গ্রন্থজগতের দুই একটি কথা

বই সম্বন্ধে একটা অদ্ভুত সত্য হইল এই, বইয়ের বাজারে একদল বড় গ্রাহক হইলেন তাহারা যাহারা কস্মিনকালেও বই পড়েন না। যাহারা বই সত্য- সত্যই পড়েন অনেক, তাহারা বই কেনেন খুব কম। আমি একজন জমিদারের কথা জানি, বই কেনা তাহার একটা নেশা ছিল।

তখনকার দিনে পয়সার তাহার কিছু অভাব ছিল না, তাই যেখানে যে ভালো বই পাইতেন কিনিয়া আনিতেন। ভালো বই কথাটার লক্ষ্য ভালো বিষয়ও নয়- ভালো প্রকাশ-ভঙ্গিও নয়; ভালো বই শব্দের মুখ্য অর্থ ভালো কাগজে ভালোভাবে ছাপা, ভালো আকার এবং ঝকঝকে তকতকে বাঁধাই। বই কিনিয়া তিনি একটি সুন্দর ঘরে আলমারির তাকে তাকে সাজাইয়া রাখিতেন, নিজেও আর ছুঁইতেন না, অপর কাহাকেও কোনো দিন ছুঁইতে দিতেন না; কিন্তু যত্নের কোনোও অভাব ছিল না; পোকা নিবারক বহুমূল্যের বার্নিশ দিয়া নিত্য ঝাড়িয়া পুঁছিয়া তাহাদের ঔজ্জ্বল্য এবং মর্যাদা নিরন্তরই বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা হইতো।

গ্রন্থগুলো ব্যবহার হইত শুধু দূরদৃষ্টির দ্বারা অভিজাত কোনো অতিথি আসিলে জমিদার মহাউৎসাহ-সহকারে তাহাকে তাহার গ্রন্থাগারে লইয়া গিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া বইগুলো দেখাইতেন- বাঙলা-ইংরেজি, আরবি-ফার্সি, সংস্কৃত- ইউরোপের অন্যান্য ভাষায়ও কিছু কিছু। দেখিয়া সকল অতিথিই তাজ্জব বনিয়া যাইতেন, আর তাহাতেই ছিল এই জমিদারের গর্বজনিত অসীম আত্মপ্রসাদ; লোকে দূর হইতে দেখিয়া তাজ্জব বনিয়া গেলেই তিনি বহু মূল্য দিয়া দেশ-দেশান্তর হইতে অনেক কষ্টে এই সব ভালো ভালো বই জোগাড় করিবার একটা পরম সার্থকতা মনে মনে অনুভব করিতেন।

জমিদারি প্রথা লুপ্ত হইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের গ্রাহকের এই বিশেষ শ্রেণিটিও যে নিঃশেষে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে এমন কথা মনে করিবার কোনো কারণ নাই। আধুনিক নাগরিক অভিজাত শ্রেণির মধ্যে এই শ্রেণিটির একটি রূপান্তরিত মূর্তি দেখা যায়। ড্রইং রুমে অল্প কিছু আসবাব; কিন্তু যেটুকু তাহা পরিচ্ছন্ন এবং রুচিসম্মত। তাহার ভিতরে একটি বিশেষাকৃতির বইয়ের তাক, তাহার ভিতরে কয়েকখানি বাজারের সেরা বই- সব জিনিসটিই অনুগ্রভাবে নয়নরোচন- এবং গৃহশোভন।

আপনি যদি কৌতূহলবশত একখানি গ্রন্থ টানিয়া স্থানভ্রষ্ট করেন তবে গ্রন্থের মালিক ভদ্রতার খাতিরে মুখে কিছু বলিবেন না, কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হইবেন। বইগুলির আশপাশে হয়তো আলগা ফ্রেমে বাঁধান দুই একখানি চিত্র বা আলোকচিত্র আছে,- দুই একটি ফুলদানি আছে- দুই একটি বিশেষ ধরনের পুতুল বা খেলনা আছে; ইহার কোনোটাই ধরিবার নয়, পড়িবারও নয়- সবটাই সৌখিন আসবাব।

আজকাল শিক্ষার ক্ষেত্রে এই মতটিকেই প্রাধান্য লাভ করিতে দেখা যায় যে, শিশুদের কাছে বইকে ঠিক আকর্ষণীয় খেলনার সামগ্রীর মতোন করিয়াই দিতে হইবে, খেলায় মত্ত শিশু আর পাঁচটা খেলনাকে নিজের আগ্রহেই যেমন খুঁজিয়া টানিয়া লয়- বই সম্বন্ধেও যেন তাহাই করে। কিন্তু বই সম্বন্ধে এই নীতিটি মানুষের শৈশব এবং কৈশোর পর্যন্তই আমার কার্যকর বলিয়া মনে হইয়াছে।

যৌবন হইতেই আর একটা সত্য আবার আমাদের প্রণিধানের বিষয় হইয়া ওঠে। কলেজের যে সব ছেলেরা নতুন নতুন ঝকঝকে তকতকে বই আনিয়া টেবল সাজাইয়া রাখে তাহাদের পড়িবার আগ্রহটা ছেঁড়া পুঁথি সংগ্রহ করিয়া বা পরের কাছে চাহিয়াচিন্তিয়া- অথবা গ্রন্থাগার হইতে বই সংগ্রহ করিয়া যাহাদের পড়াশোনা করিতে হয় তাহাদের যত্ন, আগ্রহ ও নিষ্ঠা এই সংগ্রহ চেষ্টাতেই বাড়িয়া যায়; অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও তাহাদের পড়া মোটের মাথায় ভালো হয়।

আমরা যখন দেশ-গাঁয়ে পড়িতাম তখন দেশ-গাঁয়ে বইয়ের আমদানি খুব কম ছিল। অন্য বই তো দূরের কথা বছরান্তে পাঠ্য বই কেনাও মহা হাঙ্গামার বিষয় ছিল, কারণ শহর ব্যতীত সেগুলি সংগ্রহ করিবার অন্য উপায় ছিল না। ইহার ফলে আমাদের ভিতরে একটা প্রথা তখন পর্যন্ত বেশ চালু ছিল; তাহা হইল বই হাতে লিখিয়া লওয়া। গোটা বই-ই হাতে লিখিয়া লইতে দেখিয়াছি। আর পুরনো বই জোগাড় করিয়া তাহাতে দুই একটা নতুন বিষয়হাতে লিখিয়া লওয়া- ইহা তো আমরা প্রায় সকলেই করিতাম। ইহাতে অসুবিধা অনেক হইত বটে, কিন্তু উপকারও কিছু হইত। পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক গভীর নিষ্ঠা এবং অধ্যবসায় আসিত।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিশ-পঁচিশ বৎসর পূর্বেও কিন্তু বই বলিতে তালপাতার পুঁথি বা দেশি তুলট কাগজের ওপরে লেখা পুঁথির প্রচলন বেশ ছিল। মুদ্রিত পুঁথির দুষ্প্রাপ্যতা বা দুর্মূল্যতাই যে ইহার মুখ্য কারণ ছিল ঠিক তাহা বলা যায় না; অনেকখানি কারণ ছিল আমাদের মুদ্রিত-গ্রন্থবিমুখতা। আমাদের সাহিত্যও কিছু দিন পূর্ব পর্যন্ত দেশ গাঁয়ে শাস্ত্রের সহিত অভিন্ন পর্যায়ে গৃহীত হইত। গীতাচন্ডীই যে আমাদের শাস্ত্র ছিল তাহা নয়, রামায়ণ-মহাভারত, শিবায়ন১, মঙ্গল কাব্য২, পদাবলী৩, চরিতগ্রন্থ, এমন কি বিবিধ পাঁলারীও এক সঙ্গেই আমাদের রস-পিপাসা এবং মোক্ষপিপাসা মিটাইত।

আর এই সঙ্গে আমাদের মনের মধ্যে আর একটা বিশ্বাস গড়িয়া উঠিয়াছিল যে মুদ্রণের দ্বারা গ্রন্থের অমর্যাদা হয়। বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্রের চাপে পড়িয়া পড়িয়া গ্রন্থের অন্তর্নিহিত মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়। এই জন্য অনেক সময় দেখিয়াছি, সস্তায় মুদ্রিত গ্রন্থ সুলভ হইলেও জনসাধারণের একটি অংশ তাহা কখনই ব্যবহার করিতেন না; তালপাতায় বা তুলট কাগজে গ্রন্থ লিখিয়া লইতেন। গ্রন্থলেখা এবং লেখানো উভয়ই সে সময়ে অতিশয় পুণ্যকর্ম বলিয়া বিবেচিত হইত। ধনবান লোক পুঁথি লেখাইয়া পুণ্যার্জনের চেষ্টা করিতেন।

পুঁথি সম্বন্ধে এই মধ্যযুগীয় সংস্কার অবশ্য শ্রদ্ধেয় নহে; কিন্তু পুঁথিকে অবলম্বন করিয়া অনেক সময় যে যত্ন, পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দেখিয়াছি তাহা অবশ্যই শ্রদ্ধার্হ্য। ভারতবর্ষের জৈন সাধুগণের মধ্যে পুঁথি লিখনচর্চা এখনো সুপ্রচলিত। জৈন সাধুগণ সাধারণত মুদ্রিত গ্রন্থ পাঠ করেন না। ধর্মসংস্কার বাদ দিলেও তাহাদের মুদ্রিত পুস্তক পাঠ করিবার কতগুলি বাস্তব বাঁধা আছে। জৈন সাধুদের স্থায়িভাবে কোথাও বসবাস করিবার নিয়ম নয়, দেশে দেশে ভ্রমণ করিয়া ধর্মের আচরণ এবং ধর্মের প্রচারই তাহাদের কাজ।

এই ভ্রমণ ব্যাপারেও তাহারা কখনো কোনো যানবাহন ব্যবহার করেন না,- কারণ পথে যানবাহন ব্যবহার করা তাহাদের মূল অহিংসাবাদেরই বিরোধী। এখনো তাই বছরে পাঁচ-সাতশ’ মাইল তাহারা হাঁটিয়া চলেন। এই হাঁটিয়া চলিবার সময় তাহাদের সামান্য বস্ত্র ও ভিক্ষাপাত্র তাহাদের নিজেদের বহন করিতে হয়; আর বহন করিতে হয় পঠন-পাঠনের প্রয়োজনীয় গ্রন্থসমূহ। কিন্তু অত্যাবশ্যক জৈন শাস্ত্র ও নেহাৎ কম নহে, খান পঞ্চাশেক হইবে। এই পঞ্চাশখানি তালপাতার বা তুলট কাগজের পুঁথি বহন করিয়া বেড়ানও একজনের পক্ষে সম্ভব নহে; তাই তাহাদিগকে গ্রন্থ-সংক্ষেপ করিতে হয়। গ্রন্থ-সংক্ষেপ তাহাদিগকে দু’ভাবে করিতে দেখিয়াছি; প্রথমত তাহারা অল্পবয়স হইতে জৈনশাস্ত্র মুখস্থ করিতে থাকেন।

বহু সাধু দেখিয়াছি যাহাদের অভিধান পর্যন্ত মুখস্থ। অতিশয় প্রয়োজনীয় গ্রন্থ মুখস্থ করিয়া বাদবাকি গ্রন্থ তাহারা পুঁথিতে লিখিয়া লন। এই পুঁথিলেখা বিষয়ে স্বভাবিকই তাহাদের একটি বিশেষ শিল্পের দিকে মন দিতে হয়, সে শিল্পটি হইল অতি ছোট অক্ষরে পুঁথি লিখিবার শিল্প- যাহাতে গ্রন্থের কলেবর বহন করিবার পক্ষে অনুপযোগী না হয়। জয়পুরে একবার এই-জাতীয় সূক্ষ্মাকারে লিখিত গ্রন্থ দেখিয়াছি; তাহার মধ্যে একখানি গ্রন্থ দেখিয়াছি, পনর ইঞ্চি লম্বা এবং তিন ইঞ্চি পাশ- ইহার দু’পাশে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করিয়া দুই ইঞ্চি বাদ দিয়া এবং উপরে নিচে আধ ইঞ্চি আধ ইঞ্চি করিয়া বাদ দিয়া শ্লোক লেখা হইয়াছে, তাহাতে প্রত্যেক পৃষ্ঠায় কিঞ্চিদধিক আড়াই শত করিয়া শ্লোক লেখা হইয়াছে। ফলে একখানি মাঝারি আকারের গ্রন্থের মধ্যে ক্ষুদ্র বৃহৎ প্রায় চল্লিশখানি গ্রন্থের নকল করা হইয়াছে।

আমরা অনেক চেষ্টা করিয়াও কিছুই পড়িতে পারিলাম না, কোনো দাগকে কোনো অক্ষর বলিয়া বুঝিতেই পারিলাম না; কিন্তু লেখক নিজে যত্র তত্র গড় গড় করিয়া পড়িয়া গেলেন। অন্যান্য সাধুদেরও পড়াইয়া দেখিলাম, দেখিলাম তাহাদেরও মোটামুটি পড়িয়া যাইতে কোনো অসুবিধা হয় না। এইভাবে এইসব সাধুদের মধ্যে পুঁথি-নকল করিবারই বিশেষ একটা শিল্প গড়িয়া উঠিয়াছে। কত সংক্ষেপে অথচ কত সুষ্ঠুভাবে গ্রন্থ লেখা যাইতে পারে, ইহার জন্যসাধনা ও অধ্যবসায় দেখিলে আশ্চর্য হইয়া যাইতে হয়।

প্রারম্ভে একজাতীয় লোকের কথা উল্লেখ করিয়াছি যাহারা শুধু গ্রন্থ কিনিয়া ঘর সাজান, কিন্তু গ্রন্থ পড়েন না। কিন্তু আর একদল লোক দেখিয়াছি যাহাদের সত্যকারের পরিচয় দিতে হইলে গ্রন্থ-পাগল ব্যতীত অন্য আখ্যা দেওয়া যায় না আমরা একটা চলিত-কথা সবাই জানি, মাছের চুপড়ির গন্ধ না হইলে মেছোনির রাত্রে ঘুম হয় না। ঠিক এমন ভাবেই দুই একজন লোক নিজের চক্ষে দেখিয়াছি; সারাদিনে নিজেদের চারপাশে কিছু বই ছড়াইয়া না রাখিলে তাহাদের শুধু ঘুম নয়, আহার-বিহারও ঠিকভাবে হয় না।

এই প্রসঙ্গে কাশীধামের বহুশ্রুত এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ ৫ মহাশয়ের নাম উল্লেখ করিতে পারি। একখানি ঘরের সর্বত্রই বই- আনাচে-কানাচে বই- মেঝেতে ভাগে ভাগে রক্ষিত বিবিধ বই ও কাগজপত্র- মাঝখানে ছোট একখানি বিছানার মতো তাহাতে একটি তাকিয়া; দিবসে তাহা বসিবার আসনের কাজ করে- নিশীথে তাহাই শয্যারূপে ব্যবহৃত হয়। একটি ঘরে নিশিদিন খালি বই- আর বই- আর শুইয়া বসিয়া একটি মানুষ। 

কলকাতায় দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে দেখিয়াছি। যে ঘরে প্রায় সদা সর্বদা থাকিতেন তাহা বইয়ে বইয়ে ঠাসা না থাকিলেই তাহাকে কেমন অস্বস্তি বোধ করিতে দেখিতাম; ফাঁকা ঘরেই যেন তিনি হাঁপাইয়া উঠিতেন। চেয়ার টেবেলে তিনি কাজ করিতে ভালোবাসিতেন না, তাহার মুখ্য কারণ- তাহাতে হাতের কাছে এবং নিজের চারদিকে ছড়াইয়া বই রাখা যাইত না; তাই একটি খাটে বসিতেন- আর চারদিকে বই ছড়াইয়া লইতেন। বাড়ি হইতে যখন বাহির হইতেন তখন কয়েকটি ধামায় ভরিয়া বই লইতেন গাড়িতে। পায়খানায় যাইবার সময় হাতে কিছু মাসিক পত্রিকা এবং এডগার ওয়ালেসের ডিটেকটিভ উপন্যাস লইয়া যাইতেন।

একদিন দুপুরের পর গিয়া দেখি তিনি ধামা ভরিয়া বই বাছাই করিতেছেন- জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম- সেদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াইতে যাইবার কথা! একদিনের কথা বলিয়া শেষ করি। অতিরিক্ত রক্তের চাপে এবং বই পড়ার জন্য অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে তাহাকে সেই অবস্থায় মেডিকেল কলেজের একটি কেবিনে রাখা হইল। সেই অবস্থায় সেই কেবিনে বসিয়া তিনি একটি কলেজের লোককে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলেন, রাত্রির জন্য তাহাকে দুই চারখানি বই পৌঁছাইয়া দিতে পারে কি না।

সে লোকটি বলিল,- ‘সর্বনাশ, এই অবস্থায় আপনি এইখানে আবার বই পড়বেন?- বলেন কি?’ তিনি চুপি-চুপি আবার উত্তর করিলেন,- ‘না রে না, পড়ব না, এই একটু হাতে নাড়া-চাড়া করব!’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //