার পঙক্তিমালায় এভাবেই স্বদেশের অস্তিত্বকে ধারণ করেছিলেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। সব্যসাচী এই লেখকের চতুর্থ প্রয়াণবার্ষিকী আজ। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বাংলা ভাষার অনন্য এই কবি ও কথাশিল্পী।

কবির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ঢাকা ও কুড়িগ্রামে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। সৈয়দ হকের জন্মভূমি কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজ প্রাঙ্গণে কবির সমাধিতে জেলা প্রশাসন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্মিলিত উদ্যোগে পুষ্পস্তবক অর্পণ, র‌্যালি, দোয়া মাহফিল।

এছাড়া জেলা কালেক্টরেট কার্যালয়ের স্বপ্নকুড়ি মিলনায়তনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সভাপতিত্ব করবেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হবে তাঁর অগ্রন্থিত উপন্যাস ‘যে কোনো দরজা’। ১৯৬১ সালে সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ২৬ বছর বয়সে রচিত এই উপন্যাসটি সংগ্রহ করেছেন ও এর ভূমিকা লিখেছেন গবেষক অনুপম হায়াৎ। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সব্যসাচী মিস্ত্রী।

এছাড়া প্রয়াণবার্ষিকীর প্রাক্কালে শুক্রবার মৈত্রী থিয়েটার ও শৌখিন থিয়েটারের উদ্যোগে ঢাকার লক্ষ্মীবাজার চাইল্ড হেভেন স্কুলে উদ্বোধন হয় সৈয়দ শামসুল হক মিলনায়তন। এখন থেকে এই নাট্যমঞ্চে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হবে।

ছয় দশক ধরে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান, নাটক, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যসহ সাহিত্য ও শিল্পের ভুবনে অবিরাম বিচরণ করেছেন বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল বিচরণের সক্ষমতাই সৈয়দ হককে দিয়েছে সব্যসাচী উপাধি।

সাহিত্য-শিল্পের নানা শাখা-প্রশাখায় দীপ্যমান সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আর মা গৃহিণী হালিমা খাতুন। বাবার ইচ্ছা ছেলে সৈয়দ শামসুল হককে বানাবেন চিকিৎসক। যার রক্তে-চেতনা সাহিত্য সৃজনে আবিষ্ট, তাকে কিভাবে আটকে রাখে পরিবার! তাই তো ১৯৫১ সালে ঘর থেকে পালিয়ে চলে যান মুম্বাইয়ে। পরবর্তীতে দেশে ফিরে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হন। একপর্যায়ে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। এরপর থেকেই লেখালেখিকে নিয়েছিলেন জীবনের প্রধান ব্রত হিসেবে।

সৈয়দ হক তার বাবা মারা যাবার পর অর্থকষ্টে পড়লে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। পরে তোমার আমার, শীত বিকেল, কাঁচ কাটা হীরে, ক খ গ ঘ ঙ, বড় ভাল লোক ছিল, পুরস্কারসহ আরে বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। বড় ভাল লোক ছিল ও পুরস্কার নামে দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে খবর পাঠক হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন।

১৯৫৪ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তাস’ প্রকাশের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যাঙ্গনে স্থায়ী আসন করে নেন সৈয়দ শামসুল হক। এর পর একে একে প্রকাশিত হয় ‘শীত বিকেল’, ‘রক্তগোলাপ’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’সহ নানা বিষয়ে গভীর জীবনঘনিষ্ঠ রচনা। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘এক মহিলার ছবি’। ১৯৬১ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশিত হয়। সৈয়দ হকের ভাষা আর আঙ্গিকের উজ্জ্বল নিরীক্ষার পরিচয় উৎকীর্ণ হয়ে আছে ‘বিরতিহীন উৎসব’, ‘অপর পুরুষ’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে। তার লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘নীল দংশন’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘তুমি সেই তরবারি’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’। লিখেছেন ৫০টির বেশি উপন্যাস। কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। ছোটদের জন্য তার রচনা- ‘সীমান্তের সিংহাসন’, ‘আবু বড় হয়’, ‘হাডসনের বন্ধু’ ইত্যাদি। ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’সহ বিশ্বসাহিত্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনাও বাংলায় অনুবাদ করেছেন তিনি।

কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক পেয়েছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //