চুল তার কবেকার

বনলতা সেন কি চুলে শ্যাম্পু করতেন? এই প্রশ্নের উত্তর কে জানে? সম্ভবত জীবনানন্দ দাশও না। জানার কথা নয়, শ্যাম্পু করা নিয়ে ভাববার কথাও নয়। আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল বনলতা সেনের চুল। এমনই ঘন সে চুল, যা ভেবে মনে পড়েছে বিদিশা নামের পুরনো নগরীর অন্ধকার রাত্রির কথা। ঠাকুর আর কী লিখবেন! তাঁর নিজেরই ছিল দীর্ঘ, ঘন, বিনুনি-বিন্যস্ত কেশভার। তরুণ বয়সের সেই ছবি রবিঠাকুরের মোহিনী মূর্তি। অজস্রবার তাঁর লেখায় চুলের প্রসঙ্গ এসেছে। ওই দিকে আরেক কেশধারী মুরলীমোহন কাজী নজরুল ইসলাম গান বেঁধেছেন ‘মেঘ-ঘন কুন্তলা’কে নিয়ে; তাঁরই আছে খোঁপার বাঁধন আলগা করার গজল।

নিত্য দিনই শুনছি কেশবতী কন্যার স্তবগান। চুল বা কেশ দিয়ে কৃষ্ণকে বেঁধে রাখার কথা লিখেছিলেন রাধারমণ। তবে কেশপাশ দিয়ে রাধা কৃষ্ণকে বেঁধে রাখতে পারেনি। অবশ্য চুল দিয়ে গাড়ি টেনে বাহাদুরি দেখিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছেন কেউ কেউ। 

চুল নিয়ে এত কা-! ‘বাল’ বাদে চুল, কেশ, কুন্তল, চিকুর- সব আসলে একই; কেননা বাল হিন্দি শব্দ, বাকি সব সংস্কৃত থেকে বাংলায় ঢুকেছে। সংস্কৃতে ছিল চূড়া, চূড়; প্রাকৃতে হয়েছে চূল, প্রাচীন বাংলায় ছিল চুলি, আধুনিক স্তরে হয়েছে চুল। পালি ভাষায় চূলা বলতে বোঝায় পাখির মাথার ঝুঁটি। সংস্কৃতে ‘কে’ মানে মাথা, ‘শ’-এর অর্থ : যে শয়ন করে। মাথায় যে শয়ন করে আছে, সে-ই কেশ, সে-ই চুল! মাথা বা শিরে আরোহণ করে আছে বলে চুলের আরেক নাম শিরোরুহ। 

বাংলায় ‘বাল’ নেই, এ-কথা বলে আমি আপাতত আবাল হতে চাই না। হিন্দি আর উর্দুতে একদম তার উল্টো। ওই দুই ভাষায় দেখা যায় বেজায় বাল-মুগ্ধতা। একটা গানের খানিকটা অনুবাদ : চুলগুলো সরিয়ে নাও প্রিয়তম/নিজের হাতে সাজিয়ে নাও/কপালের সরে যাওয়া টিপ।’ কানের কাছে ঝুলে থাকা চুলের অংশবিশেষকে আমরা বলি জুলফি; কিন্তু কেশবতী কন্যার সমতুল্য হিসেবে হিন্দিতে আছে জুলফওয়ালি। ফারসি জুলফ থেকে জুলফি- চুলের সমার্থক হিন্দি ও উর্দুতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়; গানে আছে : ‘তোমার চুল এত ঘন, আমি দেখি আর ভাবি, তার ছায়ায় আমি বেঁচে থাকব।’ কিন্তু ছায়া চাইলেই তো হবে না, চুল থাকতে হবে, আবার চুলের পরিচর্যাও করতে হবে। ঝরেপড়া চুলের সাহারা মরুভূমিতে ছায়া পাবেন কোথায়? তাই শ্যাম্পু চাই, কলপ চাই। 

ভারতীয়দের কেশচর্চা ও চিন্তনের আরেকটি উদাহরণ শ্যাম্পু। মজার ব্যাপার হলো চুল-বাল-কেশের মতো করে শ্যাম্পু শব্দটিও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। কেবল কলপ এসেছে আরবি কলফ থেকে। আমরা কলপকে স্মার্ট করেছি ইংরেজি রঙ মেরে, তাই বলি ‘হেয়ার কালার করা’, ‘হেয়ার ডাই’ করা। 

ইংরেজি হেয়ারের উৎস খুঁজতে গিয়ে শব্দ-পণ্ডিতেরা হেয়ার ছিঁড়ে ফেলেও কুলকিনারা করতে পারেননি। তবে জার্মান, ডাচ ও ডেনিশ ভাষায় আছে haar। এই সূত্রে ইংরেজিতে hair-এর অনুপ্রবেশ অস্বাভাবিক নয়। যাই হোক হেয়ার ফল রুখতে আমরা আপাতত শ্যাম্পুর দিকে একটু চোখ ফেরাই। কেননা আমাদের খুশকি দূর করতে হয়, মাথায় ড্যানড্রাফ থাকলে লোক হাসার মতো কা- ঘটতে পারে। এমনকি পার্টি থেকে রেগেমেগে উঠে যেতে পারেন আপনার মনপসন্দ প্রেমিকা বা প্রেমিক! অ্যান্টি-ড্যানড্রাফ শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন তো তা-ই দেখায়। 

(চুল না থাকলে কি হবে! টেকো লোকের পকেটেই নাকি চিরুনি বেশি থাকে। আসলে মাথায় চুল থাকুক বা না থাকুক চিরুনি আসবেই; সম্ভবত চুলের সিঁথি তৈরি করার সময় চুলে চির বা ফাটল তৈরি করতে হয় বলেই চিরুনি হয়েছে চির+উনি। চিরুনির আরেক নাম কাঁকই। এটির প্রয়োগ বহু বছর ধরে শুনি না। কাঁকইয়ের পূর্বসূরি সংস্কৃত কঙ্কতিকা- তারপর কাঁকইআ, কাঁকই)

বলে রাখা ভালো dandruff শব্দটির উৎস নিয়েও বিভ্রান্তির শেষ নেই। তবে খুশকি নিয়ে ভাবনা নেই; এটি বাঙালির মাথায় ঢুকেছে ফারসি খুশকী থেকে। খুশকির মানে হলো মাথার শুকনো চামড়া। খুশক্ মানে রুক্ষ, নিরস। উসকো-খুশকো চেহারা ও চুলের কথা বলা হয় খুশক্ থেকেই। শ্যাম্পু দূর করে দেয় খুশকি। শ্যাম্পু শুধু খুশকিই দূর করে না, সংস্কৃত উৎকুণ আর বাংলা উঁকুনও দূর করে। 

হিন্দি শব্দ চাঁপনা, অর্থাৎ চাপা, বল প্রয়োগ করা, তার সূত্রে চাঁপো- চাপ দাও এবং চাঁপোর লেজ ধরে shampoo শব্দটি তৈরি হয়েছে বলে অনেকের অনুমান; কিন্তু কী চাপার কথা ভেবে চাঁপো থেকে শ্যাম্পু হলো? শরীর- শরীর চেপে, ঘষেমেজে স্নান করা। আরেকটা হলো মাথা ঘষে চুল সাফসুতরো করা। সতেরো-আঠারো শতকের ভারত ঘুরে যাওয়া ইংরেজরা চাঁপনা শব্দটিকে লিখেছেন champa, চাঁপোকে champo এবং অবশেষে লিখছেন shampoo। শরীরের ওপর থেকে কমিয়ে চাপাচাপি শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে চুলে।

ভারতীয় উপমহাদেশের কেশচর্চায় সাম্প্রতিক সংযোজন কেশকেন্দ্রিক তিনটি ছবি। ছবির বিষয় : টাক! যার চুল নেই, তার বেদনার অন্ত নেই। চুল ঝরতে থাকলে ত্বক বেরিয়ে আসে, তাই সংস্কৃত ত্বক শব্দটি থেকে ধ্বনি ঝরতে ঝরতে বেরিয়ে এসেছে টাক। আঞ্চলিক বাংলায় টাক্কু; বেলের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয় টাক্কু বেল, নাইড়া বেল। নেড়া বা ন্যাড়া থেকে নাইড়া। সংস্কৃত নগ্নাট থেকে নেড়ার জন্ম বলে অনুমান অভিধানকারদের। 

চুল না থাকলে কি হবে! টেকো লোকের পকেটেই নাকি চিরুনি বেশি থাকে। আসলে মাথায় চুল থাকুক বা না থাকুক চিরুনি আসবেই; সম্ভবত চুলের সিঁথি তৈরি করার সময় চুলে চির বা ফাটল তৈরি করতে হয় বলেই চিরুনি হয়েছে চির+উনি। চিরুনির আরেক নাম কাঁকই। এটির প্রয়োগ বহু বছর ধরে শুনি না। কাঁকইয়ের পূর্বসূরি সংস্কৃত কঙ্কতিকা- তারপর কাঁকইআ, কাঁকই। 

চুল থাকলে খোঁপা থাকবে, বেণি থাকবে, সিঁথি থাকবে; এটাই স্বাভাবিক। মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় ছিল খোম্পা, হিন্দিতে খোংপা। বেণি পুরোদস্তুর সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় বেণির বিকল্প শব্দ বিনুনি। এমন গান নিশ্চয়ই আপনাদের মনে পড়বে, ‘আমার যেমন বেণি তেমন রবে চুল ভিজাব না।’ 

চুল বাঁধার অনেক ধরন আছে; তার একটি পনিটেল। ইংরেজি পনি অর্থাৎ, টাট্টু ঘোড়ার লেজের সঙ্গে মিল রেখেই নাম হয়েছে পনিটেল। সিঁথির আদিতে আছে সংস্কৃত সীমন্ত। হিন্দিতে ব্যবহৃত হয় সিন্থি। বাংলায় সিঁথি। সিঁথির সঙ্গে সিঁদুরের চমৎকার একটি ঐক্য আছে। সিদুঁর এসেছে সিন্দুর থেকে। এখনো হিন্দিতে সিন্দুর শব্দের প্রয়োগ আছে। আঞ্চলিক বাংলায় সিঁদুরের চেয়ে সিন্দুর বেশি জনপ্রিয়।

টাকপড়া লোকের পরম বন্ধু পরচুলা; অভিধানে পরচুলার একটি সুন্দর নাম দেওয়া হয়েছে : উপকেশ- কেশের তুল্য, কৃত্রিম কেশ; কিন্তু টাকপড়া লোকের মাথা বা উপকেশ নিয়ে হাসাহাসি করা যাবে না। বলা যাবে না স্টেডিয়াম, টাক্কু কিংবা নাইড়া বেল। সুভাষণ প্রয়োগ করে বলতে হবে বিরলকেশ। 

আর টাক বললেই বিরলকেশ ব্যক্তিটি মুখ খিঁচিয়ে বলে বসতে পারেন, ‘তেরে বাপ টাকিয়া।’ চুল নিয়ে শুরু করে দিতে পারেন চুলাচুলি। আর তাই চুল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের এখানেই সমাপ্তি। কারণ কথা আরেকটু বাড়ালে এই লেখার পাঠক ও লেখক- দু’জনেরই চুল ছেঁড়ার অবস্থা দাঁড়াবে; কিংবা আমাকে শুনতে হতে পারে সেই গান, ‘বালা, বালা, বালা/শয়তান-কা সালা।’ আর যাই হোক শয়তানের শালা হতে চাই না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //