রবি না হয় বুঝলাম; কিন্তু ঠাকুর?

বৈশাখের ২৫ তারিখ আসার অনেক আগে থেকেই বাঙালির মাথায় ঠকঠক করে টোকা দিতে থাকে ঠাকুরের জন্মদিন। ঠাকুর আর কে?- ওই যে লম্বা চুলের দাঁড়িওয়ালা লোকটা- দাঁড়িতে রস লাগার ভয়ে কাঁটা চামচ দিয়ে যিনি আম খেতেন। বাংলা সাহিত্যে অনেকেই ঠাকুর সেজে বসে থাকেন; কিন্তু ঠাকুর তো সেই একজনই- রবিঠাকুর। কবিতার রবি, গানের রবি, গল্পের রবি, নাটকের রবি, উপন্যাসের রবি। রবিকরোজ্জ্বল বঙ্গদেশ। রবি নিজেই লিখেছেন-
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাব পাখির গান
না জানি কেন রে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
সেই যে রবি জেগেছিলেন, আর ঘুমাননি। বাংলা সাহিত্যের একূল-ওকূল দুকূল ভাসিয়ে দিয়েছেন আলোর বন্যায়। এজন্যই আমাদের রবিস্তব ফুরায় না। বৈশাখ দিয়ে আরম্ভ তার, বসন্তে শেষ; ঋতুর আবর্তনে আবারো ফিরে ফিরে আসেন তিনি। আমাদের ছয় ঋতুর রবি ঠাকুর। মনে করিয়ে দেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/আমি তোমাদেরই লোক।’ অতএব, আমাদের লোকটার নামধাম নিয়ে দুই-একটা কথা বলা যাক। আর সে সূত্রেই না হয় এদিক-সেদিক একটু মোচড় দিয়ে ঘুরে আসব।
রবি না হয় বুঝলাম- সূর্য; তার সঙ্গে যোগ করে দিলাম ইন্দ্র, হয়ে গেল রবীন্দ্র। ইন্দ্র- ইন্ + দ্ +র্ - মানে জয় করা, দমন করা। এখানে স্বর্গের রাজা, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। একে তো রবি, তার সঙ্গে আবার ইন্দ্র! দুটিই সংস্কৃত শব্দ। দুয়ে মিলে দারুণ শ্রেষ্ঠত্ব; কিন্তু ঠাকুরের বেলায় কী ফয়সালা?

রবি না হয় বুঝলাম- সূর্য; তার সঙ্গে যোগ করে দিলাম ইন্দ্র, হয়ে গেলো রবীন্দ্র। ইন্দ্র- ইন্ + দ্ +র্ - মানে জয় করা, দমন করা। এখানে স্বর্গের রাজা, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। একে তো রবি, তার সঙ্গে আবার ইন্দ্র! দুটিই সংস্কৃত শব্দ। দুয়ে মিলে দারুণ শ্রেষ্ঠত্ব; কিন্তু ঠাকুরের বেলায় কী ফয়সালা?

রবি ঠাকুরের প্রতিভার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঠাকুর শব্দের উৎস নিয়ে আছে দারুণ সন্দেহ; মীমাংসিত কোনো সিদ্ধান্ত নেই বললেই চলে। কারো মতে সংস্কৃত ঠক্কুর থেকে তৈরি হয়েছে ঠাকুর। কেউ বলেছেন হিন্দি ঠাক্কুর থেকে ঠাকুর। কারও মতে আবার ফারসি উৎসজাত তুর্কি শব্দ তাগরি থেকে হয়েছে ঠাকুর। বাংলা ঠাকুরের অর্থ যেমন দেবতা, তুর্কি তাগরির অর্থ তেমনি দেবতা। একটা প্রশ্ন আছে : ঠাকুর টেগোর হয়েছিলেন কবে?
আরো কয়েক জন ঠাকুর আছেন আমাদের সাহিত্যে- কোরেশী মাগন ঠাকুর; আরাকান রাজসভার এই কবি লিখেছিলেন সতী ময়না ও লোরচন্দ্রাণী কাব্যগ্রন্থ। মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া পালায় পাচ্ছি নদ্যার ঠাকুর। নামের সঙ্গে পদবি হিসেবে ঠাকুরের ব্যবহার যে পুরনো নদ্যার ঠাকুর তার একটি প্রমাণ :
সভা কইরিয়া বইস্যা আছে ঠাকুর নদ্যার চান।
আসমানে তারার মধ্যে পূর্ণ মাসীর চান।
উনিশ শতকে রবি ঠাকুরের আগে ছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর- আলালের ঘরের দুলাল নামে এক বই লিখে স্থায়ী একটা আসন গেঁড়ে বসেছেন বাংলা গদ্যের ইতিহাসে।
অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয় ঠাকুর শব্দটি; যেমন : দেবতা, প্রতিমা, ঈশ্বর, গুরু, ব্রাহ্মণ, মালিক, রাজা, অধিপতি ইত্যাদি। ব্রাহ্মণ পাচক বা রাঁধুনিও ঠাকুর হিসেবে অভিহিত হন। ঠাকুর শব্দের প্রাচীন প্রয়োগ আছে চর্যাপদে; ১২ সংখ্যক পদে আছে দুটি শব্দ : ঠাকুর ও ঠাকুরক- রাজা ও রাজাকে- এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই জাতীয় পদ রচনার আগে তুর্কি তাগরি শব্দ প্রবেশের অনুমান খানিকটা অনৈতিহাসিক বলেই মনে হয়।
মধ্যযুগের বিভিন্ন লেখায় ঠাকুরের ঠাকুরালি, অর্থাৎ প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখা যায়- কখনো রাজা অর্থে, কখনো সন্ন্যাসী অর্থে, কখনো শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি অর্থে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে পাওয়া যাচ্ছে, ‘ঠাকুরাণি! সফল করহ মোর আশ’, ‘আদি দেব বন্দিব ঠাকুর নিরঞ্জন।/ যাঁহার সৃজন সৃষ্টি সকল ভুবন।’ শিবের কাছে পিত্রালয়ে যাবার অনুমতি চাইছেন গৌরী, নিবেদন শুনহ ঠাকুর পঞ্চানন।/ যজ্ঞ দেখিবারে যাব বাপার ভবন।’ উনিশ শতকের কবি হাসন রাজা নিজের ভেতরই খুঁজেছেন ঠাকুরকে :
আপন সাধন আমার হইল না।
আমার পাগলা মনে কি বুঝিল, আপন সাধন কইল না।
আমার মাঝে কোন জন, তাঁরে খুঁজল না।
ঠাকুর চান্দ যে ঘরের মাঝে (তাঁরে) চেয়ে দেখল না।
এই ঠাকুর প্রভু, পরমেশ্বর। নিজের ভেতর প্রভুর খোঁজ। আমি তো মনে মনে ভাবি, ঠাকুরের সঙ্গে ঠোকর মারার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা! বিশেষ করে সেই সব ঠাকুর যারা দাপট দেখিয়ে হম্বিতম্বি করেন। ঠাকুরালি তো এক ধরনের ঠোকরানোই! সামন্ত যুগের শাসনকর্তারা ঠোকর মারতেন- এ-আর নতুন কী! ঠাকুরের এক অর্থ তাই শাসনকর্তা।
ঠাকুরের সঙ্গে পূজা-পার্বণের সম্পর্ক আছে। হিন্দু-অধ্যুষিত মহল্লায় বড় হবার সূত্রে তা-ই জানতাম। তাছাড়া ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না- এটা বুঝতাম। রবিঠাকুর নিয়ে ভাবতাম তিনিও বোধ হয় পুরুত ঠাকুর, পূজাটুজা করেন। একবার ঠাকুরের ভিন্ন একটা অর্থের মুখোমুখি হলাম। তখন বোধ হয় সিক্স-সেভেনে পড়ি। আম্মা বললেন, ‘এহনো বই নিয়া বসলি না; ওই যে তর ঠাকুর আসতাছে।’ ভেবে পেলাম না; ঠাকুরটা আবার কে! একটু পর দেখি আব্বা আসছে। দেখে ধুপধাপ করে দৌড়ে বই নিয়ে পড়তে বসলাম। বুঝতে পারলাম, ঠাকুর নিরীহ গোছের কোনো বিষয়ের সঙ্গে আটকে নেই, ঠাটবাটেরও যোগসূত্র আছে।
ঠাকুরের সঙ্গে পুরুষের সামাজিক পুরুষত্বের সম্পর্ক দৃঢ় বলেই মনে হয়। বিশেষ করে হিন্দু আত্মীয়তা-সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই পৌরুষ দৃশ্যমান। ঠাকুরঝি- ননদ; ঠাকুরপো- দেবর; ঠাকুর জামাই- ননদের স্বামী; ঠাকুরদা- পিতামহ; ঠাকুরমা- পিতামহী। ঠাকুরের পুত্র, কন্যা, মাতা, জামাতা- প্রত্যেকের পরিচয় ঠাকুরের সঙ্গে সম্পর্কিত; মা ঠাকরুনের অবস্থা সেদিক থেকে করুণ। কেননা পুরুষতন্ত্রে পুরুষমাত্রই দেবতা। লোকগানে আছে:
বলি, ও ননদি,
আর দুমুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে
ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে,
লো ননদি...
আমাদের রবিঠাকুরও পুরুষ; কিন্তু তাঁর ঠাকুরালি পুরুষত্বের ছলে নয়, লেখকত্বের বলে। আর তাই তাঁর সাহিত্যিক দাপটের সামনে টেকা দায়। তাঁর পরও কত ঠাকুর এলো গেলো, ঠাট দেখাল; লেখা হলো ঠাকুরবধকাব্য, ঠাকুরের বিসর্জনও হলো বহুবার। শেষ পর্যন্ত ঠাকুর-সেবা আর ঠাকুর-পূজা আমাদের করতেই হয়। আজও যারা পাঁচ-দশটা রবিঠাকুর পকেটে পুরে ঘুরে বেড়ান আর বলে বেড়ান ওই রকম জমিদারি ও বজরা থাকলে, পদ্মায় ভেসে বেড়ালে তারাও লিখতে পারতেন রাশি রাশি ভারা সোনার তরী-সমান লেখা, তাদের প্রসঙ্গে একটি সংস্কৃত শব্দই যথেষ্ট- অপোগণ্ড- মানে শিশু, বালক এবং মূর্খ। এই শব্দটি প্রথম শুনেছিলাম আমার মামার কাছে, তাও আবার আঞ্চলিক বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে বলা কথায়। অদ্ভুত! যাই হোক, আমার মতো অজমূর্খ যে ঠাকুর নিয়ে লিখছে তাঁর কারণও এক অর্থে ঠাকুর সেবাই। বাইশে শ্রাবণের শেষ বেলায় ঠাকুরকে সেলাম। যুগ যুগ জীয়ে!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //