দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা

তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা

ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি…

এ অসামান্য গানটির স্রষ্টা, আধুনিক বাংলা গানের পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন) দ্বিজেন্দ্রলাল (যিনি ডি.এল. রায় নামেই সমধিক পরিচিত) রায়ের আজ ১৭ মে (রবিবার) ১০৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ১৯১৩ সালের এই দিনে পরলোকগমন করেন।

‘ধন ধান্য পুষ্পভরা...’ গানটির সুরারোপ করে স্বকণ্ঠে প্রায়ই গেয়ে শোনাতে ভালোবাসেন স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। গানটিতে দেশি সুরে বিদেশি সুরের মিশ্রণ ঘটেছে। একদা বিলেতপ্রবাসী দ্বিজেন্দ্রলাল বিলিতি সুরলহরিতে মুগ্ধচিত্ত হন। তারই ফলে তার লেখা বহু গানে বিলিতী সুরের মনমাতানো ধ্বনি আমাদের মুগ্ধ করে। 

প্রসঙ্গত, দ্বিজেন্দ্রলাল তার ‘ইংরেজি ও হিন্দু সংগীত’ নামক রচনায় বলেছেন, ‘আমাদের রাগরাগিণীগুলি একটি আশ্রয় অবলম্বন করিয়া থাকে।... সে আশ্রয়বিচ্যুত হইতে চাহে না। ইংরেজি সংগীতে প্রতি গানের সুর নিরাশ্রয়। তাহারা কোনো নির্দিষ্ট ভিত্তি হইতে ওঠে না, বা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে শেষ হয় না। ধূমকেতুর মতো কোথা হইতে আসিয়া কোথায় চলিয়া যায়, তাহার ঠিকানা নাই।’ 

তিনি আরো বলেছেন, ‘আমাদের গানে আগে যেন একটা স্বভাবের সমুদ্র রচনা করিয়া লইতে হয়, রাগরাগিনীগুলি যেন সেই সমুদ্রের বক্ষে ঊর্মিমালার ন্যায় - তাহা হইতেই ওঠে, তাহাতে মিলাইয়া যায়। অন্যদিকে বিলিতি গানের সুরগুলি যেন হাউয়ের মতো একেবারে ঊর্ধ্বে উঠিয়া চলিয়া যায় এবং সেখানে অগ্নিস্ফুলিঙ্গরাশি প্রক্ষিপ্ত করিয়া শূন্যমার্গেই নিভিয়া যায়।’

লক্ষণীয়, দ্বিজেন্দ্রলাল বিদেশি সংগীত থেকে আহরণ করেছেন স্বতঃস্পন্দিত দীপ্তিভরা জৌলুস, অর্থাৎ দুরন্ত আবেগদৃপ্ত প্রাণশক্তি। তৎসম শব্দে যাকে বলে - ওজঃ।

দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র দিলীপকুমার রায় সংগীতজ্ঞ ও তার বাবার গান সুন্দরভাবে গাইতে পারতেন। তিনি বলেছেন, ‘দ্বিজেন্দ্রলালই প্রথম আমাদের সংগীতের মধ্যে বৈদেশিক প্রাণশক্তির নিবিড়তার রসদ্যুতি আবাহন করে, ভারতীয় আত্মিক সুরের সঙ্গে বৈদেশিকী ওজঃশক্তির সমন্বয়ে এক অপূর্ব রসের সৃষ্টি করেছিলেন, যার ফলে শুধু যে তার সুরের নানা বৈদেশিকী চলাফেরাকে অচেনা মনে হয় না; তাই নয়, বিদেশিরাও তার সুর শুনে বলতে বাধ্য হয় : এ কী! এ-সব অচিনসুরও যে আমাদের কণ্ঠে সহজেই বসে। এ অত্যুক্তি নয়, আমি এদেশে ও বিদেশে নানা বিদেশিকেই তার গান শিখিয়ে তাদের মনে চমক জাগিয়েছি। একটিমাত্র উদাহরণ দিই : ১৯৫৩ সালে, সানফ্রান্সিস্কোয় এশিয়ান আকাদেমিতে রীতিমতো গান শেখাতাম আমেরিকান ও আরো নানা জাতের জার্মান ছাত্রছাত্রীদের। তারা তার [দ্বিজেন্দ্রলালের] ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’ গানটি গাইতে গাইতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। বলত - ‘কী সুন্দর সুর! তার (পিতৃদেবের) ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে’ গানটি বাংলায় গেয়ে  জার্মান ভাষায় গেয়েছি, জার্মানিতেও উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন পেয়েছি, গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। এ কৃতিত্বের গৌরব আমার প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য তার, যিনি এ-সুর রচনা করেছিলেন, ভারতীয় আত্মিক শক্তির সঙ্গে ইউরোপীয় প্রাণশক্তির সমাহারে।’)

১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে জুলাই কৃষ্ণনগরের প্রসিদ্ধ দেওয়ান বংশে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন কার্তিকেয়চন্দ্র রায় । চরিত্রমাহাত্ম্যে ও বাংলা, ইংরেজি ও ফার্সী ভাষায় পারদর্শিতার জন্য কার্তিকেয়চন্দ্র বিদ্যাসাগর–মধুসূদন–দীনবন্ধু–বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ ব্যক্তিত্বের বন্ধুত্ব লাভ করেন। প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম. এ. পাশ করার পর ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান। সেখানে বিদেশি সংগীত চর্চার সাথে সাথে শেলী–কীটসদের রচনাপাঠে মনোনিবেশ করেন।

বাল্যকাল থেকেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত হয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় ও হরেন্দ্রলাল রায় - দু'জনেই ছিলেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। গৃহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের যাতায়াত ছিল। এরকম একটি পরিবেশে কৈশোরেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্ণিমা সম্মেলন নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনার প্রতি তার ঝোঁক ছিল।

১৯০৩ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্ত্রীবিয়োগ হয়। তারপর তিনি নাটক লেখার জগতে আসেন। তারাবাঈ (১৯০৩) কাব্যনাট্যটি অবশ্য স্ত্রীবিয়োগের পূর্বে রচিত। তারপর একাদিক্রমে নাটক-রচনা। প্রতাপসিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৬), নূরজাহান (১৯০৮), সোরাব রুস্তম (১৯০৮), মেবারপতন (১৯০৮), সাজাহান (১৯০৯), চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১) ইত্যাদি। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত ভীষ্ম (১৯১৪), সিংহলবিজয় (১৯১৫)।

স্ত্রীবিয়োগের পর কবি দ্বিজেন্দ্রলালের অন্তরে জাগে অপার শূন্যতাবোধ ও বিশেষ এক দার্শনিক চেতনা। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জাগে গভীরতাবোধ। তখন তার কবিদৃষ্টিতে প্রেমের অতলান্ত বিরহ ও উচ্ছ্বল আবেগের অন্তরে প্রেমের বিচিত্র অন্তর্দীপ্তি জেগে ওঠে। সেই প্রেমানুভূতি মানবজীবনের অন্তর্লোকের বিচিত্র আলো-আধাঁরীর বর্ণবিভায় প্রেমের গানের কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে।

দ্বিজেন্দ্রলালের কবি জীবনে নেই রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন বউঠান্’ কিংবা সুন্দরী-বিদুষী কবি-অনুরাগিণীরা। পরকীয়া প্রেমের চিন্তাবর্ধক বর্ণালিতে তিনি জীবনকে দেখার আগ্রহ বোধ করেননি। অথচ শেক্সপিয়র-বায়রন-গ্যেটে-শিলার প্রমুখ বিদেশি            কবি-নাট্যকারদের সাহিত্যরসে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তার সাথে একদা সুখি দাম্পত্যজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে স্মৃতির আলোয় প্রজ্বলিত করেছেন কবিত্বশক্তির দুর্বার প্রেরণায়। উদাহরণ হিসেবে তার লেখা কয়েকটি নাটক থেকে বহুমুখী প্রেমানুভবের প্রকাশ দেখানো যেতে পারে।

দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটে কবি ও নাট্যকার রূপে। বাংলা কবিতায় আনতে চেয়েছিলেন ইন্দ্রিয়াবেগের প্রত্যক্ষ স্ফূর্তির সাথে সামাজিক বাস্তববুদ্ধি। বাংলা কবিতায় ইংরেজি শব্দ বসিয়ে মৌখিক রীতি প্রবর্তনেও তার কৃতিত্ব দেখা যায়।

বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হলেও জন-গণ-মন হরণে সক্ষম হন নাট্যকাররূপে। এইভাবে প্রহসন, তারপর পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক রচনায় দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যপ্রতিভা বিকশিত হয়।

তার সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধাবলীর মধ্যে একটি বিশিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়- ‘কালিদাস ও ভবভূতি’ গ্রন্থটি। তার সৌন্দর্যমুগ্ধ সংবেদনশীল কবি মন ইংল্যান্ড যাত্রার পথে লোহিত সাগরের ওপরে চন্দ্রোদয় দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে- ‘ওমন চাঁদ উঠিতেছে- সমুদ্রের কিনারায় লহরীময়ী নীলিমা প্রান্তে, স্নিগ্ধ লোহিত গরিমায়, প্রক্ষান্তভাবে চাঁধখানি দেখা দিল। মধুরস্নিগ্ধ জ্যোতি, প্রেমময় চন্দ্রমার উদয়ে, সমুদ্রের শান্ত হৃদয় মৃদুল সমীর সন্তারণে দোলায়িত হইতে লাগিল। প্রেমিকের মধুর আগমনে, প্রণয়ীর মধুরতর সম্ভাষণ চুম্বনে স্নিগ্ধ চঞ্চল হৃদয়ে প্রেমপূর্ণ অন্তরে চুম্বনের প্রতিদান করিল। এ চুম্বন কি সুন্দর! এ চুম্বন কি সুন্দর! অঞ্ঝরা কণ্ঠ গীতব্য ‘ইয়োলিয়’ বীণা ঝঙ্কারবৎ স্নিগ্ধ ও মধুর। সুন্দর জিনিস সুন্দর, কিন্তু সুন্দর জিনিসের সম্মিলন শত গুণ মধুর।’

বস্তুত আবেগের আতিশয্যে লেখকের ব্যক্তি হৃদয়ের উদ্বেলিত বর্ণনা শক্তির একটা সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানগুলোর বর্ণনায় দ্বিজেন্দ্রলালের স্মৃতিরঞ্জিত রোমান্টিক কল্পনা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেছে। প্রাচীন ইতিহাসকে চিত্রময়ী বর্ণনার সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা লেখকের স্বদেশী গান ও ঐতিহাসিক নাটকগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

শেক্সপিয়রের সমাধি মন্দিরে উপস্থিত হয়ে নিজেকে তার আত্মার আত্মীয় মনে করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছেন, আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পার হইতে তোমার নাম-গীত হইবে, দক্ষিণ মহাসাগরের তোমার নাম প্রতিধ্বনিত হইবে, সমগ্র ইউরোপ জাতি বিদ্বেষ ভুলিয়া তোমার জয়গান করিবে। আর দূরে গঙ্গাতীরবাসী আর্কাবর্তের শ্যামল সন্তান তোমাকে ভারতীয় বরপুত্র কালিদাসের প্রিয় ভ্রাতা, জগতের প্রিয় কবি বলিয়া আলিঙ্গন ও আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করিবে।’

‘মন্ত্র’ দ্বিজেন্দ্র প্রতিভার বিশিষ্ট শক্তির কাব্য। এ কাব্যে তারুণ্যের দীপ্তির সাথে প্রৌঢ়চিন্তার গভীরতা সমন্বিত হয়েছে। তিনি জানেন যে এ কঠিন বৈজ্ঞানিক যুগে রোমান্স ও আদর্শবাদ অতীতের কাহিনীতে পরিণত হয়েছে, তাই তার চিন্তা ও ভাবনা-

‘দিব সত্য যাহা চাহো- ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সভ্যতার তীব্রালোকে, জানি স্থির অন্য গান লাগিবে না ভালো’।

কবির ‘কুসুমে কণ্টক’ কবিতায় নারী ও প্রেম সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ ও কল্পনার মধ্যে রোমান্টিকতা বিরোধী এক সংশয়াতুর দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়- ‘এই প্রেম, এই ঈঞ্ঝা শুধু কাম শুধু লিঞ্ঝা এ শুদ্ধ বিধির বিধিভবে রাখিতে তাহার সৃষ্টি আর এই রূপবৃষ্টি প্রলোভনে বাঁধিবে মানবে’।

নারীকে ঘিরে যে রোমান্স লোকের সৃষ্টি করা হয় তিনি তার বাস্তব সত্যটি দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যক্ষ বাস্তবের সাথে কল্পনার বিরোধকে তিনি অ্যান্টিক্লাইমেক্সে রূপ দিয়েছেন- 

‘ভূধর দূর বিগম্য, দূর হতে অতি রম্য

ধুম্রনীল তুষারকিরীটি

নিকটে বিকট, শীর্ণ, বন্ধুর কঙ্করাকীর্ণ

শুষ্ক যেন উকিলের চিঠি’।

এখানে কবির বাস্তব সচেতন বিচার বুদ্ধি বিশ্লেষণ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। জীবনের সাথে কবি মৃত্যুকেও ভাববার চেষ্টা করেছেন। 

আজ প্রথম পাঠে তার সাজাহান নাটকটিকে বর্তমান সময়ে পড়ার চেষ্টা করব।

নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) পঞ্চাশ বছরের আয়ুষ্কালের মধ্যে তার রচনায় বিস্ময়কর বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছিলেন। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্মের ১৫৪ বছর ও প্রয়াণের ১০৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেকে ও নিজেদের জিজ্ঞাসা করতেই পারি যে, আমরা এখন কেন দ্বিজেন্দ্রলালের লেখা পড়ব? তিনি ভালো ছাত্র হিসেবে বিলাত গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পাশ্চাত্য নাট্যসাহিত্য ও অভিনয়শিল্পের সাথে পরিচিত হন। সেখানে তিনি দেশপ্রেমের আবেগসমৃদ্ধ ইংরেজি কবিতা লেখেন ও গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। দেশে ফিরে চাকরির পাশাপাশি সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। প্রথমে প্রহসন লিখতে শুরু করেন। তারপরে নাট্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি তার গীতিকাব্যসংগ্রহ ও হাসির গান ও কবিতার সংকলনেও তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।

দ্বিজেন্দ্রলালের ইতিহাস-আশ্রিত নাটকগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম রচিত তারাবাই (১৯০৩) নাটকের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘এই নাটকের উপাদান টড্ প্রণীত রাজস্থান হইতে গৃহীত।... আমি  যদিও নাটকের মূল বৃত্তান্ত ‘রাজস্থান’ হইতে লইয়াছি, তথাপি অপ্রধান ঘটনা সম্বন্ধে স্থানে স্থানে ইতিহাসের সহিত এই নাটকের  অনৈক্য লক্ষিত হইবে। এ অনৈক্য আমি মারাত্মক বিবেচনা করি না। কারণ নাটক ইতিহাস নহে। কোনো কোনো সমালোচক এইরূপ অনৈক্য লইয়া অনেক কালি ও কাগজ খরচ করেন, দেখিয়া এ কথাটি বলা দরকার হইল।’ 

সাজাহান (১৯০৯) নাটকেও দ্বিজেন্দ্রলাল নিজস্ব কল্পনাশক্তির বিস্তার ঘটিয়েছেন। তা না হলে সাজাহান নাটকে ট্র্যাজেডির যে-ব্যাপকতা ও বিস্তার ঘটেছে তা হতে পারত না।

দ্বিজেন্দ্রলাল ঐতিহাসিক বাস্তবকে শিল্পের বাস্তবে রূপান্তরিত করার সময়ে তার কল্পনাশক্তির সাহায্যে ইতিহাসকে অতিক্রম করে যেতে শেক্সপিয়রের ও শিলারের টেকনিককে অনুসরণ করেছিলেন। একজন ব্যক্তিমানুষ একসাথে সামাজিক মানুষ ও  একলা মানুষ। মানুষকে বাদ দিয়ে যেমন ইতিহাস নেই, তেমনভাবেই মানুষ যখন একা তখনো ইতিহাস নেই। কিন্তু সেই একলা মানুষটির সন্ধান পাওয়া যাবে সাহিত্যে। সাজাহান ও ঔরংজেবরা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকে একইসাথে সামাজিক-ঐতিহাসিক চরিত্র, আবার একলা মানুষও বটে। এই একলা মানুষটিকে দ্বিজেন্দ্রলাল তার নাটকে সংলাপ আবেগ অলংকার দিয়ে ধরতে পারেন, কিন্তু ঐতিহাসিক তা পারেন না। তা থেকে অবশ্য এমন কথা বলা যায় না যে, ঐতিহাসিকের ইতিহাস-রচনার ক্ষেত্রে কল্পনাশক্তির কোনো ভূমিকা নেই। ঐতিহাসিকরা তথ্য আবিষ্কার করেন, নির্বাচন করেন ও তথ্য উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তথ্য ও কল্পনা উভয়েরই গুরুত্ব রয়েছে। সেই কারণে ঐতিহাসিক একইসাথে বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক। কিন্তু ঐতিহাসিকের কল্পনা ও সাহিত্যিকের কল্পনা আবার ভিন্নধর্মী।

ঐতিহাসিক শেষ পর্যন্ত দ্রষ্টা, কিন্তু সাহিত্যিক স্রষ্টা। দ্বিজেন্দ্রলাল সাজাহান বা ঔরংজেবের চৈতন্যের গভীরে ঢুকে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বকে যেভাবে উন্মোচন করতে পারেন ঐতিহাসিকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। টড্-যদুনাথ সরকার মানুষের মনের গভীরে  ঢুকতে পারেন না, কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল তা স্বচ্ছন্ধে করতে পারেন। সাজাহানের চার পুত্র একই সমাজে, একই শ্রেণিতে, একই পরিবারে বড় হয়ে উঠলেও তাদের ব্যক্তিত্বের গড়ন ভিন্ন-ভিন্ন কেন, তার বিশ্লেষণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তার মর্মোদ্ঘাটন সাহিত্যিকই করতে পারেন।

কলিংউডের মতে, ঐতিহাসিক যখন পুরনো যুগের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন তখন তাকে পুরনো মন নিয়ে পুরনো সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে। না হলে সমস্যাটার চেহারা তার আলোচনায় ধরা পড়বে না। মানুষের চেতনাকে নির্ধারণ করে তার সামাজিক সত্তা। অতীতের সমাজ অতীতের মনকে গড়ে তুলেছিল। আবার বর্তমানের সমাজ বর্তমানের মনকে গড়ে তুলেছে। তাহলে বর্তমানে মনকে অতীতের মনে সাময়িকভাবে হলেও রূপান্তরিত করা সম্ভব কীভাবে? ঐতিহাসিককে যেহেতু একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক হতে হয় - সেকারণেই তিনি কীভাবে বর্তমানের মনকে অতীতের মনে রূপান্তরিত করবেন? করলেও কতদূর পর্যন্ত করবেন? বর্তমানের মন কতটা চিরন্তন, আর কতটা পরিবর্তনশীল? কিন্তু সেখানে সাহিত্যিকের সুবিধা অনেক বেশি। দ্বিজেন্দ্রলাল যেভাবে নাটকের চরিত্রগুলির মনের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছেন ঐতিহাসিকদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সেই যুগে পারিবারিক কাঠামো-বন্ধন, আবেগ-উচ্ছ্বাস, জীবনবোধ-মৃত্যুভয়, মেজাজ কাঠামো-ধর্মবোধ ইত্যাদি সব মিলিয়ে মনের যে কাঠামো সাজাহান নাটকে উন্মোচিত হয়েছে তা ইতিহাসে পাওয়া সম্ভব নয়। সময়-চেতনা ও পরিবর্তনের ব্যাখ্যা ইতিহাসের অনুসন্ধেয় বিষয় অবশ্যই। কিন্তু সাজাহান নাটকে মানবচরিত্রগুলোর যে এক অনন্ত বিস্তারের ইশারা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়ে আসেন তা ইতিহাসে অসম্ভব। নাটকটির চরিত্রগুলির অমন দীর্ঘ, অলংকারে ঝংকারে ঝংকৃত ডায়ালগ হুবহু বলে যাওয়া আজকের সময়ে কতটা সম্ভব, বা বললেও তা কতটা গৃহীত হবে, সেই প্রায়োগিক আলোচনা আমাদের বিষয় নয়। আমরা নাট্যসাহিত্য হিসেবে সাজাহান পড়লে বারবার অনুভব করি : নাটকটি ইতিহাস-আশ্রিত হয়েও কেমনভাবে ইতিহাস যা বলতে পারে না, তা স্বচ্ছন্দে বলে দেয়। নাটকটি জীবনের একটি সময় ও পরিসরকে জীবনের ভেতর থেকে আমাদের দেখায়। নাটকটিতে নাট্যকার সময় ও পরিসরকে নিজের মতো করে ব্যবহার করেছেন, নির্মাণ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন। আর তা সাফল্যের সাথে করতে পেরেছেন বলেই ইতিহাসের বড় সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে চরিত্রগুলির ছোট সময় ও ব্যক্তিগত সময়কে অন্বিত করতে  পেরেছেন।

ইতিহাসের বড় সময়ের সাথে সাজাহানের মিল লক্ষ্য করার মতো। নাটকটির আরম্ভ ১৬৫৮-র নভেম্বরে। অল্পদিন আগে সাজাহান অসুস্থতার কারণে দিল্লি থেকে আগ্রা এসেছেন। নভেম্বরের মধ্যপর্বে সুস্থ হয়েছেন কিছুটা। সুজা বঙ্গদেশে বিদ্রোহ করেছে বটে, কিন্তু এখনো সম্রাট নাম নেয়নি। কিন্তু মোরাদ গুর্জরে সম্রাট নাম নিয়ে বসেছে, আর দাক্ষিণাত্য থেকে ঔরংজেব তার সাথে যোগ দিয়েছে। ৪ সুজার বিরুদ্ধে জয়সিংহ ও সোলেমানের বিতর্ক এবং ঔরংজেব-মোরাদের বিরুদ্ধে যশোবন্ত সিংহ ও কাশিম খাঁর যুদ্ধ এবং তার ফলাফল পুরোপুরি ইতিহাসকে অনুসরণ করেছে। দারা, সুজা ও মোরাদের পরিণতিও ইতিহাসসম্মত। সাজাহান ঔরংজেবকে ক্ষমা  করছেন - এ ঘটনা ইতিহাসবিরুদ্ধ নয়। ইতিহাসের বড় সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে দিলদার, মহামায়া ও পিয়ারার মতো কল্পিত চরিত্রের মাধ্যমে দ্বিজেন্দ্রলাল ছোট সময় ও  ব্যক্তিগত সময়কে সৃষ্টি করেছেন।

সাজাহান একদিকে সম্রাট, অন্যদিকে পিতা। তাই বারবার তার আচরণে এক প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। কখনো বলেন, ‘তারা জানুক যে সাজাহান শুধু পিতা নয় সাজাহান সম্রাট।’ আবার বলেন, ‘কাজ নেই দারা। তারা রাজধানীতে আসুক; আমি তাদের বুঝিয়ে বলবো।’

আবার ঔরংজেব চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব তাকে ভিলেন করে তোলেনি। চতুর্থ অঙ্কের ষষ্ঠ দৃশ্যে কাজীর বিচারের পত্রখানি হাতে নিয়ে ঔরংজেব স্বগতোক্তি করছেন, ‘এই দারার মৃত্যুদণ্ড। - এ কাজীর বিচার। আমার অপরাধ কি? - আমি কিন্তু - না, কেন - এ বিচার! বিচারকে কলুষিত কর কেন। এ বিচার।’ ৬ অর্থাৎ কাজির বিচারকে সামনে রেখে ঔরংজেব দারার মৃত্যুদণ্ডকে যথার্থ বলে মনকে মানাতে চাইছেন।

তারপরে দিলদার বলছে, ‘জাঁহাপনা, সে কাজীরা যখন দারার মৃত্যুদণ্ড উচ্চারণ কর্চ্ছিল, তখন তারা ঈশ্বরের মুখের দিকে চেয়ে ছিল না। তখন তারা জাঁহাপনার সহাস্য মুখখানি কল্পনা কর্চ্ছিল, আর তার সাথে মনে মনে, তাদের গৃহিণীদের  নতুন অলঙ্কারের ফর্দ্দ কর্চ্ছিল।’ তখন ঔরংজেব বললেন : ‘...দিলদার তুমি সত্য কথা বলেছো। তুমি আজ দারাকে বাঁচালে!’ (দিলদারের প্রস্থানের পর আবার ঔরংজেবের স্বগতোক্তি) দারা বাঁচুন, আমায় যদি তার জন্য সিংহাসন দিতে হয় দেব! অতখানি পাপ - যাক্ এ মৃত্যুদণ্ড ছিঁড়ে  ফেলি...। (তারপর শায়েস্তা খাঁ ও জিহন খাঁর প্রবেশ করলে ঔরংজেব বলেন) : বিচারে ভাই দারার প্রাণদণ্ড হয়েছে।... কিন্তু তাকে মার্জ্জনা করেছি।’ ৭ ‘শায়েস্তা খাঁ : ‘একটা মহাবিপদকে ঘাড়ে করে সমস্ত জীবন রাজ্য শাসন কর্ত্তে হবে! জানেন সমস্ত প্রজা, সৈন্য দারার দিকে?’ ঔরংজীব : ‘... না হয় সিংহাসন দেব।’ জিহান : ‘দারা কাফের! কাফেরকে ক্ষমা করবেন আপনি খোদাবন্দ।’ ঔরংজীব : ‘সত্য কথা জিহন খাঁ!... হ্যাঁ দারার মৃত্যুই তার যোগ্য দণ্ড।’ ঔরংজীব দণ্ডাজ্ঞাতে সই করলেন। জিহান চলে যাবার পর ঔরংজীব আবার জিহানের দিকে গেলেন; আবার ফিরলেন, তারপরে অনেক ভাবলেন; বললেন : ‘না কাজ নেই! - জিহান আলি! জিহান আলি! না চলে গেছে।’  শায়েস্তা খাঁর প্রতিক্রিয়া : ‘ঔরংজীব! তবে তোমারও বিবেক আছে?’

ঔরংজীবের অন্তর্দ্বন্দ্ব হিউম্যান এসেন্স ও হিউম্যান একজিসটেন্সের দ্বন্দ্বকে উন্মোচন করে। ঔরংজীব একমাত্রিক ভিলেন থাকে না এই নাটকে। ক্ষমতার নিজস্ব নিয়মেই, ধর্মের আড়ালে হলেও, ঔরংজীবকে দারাকে মৃত্যুদণ্ড দিতেই হয়। শায়েস্তা খাঁ বলে : ‘তবে এত শ্রম করে তা (সিংহাসন) অধিকার করার প্রয়োজন কি ছিল? পিতাকে সিংহাসনচ্যুত, ভ্রাতাকে বন্দী - বড় বেশী দূর এগিয়েছেন জাঁহাপনা।’

সুতরাং ঔরংজীবের পক্ষে আর পেছনে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। কাফেরকে ক্ষমা না করার পেছনে ধর্মবিশ্বাস, নৈতিকতা ও সত্যের একটি ভূমিকা থেকে যায়। ঔরংজীবের অন্তর্দ্বন্দ্বের পেছনে যে দুধরনের নৈতিকতা ও সত্যের ভূমিকা রয়েছে তা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল। আবার এই সত্য ও নৈতিকতার সাথে ক্ষমতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।

নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর নাটকের প্রেমের  গানে কিংবা পরিবেশনায় প্রায়শ গভীর আত্মমগ্ন (subjective) হয়ে যেতেন, যদিও নাট্যশিল্প বহিরঙ্গভাবনার (objectivity) প্রকাশ। একটি সহজ উদাহরণ প্রসঙ্গত নিবেদন করি। সাজাহান নাটকের তৃতীয় অঙ্ক, ষষ্ঠ দৃশ্য। স্থান - যোধপুরের প্রাসাদকক্ষ। কাল - মধ্যাহ্ন। যশোবন্ত সিংহ ও জয়সিংহ। মহামায়ার প্রবেশ। মহামায়া বলেন - ‘চেয়ে দেখ - ঐ রৌদ্রদীপ্ত গিরিশ্রেণি - দূরে ঐ ধূসর বালুস্তূপ। চেয়ে দেখ - ঐ পর্বত স্রোতস্বতী - যেন সৌন্দর্যে কাঁপছে।’ তখন চারণবালকগণের প্রবেশ। মহামায়া বলেন - ‘গাও  বালকগণ! সেই গান গাও - আমার জন্মভূমি!’

তখন চারণবালকদের মুখে কবিনাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল শ্যামস্রী বঙ্গভূমির বন্দনাগান শোনান! যা তার অন্তরের গভীরে আবেগে স্বতঃস্পন্দিত। [বলা বাহুল্য, গানটি রাজস্থান যোধপুরের প্রাকৃতিক দৃশ্যে একান্তই বেমানান।] গানটি বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তা নিম্নরূপ :

ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা

তাহার মাঝে আছে দেশ এক - সকল দেশের সেরা;

ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা

এমন দেশটি্ কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,

সকল দেশের রাণী সে যে-আমার জন্মভূমি।

মিশেল ফুকোর ভাষায়, ‘...truth isn’t outside power, or lacking power... Truth is a thing of this world : it is produced only by virtue of multiple forms of constraint. And it includes regular effects of power. Each society has its regime of truth, its ‘general politics’ of truth : that is, the types of discourse which it accepts and makes function as true; the mechanism and instances which enable one to distinguish true and false statements, the means by which each is sanctioned; the techniques and procedures accorded value in the acquisition of truth, the status of who are charged with saying what counts are true.

ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণি সত্যকে সন্দর্ভের মাধ্যমে চ্যানালাইজ করে, প্রবাহিত করে। সেই সন্দর্ভ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেই শাসকশ্রেণির মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

ভাষাই ক্ষমতার সাথে সত্য ও জ্ঞানকে অবিচ্ছিন্ন করে রাখে, রেজিম অফ ট্রুথ নির্মাণ করে। সাজাহানের প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে সুজা ও পিয়ারার দ্বিরালাপ মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করলে, ঠাট্টা-মজার মধ্যেও, ভাষা-ক্ষমতা-সত্যের সম্পর্ককে নাট্যকার কীভাবে বুঝতে চেয়েছেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

পিয়ারার বক্তব্য পরপর সাজিয়ে দেয়া হলো : (১) ‘তুমি আবার বলবে কি! তুমি তো কেবল যুদ্ধ কর্বে (২) ‘আমরা যেমন গুছিয়ে বলতে পারি, তোমরা তা পারো? তোমরা কিন্তু বলতে গেলেই এমন বিষয়গুলো জড়িয়ে ফেল আর এমন ব্যাকরণ ভুল কর যে -’, (৩) ‘আর অভিধানের অর্দ্ধেক শব্দই তোমরা জানো না। কথা বলেছ, কি ভুল করে বসে আছ। বোবা শব্দ অন্ধ ব্যাকরণ মিশিয়ে, এমন এক খোঁড়া ভাষা প্রয়োগ কর, যে তার অন্তত কুঁজো হয়ে চলতে হবেই।’ (৪) ‘আমাদের ভাষা বুঝবার ক্ষমতাটুকুও তোমাদের নাই? হা ঈশ্বর! এমন একটা বুদ্ধিমান স্ত্রীজাতিকে এমন নির্বোধ পুরুষজাতির হাতে সঁপে দিয়েছো...।’ক্ষমতা নিজেই স্বায়ত্তশাসিত। যার ফলে যে সন্দর্ভ নির্মিত হয় তার সাথে সাধারণ নাগরিকদের বড়রকম দূরত্ব নির্মিত হয়ে ওঠে। যে শুধু যুদ্ধ বোঝে, তার ভাষা আর পিয়ারার ভাষা আলাদা হতে বাধ্য। পিয়ারার মনে হয়, ‘সুজার ভাষা খোঁড়া ভাষা’। জীবনপ্রবাহের বহুমাত্রিকতার প্রতিনিধিত্ব সেই ভাষার পক্ষে সম্ভব নয়। শাসকশ্রেণি নিজস্ব সন্দর্ভের মাধ্যমে ‘রেজিম অফ ট্রুথ’ নির্মাণ করতে চাইলেও সে-সত্য শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয় না, তা ভেঙে যায় নতুন শাসকশ্রেণিকে নতুন ‘রেজিম অব ট্রুথ’ নির্মাণ করতে। ক্ষমতা, সত্য ও জ্ঞানের সম্পর্ক ও সমগ্রতার অবয়ব বদলে যায়। 

আন্তোনিও গ্রামসির ভাষায় : ‘One could sketch a picture of the ‘normative grammar’ that operates spontaneously in every given society, in that this society tends to become unified both territorially and culturally, in other words it has a governing clan whose function is recognized and followed. The number of ‘immanent of spontaneous grammars’ is incalculable and theoretically, one can say that each person has a grammar of his own. Alongside this actual ‘fragmentation’, however, one should also point out the movements of unification, with varying degrees of amplitude both in terms of territory and ‘linguistic volume’.

আন্তোনিও গ্রামসি সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হবার আগে তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের ছাত্র ছিলেন। ভাষার খণ্ডায়ন ও ঐক্যের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে তিনি যেভাবে দেখেছেন, তার সাথে ভাষা, সত্য ও ক্ষমতার বিষয়টিকে সমন্বিত করে সুজা ও পিয়ারার দ্বিরালাপকে অনুধাবন করি - তাহলে  জন্মের ১৫০ বছর পরেও দ্বিজেন্দ্রলালকে কেন পড়ব তার উত্তর বোধহয় কিছুটা হলেও খুঁজে পেতে পারি। ইতিহাসের বড় সময়, ছোট সময় ও ব্যক্তিগত সময়কে নিজের মতো করে অন্বিত করতে পেরেছিলেন বলেই দ্বিজেন্দ্রলাল ২০১৭-তেও নতুন করে ভাবার মতো উপাদান আমাদের সামনে নিয়ে আসতে পারেন।

কাব্যগ্রন্থ ও তার বিষয়

“আর্যগাথা” (১ম – ১৮৮২, ২য় – ১৮৯৩) – এই কাব্যের ১ম ভাগে আছে ঈশ্বর – প্রকৃতি আত্মানুভূতর বিষয়ে সমৃদ্ধ । আর ২য় ভাগে আছে মানবপ্রেমের প্রকাশ ।

“The Lyrics of Ind” (১৮৮৬) – এই কাব্যের মধ্য দিয়ে ইংরেজি ভাষার কাব্যভাবনার মিলনসূত্র রচনা করতে চেয়েছিলেন ।

“আষাঢ়ে” (১৮৯৯) ,- এই কাব্যটি ইংরেজি ব্যঙ্গকাব্যের অনুসরণে রচিত।

“হাসির গান” (১৯০০) – এই কাব্যটিও বারহামের “Ingoldsby Legend’s” এর দ্বারা অনুভাবিত। কাব্যটির মধ্য দিয়ে বাঙালি সমাজে একটা ভাবের বিপ্লব ঘটিয়েছিল।

“মন্দ্র” (১৯০২) – এই কাব্যে দেখা যায় গীতিকার এবং তার্কিক কবি-চিত্তে দুই স্ববিরোধী সত্ত্বার অবস্থান।

“আলেখ্য” (১৯০৭) – এর একদিকে আছে স্ত্রী বিয়োগের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে আছে নতুন সমাজভাবনা ও গণতান্ত্রিক চেতনা ।

“ত্রিবেণী” (১৯১২) – কাব্যটি স্থির গম্ভীর স্মৃতির বেদনায় পূর্ণ । এখানে যেমন আছে অতীত স্মৃতির পর্যালোচনা, তেমনি আছে জগৎ ও জবনের নতুনতর অর্থের তৃষ্ণা।

কাব্য সংক্রান্ত প্রবন্ধ 

“কাব্যের অভিব্যক্তি” ( ১৩১৩, কার্ত্তিক ‘প্রবাসী’ ) , “কাব্যের উপভোগ” ( ১৩১৪, মাঘ ‘বঙ্গদর্শন’ ) , “কাব্যের নীতি” ( ১৩১৬, জ্যৈষ্ঠ ‘সাহিত্য’ ) ।

প্রহসন ও তার বিষয় 

“এক ঘরে” (১৮৮৯) – ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বিলেত থেকে দেশে ফেরার পর বিনা প্রায়শ্চিত্তে হিন্দুসমাজ তাকে গ্রহণে অসম্মত হয়। সমাজের এই অন্যায় ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় এই রচনা প্রকাশিত হয়।

“কল্কি অবতার” (১৮৯৫) – এ নব্যহিন্দু , ব্রাহ্ম , রক্ষণশীল , পন্ডিত ও বিলাত-ফেরত – এই পাঁচ সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যঙ্গবান নিক্ষিপ্ত।

“বিরহ” (১৮৯৭) – এতে আখ্যান বিন্যাস যথেষ্ট জটিল । সামাজিক বিদ্রুপ অনেক কম ।

“ত্র্যহস্পর্শ” (১৯০১) – এটী তেমন সার্থক হতে পারেনি ।

“প্রায়শ্চিত্ত” (১৯০২) – এতে আছে বিলাত ফেরত সমাজের অর্থলোলুপতা, কৃত্রিমতা, বিলাসিতার বিরুদ্ধে বিদ্রুপ বর্ষণ।

“পুনর্জন্ম” (১৯১১) – এতে এক কৃপণ, নির্মম ও স্বার্থপর সুদখোরের হাস্যকর পরিণতি দেখানো হয়েছে।

“আনন্দ-বিদায়” (১৯১২) – রবীন্দ্র বিরোধিতার এক উজ্জ্বল স্মৃতিখণ্ড আছে এই প্রহসনে।

নাটক 

পৌরাণিক নাটক ও তার বিষয়

“পাষাণী” (১৯০০) – এতে অভিশাপের প্রভাবে অহল্যার পাষাণ হওয়ার কাহিনী পরিব্যপ্ত ।

“সীতা” (১৯০৮) – এর কাহিনী ভবভূতির ‘উওর রামচরিত’ এবং বাল্মীকি রামায়ণের উওরকাণ্ড থেকে গৃহীত। এতে রাম ও সীতার অনেক উক্তি বিচ্ছিন্ন গীতিকবিতা বলে ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

“ভীষ্ম” (১৯১৪) – এই নাটকটি মহাভারতের সর্বাংশে অনুকরণ নয় ।

নাটক রচনার ক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্রলালের অশেষ প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘নূরজাহান’ নাটকে শের খাঁ ও জাহাঙ্গীর দুটো চরিত্রই পরিস্ফুট হয়েছে। উদার হৃদয় শের খাঁ স্ত্রীর কাছে ‘বিশ্বাস’ পেয়েছেন, ‘সেবা’ পেয়েছেন, কিন্তু প্রকৃত প্রেম পান নি। শের খাঁর অতৃপ্ত প্রেম পিপাসা, আত্মাভিমান ও আসন্ন মৃত্যুর কথা চিন্তা করে জীবন সম্পর্কে ঔদাসিন্য নাট্যকার দক্ষতার সাথে রূপ দিয়েছেন। নূরজাহানের প্রেম স্বপ্ন ও রূপবহ্নিই শের খাঁর নিয়তি। জাহাঙ্গীর নূরজাহানকে বিবাহ করার পর সম্পর্কটি এক অর্ধগুঢ় ব্যঞ্জনায় অভিব্যক্ত হয়েছে। সুরা ও সংগীতের নেশায় আচ্ছন্ন জাহাঙ্গীর স্বল্পলোকিত কক্ষে নূরজাহানকে বলেছেন, ‘তুমি দেবী না মানবী’। নূরজাহান উত্তরে বলেছেন, ‘আমি পিশাচী’। তাই সুর সুরা ও রূপ মুগ্ধতার মধ্যেও তার এই অসহায় পীড়িত সত্তাটি যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠেছে। নাট্যকার নূরজাহান নাটকটিতে প্রশংসনীয় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

‘ভীস্ম’ নাটকে নাট্যকার অম্বা-কাহিনীর ভিতর দিয়ে ভীস্মের মানবীয় সংঘাতকে রূপায়িত করেছেন। প্রেম বুভুক্ষু অম্বার লালসা শিথিল মোহিনী মূর্তির প্রেমময়ী বর্ণনায় দ্বিজেন্দ্রলাল লিরিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ভীস্ম ও অম্বার প্রণয়কাহিনী সমগ্র নাটকে গতিসঞ্চার করেছে।

সামাজিক নাটক ‘বঙ্গনারী’ উপেন্দ্র ও তার ভক্তবৃন্দের দৃশ্য কৌতুক রসোজ্জ্বল। উপেন্দ্রের মধ্যে ধর্মধ্বজী ভণ্ড চরিত্রকে শ্লেষাত্মকভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রথম জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নাট্যকার পরিণত বয়সেও বিস্মৃত হতে পারেননি। তিনি তার ব্যক্তি জীবন ও শিল্প জীবনের পরিবর্তনের কথা মর্মভেদী বেদনার সাথে উচ্চারণ করেছেন- প্রেমের গান আর গাই না, হাসির গান আর গাই না। সেদিন গিয়েছে। হাসি-তামাশার দিন গিয়েছে, আমারও গিয়েছে, সমাজেরও গিয়েছে’- এ উক্তির আলোকে শিল্পী দ্বিজেন্দ্রলালের মনোজীবনের একটি নিগূঢ় সংকেত পাওয়া যায়।

ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক কাব্য ও তার বিষয়

“তারাবাঈ” (১৯০৩) – মোগল–রাজপুত সম্পর্ক অবলম্বন করে এই নাটক রচিত।

“সোরাব রুস্তম” (১৯০৮) – ফিদৌসির ‘শাহনামা’ গ্রন্থটি এর মূল উৎস । এখানে আফ্রিদ চরিত্রে দেশপ্রেমের দিকটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক নাটক ও তার বিষয়

“রাণা প্রতাপসিংহ” (১৯০৫) “দুর্গাদাস” (১৯০৬), “মেবার-পতন” (১৯০৮) – এই তিনটি নাটকে রাজপুতদের বীরত্ব, আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেমের ছবি পরিস্ফুট হয়েছে।

“নূরজাহান”(১৯০৮), “সাজাহান” (১৯০৯) – এই নাটকদ্বয়ে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সাজাহানের পরিবারের কলঙ্কের ঘটনা বর্ণিত আছে ।

“চন্দ্রগুপ্ত” (১৯১১) , “সিংহলবিজয়” (১৯১৫) – প্রাচীন ভারতের হিন্দুযুগ থেকে বিষয় নির্বাচন করে এই দুই নাটক দ্বিজেন্দ্রলাল রচনা করেন।

সামাজিক নাটক

“পরপারে” (১৯১২) , “বঙ্গনারী” (১৯১৫) ।

দ্বিজেন্দ্রলাল বেঁচে ছিলেন মাত্র পঞ্চাশ বছর। অথচ ওই বয়সে তার রচিত সাহিত্য সম্ভার প্রচুর। স্বাভাবিক কবিপ্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তিনি পরবর্তীকালে তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের শেষ কবিতার বই ১৯১২ সালে প্রকাশিত। ‘চৈতালি’ ও ‘গীতাঞ্জলি’ ছাড়াও তখন রবীন্দ্রনাথের আরো কয়েকটি কবিতার বই বের হয়েছে বটে, বাকি সবই ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত। দ্বিজেন্দ্রলালের খণ্ডিত সাহিত্য জীবনে গানে, কবিতায়, নাটকে দৃপ্ত, দুঃসাহসী পদক্ষেপ ও নির্ভেজাল স্বাতন্ত্র্য ভেবে দেখার বিষয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //