সাংবাদিকতা, ইতিহাস সাহিত্য

মানবস্বভাব সীমাহীনরূপে শোধনীয় বলে মানবসমাজে প্রগতিমাত্রই আপতিক, কোনো মঙ্গলই অমিশ্র নয়, ভালোর বিশুদ্ধতা, অন্তত ব্যতিক্রমরূপে, সম্ভব শুধু জনজীবনে, কিন্তু গণজীবনে তার মিশ্রতাই অব্যতীত নিয়ম; আর যেহেতু সব মানুষের, এমনকি অধিকাংশ মানুষের, বিশুদ্ধতা এখন পর্যন্ত অচিন্তনীয় প্রস্তাব, যূথজীবনে এমন কোনো ভালোর উদ্ভব হতেই পারে না, কালক্রমে মন্দের মাশুল দিয়ে যার দেনা ডবল শুধতে না হয়।

উদাহরণত, সংস্কৃতির ওপর মুদ্রাযন্ত্রের ও গণতন্ত্রের প্রভাবের কথা যদি ভাবি? মাতৃভাষায় বর্ণপরিচয় দেশের প্রত্যেক মানুষের হতেই হবে, এ ব্যবস্থা কি ভালো নয়? পাঠ্যবস্তুর দ্রুত, সুলভ ও বহুল প্রচার কি অকাম্য? নিশ্চয়ই ভালো, নিশ্চয়ই কাম্য। ...কিন্তু দুঃখের বিষয়, ফলিত বিজ্ঞান মানুষকে এমন একটা অসহায় অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে, নিজের ক্ষমতার সীমা সে টানতে পারে না; কোনো একটা শক্তি একবার জ্যামুক্ত হলে কোথায় গিয়ে 

থামবে, এবং পথে পথে কী কা- করবে, তা স্বয়ং উদ্ভাবকের অজ্ঞাত। আমাদের পুরাণে দেখতে পাই, দারুণতম অস্ত্র প্রভুর আজ্ঞায় দুঃসাধ্য সাধনে বেরুলো, এবং যেটুকু প্রয়োজন ঠিক সেটুকু সম্পন্ন করেই ভালোমানুষের মতো ফিরে এলো তূণে। এই প্রত্যাহরণ বিদ্যাটা আধুনিক মানুষ হারিয়েছে : পুরাকালে, বীরেরা অন্তত উপায়ের কর্তা ছিলেন, এ যুগে দিগি¦জয়ীরাও উপায়ের দাস। মুদ্রাযন্ত্র জন্ম দিল সংবাদপত্রকে, সর্বজনীন প্রথম পাঠ তাকে লালন করল, তারপর দেখতে দেখতে তা হয়ে উঠল প্রজাবৃন্দের প্রধান পাঠ্য, জনগণের একমাত্র মানসিক খাদ্য।

বর্তমান পৃথিবীর স্বাক্ষর জনসংখ্যার বিশাল অধিকাংশের পক্ষে প্রতিদিনের প্রথম প্রাতঃকৃত্য হলো পত্রিকাপাঠ, অনেকের পক্ষে ত্রিসন্ধ্যার আহ্নিক অনুষ্ঠান; আর বয়স্কদের মধ্যে এমন ব্যক্তির সংখ্যাও আজ তুচ্ছ নয়, যারা জীবন কাটিয়ে দেন দৈনিক কিংবা প্রাহরিক সংবাদস্তম্ভ ছাড়া আর কোনো মুদ্রিত বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্র না করে।

বর্তমান জগতে সংবাদপত্রের অপরিহার্যতা স্বতঃসিদ্ধ। পৃথিবী আজ ভৌগোলিক অর্থে এমন সংকুচিত, ঐতিহাসিক অর্থে এমন একীকৃত যে কোনো এক দেশে কোনো এক সময়ে এমন কিছু প্রায় ঘটতেই পারে না, যার প্রভাব ছড়িয়ে না পড়ে অন্য সব দেশের আশু কিংবা ভবিষ্যৎ সুখদঃখে; সে জন্য বিশ্বব্যাপারে দৈনন্দিন অনুসন্ধিৎসা মানুষের পক্ষে অদম্য। পূর্বযুগে দেশে দেশে, এমনকি জনপদে জনপদে, ভৌগোলিক ব্যবধান দূরতিক্রম্য ছিল বলে মানুষের কৌতূহলের ক্ষেত্রও ছিল সংকীর্ণ এবং গণে গণে বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন; তখন সংবাদপত্র রচিত হতো মানুষের মুখে মুখে, হাটের কোলাহলে, ঘাটের কলরবে, চন্ডীম-পের চর্চায় কিংবা শুঁড়িখানার হল্লায়- এই শেষোক্তেরও বৃত্তান্ত আর এগোতো না নাবিকের উপবাদের পরে।

এর বিলুপ্তি, বলা বাহুল্য, নাগরিক সমাজেও এখনো ঘটেনি; আর এই স্বতোরচিত মৌখিক সংবাদপত্র সম্বন্ধে এমার্সনের উক্তি মেনে নিতে কারোরই আপত্তি হবে না যে সংবাদমাত্রেই পরচর্চা’। এমনকি, এর সামাজিক স্বীকৃতি দেখতে পাই এই ভিক্টরীয় প্রবচনে যে, ভদ্র লোকেরা কথা বলেন নানা বিষয়ে আর ভৃত্যেরা কথা বলে ব্যক্তিদের নিয়ে; কিন্তু মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রতি এমার্সনীয় সংজ্ঞাটি আরোপ করতে অনিচ্ছুক হবেন প্রায় সকলেই, যদিও তাতে মিথ্যার পরিবেশন স্নানের ঘাটের বা চায়ের পার্টির পরচর্চার তুলনায় গুরুত্বে আয়তনে ও ব্যাপ্তিতে বহুগুণ।

ইংল্যান্ডে অ্যাডিসন যখন প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তার প্রতিশ্রুত ও প্রযুক্ত উদ্দেশ্য ছিল সরসতার দ্বারা নীতির উজ্জীবন, আর নীতির দ্বারা সরসতার সংশোধন; কিন্তু এ সূত্র গ্রহণ করলে আধুনিক ব্যবসা সেবক, পার্টিপোষিত সংবাদপত্রের পক্ষে অস্তিত্বই অসম্ভব। আধুনিক সংবাদপত্রের তিনটি অংশ : সংবাদ, মন্তব্য ও বিজ্ঞাপন। তিনটিই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষরূপে সত্যের অপলাপী। প্রত্যক্ষ অপলাপ ঘটে তথ্যের নির্বাচনে, অন্যগুলো বাদ দিয়ে শুধু সেই সব তথ্যের বিকীরণে যা কেবল কোনো একটি সামাজিক শ্রেণির কিংবা রাজনৈতিক দল বা উপদলের স্বার্থানুকূল : অর্থাৎ, যেসব তথ্য নির্বাচিত হয়, আর নির্বাচিত হয়ে যেভাবে তারা পরিবেশিত হয়, তাতেই নিহিত থাকে চিত্তবিকারী মন্তব্য। খবর সাজাবার কৌশলে পাঠকের মনকে তৈরি করে নিয়ে তারপর প্রয়োগ করা হয় সম্পাদকীয় মন্তব্য দ্বারা পরোক্ষ অপলাপ; ফলত লোকচিত্তে সেই তথ্যের অধিকতর বিকৃতি ঘটে, যার ওপর নির্ভর করে মানুষ ‘সত্য কথাটা’ জানতে চায়।

এই অপলাপের ব্যতিক্রম সংবাদে ও মন্তব্যে যত দেখা যায়, বিজ্ঞাপনে তার চেয়ে অনেক কম; বিজ্ঞাপনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় অপলাপেরই সক্রিয়তা তীব্রতর, পাঠকের পক্ষে অদম্যতর। আধুনিক বিজ্ঞাপন চতুর্বিধ : প্রথম, যেখানে তথ্য আর মীমাংসা দুটোই যথার্থ; দ্বিতীয়, যেখানে তথ্য ভ্রান্ত কিন্তু মীমাংসা গ্রহণীয়; তৃতীয়, যেখানে তথ্যে ভুল নেই, কিন্তু মীমাংসা কাল্পনিক; চতুর্থ, যেখানে তথ্য আর মীমাংসা দুটোই ভ্রান্ত। প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞাপন অত্যল্প, কেননা সেটা সম্ভব শুধু সেই ক্ষেত্রে যেখানে প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত বা নগন্য, কিংবা যেখানে পণ্যবস্তুর নামটা জানানোই যথেষ্ট; যেমন সৎগ্রন্থের বা প্যালিউড্রিনের বিজ্ঞাপন। চতুর্থ শ্রেণির বিজ্ঞাপনও পরিমাণে অপেক্ষাকৃত অল্প এবং অন্তত শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে- প্রতিপত্তিতে দুর্বল; এখন পর্যন্ত এই শ্রেণিটা নিতান্তই যুবকীকরনী ভেষজে আর সন্তাননিবারিকা বটিকায় আবদ্ধ। আধুনিক সংবাদপত্রে প্রচারিত অধিকাংশ বিজ্ঞাপন দ্বিতীয় কিংবা 

তৃতীয় শ্রেণির: যেমন, ‘রাত্রিকালীন অপুষ্টি’ তথ্য হিসেবে ভ্রান্ত কিন্তু এই অলীক ব্যাধির প্রতিকারীরূপে যে পানীয় বিজ্ঞাপিত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা উপকারী হতেও পারে; কিংবা নিয়মিত স্নান যে স্বাস্থ্যকর এ তথ্য অকাট্য, তাই বলে সাবান না মাখলে, তার ওপর বিশেষ কোনো একটি সাবান না মাখলেই যে স্নান ব্যর্থ হলো, এ মীমাংসা একেবারেই অলিক; অতএব, অধিকাংশ বিজ্ঞাপনই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সত্যের অপলাপী; অথচ প্রত্যেক সংবাদপত্রের একটি প্রধান অংশ বলে, এবং কোনো কোনো পত্রিকার সুপাঠ্যতম অংশ বলে, প্রতিপত্তিতে বিজ্ঞাপন আজ সংবাদ ও সম্পাদকীয় স্তম্ভের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।

এ যুগের সাধারণ মানুষ তার কাজ চালানোর মতো জীবনদর্শন সংবাদপত্র থেকেই সংগ্রহ করে (যেহেতু মোটের ওপর সে আর কিছুই প্রায় পড়ে না), কিছুটা তার ‘পাঠ্য বস্তু’ থেকে, কিছুটা বিজ্ঞাপন থেকে- বোধহয় বিজ্ঞাপন থেকেই বেশি, কেননা অনেক পত্রিকার ‘পাঠ্য বস্তু’ও মুখ্যত প্রতিপালক বিজ্ঞাপনদাতারই প্রচারক, অর্থাৎ ছদ্মবেশী বিজ্ঞাপন। এ অবস্থায়, যতই মন খারাপ হোক, এ সিদ্ধান্তে না এসে তো উপায় দেখি না যে, বর্তমানে সাধারণ মানুষের সমস্ত ধারণা ও অনুমানের; অতএব, সমস্ত ব্যবহারের ভিত্তিটাই মিথ্যা।

পুরাকালীন মৌখিক সংবাদপত্র এত মারাত্মক নিশ্চয়ই ছিল না। লোকে পরচর্চা করতো, কিন্তু তাকে পরচর্চা বলেই জানতো, পরাবিদ্যা বলে ভ্রম করতো না। তাতে বিশ্বাস ছিল না, শুধু বিনোদন ছিল। বিশ্বাস সংগ্রহের অন্য ক্ষেত্র ছিল তখন, ছিল ভিন্ন ভিন্ন দেশে নিত্যক্রিয়াশীল ভিন্ন ভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও আদিকাব্য। আধুনিকের দৃষ্টিতে বাইবেল কিংবা রামায়ন-মহাভারত তথ্যের দিক থেকে যতই অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত হোক, বিজ্ঞানের তৎকালীন অপরিণতির পরিমাপে মানুষের সর্বাঙ্গীণ শিক্ষারই ব্যবস্থা ছিল তাতে; তা ছাড়া, যে সংশ্লেষণ শক্তির বা জ্ঞানের সহায় ব্যতীত কোনো বিশেষ জ্ঞান, বিশ্লেষণী জ্ঞান, অর্থাৎ বিজ্ঞান শুভপ্রসূ হতে পারে না, এসব গ্রন্থ সেই জ্ঞনেরই ভান্ডার বলে তাতে জীবনের মৌল মূল্যবোধ সম্বন্ধে স্বীকৃতির পরাকাষ্ঠা আজ পর্যন্ত আমাদের বিস্ময় জাগায়। সেকালে মানুষ তার প্রতিদিনের কাজ চালানো জীবনদর্শন যে উৎস থেকে সংগ্রহ করতো, সেই উৎসটা অন্তত সত্যাভিমুখী ছিল, একালে উৎসটাই মিথ্যাশ্রয়ী। প্রভেদটা নিঃসন্দেহে নিদারুণ।

সংবাদ যে মিথ্যা, বিজ্ঞাপন যে ততধিক- এ কথা মনে মনে অনেকেই জানেন, মুখেও মানেন, কিন্তু কার্যত এ কথা মনে করতে অনেকেই সীমাহীনরূপে অক্ষম যে রটারিযন্ত্রের রটনাও হাটের চেঁচামেচি বা ঘাটের কিচিমিচির মতোই ‘গসিপ’। এক তো মুদ্রাক্ষর সম্বন্ধে ছেলেবেলার অন্ধ আস্থা অনেকেই আজীবন কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার উপর, আপাতদর্শনে আধুনিক সংবাদপত্রের তথ্যাবলি এতই প্রামাণিক, তার সংগ্রহে মানুষের উপায় নৈপুণ্যের ক্রীড়া এতই চমকপ্রদ যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাস্থার অস্থায়ী অপনোদন- যদিও কোলরিজীয় অর্থে নয়- অনিবার্য।

বস্তুত, এই তথ্যাবলি অনেক ক্ষেত্রেই অতথ্য নয়, তবু সত্যের অপলাপী; কেননা সংবাদপত্র শুধু জীবনের বিভিন্ন বিভাগের ক্রিয়াকালের বিবৃতি দেয়, কোনো সংশ্লেষণী নীতির দ্বারা ঘটনাবলিকে সুসংবদ্ধ ও অর্থম-িত করার কোনো চেষ্টাই করে না। রাজনীতি, ঘোরদৌড়, রঙ্গালয়, বিচারালয়, মৃদুমধুর পরচর্চা ও বিবিধ বিচিত্র পণ্যপ্রচার- এই সব পরস্পর বিচ্ছিন্ন বিষয়ের দিনপঞ্জীতে তথ্যের যথার্থ কিছতা যদি থাকেও, এই বিচ্ছিন্নতাকে একসূত্রে গাঁথার মতো কোনো মূলনীতির প্রয়োগ নেই বলে তথ্য আর অতথ্য মানুষকে সমপরিমাণেই উদভ্রান্ত করে।

অর্থাৎ কোথায় কী ঘটছে তা আমরা কাগজ পড়ে জানতে পারি, কিন্তু ঘটনাবলির তাৎপর্য বুঝতে পারি না, আর সেটা না বুঝলে আমরা যে যত জানব ততই মূঢ় হব, মানবজাতির সাম্প্রতিক ইতিহাসই তার তর্কাতীত প্রমাণ। বিজ্ঞান ও দর্শনের গ্রন্থও বিবিধ বিষয়ে তথ্যের আধার; কিন্তু সেসব তথ্য একটি একাভিমুখী উদ্দেশ্যে, একটি সত্যান্বেষী মূলনীতির দ্বারা সংবদ্ধ ও সংশ্লিষ্ট বলে সেখানে তথ্যাবলির তাৎপর্য এতদূর সুপরিস্ফুট যে অতথ্যও সর্বত্র সত্যনির্ণয়ের অন্তরায় হয় না।

যেমন, বস্তুবিশ্ব সম্বন্ধে প্রচীন দার্শনিকদের অনেক ধারণাই ভ্রান্ত ছিল, আর আমরা এ কথা জেনেছি বলে তাদের মুখ্য মীমাংসা, তাদের সামগ্রিক উপলব্ধি আমাদের কাছে অনর্থক হয়ে যায়নি। উদ্দেশ্য সংবাদপত্রেরও আছে, কিন্তু সে উদ্দেশ্য সত্যান্বেষী নয়, একাভিমুখীও নয়, কেননা তার আশ্রয় দিনানুদৈনিক রাজনীতি, অর্থাৎ আজ-নীতি। আজ-নীতি বলি তাকেই যার কাছে আজকের মুহূর্তটাই সবচেয়ে প্রধান, বর্তমান সময়টা অতীত ও ভবিষ্যৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, আর সত্যের একমাত্র সংজ্ঞাই হলো ঘটনা। সংবাদপত্র সেবিত মানুষের কাছে নীতি মানেই যেহেতু আজ-নীতি, বর্তমান জগতে এ ধারণা প্রায় সর্বব্যাপী যে সত্য তথ্যেরই নামান্তর মাত্র; অতএব, শিক্ষা মানেই তথ্যসংগ্রহ। সামাজিক মূল্য সবচেয়ে বেশি আজ ‘বিষষ রহভড়ৎসবফ’ মানুষের, অর্থাৎ সবজান্তার। উদারতম শিক্ষা ব্যবস্থাতেও কোনো সত্যান্বেষী সংশ্লেষণী নীতির প্রভাব নেই, শুধু খবর, শুধু কতগুলো খবর কুড়োতে পারলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম উপাধি লাভ সম্ভব।

আমরা যারা সেসব উপাধি পেয়েছি, কখনো, কোনো উপলক্ষে কোনো শিক্ষকের মুখে এমন পরামর্শের আভাসও আমরা শুনিনি যে খবর সংবাদ হয় শুধু তখনই যখন তাকে কোনো এক সমগ্রের অংশ বলে উপলব্ধি করি। আর সেই সমগ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলে যে কোনো খবরই ‘গসিপ’ ছাড়া কিছু নয়। কেউ আমাদের বলেননি যে, আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য ধাতুগত অর্থে সংবাদ, অর্থাৎ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি সংবিদ হতে, সম্বিৎ জাগাতি, জ্ঞানের অন্বেষণে। দৈনিকপত্রের মতো বিভিন্ন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন, তাৎপর্য বঞ্চিত খবর কুড়োনোকেই আমরা জেনেছি শিক্ষা বলে। যে সমগ্রের অংশরূপে না দেখলে সব খবর ‘গসিপ’, সেই সমগ্রের অস্তিত্বের কথাও এমনকি আমরা শুনিনি।

তবু আমাদের সময়ে তথ্য তৃষ্ণা অপেক্ষাকৃত অনুগ্র ছিল; সাধারণত, সাহিত্যের ছাত্র সাহিত্যের খবরই শুধু রাখতো, আর বিজ্ঞানের ছাত্র বিজ্ঞানের। এই বিষয় বিভক্ত শিক্ষা জ্ঞানের অন্তরায়, কিন্তু এর চেয়েও বড় অন্তরায় অধুনাপ্রবর্তিত তথ্যোন্মাদনা- শুধু ছাত্ররা নয়, অগ্রগামী বয়ষ্করাও এ ধারণার বশবর্তী যে যত বেশি তথ্য তারা জানবের আর তার বিষয় যত বহুল বিচিত্র হবে, ততই তারা শিক্ষিত হবেন, ততই পাল্লা দিতে পারবেন আধুনিক জীবনের জটিলতার সঙ্গে।

এই তথ্যোন্মাদনার পরিচয় পাই রিডর্স ডিজেস্ট ধরনের বটিকা পত্রিকার পৃথিবীব্যাপী পরার্ধ প্রচারে, আর রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন ও বিবিধ বিজ্ঞান বিষয়ে গণপাঠ্য গ্রন্থ ও পুস্তিকা সংখ্যার অফুরন্ত গুণনে। বলা বাহুল্য, এই পত্রিকা ও পুস্তিকারাশি দৈনিক পত্রেরই করিৎকর্মা সহযোগীমাত্র, কেননা স্বল্প পরিসরে, জলবৎ ভাষায় এসব বিষয়ে কতগুলো তথ্যই শুধু জানানো যায়, সেসব তথ্যের সংশ্লেষণ, মূল্যবিচার, তাৎপর্য নির্ণয়, অর্থাৎ তথ্যে নির্ভর করে সত্যের অন্বেষণ, লেখকের অভিপ্রেত এবং শক্তির অধিগম্য হলেও (বস্তুত, প্রায়ই তা হয় না) কার্যত অসম্ভব।

সাধারণ মানুষের চিন্তার জগতে তাই, নৈরাজ্য আজ ঘোরতর; পনেরো বছর আগেকার তুলনায় আজকের দিনের উৎসাহী ছাত্র কিংবা অগ্রগামী মধ্যবয়সী খবর রাখেন ভুরিপরিমাণে বেশি, কিন্তু কোনো এক সমগ্রের অংশরূপে না দেখলে সব খবরই যে ‘গসিপ’, এ বিষয়ে অচেতনা আরও ব্যাপ্ত, আর সেই সমগ্রের অস্তিত্ব সমন্ধে অজ্ঞতা আরও নীরন্ধ্র। ফলত, তথ্যের আধিক্যের পরিমাপে আরও ঘনীভূত হচ্ছে প্রমাদ; তথ্য যত পাচ্ছে, সত্য থেকে তত দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ; বুদ্ধিমানেরাও তাজ্জব সবজান্তার বেশি কিছু হতে পারছেন না। আর এই অবস্থাটাই অনেকের মতে প্রগতি, আর কোনো কারণে নয়, আমাদের জৈব জীবনের বর্তমান ব্যবস্থা এরই অনুকূলে বলে, আজকের দিনে আর্থিক মূল্য ও সামাজিক মর্যাদা সবজান্তারই সর্বাধিক বলে। মুদ্রাযন্ত্র ও গণতন্ত্রের ফলে সংবাদপত্রের উত্থান ও প্রতিপত্তি; সংবাদপত্রের উত্থান ও প্রতিপত্তির ফলে সাধারণের তথ্যোন্মাদনা, সাধারণের তথ্যোন্মাদনার ফলে  সংস্কৃতির অধঃপাত- আমাদের আপতিক প্রগতি বলতে গেলে মাত্র এক শতকের মধ্যে এতদূর নিয়ে এসেছে আমাদের। শেষোক্ত প্রস্তাবের প্রমাণস্বরূপ এখানে এটুকুমাত্র বলবো যে তথ্যোন্মাদনার সংক্রমণ আজ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়।

এটা উল্লেখযোগ্য এজন্য যে সাহিত্য, কল্পনাপ্রবণ সাহিত্য, বিজ্ঞান নয়, অর্থাৎ বিশেষ কোনো জ্ঞান নয়; সাহিত্য রচনার জন্য কোনো তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না কিংবা, এমন কোনো তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না, যা সাধারণ মানুষের অনায়ত্ত। স্পষ্টত, নতুন কোনো খবর পাবো বলে আমরা কবিতা গল্প উপন্যাস পড়ি না, কেননা আমরা সকলেই জানি ওতে যে সব খবর পাওয়া সম্ভব, তা সাধারণত আমাদের সকলেরই জানা। অবশ্য নতুন খবর আমরা পেতে না পারি তা নয়; যেমন, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ পড়ে আমরা জেনেছি যে সেকালের কলকাতার বাবুরা পাড় ছিঁড়ে ঢাকাই ধুতি পড়তেন, কিংবা চেখভ পড়ে জেনেছি যে সেকালের রুশদেশে বৃদ্ধ কৃষক দম্পতি পরস্পরকে সম্বোধন করতো ‘মা’ এবং ‘বাবা’ বলে। এ রকম ক্ষেত্রে আমি সাহিত্যপাঠের উপফলস্বরূপ খানিকটা ইতিহাসও জেনে গেলুম; এই ইতিহাসটা, বলা বাহুল্য, সাহিত্যের মধ্যে মুখ্য নয়, গৌণ; প্রাথমিক নয়, প্রাসঙ্গিক; সারবস্তু নয়, শুধু প্রসারের ক্ষেত্র।

সাহিত্যের শরীরে- বিশেষত গল্প উপন্যাস নাটকে- ইতিহাসের অংশ কিছু না কিছু থাকেই, কিন্তু সেটা একেবারে বর্জন করেও যে সাহিত্য হয়, শুধু তা-ই নয়, সাহিত্য হিসেবে তার কাজ অতুলনীয়রূপে সম্পন্ন করতে পারে গীতি-কবিতাই তার প্রমাণ। কখনো এমনও হয় যে দেশে কিংবা কালে দূরবর্তী কোনো লেখকের রচনা আমরা পড়ি কষ্ট করেও পড়ি- সুদ্ধু সেই দেশের বা কালের জীবন্ত ইতিহাস জানবার জন্য (পৃথিবীর রাশি রাশি অনুত্তম পদ্য বা গদ্য কাহিনীর সার্থকতা একবার স্বকাল পেরোলে এতেই পর্যবসিত হয়); কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা সাহিত্যকে খাটিয়ে নিচ্ছি ইতিহাসের কাজে, সাহিত্য আর সাহিত্য নেই আমাদের কাছে, হয়ে উঠেছে ছদ্মবেশী ইতিহাস। সাহিত্যের কাছে সাহিত্যের প্রার্থনা নিয়ে যখন আমরা যাই, সাহিত্যের কাছে সাহিত্যের ফল যখন চাই, তখন এই ইতিহাসের অংশটা অবান্তর, বড় জোর প্রাসঙ্গিক।

অথচ আজকের দিনের অধিকাংশ মানুষের শিক্ষা আর মানসিক অভ্যাস এইরকমই যাতে সাহিত্যের কাছে সাহিত্যের ফল চাইতে তারা ভুলেই গেছে। দৈনিকপত্র আর বটিকা পত্রিকার সম্পাদকরা তাদের কোটি কোটি ক্রেতার মনে এই ধারণা সঞ্চারে কৃতকার্য হয়েছেন যে গুছিয়ে লেখা খবরকেই বলে। কাহিনীরঞ্জিত তথ্য পড়ে পড়ে এমন অভ্যেস তাদের হয়েছে যে তারা যখন খবর কাগজের বানানো গল্প ছেড়ে বইয়ের পাতার বানানো গল্পে মন দেয়, তখনও প্রত্যাশা করে তথ্যাকীর্ণ কাহিনী। অর্থাৎ, সাহিত্যের কাছে ইতিহাসের ফল চায় তারা। শুধু চায় না, দাবি করে। শুধু যে বহুল তথ্যাংশ না থাকলে সে বই তাদের ভালো লাগে না, তা নয়; উপরন্তু এ ইচ্ছাও তারা ঘোষণা করে যে নতুন যত সাহিত্য জন্মাবে সবই হবে আজ-নীতির একান্ত অনুগত, আজকের এই মুহূর্তের বিবিধ ঘটনার ঈষৎ রঙ ফলানো বিবরণ।

স্বভাবত এবং ন্যায়ত সাহিত্যের যা কাজ নয়, সাহিত্যের কাছে সেই কাজের দাবি দিনে দিনে প্রবল হয়ে উঠছে, আর সে দাবি নিয়মিত মিটিয়েও চলেছে পৃথিবীর সমস্ত ভাষায় রাশি-রাশি সাংবাদিক গল্প, সাংবাদিক নাটক এমনকি সাংবাদিক কবিতা। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর সব দেশেই সাহিত্যক্ষেত্রের যশস্বী ও যশোলিপ্সুদের অনেকেই গেলো কবছর ধরে নির্ভুল নিয়মে জুগিয়ে গেছেন যুদ্ধের এবং আনুষঙ্গিক ঘটনাবলির সাহিত্যবেশী বিবৃতি। বেশভূষাটা সাধারণত অগোছালো, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে রীতিমতো মনোরম বলে উচ্চশিক্ষিতের মধ্যেও অনেকের মনে আজ এ বিভ্রম জন্মেছে যে সাহিত্য সাংবাদিকতারই নামান্তর কিংবা উচ্চ স্তর, যে সেই লেখাই ভালো যা হালখবরের হালখাতা, আর সেই লেখাই দূষ্য যাতে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কোনো উল্লেখ নেই।

সাহিত্যবেশী, কিংবা সাহিত্যের মধ্যে গ্রথিত, সাংবাদিকতা পৃথিবীতে অবশ্য নতুন নয়, বরং অত্যন্তই প্রাচীন। খবরের কাগজ যখন ছিল না, তখনো যেহেতু খবর ছিল, সেই খবর কোনো না কোনো উপায়ে লিপিবদ্ধ না করেও মানুষ পারেনি। আর পুরাকালে উপায়ের বৈচিত্র বেশি ছিল না; ছন্দবদ্ধ কাব্যই ছিল প্রধান বাহন, এইজন্য ছন্দবদ্ধ যাতে পুঁথির অভার স্মৃতি দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যায়। মহাভারতের কাহিনীর মধ্যে যেমন দর্শন, সমাজনীতি, বিবিধ বিজ্ঞান যথেচ্ছ বিক্ষিপ্ত ও প্রক্ষিপ্ত, তথ্যও তেমনি পর্বতপ্রমাণ; বস্তুত, প্রচীন ভারতের ইতিহাসরূপে মহাভারতই আখ্যেয়।

একই গ্রন্থের মধ্যে কাব্য, কাহিনী ও ইতিহাসের, আর সেই সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব থেকে অশ্ববিদ্যা পর্যন্ত সর্ববিষয়ে উপদেশের অঙ্গীকরণ আজ আমাদের কাছে অচিন্তা; মুদ্রাযন্ত্রের উদ্ভাবনের পর থেকে শুধু যে ছন্দবন্ধনের আবশ্যিকতা ঘুচে গিয়ে গদ্যের প্রসার বেড়েছে, তা নয়, সাহিত্যরূপের বিভেদীকরণ এবং বিশেষীকরণও সম্ভব হয়েছে; দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি তত্ত্ব, তথ্যে যার নির্ভর, সেগুলো সাহিত্যশরীর থেকে চ্যুত হয়ে নিয়েছে যার ফলে সাহিত্য বলতে আমরা আধুনিক যুগে বুঝি শুধু কল্পনাপ্রবণ রচনা, সংস্কৃত পরিভাষা রন-সাহিত্য। বিশ্লেষীকরণ এখানেই থামেনি; রস-সাহিত্যের মধ্যেও ভেদ বেড়েছে, কাহিনী (মোটের ওপর) বিচ্ছিন্ন হয়েছে কাব্য থেকে, আর গীতিকাব্য (বহুলত) সংগীত থেকে, আবার কাব্য আর কাহিনী উভয়েই শাখান্বিত হয়েছে ভিন্ন-ভিন্ন আকার ও আকৃতি নিয়ে। কবিতা ছোটোগল্প, নাটক, উপন্যাস, আধুনিক রস-সাহিত্যের এই সব স্থুল বিভাগের পরেও আরও বৈচিত্র্যের সম্ভাবনা এনে দিয়েছে প্রবন্ধাদি উপসাহিত্য, ফরাশিরা যাকে বলে রূপ-সাহিত্য সাহিত্যরূপের এই বিশেষীকরণ আধুনিক জগতের একটি প্রধান ঘটনা।

সাহিত্য আর সাংবাদিকতার ভেদ ভুলে যাওয়া মানেই এই বিশেষীকরণের অস্বীকরণ, মুদ্রাযন্ত্রের যথার্থ উপকর্মের প্রত্যাখ্যান। সাহিত্যরূপের বর্তমান বৈচিত্র্যের অন্যতম কারণ নিশ্চয়ই মুদ্রাযন্ত্রের প্রয়োগ, আবার সেই মুদ্রাযন্ত্রের বিশ্ব-ব্যবহারের ফলেই কি বৈচিত্র্যবিলোপের আন্দোলন? সাহিত্যে তথ্য চাই, তারিখ মাফিক খবর সরবরাহ চাই, এই সূত্রের একমাত্র ন্যায়সম্মত পরিণতি হতে পারে সাহিত্য আর ইতিহাসের পুনরঙ্গীকরণে। সেই সঙ্গে যদি মহাভারতের মতো কোনো একটি সংশ্লেষণী জ্ঞানের প্রভাব থাকতো, কোনো সার্বভৌম বিশ্বাসের সক্রিয়তা থাকতো, তাহলে এর ফলে সাহিত্য অবান্ততা ভারাক্রান্ত আর ইতিহাস সংশয়াচ্ছন্ন হলেও কোনো নৈতিক বিকৃতির আশঙ্কা থাকতো না। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সে রকম কোনো সম্ভাবনা দেখি না; মানুষের বিশ্বাস আজ সার্বভৌমত্য হারিয়ে নানা শিবিরে বিভক্ত, কিংবা তার জীবন্ত কোনো বিশ্বাসই নেই; তাই সাহিত্যশরীরে ইতিহাসকে গ্রথিত করতে গেলে তার ফল হবে ভিন্ন ভিন্ন দল বা উপদলের আপন স্বার্থান্বেষী অপলাপ, কিংবা নিতান্তই সংবাদপত্রিক তথ্যপ্রলাপ। হবে কেন, তা-ই হচ্ছে।

সাহিত্যে এই ঐতিহাসকিতার আন্দোলন শুধু যে নীতিবিকারী তা নয়, তদুপরি অনর্থক। অনর্থক এই জন্য যে, আন্দোলনের প্রবক্তারা লেখককে দিয়ে যা করিয়ে নিতে চাচ্ছেন, অন্য অর্থে লেখক তা না করে মোটে পারেনই না। যে দেশের যে সময়ে তিনি বাঁচেন, সেটা তার নিঃশ্বাসের হাওয়া; তার দেহ যেমন সেই দেশের মাটির, তার মন তেমনি সেই সময়ের হাওয়ার। তার রচনার বস্তু, তার চিন্তার উপকরণ তার মনে পৌঁছায় তার জীবৎকালের পরিধি থেকেই, তাছাড়া পথ নেই। শুধু বস্তু বা বিষয় নয়, রচনার রূপ ও রীতি, অর্থাৎ তার কলাকৌশলও কালাদিষ্ট। বর্নার্ড শ শেক্সপিঅরের সমসাময়িক হলে অমিত্রাক্ষরে ছাড়া নাটক লিখতে জানতেন না, ব্রাউনিং তার সময়কারই ফ্রান্সে জন্মালে খুব সম্ভব হতেন মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে অন্যতম অগ্রণী।

তাই বলে এমন অনুমান অসহ্য যে লেখকরা ইতিহাসের এক একটি উপসর্গ বা কালতরঙ্গের এক একটি বিক্ষেপ মাত্র, কেননা বিষয় তো উপকরণ, আর কলাকৌশল তো উপায়। কিন্তু উপকরণ আর উপায় অন্বিষ্ট, সুসংবদ্ধ, অর্থময় হয়ে উঠে একটি তৃতীয় সত্তাকে জন্ম দেয় যে শক্তির প্রভাবে, তার উৎস লেখকের দেশকালাতীত মন। শিল্পীনামযোগ্য লেখকমাত্রেরই মন কিছু পরিমাণে দেশকালাতীত হতেই হবে; যার মন যত মুক্ত, তিনিই, শেষ পর্যন্ত তত বড় লেখক। কিপলিঙের ছিল উপকরণে অগাধ অধিকার, কলাকৌশলে আশ্চর্য দক্ষতা, তবু তার মন নিতান্তই দেশকালে আবদ্ধ ছিল বলে লেখক হিসেবে তার ক্ষুদ্রত্ব কিছুতেই ঘুচলো না। পক্ষান্তরে, তারই সমসাময়িক ইএটস, যদিও কিপলিঙের তুলনায় উপকরণের পরিধি তার অনেক সংকীর্ণ, কলাকৌশলেও আপাতবৈচিত্র্য ও আপাতরমণীয়তার অভাব, তবু তার দেশকালাতীত মুক্ত মনের অমৃতক্ষরণে তিনি তো বৃত হলেন অমরাবতীত।

কলাকৌশলকেই কলাকৈবল্য বলে গ্রহণ করে ইংলন্ডের ‘নব্বই’ যুগের সমালোচনা যেমন ভুল করেছিল, তেমনি, হয়তো তার চেয়েও মারাত্মক ভুল করছে এ যুগের এক শ্রেণির সমালোচনা উপকরণকেই সর্বস্ব বলে ভেবে। উপকরণকেই যদি করে তুলি সাহিত্যবিচারের মান, অনাচার তাহলে অনিবার্য : তাহলে, অন্তত পরোক্ষে এ কথাই বলতে হয় যে, অপাঠ্য মঙ্গলকাব্য যেহেতু ইতিহাসের উপাদানে সমৃদ্ধ, তাই অশরীরী বৈষ্ণব কাব্যের চেয়ে তার প্রাধান্য বেশি, আর একই কারণে ‘সংবাদ প্রভাকর’ ‘সন্ধ্যা সংগীত’ অপেক্ষা গরীয়ান।

আবার বলি, সাহিত্যে সমসাময়িকতা চাই, এ নিয়ে আলাদা করে একটা দাবি উত্থাপন করাই বাহুল্য; আর কোনো কারণে নয়, লেখক মানুষ বলেই সেটা না হয়েই পারে না; স্মরণীয় ও বরণীয়দের অনেকের মধ্যেই এই সমসাময়িকতা ঘননিবিড়, যদিও কোনো ক্ষেত্রে সুদূরপরাহত। পোপ বা ডিকেন্সের স্বকালের স্বাক্ষর তাদের রচনার প্রতি পৃষ্ঠায় অঙ্কিত, কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যে ব্লেক যে আঠারো শতকের, আর হপকিন্স যে ভিক্টরীয় যুগের, তাদের রচনা থেকে সে কথা আমরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারি না, তথ্য হিসেবে জেনেও রীতিমতো অবাক লাগে। দান্তে, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, এই সব বিশ্ববরেণ্যরা প্রথমে শ্রেণির অন্তর্গত, অর্থাৎ ঘননিবিড়রূপে সমসাময়িক বলে, আমাদের মনে কখনো কখনো এ রকম মোহসঞ্চারও সম্ভব যে সুপ্রচুর পরিমাণে স্বকালের বিবৃতি যিনি দিয়ে যাচ্ছেন, তিনিই বড় লেখক।

বস্তুত, অমর কবিদের অধ্যয়নের ফলে এই শিক্ষাই আমরা পাই যে সমসাময়িকতা ততক্ষণই গুণ, যতক্ষণ লেখক স্টো অতিক্রম করতে পারেন; আর যখন তিনি সমসাময়িকতাই আবদ্ধ হয়ে পড়েন, তখন প্রণম্যদেরও পতন ঘটে। শুদ্ধশীলা শকুন্তলার প্রেমিক-স্বামীরূপে হারেমবিলাসী দুষ্যন্ত আমাদের আধুনিক ধারণায় অসহ্য, কিন্তু কালিদাসের যে কখনোই অসহ্য লাগেনি, সেটুকুই কালিদাসত্বে তার ন্যূনতা। ইহুদি শাইলককে চরম দন্ড দেবার পরেও শেক্সপিয়রের মনে তার জন্য কোনো বেদনাবোধ নেই, বিধবা বিনোদিনী যখন অপরাধের ভার নিয়ে হ্রস্বকেশ নতশিরে কাশীধামে নির্বাপিত হলো, তখন রবীন্দ্রনাথ এতটুকু করুণা করলেন না তাকে। এ সব ক্ষেত্রে কালিদাস, শেক্সপিঅর, রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ হয়েছেন তাদের স্বীয় সমসাময়িকতার সীমা পেরোতে পারেননি বলেই। সমসাময়িকতাটাই লক্ষ্য নয়, সেটা পথ, যে পথ চলে গেছে চিরন্তনের দিগন্তে, আর সে পথে যিনি যত অগ্রসর, তিনিই তত মহান।

উল্লিখিত পতন থেকে আত্মরক্ষার জন্য আধুনিক কবিরা কেউ কেউ সমসাময়িকের জীবন্ত রঙ্গালয় থেকে ইচ্ছা করে, এমনকি চেষ্টা করে অনেকটা দূরে সরে যান, বেছে নেন প্রতীকী পন্থা, আত্মরোপণ করেন কোনো পুরাণ, রূপকথা বা দর্শনের অখ- উপলব্ধির ভূমিকা। দৃষ্টান্ত আছেন ইএটস, রিলকে, এলিঅট, বর্তমান পাশ্চাত্ত্য দেশের সবচেয়ে প্রতিপতিশীল কবিত্রয়, গদ্যলেখকদের মধ্যে ভার্জিনিয়া উলফ। সমসাময়িক ঘটনার বর্ণনা ছাড়া সমসাময়িকতার আর কোনো সংজ্ঞা যাদের মনে নেই, এঁদের লেখা পড়ে তাদের হতাশই হতে হবে। টেনিসনের কয়েকটি নিকৃষ্ট আর কোলরিজের দু’একটি গৌণ কবিতা, তার ওপর সুইনবর্ণের কয়েকটি অপ্রধান আবেগোচ্ছ্বাস- এ ছাড়া আর কী দিয়ে তাদের সান্ত¡না দিতে পারি ভেবেও পাই না।

কেননা ইতিহাসই বলে যে ইতিহাসের বড় বড় ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন অনেক সময়সাহিত্যের ওপর কিছুই হয় না। ইংরেজি সাহিত্য থেকে দুটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করি। ইংলন্ডে প্লেগের মহামারি আর তৎপরবর্তী কৃষক-বিপ্লব দুটোই ঘটেছিল চসরের জীবদ্দশায়, কিন্তু এই বহুপ্রসাবী প্রতিভাবানের সমগ্র রচনাবলির মধ্যে প্লেগের নামগন্ধ নেই, আর কৃষক-বিপ্লবের একটিমাত্র সকৌতুক উল্লেখ আছে। চসরের সমসাময়িক ল্যাংল্যান্ডের কাব্য তৎকালীন দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনায় পরিপূর্ণ, অর্থাৎ সাম্প্রতিক পরিভাষায় তিনি চসরের চাইতে অনেক বেশি সমাজসচেতন, কিন্তু ল্যাংল্যান্ডের কাব্য কি তাতে বাঁচল?

কার্যত দেখা গেল, চসরের মধুচক্রেই ইঙ্গজন নিরবধি আনন্দের সুধাপান করলো, আর ল্যাংল্যান্ড আবদ্ধ হলেন পন্ডিত মহলে, উপাধিপ্রার্থীর ক্লেশকর অধ্যয়নে, ইতিহাসের তথ্যান্বেষীর পরিশ্রমে। তারপর স্প্যানিশ আরমাডার পরাজয়ের মতো এত বড় একটা ঘটনাও একটি কবিতার নিমিত্ত হলো না, যদিও স্পেনসর আর মার্লো দু’জনেই বেঁচে, এলিজাবিথান গীতবিতান কলমুখর, আর ঠিক সেই সময়েই সাহিত্যক্ষেত্রে শেক্সপিঅরের আবির্ভাব। যে সব লেখক স্বকালের আত্মাকে থারণ করেন, তাদের বসবাস, মনে হয়, ঘটনার অন্তরালেই।

এই শেষের কথাটা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের মতো ঘননিবিড় সমসাময়িক লেখকের পক্ষে প্রযোজ্য নয়। ইএটস, এলিয়ট, বা রিলকের মতো নন তিনি, সমসাময়িকের ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরে যাননি কখনোই; বরং তিনি সর্বত্র এবং সব সময় একটু যেন বেশি পরিমাণেই উপস্থিত। তার স্বকালের ইতিহাস এমন কোনো তথ্যই বোধহয় নেই, তার রচনাবলির কোনো না কোনো পৃষ্ঠায় যার উল্লেখ না আছে। অপঘাতের আশঙ্কা যেমন ছিল, তেমনি জন্মেওছিলেন রক্ষাকবচ নিয়ে। সে কবচ আর কিছুই নয়; মহাকবিদের সহজাত সংশ্লেষণশক্তি, এই সহজাত জ্ঞান যে কোনো এক সমগ্রের অংশ করে না দেখলে সব তথ্যই অর্থহীন, খবরমাত্রেই মিথ্যা এবং ইতিহাসমাত্রেই বানানো।

এ বিষয়ে তার সমধর্মী অন্যান্য কবিদের মতো, দান্তে বা শেক্সপিয়রের মতো, তিনিও তাই ইতিহাসকে বানিয়ে ছেড়েছেন সেই করুণ রঙিন পথ, যে পথে বেরোলে চোখের তারায় অরণ্য পর্বতের গান শোনা যায়; স্বকালকে অবলম্বন করে ব্যক্ত করেছেন চিরকালকে, স্বদেশের জীবনের মধ্যে প্রকাশ করেছেন বিশ্বজীবন। মহাকবিদের সমসাময়িকতার বৈশিষ্ট্য এইখানে যে সমসাময়িক প্রসঙ্গ উপলক্ষ করে তারা যা বলেন, ভিন্ন দেশে বা ভিন্ন সময়ে, কিংবা ভিন্ন দেশে ভিন্ন সময়েও তার সার্থকতা নষ্ট হয় না, যে কোনো দেশের, যে কোনো কালের ঘটনাবলির সঙ্গে তা মানিয়ে যায়, ভিন্ন-ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন-ভিন্ন ব্যঞ্জনা তার বিচ্ছুরিত হয় অর্থাৎ, মহাকবিরা আসলে যা করেন, সেটা সমসাময়িকতার সেবা নয়, চিরন্তনেরই অর্চনা।

সমসাময়িক থেকে চিরন্তনে পৌঁছবার দিগন্ত দীর্ঘ পথে রবীন্দ্র রথের জয়যাত্রর কাহিনী, আমার বিশ্বাস, তুলনাহীন। এ বিষয়ে এমন অবিশ্বাস্য স্বাচ্ছন্দ্য তার ছিল যে সমসাময়িককে শুধু নয়, সাময়িককেও নিশ্চিন্তের স্থান দিয়েছেন, আর তাতেও সোনা ফলিয়েছেন। শুনেছি, ‘জন-গণ-মন-অধিনায়ক’ গানটি তিনি বানিয়েছিলেন যুবরাজ জর্জের ভারত ভ্রমণের সংবর্ধনার ছলে, আর ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ শান্তিনিকেতনের সংকুচিতা ছাত্রীদের জিউজুৎসু শিক্ষায় উৎসাহিত করতে।

কিন্তু কিসে থেকে কী হলো। শুধু বাংলার ‘স্বদেশী’ উদ্দীপনাতেই নয়, কত বিবাহে আর মৃত্যুতে, কত রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ঘটনায়, কুত দিক থেকে কত বিচিত্র অনুরোধরক্ষার্থে কত কবিতা, কত গান তিনি গেঁথেছেন নিছক সাময়িকতার প্ররোচনায়, শুধুমাত্র কোনো উপলক্ষ্যের ক্ষণিক প্রয়োজনে, তার অধিকাংশই উপলক্ষ পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছেছে, স্থায়ী হয়েছে সাহিত্যে। প্রমান করি এই অসম্ভব প্রতিভাকে, কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলি যে অন্যদের প্রতিভা যেহেতু সম্ভবত সম্ভবপরতারই সীমানার মধ্যে, সেজন্য এ বিষয়ে তাকে অনুকরণ করতে যাওয়া মারাত্মক; আমাদের দুজন শক্তিশালী কবি, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আর নজরুল ইসলামকে তো চোখের ওপরেই কতবার দেখলাম এ বিষয়ে রাবীন্দ্রিক হতে গিয়ে সাংবাদিকতায় পথ হারাতে।

সাময়িক প্রসঙ্গকে, নির্দিষ্ট ঘটনাকে কবিতাদ্বারা চিহ্নিত করাটা আসলে প্রাচীনকালের প্রচলন। যেকালে রাজাই ছিলেন কবিদের ভরণকর্তা, সেকালে রাজবাড়ী ক্রিয়াকর্মে শোকে উৎসবে পুরোহিতের মতো কবিরাও যে কিছু করণীয় ছিল, সেই প্রথা পাশ্চাত্য দেশ মুছে ফেলেছে কিছুটা আগেই, আমরা ভুলতে ভুলতেও আঁকড়ে ছিলাম। যে কোনো উপলক্ষে কবিরও ডাক পছুক, এমনকি নতুন রঙ্গালয় বা মোদকভা-ারের উদ্বোধনের, এই সামাজিক স্বীকৃতির ইচ্ছাটুকুতে দোষ নেই, কিন্তু আধুনিক জগতে সামাজিক স্বীকৃতি অন্যরকম হওয়াই সর্বতোভাবে বাঞ্ছনীয় মনে করি। ইংল্যান্ড আজও অবশ্য একজন রাজকবিকে রেখেছে, বিগ্রহে বিবাহে অভিষেকে তাকে বাধ্য হয়েই আজ কবি হতে হয়; তবে এটুকু সুবুদ্ধিও ইংরেজের হয়েছে যে অ্যালফ্রেড টেনিসনের পরে আর কোনো মুখ্য কবি কে ঐ আসনে তারা আর কাউকে বসায়নি।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাজ কবির যে পদ উত্তর উত্তরজীবনে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন সেটিও কবি বলে পেয়েছিলেন বিশ্ব বিশ্রুত একজন ব্যক্তি বলে, এমন একজন ব্যক্তি যার নামের সঙ্গে কোনোরকম সংশ্রবই একটা বিরাট বিজ্ঞাপন। আশ্চর্য এই যে, রবীন্দ্রনাথের কর্ণ কুন্তল দুর্বিপাকেও তাকে রক্ষা করেছে, কেননা যদিও দধিমস্থনে কবিতা লক্ষ্মীকে উৎপন্ন করতে প্রতিভাও ফেল পড়েছে, তবু সিনেমাবিষয়ক গদ্য কবিতাটিতে চিহ্ণিত হয়েছে তার তুলনাহীনের অন্যতম উদাহরণ ‘তুলনাহীন’ কথাটির বিশেষ একটি তাৎপর্য আছে এখানে।

রবীন্দ্র অভ্যুত্থানের পর পর্যন্ত রাশি রাশি প্রাসঙ্গিক কবিতা লিখেছেন প্রত্যেক বাঙালি কবি। তার কোনোটাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনীয় হলো না। কোনো কোনোটি এখনো পাঠযোগ্য হলেও আধিক্য ধুলো হয়ে গেল গত চৈত্রের ঝরা পাতার মতোই। পুরীতে গিয়ে সমুদ্রকে, দার্জিলিংয়ে গিয়ে হিমালয়কে, আর আগ্রাতে গিয়ে তাজমহলকে উদ্দেশ্য করে উচ্ছ্বাস, উপরন্ত যে কোনো ব্যক্তিগণ আত্মীয়ের কিংবা প্রখ্যাত পুরুষের মৃত্যুতে শোকগাথা- আমাদের ছেলেবেলায় এসব ছিল কবিত্বে নিত্যকর্মপদ্ধতি। বড় হয়ে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলুম আমরাই, অন্তত এ ধরনের কৃত্রিমতাতে তাড়িয়েছিলুম সাহিত্য থেকে। আজ নাকি সে আবার ফিরে এলো হাল ফ্যাশনে সাজগোজ করে, আর তার যজমানি করলেন, এসমনি কয়েকজন যারা সেই বিদ্রোহে সঙ্গি ছিলেন আমাদের।

বাল্যকালে ফরমায়েশ পেয়েছি আত্মীয়মহলে প্রত্যেকটি বিয়েতে একটি করে পদ্য লিথে দেবা যৌবনে ফরমায়েশ পেয়েছি বছর বছর সরস্বতী পূজোয় বাণী কন্দনা রচনার, আর এসব ফরমায়েশ যখন- কৌতুকাবহ ইতিকথায় পর্যবসিত হলো, তারাই এতদিন পর আজ কিনা পাঠকদেরই বড় তরফ থেকে নতুন করে ফরাময়েশ চেতিয়ে উঠল কয়লার, কেরসিনের, কালোবাজারের কবিতার!

বাংলা সাহিত্যের কি তাকে প্রাসঙ্গিকতর দিকে, সাংবাদিকতার দিকে স্বাভাবিক একটু প্রবণতাই আছে। নাকি এটি রবীন্দ্র প্রভাবের শোকাবহ বিকৃতি? দুটোই সম্ভব, কিন্তু আরও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূত্রপাত পরাধীন দেশেই এ পর্যন্ত পরিণতি। দুর্বল ও দুর্গত দেশে কি পলিঙের সমালোচনা, প্রসঙ্গে এলিয়ট লিখেছেন, যে দেশপ্রেমের কবিতা মানেই ‘রুল বিটানিয়া’র দাম্ভিক চিৎকার কিংবা বড় জোর তার কিপলঙ্গীয় সংরক্ষণ। দেশপ্রেমের কবিতা সম্ভব হতে পারে শুধু দুঃস্থ পরাধীন দেশে, সম্ভব হয়েছে আয়ারল্যান্ড এবং বাংলাদেশে।

স্বদেশ বন্দনার পরিমাণ বাংলা সাহিত্যে যত বহুর, আয়তনে অত বৃহত্তর ইংরেজি সাহিত্যে তার অংশ মাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। জাক করবার মতো কিছু নয়, এটা আমাদের দুর্দশারই পরিমাপ দেশ প্রেমেরে এক মুঠো উৎকৃষ্ট কবিতা রবীন্দ্রনাথ যদি দিতে পেরে থাকেন, সেই সঙ্গেই দেশ ছেয়ে গেছে- সেন্টিমেন্টাল দ্বিজেন্দ্র লালে। পরাধীনতার মানুষকে হীনতাবোধে বিদ্ধ করে আপ্লুত করে, সে লুব্ধ হয় অতিরঞ্জনে, অতিকথনে, আত্মপ্রদর্শনে, নিজের গৌরব রটনার এতটুকু সুযোগ পেলেসেটাকে তুলোধুলো না করা পর্যন্ত ছাড়ে না, তখন এমন কথাও মুখ দিয়ে বোরোয় যে, সর্বজীবের মাতা যে পৃথিবী সে পৃথিবী ধন্য হলো তার মাতৃভূমির পদস্পর্শ করে। অবিশ্রাম আমরা খুঁজে বেরিয়েছি আমাদের বন্ধন দশার দুঃখ প্রকাশের সুযোগ, ছোট-বড় কোনো উপলক্ষকেই ব্যবহার করতে ভুলিনি, সে জন্যই আমাদের দেশে প্রাসঙ্গিক সাময়িক, বা সাংবাদিক রচনার, পরিমাণ সমগ্র সাহিত্যর তুলনায় এখন পর্যন্ত অত্যধিক।

রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল প্রাইজ পেলেন, তৎকালীন সম্ভ্রান্ত জীবিত কবিরা, প্রত্যেকে কবিতা লিখেছেন সে উপলক্ষে, সে তো কবি প্রশস্তি নয়, ইঙ্গ শাসিত হলেও বঙ্গভূমি যে আসলে কত বড়, তারই গৌরব ঘোষণার কলরব। মনের এই দুর্বলতা অবশ্যই মার্জনীয়, কিন্তু রচনার দুর্বলতার তো মার্জনা নেই। আমাদের দুঃখ আমাদের তাড়না করে বেরিয়েছে চলতি মুহূর্তে ক্ষণিক আবেগ লিপিবদ্ধ করতে। সহজ উত্তেজনায় সহজে কিছু একটা লিখে ফেলে আমাদের নিজের মন কিছতা হালকা হয়েছে তখনকার মতো, কিন্তু সাহিত্য কি দুঃখ প্রকাশের বাহন, দুঃখ লাঘবের উপায়, এই ভাবে পরাধীনতার পরোক্ষ অভিশাপে, কতদন ধরে প্রচুর অপব্যয় হয়েছে।

আমাদের সাহিত্য শক্তির; এমনকি এত বড় যে, রবীন্দ্রনাথ, তিনিও ‘এবার ফিরাও মোরে’ না লিখে পারেননি- দেশ পরাধীন না হলে কি ও কবিতা লিখে সময় নষ্ট করতে হতো তাকে। কিন্তু আর কেন? আজ তো দেশে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অনেকাংশে স্থাপিত হলো, আমরা আত্মমর্যাদা ফিরে পেলাম, আমরা যে খুব বড়, খুব ভালো কিংবা খুব দুঃখী, এ কথা সবাইকে ডেকে চেঁচিয়ে বলার আবেগের তাড়নাটা অন্তত রইল না। আর কেন ঘটনার বিবৃতি, রটনার অনুলিখন, উচ্ছ্বাস, সদিচ্ছা, আত্মকরুণা?

চলতি মুহূর্তের ক্ষণিক আবেগকে লিপিবদ্ধ করার কর্তব্যপরায়ণতা থেকে মুক্তির সময় কি এখনো আসেনি? এই ক্ষণিক আবেগের উপলক্ষ ছিল যখন পুরীর সমুদ্র, কি আত্মীয়ের মৃত্যু, অর্থাৎ ব্যক্তিগত, তখন বিলাপে প্রলাপেনিরীহতা অন্তত ছিল. কিন্তু আত্মজীবনের বদলে, যারা আজ আত্মজীবনের তথ্যানুগামী,নিজত্বকে জনতায় লীন করার, পক্ষপাতী, প্রতিমুহূর্তের ঘটনাপ্রসূত উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তারা যা লিখছেন, সেটা তো শুধু সাহিত্য নিয়ে পরিহাস নয়। মানুষের দুঃখকে অপমান।

তারা নিখিলপন্থী, অর্থাৎ ঘরের দরোজ বন্ধ করার বিরোধী, কিন্তু বিষয় হিসেবে পাপজীবনকে অবলম্বন করেও তারা প্রকাশ করেছেন সেই ক্ষণিক, ব্যক্তিগত আবেগের বুবুদ্ধ, চলতি মুহূর্তের উত্তেজনা, ব্যক্তিগত ক্রোধ, কি ব্যক্তিগত দুঃখটা কখনো কখনো, এত চড়া গলায়, এত বেশি করে বলা যে, আমাদের মনে পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক অসাহিত্যের উদাহরণ স্বরূপ, উদ্ধৃত ‘দুঃখ কর অবধান, দুঃখ করো অবদান, আমানি খামার গর্ত দেখ বিদ্যমান’, কিন্তু এমনো হয় এ যেন বাংলা সাহিত্যের একদা খ্যাত ‘উদভ্রান্ত প্রেমের’ শোকোচ্ছ্বাসের আধুনিক প্রকরণ।

প্রভেদটা শুধু এই যে, উচ্চাসের উপলক্ষ সমুদ্রের বদলে মজদুর, মাতৃপত্নীর বদলে লক্ষ লক্ষ মুমূর্ষ মানুষ। ‘শুধু’ বললাম, প্রভেদটা এদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে ভাবালুতা কু সাহিত্যে প্রসব করেই ক্ষান্ত হয়, তার বেশি ক্ষতি করে না; কিন্তু বিষয় যেখানে দেশব্যাপী ক্ষুধা, বিশ্বব্যাপী হত্যা, সেখানে ভাবলুতায় মানুষের প্রতি যে অশ্রদ্ধ প্রকাশ পায়, সেটা মনুষ্যত্বরই পরিপন্থী।

প্রতিদিনের সংবাদ জ্ঞাপন, বিবিধ তথ্যপ্রচার, বিক্ষোভ , অভিযোগ ওস্বদিচ্ছার বিচ্ছুরণ, এর প্রয়োজন আছে আমাদের সামাজিক সাংসারিক জীবনে, সে প্রয়োজনে, ক্রমবর্ধমান নৈপুণ্যে পূরণ করুক সংবাদপত্র আর সাংবাদিক পত্রিকা ও পুস্তকাবলি। সাহিত্য আর সাংবাদিকতা যে ভিন্ন, ভিন্ন জগতের, জীবনের ভিন্ন মহলের অধিবাসী, এ কথায় স্বক্রিয় স্বীকৃতি, রাষ্ট্রিক স্বাধিকার, প্রাপ্তির পরেও দেখা দেবে না, আমাদের জাতীয় জীবন থেকে; অতএব, সাহিত্য থেকে, ভাবালুতার বিলুপ্তি এখনো ঘটবে না।

এ কথা মেনে নিতে হলে যত বড় হতাশা কে প্রশ্রয় দিতে হয়, তাতে প্রাণধারণ অসম্ভব। সেজন্য আশা করি এ চৈতন্য আমাদের হবে যে ঘরের দরোজা নিখিল করে দিলেই নিখিলি মিলন ঘটে না বরং উল্টো, অর্থাৎ নিজের ঘরে নিজের মনের মধ্য ছাড়া, বিশ্বকে উপলব্ধি করার আর উপায় নাই। ঠিক ততটুকুই আমরা উচ্চারণের অধিকারী, যতটুকু আমাদের উপলব্ধি, আর অধিকার অতিক্রম করার প্রলোভন ত্যাগ করতে করতেই, উপলব্ধির পরিধি বাড়ে।

ক্ষণিক আবেগকে, চলতি ঘটনার উত্তেজনাকে, তখন প্রকাশ করে ফেলে হাতে নাতে নগদ বিদায় যদি না চাই, যদি উপলব্ধির জন্য অপেক্ষা করতে শিখি, তাহলেই আমরা পারব, সমসাময়িককে অবলম্বন করে চিরন্তনে পৌঁছতে, ঘটনাকে , তথ্যকে, বস্তুকে কেন এক সমগ্রের অংশরূপ দেখতে তার চরম তাৎপর্য বুঝতে। অপেক্ষায় যিনি অক্ষম, উপলব্ধি যার অনায়ত্ত, যার পরিশ্রম পর্যবসিত, শুধু ইতিহাসের উপকরণর, স্তূপীকরণের, তিনি মূল্যবান সমাজ সেবক হতে পারেন, কিন্তু তিনি যে সাহিত্য শিল্পী নন, যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ এই সত্যকে আচ্ছাদন করে রেখেছিল, তার অবসান হোক, চিন্তামুক্ত হোক, আমাদের সাহিত্য আজ সাবালক হোক।

লেখক : কবি, সাহিত্যিক


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //