‘সে কী করে হবে’

‘পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, “সে কী করে হবে"। ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব তাহা বালিকাকে বুঝানো আবশ্যক বোধ করিলেন না। সমস্ত রাত্রি স্বপ্নে এবং জাগরণে বালিকার কানে পোস্টমাস্টারের হাস্যধ্বনির কণ্ঠস্বর বাজিতে লাগিল-‘সে কী করে হবে।’
আমরাও বলি, ‘সে কী করে হবে?’ -এ কখনও হবার নয়। এ কখনও সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ চারটি শব্দের যে বাক্যটি পোস্টমাস্টারের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন তা কি তাঁরও মনের কথা নয়? এটি শুধুমাত্র একটি বাক্য নয়-এটি একটি দর্শন-একটি philosophy.
রবীন্দ্রনাথ কিংবা পোস্টমাস্টার কেউই মিথ্যে বলেননি। তেলে আর জলে কি মিশ খায়? উলাপুরের মত পানাপুকুর আর জঙ্গলে ভর্তি যে গন্ডগ্রাম সে গ্রামের পিতৃমাতৃহীন অশিক্ষিত দরিদ্র বালিকা রতন কিনা কলকাতার এক ভদ্রলোকের সাথে তার বাসাবাড়িতে চলে যেতে চায়। এ কেমন কথা! এমন কথা ভাবাও যে পাপ। এ অবোধ, বোকা বালিকা কেমন করে এমন আশা করে? ‘বোকা’ না হলে কী এমন কথা কেউ বলে, ‘দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?’
‘বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল। বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, হাগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।’ কিন্তু কতক্ষণ এ জননীর ভূমিকায় থাকা? যতক্ষণ পর্যন্ত না পোস্টমাস্টার সুস্থ হলেন।
পোস্টমাস্টার সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে রতন আবার দরজার বাইরে ‘স্বস্থানে’ ফিরে গেল। এখন আর শত অপেক্ষা করেও তার ডাক পড়ে না। সহস্রবার পুরোনো পড়া আওড়ালেও আর ‘নতুন পড়া’ তাকে দেওয়া হয় না। কারণ ইতোমধ্যেই পোস্টমাস্টার কলকাতায় তার বদলির দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছেন।
       ডাক পড়ল এক সপ্তাহ পর একদিন সন্ধ্যাবেলায়।
       পোস্টমাস্টার। ‘রতন, কালই আমি যাচ্ছি।’
       রতন। ‘কোথায় যাচ্ছ, দাদাবাবু।’
       পোস্টমাস্টার। ‘বাড়ি যাচ্ছি।’
       রতন। ‘আবার কবে আসবে।’
       পোস্টমাস্টার। ‘আর আসব না।’
বদলির দরখাস্ত না-মঞ্জুর হওয়ার পর পোস্টমাস্টার যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি আর এ অজ পাড়াগাঁয়ে থাকবেন না, চাকুরি ছেড়ে দেবেন- তখনই বাড়ি যাওয়ার খবরটা রতনের কানে দিলেন। এর আগে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন নি। ‘আর আসব না’ বলার পর রতন পোস্টমাস্টার দাদাবাবুকে অন্য কিছু জিজ্ঞাসা করেনি বা করার সাহস পায়নি। দুজনেই কিছুটা সময় নীরব রইলেন। তাদের এ নীরবতার সময়টুকুকে রবীন্দ্রনাথ ভাষা দিলেন, ‘মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং একস্থানে ঘরের জীর্ণচাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপ্ টপ্ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।’
এ কি আসলেই বৃষ্টির জল নাকি রতনের চোখের জল? দরদী লেখক তা স্পষ্ট করলেন না। কিন্তু যেটা স্পষ্ট করলেন সেটা হল ‘ভদ্রলোক’ পোস্টমাস্টার আর তার সেবিকা দরিদ্র আশ্রিত বালিকা রতন-এর আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক। চারটি শব্দের একটিমাত্র বাক্যে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান পরিস্কার করে দিলেন বিশ্বখ্যাত গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পোস্টমাস্টার যখন বলছেন ‘আর আসব না’ তখন কোনকিছু না ভেবেই ‘অনাত্মীয়’ রতন দাদাবাবুর সাথে তার বাড়ি যাওয়ার আবদার করে বসল। এ আবদার তো ক্ষণিক সময়ের জন্য বেড়াতে যাওয়ার আবদার নয়। এ যে চিরদিনের জন্য একটি স্থায়ী আশ্রয় পাওয়ার আবদার। কাছাকাছি থেকে চিরদিন পোস্টমাস্টারের সেবা করার আবদার। এ যে পোস্টমাস্টারের মাকে মা ডাকার আবদার-দিদিকে দিদি বলার অধিকার।
‘বোকা বালিকা’ ‘মোক্ষম’ জবাবটিই পেয়েছে। কারণ এ জবাবটিই যে তার ‘প্রাপ্য’ ছিলো। ‘দাদাবাবু’ সামনে পেছনে কিছু না ভেবেই হেসে উত্তর দিলেন, ‘সে কী করে হবে।’ সত্যিই তো, সে কী করে হবে? সে তো হবার নয়। সে কেন হবার নয় সেটাও রতনকে বুঝানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন না রতনের ‘প্রভু’।
‘প্রভু’ নিশ্চিন্তে ঘুমোলেন। কিন্তু সারারাত স্বপ্নে আর জাগরণে বালিকার কানে একটাই হাস্যধ্বনির কণ্ঠস্বর বাজল ‘সে কী করে হবে।’ এরপরও রতন তার ‘যথাকর্তব্য’ করে গেল। প্রাতঃকালে কখন আবশ্যক হয় এই ভেবে রাতেই নদী থেকে ‘প্রভু’র জন্য জল তুলে রেখে দিল।
‘প্রভু’ আশ্বাস দিলেন, ‘আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাঁকে বলে দিয়ে যাব তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন। আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।’ কথাগুলো প্রভুর ‘স্নেহগর্ভ’ ও ‘দয়াদ্র হৃদয়’ হতে উত্থিত হলেও ‘নারীহৃদয়’ এ ‘নরম কথা’ সইতে পারল না। নারীহৃদয়ের উচ্ছ্বসিত কান্না, ‘না, না, তোমাকে কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি থাকতে চাই নে।’
নতুন আরেকজন প্রভুর অধীনস্থ হতে সে চায় না। সে হতে চায় পুরোনো প্রভুর পরিবারের একজন। কিন্তু এ যে কিছুতেই সম্ভব নয় অভিমানী বালিকা তা বুঝবে কেমন করে?
রবীন্দ্রনাথ এখানে চিরাচরিত নারী হৃদয়ের ভালোবাসার দোহাই পেড়ে খুব বড় একটা সত্যকে আড়াল করলেন। ‘রতন’ নারী বলেই কি তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে ‘প্রভুর’ এত অনীহা? ‘রতন’ ছেলে হলে? তাহলেও তাকে কলকাতার সমাজে নিয়ে যাওয়া পোস্টমাস্টারের পক্ষে সম্ভব হত না। কারণটা আর্থ-সামাজিক। রতন যে সমাজের মানুষ সে সমাজের মানুষ কলকাতায় ভদ্র পরিবেশে মানানসই নয়। ওখানে হৃদয়ের আবেগের কোন মূল্য নেই। আর নেই বলেই পোস্টমাস্টার কয়টি টাকা দিয়ে রতনের ভালোবাসার মূল্য পরিশোধ করতে চেয়েছেন। হৃদয়ের টান আর অর্থের মান যে এক নয় তা রতন ঐ টাকা প্রত্যাখ্যান করে তার প্রভুকে বুঝিয়ে দিয়েছে। রতন তো টাকা চায়নি, রতন চেয়েছিল একটু ভালোবাসার আশ্রয়।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক। আমাদের পোস্টমাস্টারও কবি ও দার্শনিক। তাই তাঁরা ‘দর্শনের তত্ত্ববিচারের মাধ্যমে’ এ বিচ্ছেদ ব্যথার উপশম ঘটিয়েছেন। ‘একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি’ ভুলতে তাই দার্শনিক পোস্টমাস্টার একটি তত্ত্ব খুঁজে পেলেন, ‘পৃথিবীতে কে কাহার?’ কিন্তু আমাদের সামান্য গ্রামের বালিকা রতন-এর মনে কখনও এমন তত্ত্বের উদয় হয়নি ‘পৃথিবীতে কে কাহার?’ হলে কখনই পোস্টমাস্টারকে এমন আন্তরিক সেবা দিতে পারত না।
‘রতন পোস্টাফিস ঘরের চারদিকে অশ্রুজলে ভেসে ভেসে ঘুরতে লাগল- আবার যদি দাদাবাবু ফিরে আসে।’- দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ এ বলে এ সমস্যার সমাধান দিলেন, ‘হায় বুদ্ধিহীন মানব হৃদয়!’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //