কবিতা: অল্প অল্প করে বাক্যে বন্দি করার ধ্যান

‘যদি জিজ্ঞাসা করা না হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি জানি না।’ কবিতা ভাবনাবিষয়ক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন সেন্ট অগাস্টিন। কবিতাকে ভাষায় প্রকাশ করা সহজ হলেও কবিতা লেখার কারণ ব্যাখ্যা করা সম্ভবত জটিলতম বিষয়, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম রহস্যের প্রায় সবই কবিতায় লুকিয়ে আছে; আমি হয়তো তাদেরই বিস্তৃতির কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। আদিম কবির ভাষা থেকে আমরা সময়ের দূরত্বে অনেক অগ্রগামী হলেও ভাবের ক্ষেত্রেও কি এমনটি বলা যাবে?

কবিতার প্রকরণ, গঠন প্রণালি, ভাষা ও ভাবের বিশ্লেষণে অনেক কিছুই স্পষ্ট করা যাবে কিন্তু একজন মানুষের কবি কিংবা বৃহৎ অর্থে শিল্পী হয়ে ওঠা অথবা শিল্পী হয়ে ওঠার কারণ কোনো ভাবেই সুনির্দিষ্ট করার উপায় নেই। নিজের আত্মাকে খুলে দেখতে গেলেও একই বিষয়; মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষকরা তো বলেই দিয়েছেন যে, মনের একটি সুবৃহৎ অঞ্চল সম্পর্কে ব্যক্তি সচেতনভাবে কিছুই জানে না। কবিতা কি সেই অবচেতন বা অচেতন থেকে সচেতন মনে প্রভাব বিস্তারকারী কোন কিছু? এসবের যথাযথ উত্তর নেই, অন্তত সচেতন মনের দুয়ারে এরা কিছুটা অপরিচিত, রহস্যময়, ঘোর, মায়া।

আর কবি জনসন বলেছেন, ‘কবিতা হলো ম্যাট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ ও সত্যকে মেলানোর শিল্প, যেখানে রিজনকে সাহায্য করার জন্য ইমাজিনেশনের ডাক পড়ে।’ এসব কথা এতই দুর্বোধ্য যে কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলে ওঠা আরও কঠিন হয়ে যায়। কেননা আনন্দের উৎস, অবস্থান, প্রকৃতি এবং সত্যের বাস্তবিক উপস্থিতি ও প্রেক্ষিতের বিষয়গুলো এতই গোলমেলে যে এসবের সঙ্গে রিজনের শর্ত ও ইমাজিনেশনের আহ্বান বিষয়গুলোর শুধু জটিলতাই বাড়াবে।

সত্যের সঙ্গে কল্পনার কোনো সংযোগ কোন মাত্রায় সম্ভব? সত্য কি সর্বক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত বিষয়? তাছাড়া ম্যাট্রিক্যাল কম্পোজিশনও নিশ্চয় আনন্দ ও সত্যমুক্ত হতে পারে। নন্দনতত্ত্বের বিস্তৃত আলোচনায় গবেষক-তাত্ত্বিক মহল অনেক রকম ধোঁয়া ছড়িয়ে কবিতা বিষয়ে আমার ভাবনাকে আরো এলামেলো করে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না। ভারতীয় এবং ইউরোপীয় গবেষকদের ছড়িয়ে রাখা পুস্তকে আছে অনেক কথার নানামুখী বিস্তার, যেখানে কবিতা সম্পর্কে মতামতের বৈপরীত্যে ভরপুর।

কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বস্তু-পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের ভাষা ও তার প্রকাশভঙ্গি। পরিবর্তিত হয়েছে কবিতার কাঠামো কিন্তু মূলভাবে কি বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়েছে? উত্তরাধুনিক সময় আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে আধুনিকতার একমাত্রিক অগ্রগতিকে সন্দেহের চোখে দেখতে। নিজস্ব কবিতা ভাবনা নিয়ে লিখতে গিয়ে শুধু এটাই মনে হচ্ছে যে, কবিতাকে নিয়ে ভাবার থেকেও হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার রচনাকৌশল এবং ধারা পরিবর্তনের বাঁকগুলোর নবতর পাঠের আয়োজন। 

শৈল্পিক ভাব প্রকাশের একটি প্রাচীন মাধ্যম হলো কবিতা। যেখানে কবি নিজস্ব দক্ষতায় প্রত্যেকটি শব্দ ও বাক্যে তার সৃজনশীল অভিব্যক্তির উপস্থাপন করে থাকে। এ জন্য আমার মনে হয় যে, অর্থপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার অনেক রাস্তার নামই হচ্ছে কবিতা। যে রাস্তায় হাঁটলে কখনো দিক ভ্রান্ত হবার ভয় থাকে না। কেননা সেখানে দিকের নিশানারও আছে অনেক গন্তব্য, যেখানে ভাষাকে বিনির্মাণ করে বহু অর্থ প্রকাশ করার সম্ভাবনা তৈরি করা যায়, সরাসরি কোন অনুভবকে অনুবাদ করার বাধ্যবাধকতা থাকে না।

যেখানে বিদ্যমান সমাজের অনুকরণে সে সমাজের নকল বাস্তবতা তৈরি করা যায় নিজেকে আড়াল করে দেয়ার স্বাধীনতাটুকু উপভোগ করার প্রয়োজনে। যে রাস্তায় বাস্তবের চেয়ে অধিক বাস্তবতাকে নিজের আত্মা হিসেবে ভাবতে ভাবতে মৃত্যুবরণ করা যায়। যেখানে পুরাতন শব্দগুলোকে, নিজস্ব অতীতকে রি-প্রেজেন্ট করে মহাআখ্যান তৈরি করা যায়। আবার প্যারাডাইম শিফট করে যে কোনো সামগ্রিক বিষয়কে বাতিল করেও বিচ্ছিন্নভাবে ভাবনা বলয়ে ঘুমিয়ে পড়া যায়। যে রাস্তায় আপাত একাকিত্বকে বহুত্বের ধারণায় পরিবর্তন করে উপভোগ করা যায় বৈচিত্র্যের মাইক্রো ন্যারেটিভ। যে পথ চিন্তা প্রক্রিয়ায় সর্বদা গতিময় এবং আনন্দদায়ক সংহতির দিকে অবিরাম ছুটে চলে- তাই আমার কবিতার কপালে লেখা।

দেশ ও ভাষার প্রতি যে দায় মানুষ সামাজিকভাবে বহন করে বেড়ায়, কবিতা সেখানে আমাকে দেয় দেশাত্ববোধের নিবিড় শ্যামলিমার ঘনপল্লব শীতলতা। আমি তাকে অক্সিজেনের মতো গ্রহণ করে রক্তে রূপান্তরিত করি, লিখি, দু-এক ছত্র ব্যাঞ্জনায় পরিপূর্ণ স্নিগ্ধতার ঘ্রাণ। সেসব সদ্য গজিয়ে ওঠা খয়েরি শালিকের পালকের মতো বাতাসে দোল খায়, কখনো কখনো দীর্ঘ শীতের পর বসন্তে ছোঁয়ায়- এসব নতুন পালক থেকে উন্মুক্ত আকাশে উড়ে যাবার ধৃষ্টতাকে হৃদয়ের উষ্ণতা মেখে সাদা কাগজে ছড়িয়ে দিই; এগুলোই কবিতা? বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ শব্দসম্ভারে নির্বিচার ঢুকে পড়ার জন্মগত অধিকারকে আমি উপভোগ করার যে পদ্ধতিতে নিজেকে ক্রমাগত জড়িয়ে ফেলেছি, যার দিগন্তজুড়ে অসীম ব্যাপ্তির অর্থময়তাকে আমি অল্প অল্প করে বাক্যে বন্দি করার ধ্যান করি তার নামই কবিতা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //